ছিমছাম এক গ্রাম রায়পুর। বটের ছায়া আগলে রাখে পুরো গ্রামকে। অসংখ্য পাখি সকাল-সন্ধ্যা গেয়ে যায় অবিরাম। পদ্ম ফুলে ছেয়ে থাকা পদ্ম পুকুর আর কদম পাঁপড়ি ছড়ানো বড় পুকুরে পথিকেরা যেতে যেতে একবার ফিরে তাকান। কখনোবা কংসের সবুজ জলের ছোঁয়া পেতে বালকেরা অবাধে ঝাঁপিয়ে পড়ে কংসের জলে। কখনো সাঁতরে ওপারে গিয়ে নিয়ে আসে চরের তরমুজ আর বাদামের ঘ্রাণ। তুলে আনে নৌকা ট্রলার আর মাঝিদের গান।
ঝুম বৃষ্টিতে কাদা মেখে ফুটবল খেলার আনন্দ এ গ্রামেও আছে। আছে শর্ষে ফুলে ছেয়ে থাকা মাঠে রোদ পোহানোর গল্প। পিঠে-পুলির উৎসব। মাছ শিকারির শান্ত চোখের ভূগোল। আছে কামারদের হাতুরির উত্তাপ। কংসের বুক চিরে কুমোরদের হাতে রূপ পাওয়া মাটির হাতির ঘোড়ার ইতিহাস। পথে পথে ভাঁট ফুলে ছেয়ে থাকা বসন্ত। মেলার বাতাসে ছেয়ে যাওয়া মোয়া-মুড়ি আনন্দ। আছে পুকুর পাড়ের করবী ফুলের গন্ধ নিতে নিতে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার শৈশব।
রায়পুর গ্রামের নামকরণ হয় মজুমদার বংশের পূর্ব-পুরুষ রায়জিত খাঁর নামানুসারে। অখণ্ড ভারতবর্ষের পশ্চিমবাংলা প্রদেশের বর্ধমান জেলার অন্তর্গত মঙ্গলকোট নামক স্থান ছিলো মজুমদারদের আদি বাসস্থান। রায়পুর ছিলো সুসং পরগনার একটি জোয়ার। সুসং পরগনার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সোমেশ্বর পাঠকের রাজত্বকালে আনুমানিক ১২৮০ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৩১০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রায়জিত খাঁ মঙ্গলকোট হতে বহু ভৃত্য ও অনুচরবর্গ নিয়ে রায়পুর আগমন করেন। কর্ণজিত খাঁ, দশজিত খাঁ, কালীজিত খাঁ নামে আরো তিন ভাই রায়জিত খাঁর সাথে আসেন। তখন ভারতবর্ষ ও বাংলা অঞ্চলে মুসলিম বাদশাদের রাজত্ব ছিলো। রায়জিত খাঁ তাঁর তালুকদারি রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রজাহিতৈষী কাজকর্ম করে সুসং মহারাজের স্নেহভাজন হয়ে উঠেন। তাঁর অন্য ভাইয়েরা এসে পাশের অঞ্চলে বসবাস করলেও রায়জিত খাঁর মতোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। রায়জিত খাঁর পরবর্তী প্রজন্মরাও শিক্ষা, সংস্কৃতির দিক দিয়ে অন্যদের থেকে এগিয়ে ছিলেন। মুসলিম শাসনামলে খাঁ উপাধি থাকলেও ব্রিটিশ আমলে রায়জিত খাঁর বংশধরদের মজুমদার উপাধি দেয়া হয়। বংশ পরম্পরায় হিন্দু অধ্যুষিত এই অঞ্চলের একচ্ছত্র শাসন করতে থাকেন মজুমদারেরা। তাঁদের কুলদেবতা গোপীনাথ বিগ্রহ।
জনসংখ্যা বাড়ায় রায়পুর গ্রামেই মজুমদারদের সাতটি বাড়ি তৈরি হয়। এক একটি বাড়ি আলাদা আলাদা নাম নিয়ে এক একটি পাড়া হয়ে উঠেছিলো। রায়পুর গ্রামের পশ্চিম দিকে কালীনাথ মজুমদারের বাড়ি। কালীনাথ মজুমদারের ছোটো ছেলে নবকিশোর মজুমদার। সেই বাড়িতেই কোনো এক ভোরে জন্মেছিলেন হীরেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার। বাবা নবকিশোর মজুমদার ও মা আনন্দময়ী মজুমদারের পাঁচ পুত্র ও তিন কন্যার মধ্যে হীরেন্দ্র ছিলেন সবার ছোটো। সবাই তাঁকে আদর করে ডাকতেন হীরেন নামে।
ছোটোবেলা থেকেই হীরেন্দ্র ছিলেন গাছেদের মতো সবুজ, শান্ত ও শীতল। বট গাছকে দুলিয়ে দিয়ে কংস নদের বয়ে চলা, নিরিবিলি সন্ধ্যা নামার মতো তিনি ছিলেন বিনয়ী। সেইসঙ্গে কর্ম ও জ্ঞানযোগী। কোনোকিছুই তার নজর এড়াতো না, সবকিছু খুব যত্ন করে রাখতেন। এমনকি নিজেকেও। যুবক বয়সে সুদর্শন হিসেবে সবার নজর কাড়েন। লম্বা, ফর্সা ও মিতভাষী এই যুবক পরিবারের সবার খুব প্রিয় হয়ে উঠেন, গ্রামের মানুষদেরও। শৈশব পার হতেই মাকে হারান হীরেন। কেমন যেনো গম্ভীর হয়ে উঠেন তখন থেকেই। বাবা ছিলেন গ্রামের শর পঞ্চায়েত। স্ত্রীর মৃত্যুতে তিনিও ভেঙে পড়েন। পরিবারের ছোটো বলে সবার বাড়তি মনোযোগ ছিলো হীরেনের প্রতি। বোনেরা তাকে আগলে আগলে রাখতেন। বড়দিদি কখনো তাকে নজরছাড়া করতেন না। ঠিক মায়ের মতোই যত্ন নিতেন আদরের ভাইটির। মেজদিদি আর ছোটদিদির পুতুল বিয়েতে হীরেন ছাড়া চলতোই না। প্রতি সোমবার পুকুরপাড়ে বসা আনন্দগঞ্জের বাজার থেকে জমানো টাকা দিয়ে বোনদের জন্য মিষ্টি কিনে আনতেন। কখনো চুল বাঁধার রঙিন ফিতে আর আলতা কিনে আনতেন। বোনেরাও তাদের জমানো টাকা তুলে রাখতেন সোমবারের অপেক্ষায়। হীরেনকে টাকা দিয়ে বলতেন- ‘যা মন চায় কিনে খা গে হীরেন’।
