সেই কবে কার কথা। মিয়া ভাই আমার হোটেলে আইসা কইত, ফজলু মিয়া আমাদের চারটা ডাল-ভাত খাওয়াও। তার সঙ্গে সব সময় মানুষ গিজগিজ করত। সে নিজে না খেয়ে মানুষরে খাওয়াইত। সবসময় নগদে খাইলিও মাঝে মাঝে টালি খাতায় লেইখা রাখতাম। মিয়া ভাই মাস ঘুরতে না ঘুরতেই বাকি টাকা নিয়ে হাজির। ফজলু মিয়া স্মৃতির অতলে গিয়ে টালি খাতা উল্টায় আর চোখের পানি ফেলে। আহা রে! মানুষটার মুখে কত যে আশার কথা শুনতাম; ভাষার কথা শুনতাম, দ্যাশের কথা শুনতাম, মুক্তির কথা শুনতাম। এমন মানুষটারে তোরা মাইরা ফেলাইলি! সত্তর পেরোনো ফজলু মিয়া তার ভাতের হোটেলের চরাটের ওপর বসে চোখের পানি ফেলে আর শেখ সাহেবের কথা ভাবে। দোকানে নতুন খরিদ্দার এলে গর্ব করে বলে- ও মিয়া, এই দুহানে শেখসাব খাইছে। আমি নিজ হাতে তারে কৈ মাছের ঝোল খাওয়াইছি। টালি খাতায় অহনো তার নাম লেহা আছে। আসপি, শেখসাব আবার আসপি। বিড়বিড় করে বলতে থাকে আর মনে মনে ভাবে, শেখসাব আসলে তারে কোন ছালুন দিয়া ভাত খাওয়াবে, কোথায় বসতে দেবে।
দিবা-নৈশ্য কলেজের শহর ক্যাম্পাসের পাশে ছোট্ট একটি ইটের সোলিং। পানির ট্যাংকের মোড় হয়ে সোজা চলে গেছে থানা মোড়, রাস্তার পাশ দিয়ে ফসলি জমি, খেলার মাঠ, পুকুর, আধাপাকা সব টিনের ঘর। এই সব বাড়িতে মেস করে থাকে দূর-দূরান্ত থেকে আগোত সব ছাত্র। পানির ট্যাংকের মোড়ে ফজলু মিয়ার ভাতের হোটেল। লোকমুখে শোনা যায়, বহু পুরনো এই হোটেল। একাত্তর সালে শহরে যখন মেলেটারি আসে, গোপন খবরের ভিত্তিতে তারা জানতে পারে, ফজলু মিয়ার হোটেলে মুক্তিযোদ্ধাদের মিটিং হয়। শহর থেকে বড় বড় নেতা আসে। এখান থেকেই দক্ষিণাঞ্চলের সব খবর বিলি হয়। দিনদুপুরে পাকবাহিনী হোটেলটা পুড়িয়ে দেয়। ফজলু তখন টকবগে জোয়ান, হোটেল হারিয়ে সে নিঃস্ব হয়ে যায়। অবশেষে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। দেশ স্বাধীন হলে আবার শুরু করে হোটেল ব্যবসা। দোকানে তার নতুন সাইনবোর্ড- ‘জয় বাংলা ভাত ঘর’। স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পার হয়েছে, ফজলু মিয়া এখন লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটে। পেশিগুলো ঝুলে গেছে। মাথার চুল সব ধবধবে সাদা। শরীরে রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে। হোটেলের ক্যাশ বাক্সের উপরে শেখ মুজিবের একখান ছবি। একটু অবসর পেলেই ফ্যালফ্যাল করে করুণ দৃষ্টিতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। আসপি, আমার দুহানে শেখসাব আবার আসপি। মুজিবভক্ত