কবি সিদ্ধার্থ অভিজিৎ কবিতার চাষ করেন বেশ আগে থেকে। এবার তিনি প্রথমবারের মতো একডালি ফসল ঘরে তুললেন। কবিতা সংখ্যা ৪০। নাম দিলেন হেমলকে চুম্বন। এ যেন জেনে শুনে বিষপান করার মতো শিরোনাম। আগ্রহ নিয়ে তাঁর ফসলের সৌন্দর্য দেখি। হেমলক খুঁজি। চুম্বনের কারণ খুঁজি। পাতা উল্টাই। কখন যেন শেষও হয়ে যায়। হ্যাঁ, অভিজিৎ তাঁর কবিতাপাত্রে যে হেমলক পরিবেশন করেন, তাতে পাঠকের নেশা ধরে। অজান্তে এগিয়ে যায় ঠোঁট। চুম্বনময় নস্টালজিক আবেশে শেষ হয় অসমাপ্ত প্রেম।
গ্রাম থেকে শহরে আসা কবি নিয়ত অনুভব করেন শেকড়ের টান। নাগরিক বিকেন্দ্রিক বিচ্ছিন্ন জীবন ও মনন তাঁকে ক্লান্ত করে। ‘নার্সারির চারার মতো’ শহুরে উৎকেন্দ্রিক জীবনে প্রায়শই তাঁর ‘সবুজ র্যাপিং পেপারে মোড়া’, ‘পাসওয়ার্ড বিহীন’ গ্রাম হাতছানি দেয়। নিজেকে বনসাইরূপে আবিষ্কার করে ব্যথিত বোধ করেন কবি। খুঁজে ফেরেন ‘চুরি যাওয়া শৈশব!’, ’নাগরিক ‘ঘুম’র ভেতরে দেখেন ‘ফুটপাতে পড়ে আছে পোয়াতি লক্ষ্মীপেঁচার লাশ।‘ তখনও ‘মেঠোপ্রেমে’ মন কাঁদে তাঁর। বৈঠার ‘ছফাৎ ছফাৎ’ তাল মাতাল করে তোলে অভিজিতকে। কিন্তু তিনি যেন ‘বাতিঘর ভেবে ভুল করে’ ‘ভিন গাঙে নোঙর’ করেন; যে অভিব্যক্তিতে একই সঙ্গে তাঁর ফেলে আসা শৈশব ও হারানো প্রেয়সীর মুখ কথা কয়ে ওঠে।
অভিজিতের কবিতায় গভীর জীবনোপলব্ধির সঙ্গে আছে অভিজ্ঞাত সময়ে দার্শনিক উপলব্ধিও। ‘মূর্তিকে দেবতা ভাবার মতো তোমাকে/প্রেম ভাবা ভুল ছিলো!’ পংক্তির ভেতর কবি শুধু প্রেয়সীর ছলনাকেই ইঙ্গিত করেন না, বরং মূর্তি, দেবতা, ধর্মবিশ্বাসের মূলভিত্তিটাকেও যেন মনে করিয়ে দেন তাঁর চমৎকার উপমায়। অথবা ‘তারা প্রজাপতি হতে চেয়েছিলো!/ফিরে এলো গুটিপোকা হয়ে।/ আর, ঈশ্বর বসে লুডু খেলে একা-/টাচফোন হাতে।‘- এখানে কবি আত্মশ্লেষের এক ব্যঞ্জনাময় কাব্যভাষ্য নির্মাণ করেন। অথবা, ‘নেই ভাত-ডাল, বাড়ন্ত চাল, আসো পেট চাপড়াই!’-ব্যক্তিশ্লেষ থেকে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক শ্লেষে রূপ নেয়।
এ কাব্যের ভাষাটি অভিজিতের নিজস্ব। নাগরিক ও গ্রামীণ জীবন-অভিজ্ঞতা থেকে ছেঁকে নেয়া শব্দ ও অলংকার নির্মিতি কাব্যভাষাকে পাঠকের কাছে আপন করে তোলে। পাঠক নিজেও নস্টালজিয়ায় বুঁদ হয়, উপভোগ করে। ‘কাঁসার থালার মতো উজ্জ্বল চোখ তার’, ‘রমণের নামতায় ফেরি করা যৌবন’, ‘অরুণিমা, চাঁদ করে রেখো না আমায়।‘, ‘কিছু টুকরো অভ্যেস জোর করে গুঁজে দিও তাতে।‘, ‘আমি তো কখনো তোমার শ্বাসকষ্ট হতে চাই নি।‘, ‘বন্ধকী প্রেমে বন্ধ্যা হয়ে গেলো হীরা।‘, ‘ঘামের দামে বিকিয়ে সোনা, ঘুম কিনেছি’ প্রভৃতি বাক্যবন্ধ অভিজিতের কাব্যভাষার স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনার সাক্ষ্য দেয়।