সবকিছু ছাপিয়েও হীরেন মাকে ভুলতে পারেননি। কেমন এক শূন্যতা তাকে ঘিরে রাখতো। খেলার সাথীদের সাথে খেলতে গিয়ে নীরবে খেলা ছেড়ে চলে আসতেন। মা হারা হীরেন কখনো কখনো পুকুর পাড়ে পারিবারির শ্মশানের পাশে কদম গাছের নিচে বসে বই পড়তেন। কখনো বেল গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে থাকা মায়ের শ্মশানের দিকে তাকিয়ে কি যেনো ভাবতেন তন্ময় হয়ে। কখনো কংসের বুকে সূর্য ডুবিয়ে দিয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরতেন। সময় যতোই যেতে থাকে সে নিজের একটা পৃথিবী নিয়ে সবার থেকে একটু একটু করে আলাদা হতে থাকে। আর সবার মতো নয়, সব কিছুতেই আছেন, আবার কিছুতেই নেই। কিন্তু পাড়া প্রতিবেশী বন্ধুদের সাথে সব সময় হাসি মুখেই কথা বলতেন। কে বুঝতো কৈশোর পার হতে থাকা মা হারা এই যুবক কতোটা যন্ত্রণা বয়ে চলেছেন।
ভেতরে ভেতরে পরিণত হতে থাকেন হীরেন। পড়াশুনায়ও ছিলেন মনোযোগী। ভাইদের চেনা পড়ার টেবিলে একসাথে পড়তে পড়তেও তাঁর ভাবনা চিন্তা অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দিয়েছিলো তাঁকে। নবকিশোর টের পেয়েছিলেন তাঁর এই ছেলের জ্ঞান-বুদ্ধি-ব্যক্তিত্ব অন্যদের থেকে আলাদা। কিন্তু ভালোভাবে পড়াশুনা করার সুযোগ থাকলেও কিছুতেই গ্রাম ছাড়তে চাইতেন না হীরেন। গ্রামই ছিলো তাঁর সব। যেখানে তাঁর অন্য ভাইয়েরা ময়মনসিংহে থেকে পড়াশুনা করতেন, কাকাতো জেঠাতো ভাইয়েরা বিশ্বভারতী থেকে পড়াশুনা শেষ করছেন সেখানে হীরেন পড়ে রইলেন গ্রামে। স্কুলের থেকে ফিরে তাঁর বাকিটা সময় কাটতো দাদু নন্দকিশোর মজুমদারের কাচারী বাড়িতে গড়া ‘নন্দ কিশোর পাঠাগারে’। পাঠাগারের বইয়ে মন পড়ে থাকতো হীরেনের। নন্দকিশোর ছিলেন নবকিশোর মজুমদারের জেঠামশাই। গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়ানোর জন্য নন্দকিশোর তাঁর পুকুরপাড়ে একটি এম. ই স্কুলও স্থাপন করেন। হীরেনকে খুব ভালোবাসতেন নন্দকিশোর। নবকিশোরকে বলতেন- ‘তোর ছোটো ছেলেটার মনটা খুব নরম। ও অনেক বড় হবে, দেখিস’।
হীরেনের ওপর পরিবারের প্রভাব ছিলো খুব। অনেক কিছু পেয়েছেন পরিবার থেকে। দাদু, কাকা, জেঠা, ভাই-বোনদের কাছাকাছি থেকে পেয়েছিলেন মনস্তত্ব গঠনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। হীরেনের জীবনে আরেক ভালোবাসার নাম ছিলো মামা রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ রায়। যিনি ঢাকা কলেজ থেকে এফ এ পরীক্ষায় ইতিহাসে বিশেষ পারদর্শিতার জন্য তখনকার সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার ‘ডোনেলী পদক’ লাভ করেন। ছিলেন বিখ্যাত আইনজীবী। পাঁচ মামার মধ্যে শ্যামা মামাই ছিলো হীরেনের প্রিয়। যখনই মামার বাড়ি কিশোরগঞ্জের বনগ্রামে যেতেন, মামার কাছ থেকে শুনতেন ব্রিটিশদের কথা, বিপ্লবীদের কথা, স্বদেশী আন্দোলন ও দেশপ্রেমের কথা। মা হারা এই ভাগনেকে মামাও খুব ভালোবাসতেন। মামাদের সবাই ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের সমর্থক, ‘যুগান্তর’ দলের সক্রিয় সদস্য। এমনকি বাড়ির মেয়েরাও ছিলেন সাধারণভাবে ব্রিটিশবিরোধী। মামার বাড়িতে সব সময় পুলিশের আনাগোনা ছিলো। স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত থাকার ফলে কিছুদিন পর পর তাদের জেলে যেতে হতো।
হীরেনের বড়দা হেমচন্দ্র মজুমদার বিএএলএলবি শেষ করে ময়মনসিংহ জেলা জজ কোর্টে প্র্যাকটিস করতেন। থাকতেন মামার বাসাতেই। ছোটদা অতুলচন্দ্রও মামার বাসা থেকে পড়াশুনা শেষ করে ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট ইংরেজি স্কুলের শিক্ষকতায় যোগ দেন। কিন্তু হীরেন কিছুতেই গ্রাম ছাড়তে চাইলেন না। পরিবারের অন্যদের মতো ডাক্তার, ম্যাজিস্টেট, উকিল কোনো কিছুই হতে চাইলেন না। কী যে করতে চাইতেন তা তার মন জানতো। যেন তাকে বারবার বেঁধে রাখতো গ্রামের মুক্ত আলো-বাতাস আর বোনেদের স্নেহ। ততদিনে বড়দিদি আর মেজদিদির বিয়ে হয়ে গেছে। দুই বোনের বিয়ের পর মা হারানোর শূন্যতা আরও গাঢ় হয় হীরেনের। তখন ছোটদিদি তাকে আগলে রাখেন। হীরেনের যেনো কষ্ট না হয় সেদিকে নজর তার। হীরেন টের পেলেন, ছোটদির স্নেহও তার বেশি দিন স্থায়ী হবে না। অবশেষে বাবা আর ভাইদের কথা ফেলতে পারলেন না হীরেন। উচ্চশিক্ষার জন্য চলে গেলেন ময়মনসিংহে মামার বাসায়।