ফজলু মিয়ার চোখ দিয়ে শুধু নোনা জল ঝরে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। শহরে এখন নতুন ছাত্রদের আগমন। তাদের চোখেমুখে স্বপ্ন। নতুন খরিদ্দার পেলেই ফজলু মিয়া খুশিতে আটখানা হয়ে যায়। হোটেলের ভেতর থেকে ডাক ছাড়ে- আসেন, চারটা ভাত খাইয়া যান। ও মিয়া, এইটা যেনতেন হোটেল না, এইখানে মিয়া ভাই ভাত খাইছে, আমাগো মিয়া ভাই এই হোটেলে কত আইছে। আসপি, আবার আসপি শেখসাপ আবার আসপি। পুরনো ছাত্ররা এসব কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। নতুনরা কৌত‚হল ভরা চোখে ফিরে তাকায় ফজলু মিয়ার দিকে।
শীতের কোয়াশা চিরে বেরিয়ে আসে সকালের সোনা রোদ। পাভেল সকালের নাস্তার জন্য মুসলিম হলের আট নম্বর রুম থেকে বের হয়ে সোজা পানির ট্যাংকের মোড় চলে যায়। তার পরনে নীল রঙের ফুলপ্যান্ট এবং সাদা রংঙের ফুলহাতা শার্ট, ওপরে কালো রংঙের সোয়েটার। শালগাছের মতো সুঠম তার শরীর। চুলগুলো কদম ফুলের ঝুরির মতো মাথার সঙ্গে লেপ্টে আছে। আদোলটা অনেকটাই খোকার মতো। কল থেকে হাতমুখ ধুয়ে পাভেল যখন খাবার প্লেটে হাত দেবে, এমন সময় ফজলু মিয়া ক্যাশ টেবিল থেকে উঠে এসে তাকে জাপটে ধরে, তুমি ফিরা আইছো মিয়া ভাই, আমি জানতাম, তুমি আবার আসফা, তুমি মরতে পারো না।’ ফজলু মিয়া চিৎকার করে কেঁদে ওঠে।
౼ছাড়েন, কে আপনার মিয়া ভাই। পাগল নাকি?’
౼হ, আমি পাগল হইয়া গেছি। যে দিন তোমার মরণের খবর আমার কানে আইছে, সেদিন থিকা আমি পাগল হইয়া গেছি। যখন শুনলাম, ঘাতকের বুলেটের আঘাতে তোমার বুকের রক্ত এই জমিনে পড়ছে, সেই দিন থিকা আমি খালি পায়ে হাঁটি। দেখো মিয়া ভাই, একবার আমার পায়ের দিকে চাইয়া দেখো। তোমার ভাবিরে যখন বউ সাজাইয়া ঘরে আনলাম, বরযাত্রায়ও আমি খালি পায়ে গেছিলাম, শ্বশুরবাড়ি মানুষ তাই নিয়া কত হাসিঠাট্টা করছে। ওই আমানত, মিয়া ভাইরে সব খুইলা ক না।’
౼‘আহ্! আমি আপনার মিয়া ভাই নই। আমি পাভেল। বাড়ি লোহাগাড়া থানায়।’
౼‘লোহাগাড়া, কালনাঘাট, নড়াইল, কত যুদ্ধ হইছে ওইখানে। পাকবাহিনীর কত বড় বড় বাঙ্কার, চারপাশ দিয়া আমরা ঘেরাও করলাম। কত রক্ত, লাল লাল রক্ত, মধুমতি নদীর পানি লাল হইয়া গেল! ওই নদীর বাঁক ধইরা আগাইলে টুঙ্গিপাড়া গ্রাম, আমার মিয়া ভাইর বাড়ি, মিয়া ভাই আইছে ওে, মিয়া ভাই আইছে।’ এক দৌড়ে সে দোকান থেকে রাজপথে নেমে আসে। ফজলু মিয়ার চিৎকারে পথচারীরা দোকানের মধ্যে ভিড় করে, সবাই অবাক হয়ে পাভেলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
౼‘লোকটা পাগল নাকি?’
