বাঙালির যাপিত জীবনে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টি সম্ভার ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। রবীন্দ্রসংগীতের আবিষ্ট সুর ও কথা আমাদের ধ্রুব জগতের উঠান জুড়ে মুক্তির পথ দেখায়।
শিল্পী অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায়। যিনি সুরের ভুবন সাজান নিজস্ব ঢং এ । যাঁর সুরের ইন্দ্রজালে তৈরি হয় অবিচ্ছিন্ন চেতনার এক মায়াময় ভুবন। জীবন বোধের গল্প থেকে যা আলাদা করা কঠিন। ভারতের কলকাতা শহরে বেড়ে উঠা এ গুণী শিল্পীর জীবনের প্রতিটা স্তরে জড়িয়ে আছে গান। নানান ধরণের গান করলেও রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি তাঁর আলাদা দরদ আছে। সাক্ষাৎকারটিতে অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাক্তি জীবন, দুই বাংলার প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রসংগীতের বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন শিশির রাজন।
আপনার ছেলেবেলার কথা ও রবীন্দ্রনাথের গানের সাথে সম্পৃক্ততার কথা শুনতে চাই?
অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায়ঃ আমার ছেলেবেলা কাটে কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকায়, সি. আই. টি রোডে। বাবা মা, ঠাকুমা আর দাদার মাঝে বড় হয়েছি। আর স্কুলে ছুটি পড়লেই যেতাম মামাবাড়ি খড়দায়। আমি বিপ্লবী বাড়ির মেয়ে তাই অনেক ধরণের মানুষের যাতায়াত ছিল বাড়িতে। সব মিলিয়ে বেশ রঙিন আমার মেয়েবেলা। বাবা খুব ভালো গাইতেন। নিজের অগোচরেই বোধহয় তাই গানের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হতে শুরু হয়েছিল।
যতটুকু জানি আপনি সব ধরণের গানই করেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি আপনার আলাদা দরদ আছে, তার কারণ কী?
অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায়ঃ আমি শুভেন্দু মাইতির কাছে লোকগান শিখছি সম্প্রতি কিছু মাস। আর এমনি কিছু অন্য গান বিভিন্ন সময়ে শিখেছি। তবে ৯ বছর বয়স থেকে রবীন্দ্রসংগীত শিখতে শুরু করেছিলাম কিংবদন্তী শিল্পী পূরবী মুখোপাধ্যায়ের কাছে। কেন ঠিক জানি না, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের কথা সুর আমাকে অন্য এক জগতে নিয়ে যায়। তাই আলাদা করে কোনো দরদ ঢালতে হয়নি কখনো, যা আসে তা অন্তর থেকেই।
রবীন্দ্র সংগীত গাওয়ার ক্ষেত্র আপনার নিজস্ব একটা ঢং আছে। অর্থাৎ কোনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেন না। এটা কেন?
অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায়ঃ দেখুন নিজের একটা পর্দাফাঁস করি, সেটা হলো আমি কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজাতে জানি না। আসলে পূরবী দি হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শেখাতেন, আমি গান শিখতাম। আলাদা করে বাদ্যযন্ত্রের প্রতি উৎসাহিত বোধ করিনি। তবে কোনো অনুষঙ্গ ছাড়া কণ্ঠ তৈরী হয় খুব ভালো। আমারও একদম খালি গলায় গাইতে আরাম হয়। আমার ধারণা তেমন করে গাইতে পারলে খালি গলার গান যে অনুরণন তৈরী করতে পারে বাজনার অনুষঙ্গে গান তা পারে না।
দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে রবীন্দ্রনাথের গান কী ধরণের প্রভাব বিস্তার করে বলে আপনি মনে করেন?
অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায়ঃ দেখুন দুই বাংলার সংস্কৃতির যে শিকড় তা তো রবীন্দ্রগানেই নিহিত। ১৯৭১ এ বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, বাংলাদেশ তখন ‘ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সংগীত হিসেবে ব্যবহার করল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো অবিভক্ত বাংলারই সম্পদ। তাই শাখা প্রশাখা ছড়ালেও রবীন্দ্রনাথের গানকে কেন্দ্র করে দুই বাংলার বাঙালির শিকড় এক ও অবিভক্ত।
দুই বাংলায় শিল্পীদের রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো পার্থক্য দেখেন কি? যদি দেখেন, সেটা কী?
অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায়ঃ দুই বাংলার শিল্পীদের গাওয়ার মধ্যে বিশেষ পার্থক্য চোখে পড়েনি। তবে আমাদের গানের প্রতি যে আবেগ ও সততা তার তুলনায় ওই বাংলার শিল্পীদের গায়নে অনেক বেশী সততা ধরা পড়ে। আমরা খোদার ওপর খোদকারি করতে গিয়ে রবীন্দ্রসংগীতের উৎকর্ষ হারিয়ে ফেলেছি যা আপনারা এখনও গর্বের সঙ্গে ধরে রেখেছেন।
এসময়ে এসেও বাঙালির যাপিত জীবনে রবীন্দ্রনাথের গান অত্যাবশকীয় কেন বলে আপনি মনে করেন?
অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায়ঃ সময় বদলালেও প্রকাশ বদলালেও মানুষের আবেগের তো পরিবর্তন হয়নি। তাই শুধু বাঙালি নয়, মানবজাতি যতদিন আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের প্রাসঙ্গিকতা ততদিন থাকবে কারণ মানুষের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে এমন কোনো আবেগ নেই যা রবীন্দ্রসংগীত ধরা পড়েনি। বিরহ থেকে প্রেম, প্রতিবাদ থেকে দুঃখ সবেতেই তিনি আছেন।
রবীন্দ্রনাথের গান অনেক শিল্পী বর্তমান সময়ে নিজের মতো করে গাইছেন, একজন সংগীত শিল্পী হিসেবে বিষয়টাকে কীভাবে দেখেন?
অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায়ঃ আসলে মুশকিল হলো নিজের মতো গাওয়া বলতে ঠিক কি বোঝায় সেটা বোঝার মতো মেধা আমরা হারাতে বসেছি। দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সকলেই নিজের মতোই গেয়েছিলেন। কিন্তু এখন আমরা বিকৃতির নেশায় মেতেছি। তাই খোদার ওপর খোদকারি করছি। রবীন্দ্রনাথের মতো একজন মেধাবী মানুষ যদি বুঝতেন তাহলে তিনি নিজের গানের কিছু জায়গা বদলাতেন। তা যখন করেননি বুঝতে হবে গানটার দাবী তা নয়। তাই যারা এই বিকৃতি করছেন, বহু নামী শিল্পীও করছেন, তাদের প্রতি আমার একটু করুণাই হয়।
রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে আপনার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায়ঃ কোমলনিষাদ ( আমার স্বামীর দেওয়া নামটি) বলে আমার একটি গানের পাঠশালা আছে যার বাংলাদেশ, ভারত এবং ভারতের বাইরে মিলিয়ে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী আছে। তাদের সাথে অনলাইনে ক্লাস চলে। করোনার আবহ একটু নিয়ন্ত্রণাধীন হলেই খুব ইচ্ছে বাংলাদেশ গিয়ে এইসকল ছাত্রছাত্রীদের সাথে দেখা করা এবং অনুষ্ঠান করা। দুই বাংলা একসাথে কোনোদিন একই মঞ্চে গাইব অসংখ্য শ্রোতার সামনে এ আমার স্বপ্ন বলতে পারেন। দেখা যাক। কোমলনিষাদ বলে আমার ইউটিউব চ্যানেলও আছে যার কাজ সম্প্রতি শুরু করেছি। মানুষের কাছে তাদের অনুরোধেরও কিছু গান নিয়ে আসব। বাকীটা ঈশ্বরের হাতে। সবরিছুর আগে প্রার্থনা এই মৃত্যুমিছিল বন্ধ হোক। সকলের মঙ্গল হোক।
অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায় হতে শিল্পী অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায় হয়ে উঠার পেছনে কাদের অবদান সবচেয়ে বেশি বলে মনে করেন?
অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায়ঃ এখনও শিল্পী অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায় হয়ে ওঠার অনেক দেরি তবু আপনার এই সম্মান আমি মাথা পেতে নিলাম। আমার গানের ক্ষেত্রে অবদানের প্রসঙ্গে প্রথমেই যে নাম আসে তা হলো আমার গুরুমা পূরবী মুখোপাধ্যায়। ওঁর শেখানোর ধরণ এতটাই অনায়াস সাবলীল ছিল যে গানকে প্রাণের আরাম ভাবতে সুবিধে হয়েছে। উনি কোনো দিন কোনো পরীক্ষায় বিশ্বাস করতেন না তাই ছোট থেকেই খুব মুক্ত মননে শিখতে পেরেছি। তারপর বলব আমায় যারা জন্ম দিয়েছেন আমার বাবা মা। বাবা নিজে নাটক করছেন আর গানটাও গাইতেন চমৎকার। চেয়েছিলেন আমিও গান শিখি। তাই আমার মধ্যে গানের প্রতি যে ভালোলাগা সেটা ওনার বুঝতে অসুবিধে হয়নি। আমার মা আমার দাদাকে নিয়ে যেতেন গান শেখাতে পূরবীদির কাছে। আমায়ও নিয়ে যেতেন কোলে করে। তখন থেকেই শিশুমনে সুরের অনুরণন চলেছিল হয়ত
যখন বড় হলাম, গান শিখতে শুরু করলাম আমার দাদা আমার খুব বড় অনুপ্রেরণার জায়গা হয়ে দাঁড়ালো। নিয়মিত অভ্যেসে গান নিয়ে বসতে ও বলত, স্বপ্ন দেখাত। এখনও দাদা আমার গানের সমালোচক তাই নিখুঁত গাওয়ার ব্যাপারে একটা খিদে এখনও কাজ করে। আর সর্বপরি যার কথা বলব , যিনি আমার মেয়েবেলার অন্যতম প্রিয় বন্ধু ছিলেন তিনি হলেন আমার ঠাম্মা, আমার বাবার মা। আমার ঠাম্মা আর মা-ই আমাকে হাতে ধরে পূরবী দির কাছে গান শিখতে ভর্তি করেন। এ গেল আমার ছোটবেলার কথা। আর এখন আমার বৌদি, আমার ছোটো ছোটো ভাইপোরা, আমার স্বামী, আমার শাশুড়িমাও আমার গানে অনুপ্রেরণা দেন। তাই আমাকে কোনো কষ্টই করতে হয় না। আমার বন্ধুরা আমার গানের ক্ষেত্রে খুব শক্তিশালী জায়গা জুড়ে আছে। ছোট থেকে এখনও তাদের উচ্ছাস, আবেগ, সমালোচনা আমার কাছে বিরাট সম্পদ। তারা সত্যিই বন্ধু। তাদের সকলের প্রতি আমি কতটা ঋণী বোঝাতে পারব না। আর এখন দুই বাংলার শ্রোতা। তাদের ভালোবাসা আর আশীর্বাদ আমার বিরাট প্রাপ্তি। তাই কিছু ফিরিয়েও দিতে ইচ্ছে করে। দেখি গান দিয়ে তা পারি কিনা!
একজন সংগীত শিল্পীর শিল্পী হয়ে উঠার পিছনে কী ধরণের সমস্যার সন্মুখীন হতে হয় বলে আপনি মনে করেন? বা আপনি হয়েছেন?
অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায়ঃ দেখুন আমায় কোনো বাধা সেভাবে পেতে হয়নি তাই হয়ত খুব বেশী বলতে আমি পারব না। তবে একটা বিষয় আমার মনে হয়েছে , একজন মানুষ যিনি শিল্প চর্চা করছেন তার একটা মানসিক, দৈহিক নিভৃতির প্রয়োজন। এটা আশপাশের মানুষকে বোঝানোটা শক্ত হয়ে যায়। যিনি মনেপ্রাণে শিল্পী তিনি প্রতিটি ঘটনাকে যেভাবে দেখবেন , যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেবেন তা তো হয়ত বাকীরা দেবেন না। তাই শিল্পী সততই আলাদা, স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্র্যকে উদযাপন করার মানুষ চারপাশে বড্ডো কমে যাচ্ছে। তাই অনেক সময়েই একধরণের মানসিক বাধা বোধ করি একথা স্বীকার করি।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায়ঃ আপনাকে জানাই অশেষ ধন্যবাদ, শুভেচ্ছা এত সুন্দর সুচিন্তিত প্রশ্নাবলীর জন্য। ভালো থাকুন, নিরাপদে থাকুন।