ময়মনসিংহে এসে হীরেন নতুন করে নিজেকে চিনলেন। আবিষ্কার করলেন নিজেকে। তাঁর সামনে নতুন এক পৃথিবীর দরজা খুলে গেলো। নতুন সব মানুষ নতুন বন্ধুদের সংস্পর্শ তাঁর মনোজগতে নতুন করে মোড় নিতে থাকে। তাঁর অন্য মেসতুতো ভাই-বোনেরাও তখন মামার বাসাতেই থাকতো। মামার সেই বাসাই ছিলো তাদের অনেকের জীবনের বড় পাঠশালা। তখনো সোচ্চার ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। বিপ্লবীদের নতুন নতুন পদক্ষেপ। মামার বাসায় ছিলো বড় বড় নেতাদের আনাগোনা। সেই সাথে পুলিশেরও। মামার বাড়ি তাকে ঘনিষ্ট হতে সুযোগ করে দিলো তাঁর আপন মসাতো ভাই সুধীন্দ্র রায়ের সাথে। সুধীন্দ্র রায়ের ডাকনাম ছিলো খোকা। মামার বাড়িতে দুজন একসাথেই থাকতেন, পড়াশুনা করতেন। মামাবাড়ির বিপ্লবী পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠে হীরেনের খোকাদাও অল্প বয়সেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন যুগান্তর দলের সাথে যুক্ত হন। একসাথে থাকতে থাকতে হীরেনও খোকাদার থেকে অনেক কিছু পেয়েছিলেন। খোকাদা তাঁর ভেতর নতুন করে জ্বেলে দিয়েছিলেন দেশপ্রেমের মন্ত্র। দিয়েছিলেন সাম্যবাদের পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন। আর শিখিয়েছিলেন নিজেদের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই। হীরেনের এই খোকাদাই হলেন বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড খোকা রায়।
হীরেনের ভাবনা-চিন্তাকে এবার তুমুল কাঁপিয়ে দিলেন তাঁর জেঠাতো দাদা অগ্নিযুগের বিপ্লবী জ্ঞানচন্দ্র মজুমদার। পরিবারের ছোটোরা তাঁকে দাদামণি বলে ডাকতেন। হীরেনও ডাকতেন। বয়সে হীরেন তাঁর থেকে অনেক ছোটো ছিলেন। এই বিপ্লবী তাঁর পড়াশুনা ও কাজের জন্য রায়পুরে খুব একটা যেতে পারতেন না। জীবনের বহু সময় তাঁর কেটে যেতো ব্রিটিশদের জেলখানায়। হীরেন যখন ময়মনসিংহে এলেন এই দাদামণিকেই যেনো নতুন করে চিনলেন। রায়বাহাদুরের সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিলো। হীরেনকে কাছে পেয়ে তিনিও যেন জন্মমাটির গন্ধ পেলেন। মামার বাসায় কিছুদিন থেকে দাদামণির বাসায় চলে গেলেন হীরেন। জীবনে যেটুকু সম্বল করেছিলেন তা বাড়ির পাঠাগার, দাদামণি আর খোকাদার থেকেই পাওয়া। হীরেনের এই দাদামণি জ্ঞানচন্দ্র মজুমদার ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম অগ্নিপুরুষ। তিনি অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা পি. মিত্রের সংশ্রবে আসেন এবং তিনিই সমিতির সর্বপ্রথম সদস্যরূপে বিধিবদ্ধ শপথগ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে এম.এস.সি. পড়ার সময় জ্ঞান মজুমদার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি তখনকার কংগ্রেস হাইকমান্ডের বিপক্ষে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁর মনোনীত ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। জীবনের ছাব্বিশটি বছর তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন ব্রিটিশরাজের জেলে। জ্ঞান মজুমদারের বাসায় এসে হীরেনের খোকাদার, সোনাদা আর ছোড়দার জন্য মন কেমন করতো। জ্ঞান মজুমদারের যখন আবার জেল হলো তারপর আবার মামার বাসায় ফিরে গেলেন হীরেন।
এতো বিপ্লব এতো বড় মানুষের সংস্পর্শে এসেও হীরেন্দ্র তাঁর প্রিয় গ্রামের কথা, বাড়ির কথা, আপনজনদের কথা একটু সময়ের জন্যও ভুলে যাননি। তিনি তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত হলেও নিজে কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেন নি। বরং নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। তিনি তাঁদের আদর্শকে অন্তরে ধারণ করলেন। ভাবলেন মাটির কথা, গ্রামের কথা। মামা চেয়েছিলেন ভাগনে তার ময়মনসিংহেই থেকে যাক। কিন্তু গ্রাম যে বারবার পিছু ডাকতো হীরেনকে। মন পড়ে থাকতো মায়ের শ্মশানে। দাদুর লাইব্রেরির বইয়ের ভাঁজে। বোনেদের স্নেহের টানে, পুতুল বিয়ের উৎসবে। বাবার আদরে। বাড়ি থেকে খবর গেলো হীরেনের ছোটদি নীহারিকনার বিয়ে। হীরেন জানতেন, মায়ের মতোন আগলে রাখা প্রিয় দিদিরাও একদিন সবাই যে যার মতোন চলে যাবে। ছোটদিও চলে যাবে। সোনাদা আর ছোটদার সাথে বাড়ি ফিরলেন হীরেন। ছোটদির বিয়ে, উৎসাহ নিয়ে কাজ করলেও একা হবার যন্ত্রণা বয়ে চললো সে। বড়দির আর মেজদির বিয়ের পর ছোটদিই ছিলো তাঁর পরমাশ্রয়। তাকে সুখে দুঃখে আগলে রাখতো ছোটদি। যেদিন তিন ভাই বাড়ি ফিরলো, নীহারিকনা কি কান্নাটাই না কেঁদেছিলেন। বড় দুই দিদিও ছিলো সেদিন পাশে। মা হারা সন্তানদের এই কান্নার উৎসবে নবকিশোর ছিলেন নীবর, নিথর। নীহারিকনার বিয়ের পর যখন চলে যাবার সময় এলো, হীরেনকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। ছোটদির কষ্ট হবে ভেবে হীরেন পালিয়েছিলেন। ঘরে ফিরে ফাঁকা ঘরজুড়ে কম কথা বলা হীরেনও বাচ্চাদের মতোন করে কেঁদে ছিলেন। ভাইবোনেরা সেদিন নিজেদের কান্না লুকিয়ে তাকে সামলেছিলেন। মা হারা ছেলেটার কষ্ট দেখে পাড়া প্রতিবেশীরাও চোখের জল ফেলেছিলো।