౼‘না, উনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। পাগল না। যুদ্ধের সময় পরিবার-পরিজন সবাইকে হারাইছে। মিয়া ভাই ছাড়া ওনার দইনাতে কেউ নাই।’
౼‘এই মিয়া ভাইটা কে? ওনার বড় ভাই?’
౼‘মিয়া ভাই কে, তা আপনি জানেন না, আমি হোটেলের বাবুর্চি হইয়া কইতে পারি, মিয়া ভাই কে, খোকা কে। আপনি জানেন না! মিয়া ভাই কে জানতে চান?
౼‘জি বলুন।’
আমানত পাভেলের হাত ধরে ক্যাশ টেবিলের সামনে নিয়ে যায়, তারপর বঙ্গবন্ধুর ছবির দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে౼‘উনি হলেন মিয়া ভাই, এইবার চিনতে পারছেন। পাভেল কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে।’
౼‘ফজলুকা কয় বঙ্গবন্ধু নাকি ওনার দুহানের খরিদ্দার আছিল। মাঝে মাঝে দল ধইরা তার দোহানে ভর্তাভাত খাইতে আসত। টালি খাতায় নাকি অহনও তাঁর নাম লেহা আছে। আপনার চেহারাডা অনেকটা মিয়া ভাইর মতো, তাই ফজলু মিয়া খুশিতে চিল্লায়তাছে, ওই দেহেন, কী রহম ফালাইতাছে। আহারে! মানুষটার পৃথিবীতে কেউ নাই।’
পাভেল নিজেকে আড়াল করতে চায়, তীব্র অপরাধ বোধ মনের মধ্যে দানা বাঁধতে থাকে। মিয়া ভাইকে আমি এখনও জানি না। সে সোজা ক্যাম্পাসের দিকে রওনা দেয়, ক্লাস শেষ করে সোজা কলেজ লাইব্রেরির বঙ্গবন্ধু কর্ণার। একে একে সে পাঠ করে- বঙ্গবন্ধু সহজপাঠ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ, সাতই মার্চ এবং বঙ্গবন্ধু, জনকের মুখ, বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী এবং শেখ মুজিবকে নিবেদিত সব বিখ্যাত বই। একটানা কয়েক মাস ধরে সমস্ত বইগুলো পাঠ করে পাভেল দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমে বলীয়ান হয়ে এ প্রজন্মের একজন খোকা হয়ে ওঠে। তার মনোজগতে মুজিববাদ দানাবাঁধতে থাকে। ক্রমেই দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি তার দৃষ্টি ভঙ্গি পরিবর্তন হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং চেতনা কে ধারণ করে পাভেল মনে প্রাণে একজন খাঁটি বাঙালি হওয়ার স্বপ্ন দেখে। ফজলু মিয়ার জন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় নত হয় তার শির। প্রায়ই সে হোটেলে যায়, ফজলু মিয়াও তার অপেক্ষায় বসে থাকে।
অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। পাভেল রাজধানীতে যাবে। ক’দিন ধরে ফজলু মিয়ার দোকান বন্ধ। কেউ তাঁর খোঁজ দিতে পারে না। বাবুর্চি আমানতকেও পাওয়া যায় না। পাভেল একটি চিরকুট লিখে পাশের পান দোকানে রেখে তার দায়িত্বের ইতি টানে, তারপর পা বাড়ায় ঢাকার উদ্দেশ্যে। বাস চলছে আর পেছনে পড়ছে ছয় বছরের চেনা শহরের রাস্তা, নদী, বৃক্ষ আর চোখে ভাসছে ফজলু মিয়ার মুখ, মনে মনে সে ভাবে, কোথায় গেল পাগল মানুষটা।