নাগরিক ক্লেদ, গ্রামীণ নস্টালজিয়া ও প্রেমই এ কাব্যের মুখ্য বিষয়। দু’একটি কবিতায় (‘তর্জনী’, ‘দেশ’, ‘আমার মা’ প্রভৃতি) স্বদেশভাবানার প্রকাশ ঘটেছে। তবে, বিষয়ই যাই হোক না কেন, প্রত্যেকটি কবিতা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কবি যেন তাঁর বেদনার হেমলক ছড়িয়ে দেন। বেদনাবোধের সঙ্গেই যেন তাঁর অযাচিত প্রেম। প্রসঙ্গত, হেমলকেই কবি এঁকে দেন তাঁর পরম চুম্বন।
এ কাব্যে কবি অভিজিতের নিজস্ব কন্ঠস্বর স্পষ্ট। তাঁর কাব্যভাষায় কার্নিশ, কাক, শহর, ছাদ, ফুটপাত, মাল্টিপ্লেক্স, ফ্যান প্রভৃতি নাগরিক শব্দের তুলনায় প্রজাপতি, ধানক্ষেত, আল, কৃষাণী, নদী, ফড়িঙ, নৌকা, মাঝি, বৈঠা, ব্যাঙ্, পোয়াতি, কলমি, বড়শি, পুঁটিমাছ, নিম, ডালিম, গোবর, কাস্তে প্রভৃতি গ্রামীণ শব্দের ব্যবহারই বেশি। তবে কিছুকিছু ক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ এবং আল মাহমুদের প্রতক্ষ্য প্রভাবকে তিনি এড়াতে পারেন নি। ‘গোধুলিতে বিয়ে হওয়া শ্যামলীর বোতামখোলা ব্লাউজ’, (কালিতে লেপ্টে গেছে স্বাক্ষর), ‘চাতুরি শিখিনি কোনো’ (পুরনো নাবিক), ‘ধানের দিব্যি’ প্রভৃতি শব্দ ও চিত্রকল্প কবি আল মাহমুদের কাছে পরোক্ষভাবে ধার নিয়েছেন। ‘মৃত্যু’ কবিতাটি জীবনানন্দ দাশের ‘আমি যদি হতাম’-কে মনে করিয়ে দেয়। ‘বাতাস ভেসে গেলো বাতাসে বাতাসে’ (বিবর্ণ শব্দ মিছিল)-এর মতো বাক্যবন্ধের জন্য কবি নিশ্চয়ই জীবনানন্দের নিকট ঋণী। তবে, এ প্রভাব দোষের কিছু নয়, হতেই পারে। এটাও ঠিক যে, অভিজিতের স্বাতন্ত্র্যের তুলনায় এ প্রভাবকে গৌণ মনে হয়। ছন্দের ক্ষেত্রে কবি গদ্য়ছন্দেই অধিক স্বতঃস্ফূর্ত বলে মনে হয়েছে। স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের ক্ষেত্রে অনেক জায়গায় ছন্দপতন ঘটিয়েছেন। অভিজিতের ভাষাসৌন্দর্য’র তুলনায় তা চোখে পড়ার মতো নয়।
অভিজিৎ তাঁর প্রথম কাব্যে যে বিষয় ও কাব্যভাষ্য উপস্থাপন করেছেন, তাতে তাঁকে প্রথম কাব্যের কবি বলে মনে হয় না। তাঁর যে পরিণত চিন্তা ও পরিমিতিবোধের ছাপ এখানে পাঠক পেয়ে যান, তাতে কবি হিসেবে বাংলা কবিতায় অভিজিৎ টিকে যাবেন বলেই বিশ্বাস। ‘হেমলকে চুম্বন’ দিয়েই অভিজিৎ যে জন্মের দাগ রেখে দিলেন, তা ক্রমাগত নতুন হয়ে জন্মাক, সেই শুভাশিস রইলো।
হেমলকে চুম্বন (কাব্যগ্রন্থ)-সিদ্ধার্থ অভিজিৎ। প্রকাশনীঃ সাহিত্য বিলাস, বাংলাবাজার, ঢাকা। প্রচ্ছদঃ বুদ্ধদেব মন্ডল। পৃষ্ঠা সংখ্যা- ৪৮, দামঃ ১৩০ টাকা।