ময়মনসিংহে ফিরে গেলেও পড়াশুনায় আর মন বসতো না হীরেনের। বাড়ির জন্য মন টানতো। কোনো শাসনই আর তাকে আটকাতে পারলো না। পড়াশুনা শেষ না করেই উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে পেছনে ফেলে তিনি ফিরে এলেন রায়পুর। যেটুকু সম্বল নিয়ে এলেন তা নিয়েই রক্তে থাকা বিপ্লবকে ছড়িয়ে দিতে চাইলেন নিজের শেকড়ে। কোনো দল নয়, উচ্চ বিলাসিতা নয়, শিক্ষকতাকেই নিজের হাতিয়ার করে নিলেন। বাড়িতে এসেই যোগ দিলেন দাদু নন্দকিশোরের গড়া এম.ই স্কুলে। ব্রিটিশরাজের শিক্ষানীতি অনুসারে এম.ই স্কুলগুলো তখন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে উন্নীত হয়েছে। তারপর সেখান থেকে বাউসি অর্ধ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক হলেন হীরেন্দ্র। সমস্ত দুঃখ সয়ে নিভৃতচারী এই মানুষটি নীরবেই শিক্ষার আলো জ্বেলে যেতে লাগলেন। গ্রামকে দেশকে জাগিয়ে তুলতে শত শত তরুণদের মাঝে তিনি শিক্ষার আলো জ্বেলে দিলেন। ছাত্রদের শোনাতেন বিপ্লবের গল্প। ব্রিটিশ শক্তির শোষণ আর বঞ্চনার কাহিনি। সম্পত্তি আর যশের মোহ ত্যাগ করলেও একজন ভালো শিক্ষক হিসেবে তাঁর ছিলো সুখ্যাতি। দূর থেকে পড়তে আসা ছাত্রদের পড়ার সুবিধার জন্য তিনি অনেক ছাত্রকে বাড়িতে রেখে পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এর মধ্যেই একদিন অমিয় রানী রায়ের সাথে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়।
ক্রমে পরিবারেও ভাঙন দেখা দিতে শুরু করে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন হেমচন্দ্র মজুমদার। তারপর দ্বিজেন্দ্র, নগেন্দ্র আর অতুল চন্দ্র। অতুল চন্দ্র ছিলেন অবিবাহিত। হঠাৎ একদিন খবর এলো হীরেনের ছোটদা অতুলচন্দ্র হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মামার বাসায় মারা গেছেন। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে পরিবারে শোকের ছায়া নিয়ে এলো। বাবা থাকতে ছেলের মৃত্যু এর থেকে কষ্টের আর কী হতে পারে। বড় অকালে চলে গেলেন অতুল চন্দ্র, তখন থেকেই শরীরে ও মনে ভেঙে পড়তে থাকেন নবকিশোর। ছেলের মৃত্যুর পর নিজেও খুব তাড়াতাড়িই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তারপর বাড়িতে হঠাৎ একদিন হেমচন্দ্রের স্ত্রী মারা গেলেন। একের পর এক মৃত্যু মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো হীরেনের। মনে হচ্ছিলো ক্রমেই যেনো চারপাশটা শূন্য হয়ে যাচ্ছে। ছোটদা বাবা আর বড় বৌদির পর তাঁর রাঙাদা নগেন্দ্রও এক ছেলে মেয়ে ও স্ত্রীকে রেখে অকালেই চলে গেলেন। পরিবারের সবাই ভেঙে পড়লেন। কাছের মানুষ হারানোর যন্ত্রণা কতো আর সহ্য করা যায়। মৃত্যুর উৎসব হয়ে একে একে আপনজনেরা চলে যাচ্ছে। এই শোক কি মেনে নেয়া যায়। তবু মেনে নিতে হয়, হীরেনেরও মানবজীবনের অমোঘ এ বিধান মেনে নিয়েছিল।
হীরেনের সোনাদা হেমচন্দ্রের ছিলো দুই মেয়ে। মণিদা দ্বিজেন্দ্রের ছিলো তিন মেয়ে ও তিন ছেলে। বাড়ির বাকিদের সাথে দ্বিজেন্দ্রর ছেলেরা কলকাতায় পড়াশুনা করতে চলে যায়। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দুই ভাই কলকাতায় আসা যাওয়া করতে থাকেন। ছেলেরাও সব ওখানে। তারা আসা যাওয়া করলেও কেমন একা হয়ে পড়েন হীরেন। সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। একদিকে চাকরি অন্যদিকে ভূসম্পত্তি, সবই দেখাশুনা করতে হতো তাকে। গ্রামের হিন্দু-মুসলিম সব সম্প্রদায়ের সাথে ছিলো তাঁর সদ্ভাব। বরাবরই ভালোবাসতেন মানুষকে। পাশে থাকতেন মানুষের।
দেশের প্রতি তাঁর টান ছিলো রন্ধ্রে রন্ধ্রে। হয়তো কখনো তিনি প্রকাশ করতেন না কিন্তু চুপচাপ থাকা মানুষ হলেও খোঁজ রাখতেন সবই। তাঁর দাদামণি জ্ঞান মজুমদার যখনই বাড়ি আসতেন তখনই তাঁর কাছে ছুটে যেতেন। জানতে চাইতেন দেশের খবর, রাজনৈতিক অবস্থা, দেশের অস্থিরতা। বলতেন কী করবো দাদামণি, সবাই একে একে কলকাতায় পাড়ি জমাচ্ছে। এখানকার প্রতি কি ওদের কোনো টান নেই। বিপ্লবের যে রক্ত তাঁর ভেতর তা তিনি চাইলেও ভুলে থাকতে পারতেন না। দাদামণি তাঁকে অভয় দিতেন, বলতেন- ‘তুই যদি এসব কথা বলিস হীরেন। ভাবিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আগে নিজের মাটি, নিজের দেশের কথা ভাববি। তারপর অন্য ভাবনা। এই মাটি আমাদের মা, মাটির থেকে আর কিছু আপন হয় না হীরেন। মাটি আগলে থাকবি। এরচে সুখ আর কিছুতে নেই। যারা যেতে চায় চলে যাক, তুই মাটিকে জড়িয়ে থাক, শান্তি পাবি হীরেন’।