সময় চলে যায় সময়ের ঘোরে, ফজলু মিয়া শেখ সাবের অপেক্ষায় বসে থাকে। ফজরের নামাজ পড়ে রাস্তা ঝাড়– দেয়। ছানিপড়া চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে পথের দিকে। লাল রঙের টালি খাতাটা চোখের জলে ভেজে। বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘আসপি, চাকরি পাইলে ঠিকই আসপি। এক দানে সব মিটায় দিবি। কত বড় মানুষ, কত বড় মানুষ, কত বড় বুকির পাটা।’ এইভাবে কেটে যায় কিছুদিন। ফজলু মিয়া বার্ধক্যজনিত জটিল সব রোগে আক্রান্ত। কোনো ডাক্তার তার রোগ ধরতে পারছে না। দিন-রাত শুধু মিয়া ভাই, মিয়া ভাই। আমানতকে ডেকে ডাক্তার বলে, ‘ওনার মিয়া ভাইটাকে আসতে বল, তাহলে চিকিৎসা করতে সহজ হবে। উনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন।’
আমানত বলে, ‘সে তো পড়া শ্যাষ কইরা ঢাকা চইলা গেছে তিন বছর হইলো। প্রথম প্রথম দুই- একখান চিঠি আসতো; এখন তা-ও বন্ধ হইয়া গেছে। চিঠি পাঠাইলে তার উত্তর আসে না। কোথায় থাকে, কী করে তা আমরা কেউ জানি না, স্যার।
ফজলু মিয়া মৃত্যুর প্রহর গুনছে। ডাক্তাররা তার বাঁচার আসা ছেড়ে দিয়েছে। তবু মনে তার তীব্র বিশ্বাস, তাকে দেখতে মিয়া ভাই ঠিকই আসবে। সময় গড়িয়ে যায়, তার শরীরের অবস্থা চরম সংকটে। সারা রাত চোখের পলক পড়ে না। ফজরের আজান চলছে। পাশের বাড়ির মহিলারা ঘরের ভেতর পরনের কাপড় দিয়ে পর্দা বানিয়ে হারিকেনের আলোয় কোরআন শরিফ আর কালেমার খতম পড়ছে। আমানতের চোখে জল, সে শুধু পায়চারি করে। হঠাৎ নৈঃশব্দ ভেঙে একটি গাড়ির শব্দ। সাদা পাজামা, পাঞ্জাবি পরা বিশাল এক দেবদূত আস্তে আস্তে ফজলু মিয়ার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। মুহূর্তে সুঘ্রাণে ভরে ওঠে ঘর। এমন তীব্র আলোর দেহ, তার দিকে চোখ তুলে তাকানো যায় না। তার মিষ্টি চাহনিতে সবাই ভরসা পায়; কিন্তু কী যেন এক মায়ার খেলায় কিছুক্ষণের জন্য সবাই বোবা হয়ে যায়। আলোর শরীর আস্তে আস্তে ফজলু মিয়া কাছে গিয়ে বসে, দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বালিসের পাশ থেকে লালশালু টালি খাতাটা হাতে নিয়ে মনে মনে হিসাব কষতে থাকে এবং পকেট থেকে পাঁচশত টাকার একটি চকককে বান্ডিল বালিশের পাশে রেখে টালি খাতা হাতে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। গাড়ি চলে যায় আপন গন্তব্যে। ঘরের সবাই ফিস্ ফিস্ করে বলতে থাকে౼‘উনি কে, এ আমরা কারে দেখলাম। পাভেল ভাইজান, না অন্য কেউ?’
ফজলু মিয়ার ঘুম আর ভাঙে না। আমানত চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। হঠাৎ তার চোখ পড়ে টাকার বাণ্ডিল উপর, দেখে চকচকে পাঁচ’শ টাকার নোটের ওপর মিয়া ভাইয়ের ছবি।
মাহফুজ রিপন– জন্ম তারিখ : ৩১ ডিসেম্বর ১৯৮৩। প্রকাশিত গ্রন্থ : বিসর্জনের নিশিকাব্য, জলকাদার ঘ্রাণ, করমজলের নাইয়া, মাইদ্যানের দুঃখ, সাঁইকাব্য (সংকলন), মাড়ভাতের গল্প ইত্যাদি।
গল্পটি অনেক সুন্দর। পাঠ করে অনেক মজা পেয়েছি।