দিন গড়াতে লাগলো। এদিকে সংসার বাড়ছে হীরেনের। কয়েকজন সন্তান তাঁর আঁতুরঘরেই চলে গেলো। কেউ চলে গেলো একটু বড় হয়ে। বারবার আসা মৃত্যুগুলো তাঁকে তুমুল নাড়িয়ে দিলেও, সব শোকতাপ নীরবে সয়ে গেলেন। কেউ টেরও পায়নি। তাঁর এই নীরবতা অনেকের কাছে দাম্ভিকতা মনে হতো। তিনি কারো মনে হওয়ার ধার দিয়েও যেতেন না। খুব সাধারণভাবে নিজের আভিজাত্য বজায় রাখতেন। এরই ছোঁয়া পাওয়া যেতো তাঁর ধবধবে সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবীতে। মণিদা তো কলকাতাতেই থাকেতেন বেশিরভাগ সময়। সোনাদা ময়মনসিংহে। বাড়ির অন্য ভাইয়েরা মাঝে মাঝে রায়পুরে আসতেন গোপীনাথ পূজায়, দুর্গাপূজায়। হীরেনের তিন বোনও আসতেন। সেই সময়টাতে বাড়িতে সবাই একসাথে হতেন। একেবারে কালিপূজা শেষ করে তবে যে যার মতো চলেও যেতেন। গোপীনাথ বিগ্রহের সমস্ত ভার ছিলো মন্দিরের পুরোহিত প্রমোদ চক্রবর্তীর ওপর।
এরমধ্যেই বাংলা জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হলো। হিন্দ-মুসলিম দাঙ্গা। লাশের পর লাশ। ক্রমে সেই অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়লো গ্রামেও। শান্ত রায়পুর গ্রামেও কেমন ভয়ের ছায়া নেমে এলো। হীরেন কেবল ভাবেন আর ভাবেন, কি করবেন কিছু সমাধান করতে পারেন না। একে একে সব বাড়ি খালি হয়ে যাচ্ছে, মজুমদার বাড়িও খালি হয়ে যাচ্ছে। হীরেন ক্রমে ফাঁকা হতে থাকা গ্রামের বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে আরেকবার শুন্যে চোখ ছুড়ে দিয়ে কী যেনো ভাবতেন। তাঁর কাকা, জেঠাদের সমস্ত পূর্ব পুরুষদের বাড়ি খালি হয়ে যাচ্ছে। সববয়সী গোষ্ঠীর সব ভাইয়েরাও চলে যাচ্ছে। তাদের সন্তানরা আগে চলে গেলেও ভাইয়েরা রায়পুরই থাকতেন। এখন তারাও চলে যাচ্ছে। এই বিচ্ছেদ কোথায় রাখবেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরক্ষণেই ভাবতেন- আছে, এখনও তার দাদামণি আছে, খোকাদা এখনও এ মাটিতেই আছে। ওঁরা সব ঠিক করে দেবে, ওঁদের বিপ্লব বৃথা যাবে না।
সাতচল্লিশে দেশভাগের পর হিন্দু অধ্যুষিত রায়পুর গ্রাম ক্রমেই আরও ফাঁকা হয়ে গেলো। এর মধ্যেই হীরেনের তিন ছেলে বাড়ির উঠোন জুড়ে বড় হচ্ছে। তাঁকে বারবার যাবার জন্য ভাইয়েরা চিঠি লিখছেন, কিন্তু কোনো সাড়া নেই তাঁর। কেউ জানতে চাইলে বলতেন- ‘আমি কেন যাবো ওই দেশে, ওখানে আমার কী। আমি এদেশেই থাকবো। এই মাটিতেই আমার সব অধিকার, ওখানে কেন পরগাছার মতো থাকতে যাবো। কেউ থাক না থাক আমি এখানেই থাকবো। আমার সন্তানরাও থাকবে’।
কলকাতা থেকে একদিন হীরেনের সব ভাইয়েরা এলেন, কাকাতো জেঠাতো সব ভাইয়েরা। হীরেনের মণিদা দিজেন্দ্র এলেন। খবর পেয়ে হেমচন্দ্রও এলেন ময়মনসিংহ থেকে। সব বাড়ির মানুষ এক সাথে হয়ে বসলেন। কারা থাকবেন, কারা চলে যাবেন এতো এতো সম্পত্তির কী হবে এই নিয়ে আলোচনা। এ যেন দেশ ছাড়ার আরেক উৎসব। সেই উৎসবে মেতেছিল সবাই। বাড়িটার শত-সহস্র স্মৃতি, নিজেদের ভিটে সব যেনো তুচ্ছ এখানে। সবার এক ভাবনা, যেতে হবে, চলে যেতেই হবে। এই যেন শেষবার সবার এক সাথে হওয়া। বিচ্ছিন্ন হবার যেন এই শেষ উৎসব। মন্দিরের পুরোহিত প্রমোদ চক্রবর্তীও উপস্থিত আছেন মিটিং-এ। সবাই সিদ্ধান্ত নিলেন কলকাতাতেই চলে যাবেন। সবার ছেলে মেয়ে যখন ওখানে তাহলে রায়পুর থেকে কি করবেন সবাই। হীরেনের দুই বোন কয়েকবছর হলো কলকাতায় চলে গেছে। ছোটদিও হয়তো চলে যাবে। সবার ইচ্ছা আদরের ছোটো ভাই হীরেনকেও নিয়ে যাবেন যে করেই হোক। এই গ্রামে একা ওকে রেখে যাওয়া যাবে না। সবাই যখন চলে যাচ্ছে তখন একা হীরেন কেন থাকবে। সমস্ত আলোচনায় নীরব রইলেন হীরেন। তিনি অনড়। এই গ্রাম ছেড়ে দেশে ছেড়ে কোথাও যাবেন না তিনি।
বড়দা হেমচন্দ্র নরম সুরে বললেন- ‘চল হীরেন চলে যাই, একা কীকরে থাকবি তুই এই গ্রামে; সবাই তো চলে যাবে, কাকা-জেঠারাও চলে যাবে। মামাতো, মসাতো, পিসাতো ভাই-বোন আমাদের সকল আত্মীয়ই তো চলে যাচ্ছে। মেয়েরা ওখানে, আমিও চলে যাবো; কাকে নিয়ে থাকবি তুই। চল ভাই চলে যাই। সবাই চলে গেলে এখানে কেউ আর তোকে সম্মান করবে না। সম্মান ছাড়া আর কী আছে আমাদের। মাথা নিচু করে থাকতে পারবি? সারাটা জীবন গ্রামে কাটিয়ে দিলি। ছেলেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে চল আমাদের সাথে। ওখানে তোর কোনো সমস্যা হবে না। চল ভাই চলে যাই’।
হীরেনের স্পষ্ট উত্তর- ‘না সোনাদা, আমার এখানে থেকেই অভ্যাস, চাকরিও এখানে। ওখানে গিয়ে কী করবো। আমি যাবো না সোনাদা। তাছাড়া দাদামণি তো থাকবে। ময়মনসিংহে থাকলেও তো বাড়ি আসবে। আমি এখানেই থাকবো’।
এবার রেগে গেলেন হেমচন্দ্র, বললেন- ‘তোর একরোখা জেদ ছাড় হীরেন। সারাটা জীবন জেদ করে কাটালি। এখানে কোথায় থাকবি তুই। এই দেশ মুসলমানদের হয়ে গেছে এখন। আমরা এখানে সংখ্যালঘু। এখানে আর কী আছে তোর যে পড়ে থাকবি। গ্রাম তো এখন মুসলমানে ছেয়ে যাবে। তোকে অত্যাচার করবে। হিন্দুরা আর এখানে শান্তি পাবে না। সব শেষ হীরেন, নিজেদের সম্মানটুকু নিয়ে চল চলে যাই ভাই’।
হীরেন এবার স্পষ্ট উত্তর দিলেন- ‘এই দেশে এই গ্রামে আমার জন্ম। আমি হিন্দু তাতে কী। এই দেশ তো আমারো দেশ। এই গ্রাম আমার নিজের গ্রাম। এখানে আমার বেড়ে ওঠা আমার জীবনের সমস্ত কিছু। কী করে ভুলে যাবো সব। এই মাটি আমার নিজের মাটি। নিজের মাটি বলতে খুব গর্ব হয় সোনাদা। এখানকার মানুষ আমার চেনা, ওরা কেউ আমার কোনো ক্ষতি করবে না আমি জানি। কেউ কোনো অত্যাচার করবে না। তুমি ভুল ভাবছো। আমি হিন্দু তা আমার পরিচয় নয়, আমি এ গ্রামের মানুষ, এখানকার শিক্ষক। যা হয় হোক, মরতে হলে এখানেই মরবো, নিজের মাটিতে। আবার কোথাও গিয়ে নতুন করে শুরু করতে আমি পারবো না। তোমরা আমায় নিয়ে আর ভেবো না। আমিই ভালোই থাকবো’।
সবাই বললো – তাহলে তুই যাবি না। যা ভালো বুঝিস কর। আমরা আর কী করবো তবে। বেণুকে কী করবি, তোর কাছেই থাকবে ও।
কাকা-জেঠারা বললেন- আমাদের জমি-জমা তবে তুই-ই দেখ হীরেন। তুই যখন থাকবি তোর কাছেই থাক। তোকে লিখে দিয়ে যাই। আমাদের আর কে আসবে এখানে। আর কী ফিরতে পারবো।
হীরেন বললেন- না গো, আমার যা আছে তাই তো অনেক, তোমরা অন্য কাউকে দেখো। এতো জমি-জমা দিয়ে আমি কী করবো। আর বেণু, ও আমার কাছেই থাক। ও আমার বড় আদরের। আমার রাঙাদার স্মৃতি ও। আমার ছেলেদের সাথেই থাক।
সবাই নিরাশ হলেন। মিটিং এখানেই শেষ হলো। কেবল দেবোত্তরের উইল করে দেয়া হলো পরবর্তী বংশধরদের নামে। তার সেবায়েত পুরোহিত প্রমোদ চক্রবর্তী। সমস্ত কিছুর ভার তার ওপর দিয়ে বাড়িঘর আর শূন্য উঠোন রেখে একে একে সবাই চলে গেলেন সীমানার ওপারে। দু্ইভাগ হয়ে গেলো দেশ, শরীরের অংশগুলো কেটেকুটে বিচ্ছিন্ন করে দেবার মতো করে সবাই চলে গেলেন; কেবল বিচ্ছিন্ন অংশগুলোর শোকে অসুস্থ মন আর শরীর নিয়ে হীরেন্দ্র পড়ে রইলেন একা। আগের মতো আর বাড়িতে উৎসব হবে না, সবাই ছুটে আসবে না। আনন্দে ভাসবে না আর এতোগুলো বাড়ির মানুষ। কথাগুলো মনে পড়তেই নিজেকে খুব অসহায় মনে হয় তাঁর। সবার কথা মনে পড়ে ভেতরটা ছিঁড়ে যেতে থাকে। জীবনে এতো কষ্টও তাঁর তোলা ছিলো। যাই হয়ে যাক, তবু মাটি ছাড়লেন না হীরেন। তাই তো হীরেন একা, ভীষণভাবে একা আজ।
দেখতে দেখতে সমস্ত গ্রাম রিফিউজিতে ভরে গেলো। মজুমদারদের খালি বাড়িগুলো দখল হয়ে গেলো রাতারাতি। পুরোহিত কিছুই ঠেকাতে পারলেন না। একদিন বিকেলে ছুটে এলেন ছোটোবাবুর কাছে। বললেন- ছোটোবাবু, কী করবো আমি একা, আপনি তো কোনো দায়িত্ব নিলেন না, সব যে দখল হয়ে গেলো। বেশিরভাগ হিন্দুই তো চলে যাচ্ছে, কীসের জন্য আপনি রয়ে গেলেন’।
ছোটোবাবু হাসতে হাসতে বললেন- ‘মাটির টান প্রমোদ, মাটির টান। ও তোমরা কেউ বুঝলে না। বুঝলে কি পরদেশের টানে গ্রাম এমন উজার হতো’।
সত্যিই প্রমোদও হয়তো বুঝতে পারেনি। কয়েকদিন পর হীরেন খবর পেলেন প্রমোদ স্থানীয় মুসলমানদের কাছে মজুমদারদের সম্পত্তি লিখে দিয়ে টাকা নিয়ে কলকাতায় চলে গেছে। সে নিরুত্তাপ, কতো আর সইবেন; শেষে প্রমোদও চলে গেলো এভাবে না বলে, লুকিয়ে। মন্দিরের কুলদেবতাও হীরেনের মতো পরে রইলো একা নিঃসঙ্গ হয়ে। একা হয়ে যাওয়া হীরেন কেবল আগলে রাখতে চাইতেন নিজের সংসার-সন্তানদের, আর রাঙাদার একমাত্র স্মৃতি সরল বেণুকে। ভাবলেন ভালোই হলো, ফাঁকা বাড়িগুলোতে মানুষ থাকবে, থাক। কোথায় যাবে ওরা। মাটি ছাড়ার যন্ত্রণা তো ওদেরও আছে।
হীরেন্দ্রর দাদামণি জ্ঞান মজুমদার মাঝে মাঝে বাড়ি আসতেন। এখন বাড়ি বলতে হীরেনের বাড়ি, পশ্চিমের বাড়ি। অন্য বাড়িগুলোর নাম মুছে যাচ্ছে ক্রমে। দাদামণি হীরেনকে সাহস দিতেন, বোঝাতেন, বলতেন- ‘মনে শক্তি রাখ হীরেন, মাটিকে ভালোবাস, দেশকে ভালোবাস। দেখবি মাটি তোকে সুখ এনে দেবে। ছেলেদের সঠিক শিক্ষায় বড় করবি। তোর মতোই লোভহীন, দেশপ্রেমিক বানাবি। শিক্ষক হবার সহজ পাঠ দিবি। ওরা দেশের সেবা করলে, মানুষের সেবা করলে তুই শান্তি পাবি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তুই আমি বেঁচে থাকবো। সাহস রাখবি, সব সময় মাথা উঁচু করে বাঁচবি। কখনো ভয় পাবি না হীরেন’।
জ্ঞান মজুমদারও ময়মনসিংহে একা থাকতেন। তাঁরও ক্রমশ শরীর ভাঙছিল। শেষ দিকে আর রায়পুর যেতে পারতেন না। হীরেন দাদামণিকে দেখতে ময়মনসিংহে যেতেন। সন্তানদের ভালোবাসার টানে ১৯৬৮ সালে তাঁকেও দেশের মায়া ছেড়ে কলকাতায় চলে যেতে হলো। সেই যে গেলেন আর ফিরতে পারলেন না। হীরেন খবর পেলেন ১৯৭০ সালে ৩ অক্টোবর সেই দাদামণিও তাঁকে একা রেখে না ফেরার দেশে যাত্রা করেছেন। শেষবারের মতো দাদামণিকে আর দেখতে পারলেন না। মাটির টানে পড়ে থাকা হীরেনের শেষ আশ্রয়ও শেষ হলো। খোকাদার সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। তিনি পার্টির কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ভাবলেন কিছুই কেনো আগের মতো নেই, থাকেনা। সেই মামা বাড়ি, অজস্র আত্মীয় পরিজনে সমৃদ্ধ গ্রাম, গ্রামের বাজার, মানুষের ভিড়, ছাত্রদের ক্লাসরুম সব কেমন করে যে বদলে যায়। সমস্ত স্মৃতিটুকু রেখে সবাই কোথায় যে চলে যায়। কোনো হিসাব মিলাতে পারেন না হীরেন। ভেতরে কিছু একটা আটকে আসে, কান্নার মতো কিছু একটা গুমরে উঠে।
অতঃপর শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। জীবন বাঁচানোর জন্য এবারও খালি হচ্ছে গ্রাম। হীরেন্দ্র এখন বয়সের ভারে ক্লান্ত। এবারো তিনি কোথাও যাবেন না। বললেন- ‘বয়স হয়েছে, মরে গেলে এখানেই মরবো, তবু দেশ ছাড়বো না’। পাড়া প্রতিবেশীরা তাঁকে খুব ভরসা করে। কেউ কেউ বললেন- ‘ছোটোবাবু, এবার তো জীবন মরণের সমস্যা। কী করবেন। নিজের কথা না ভাবুন, ছেলের বউ, নাতি-নাতনিদের নিয়ে তো এভাবে থাকা ঠিক না। চলুন চলে যাই’।
হীরেনের ছোটো ছেলে বাবুল ছিল বড্ড বেপোরোয়া। অল্প বয়সেই রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছে সে। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে ছাত্রলীগে যোগ দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের জনসভায় যোগদান করে মিছিলে প্রথম সারিতে থাকে। চাইলেও ছেলেকে ফেরাতে পারেননি হীরেন। তাকে নিয়েই চিন্তা তাঁর। স্ত্রী অমিয় প্যারালাইসিসের রোগী। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ভাবলেন এই গ্রামে কে তাঁর ক্ষতি করবে। কোথাও যাবেন না তিনি। এর মধ্যেই চৌদ্দ বছর বয়সী ছোটো ছেলে বাবুল কাউকে কিছু না বলে লুকিয়ে যুদ্ধে চলে গেলো। আরোও ভেঙে পড়লেন হীরেন-অমিয় দম্পতি। আদরের ছেলেটাকে বুঝি আর ফিরে পাবে না কোনোদিন। এতো ছোটো একটা ছেলে যুদ্ধে গেছে, সে কী আর ফিরবে। এই দুর্ভাবনায় অমিয় দিনরাত কান্নাকাটি করতেন। তাঁর ছোট্ট খোকা বুঝি আর তার কোলে ফিরবে না। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই সাহসিকতার জন্য তাঁর ছোট্ট খোকাকেই ভয় পেতো সবাই। কোথাও কেউ মারা গেলে বাবুল সেখানে সবার আগে ছুটে যেতো। তার ভয়ে তখন কেউ কুমতলবে পা বাড়াতো না মজুমদার বাড়ির দিকে। বাবুল যুদ্ধে চলে যাবার পরই বাড়িতে লুটপাট শুরু হলো, পুড়িয়ে দেয়া হলো গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র, হীরেনের প্রিয় দাদামণির ছবিও ভস্ম হলো। যুদ্ধকালীন চারপাশের চেনা মানুষদের এমন অচেনা বীভৎস রূপ হীরেনকে যেন তুমুলভাবে কাঁপিয়ে দিলো। তাঁর মনে হলো- এদের সাথে থাকবেন বলেই একদিন সবাইকে ছেড়েছিলেন, এতো বছর অনেক সম্মানে মাথা উঁচু করে ওদের সাথেই আছেন; আর এরাই কিনা আজ…!কী করে পারলো ওরা! চেনা মাটিকে কেমন অচেনা ঠেকলো তাঁর। বারবার কানে বাজতে থাকে সোনাদার সেই কথাগুলো- ‘এ মুসলমানের দেশ হীরেন, কোথায় থাকবি তুই। কেউ তোকে সম্মান করবে না। চল ভাই চলে যাই’। এই একটিমাত্র কথাই হীরেনকে ভীষণভাবে ভাবালো- সেদিন কি তবে সে হিন্দুর দেশে না গিয়ে ভুল করেছিলেন? কিন্তু এ দেশ যে তাঁরও, তা কীকরে সবাই ভুলে গেলো।
এই ঘোরের ভেতরেই প্রতিবেশীদের সাথে নিয়ে, তাঁর আর বেণুর পরিবার নিয়ে পরদিন মাঝরাতে প্রিয় রায়পুর গ্রাম ছাড়লেন হীরেন। কোনোদিন যেতে না চাওয়া সেই পরদেশই আজ তার নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠলো। নিজের আজীবনের প্রতিজ্ঞার কাছে নাছোড়বান্দা এই মানুষটি আজ বড় অসহায় হয়ে গেল। যাবার সময় বাড়ির দায়িত্ব দিয়ে গেলেন প্রতিবেশী নয়ন মিয়ার হাতে। যাবার সময় চোখের জল ঢেলে দিয়ে বললেন- ‘যখন সম্মান নিয়ে যাবার ছিলো তখন গেলাম না নয়ন, আজ চোরের মতো মাঝরাতে চলে যাচ্ছি। শেষ বয়সী আমাকে ধরতে তোমাদের নৌকায় জায়গা হবে তো। বাড়িটাকে দেখো, আমি আবার ফিরে আসবো। তোমরা সাবধানে থেকো সব। আমি ফিরে আসবো নয়ন’।
যুদ্ধ তখন মধ্যভাগে। অমিয় ছোটো ছেলের জন্য এখনও দূর পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখের জল মুছে। মনের সঙ্গে শরীরও তার নুয়ে পড়তে থাকে। একদিন জীবনসঙ্গী হীরেনকে আরও শূন্যতায় ডুবিয়ে চোখ বন্ধ করেন অমিয়। যে অমিয় সারাজীবন হীরেনকে আগলে রেখেছেন, স্বামী ছাড়া আর অন্য কিছু বোঝেননি, স্বামীর কথাকেই বেদবাক্য ভেবেছেন, সেই অমিয় এখন শুধুই স্মৃতিমাত্র। ভাবতেই যেন হাজার নদী উথলে উঠে হীরেনের চোখে। এক জীবনে কত আর হারাবেন হীরেন, তাঁর শোকের নদী কত আর দীর্ঘ হবে। যে দেশের মাটি অমিয়কে কেড়ে নিয়েছে সে মাটিতে তাঁর মন টেকে না। জীবনের সব আলো আজ গিলে খাচ্ছে অন্ধকার। তবে এখনও যে আছে অমল, দিলীপ, মলয়, মৃদুল। আছে আদরের ভাতিজা বেণু। কয়েকটা নাতি-নাতনি। ওদের নিয়ে বাঁচার স্বপ্নে আবার বুক টান করে হীরেন। ভাবেন- ফিরে যাবেন, রায়পুরে ফিরে যাবেন। ওখানেই যে তাঁর সব।
একদিন যুদ্ধভূমিতেও শান্তির শ্বৈত পায়রা উড়তে লাগলো। স্বাধীন হলো দেশ। আকাশে উড়লো বিজয়ের ধ্বজা। হীরেনের বয়েসী বুকে বয়ে গেলো কংসের শীতল ঢেউ। এবার তার ফেরার অপেক্ষা জন্মভিটায়। নিজের মাটিতে। যেখানে সব অধিকার তার। মণিদা দ্বিজেন্দ্র বললেন- ‘আর কোথাও যাসনে হীরেন। এসেই যখন পড়েছিস বাকি জীবন এখানেই থেকে যা। ছেলেগুলোর ভবিষ্যত আছে। ওদের নিয়ে এখানেই থাক। আর কোথাও যাবার দরকার নেই। আমি আর ক’দিন। সবাই তো একে একে চলে গেলো। তুই আমার কাছে থেকে যা। আমরা তো ভাই, আপন ভাই। থেকে যা হীরেন’।
এবারও সহজ উত্তর তাঁর- ‘সব ঠিক হয়ে গেছে মণিদা, আর কিছু হবে না। এখানে তোমার ছেলেরা, ভাই আর অন্য ভাতিজারা আছে। ছেলেগুলো ছাড়া আমার কে আছে। তাছাড়া বাবুলটা আছে কিনা জানিনা, থাকলে হয়তো বাড়ি ফিরে আসবে; খুঁজবে আমাদের। ও একা কীভাবে থাকবে বলো। অমিয়ও চলে গেলো, আমি না হয় নিজের মাটিতেই মরবো। বেল গাছের ছায়ায় বাবা-মার পাশে শেষ আশ্রয় হবে, এর চেয়ে আর শান্তি কী বলো। কতো মানুষ শহীদ হয়ে দেশের মুক্তি এনে দিয়েছে। ওখানে মরার স্বাধীনতা আমার আছে। আমার ছোটো ছেলেটা যদি এতো ত্যাগ করতে পারে আমি কীসের মোহে এখানে থাকবো। আমাকে যেতেই হবে। তাছাড়া আমার তিন ছেলে বাংলাদেশে স্কুলে মাস্টারি করছে, এখানে আর ওদের নতুন করে কিছু করতে হবে না। আমরা চলে যাবো মণিদা। আমরা রায়পুরে চলে যাবো। এ দেশটাকে যে আমি নিজের ভাবতে পারিনা, আমার ছেলেরাও পারবে না। এখানে থাকবো কী করে বলো’। মণিদা বললেন- ‘আবার ভুল করছিস হীরেন, ও দেশ মুসলমানদের দেশ। ও দেশ হিন্দুর নয়। কিচ্ছু পাবিনা ওখানে। কেউ সম্মান করবে না। এখানে কতো সম্ভাবনা, আর তুই কিনা জীবনভর গ্রাম ছাড়া কিছু বুঝলিনা। জেদ করিস না, থেকে যা হীরেন’।
কিছুতেই কিছু হলো না। হীনের তাঁর সন্তানদের নিয়ে দেশমাতৃকার পথে পা বাড়লেন। পরদেশে রেখে গেলেন চিরসঙ্গিনী অমিয়কে। এই পথেই একদিন সবাইকে নিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন, এই পথেই আজ ফিরছেন, কেবল পাশে নেই তার অমিয়। একবার পেছন ফিরে তাকালেন, বুকের ভেতরটা চিরবিদায়ের বিচ্ছেদে মোচড় দিয়ে উঠলো হীরেনের, হু-হু করে কেঁদে উঠলো মনপাখিটা। চোখের পাতায় বৃষ্টি নামলো, কণ্ঠ ভারি হয়ে উঠলো। দীর্ঘ নিঃশ্বাস আর অমিয়ও স্মৃতিটুকু ছাড়া আজ সত্যিই কিছু কি আছে তাঁর, হয়তো আছে কিংবা নেই।
গ্রামে ফেরার পথে চেনাজনের কাছে খবর পেলেন তাঁর বাবুল যুদ্ধ জয় করে বীরবেশে বাড়িতে ফিরে এসেছে। আনন্দে আর গর্বে নেচে উঠলো হীরেনের বুক। শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো তাঁর। যে ছোট্ট খোকা মায়ের কোল ছেড়ে একদিন পালিয়েছিল নীরবে, সে আজ মাকে হারিয়ে মাকে ফিরে পেয়েছে। মুহূর্তে হীরেনের সব শোক সব না-পাওয়া শোকের পাখিটার মতো উড়ে গেল। তাঁর পুত্র আজ যুদ্ধজয়ী বীর, দেশমাতার অকুতোভয় সন্তান। ছোট্ট ছেলাটার মাঝে সেদিন প্রিয় দাদামণির ছায়া খুঁজে পেলেন হীরেন। মনে হলো, এই ছেলেই তাঁর দাদামণির যোগ্য উত্তরসূরি। আজ সে বুঝলো, এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি। হীরেন মনে মনে বলতে লাগলেন- ‘দাদামণি, দেশের মাটি আমাকে আজ শান্তি দিয়েছে, এই স্বাধীন বাংলাদেশ আমার, এ আমার দেশ, আমাদের দেশ’। নয়ন তাঁর বাড়িটা আগলে রেখেছে। বুকের খুব কাছে শুনলেন প্রিয় রায়পুর গ্রাম ডাকছে, তাঁকে হাতছানি দিচ্ছে প্রিয় মাটি, বাড়ির উঠোন, অমিয়র গড়া সংসার, বিশাল ছায়া দেয়া অমিয়র প্রিয় আম গাছ আর কংসের রুপোলি জলের ঢেউ। কতোদিন এই বিস্তীর্ণ স্নেহের পরশ নেই, পুকুর পাড়ের কদমগন্ধ নেই। পারলে যেন পাখির মতো উড়ে যান হীরেন। পথ যেন শেষ হয় না আর…।