শহরে আবার লকডাউন চলছে। এই কয়দিন ঘরের দরজা খুলেও দেখিনি, রাতের খাবার শেষ করে কেন জানি খুব বের হতে মন চাইলো ভাবলাম দু’পা এগিয়ে সামনের মোড় থেকে একটা ঢুঁ মেরে আসি,জানি এত রাতে কেউ নেই। কিন্তু কোথায় কি… হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর এগিয়ে এলাম,রাস্তার দুপাশে কেবল মানুষ আর মানুষ!
কোথাও কোনো শব্দ নেই,দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে কিনা,মুখে মাস্ক,হাতে গ্লাভস আছে কিনা কিচ্ছুই দেখতে পেলাম না। কেননা স্ট্রীট লাইটগুলো নেই, বেশ খানিকটা এগোনোর পর, রাস্তার ধারে জ্বলতে দেখলাম অন্ধকার। একটা লোক, একা একাই রাস্তার ধারে উবু হয়ে শুয়ে,মনে হলো মুখের ওপর একটা নীল আলো জ্বলছে নিভছে। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম সেই অবয়ব, তবে মুখটা অন্ধকারে ভাল বোঝা গেল না। এ শহরে আমি জোনাকি দেখিনি কোনোদিন আজ নীল যেটা জ্বলছে নিভছে সেটা কি তবে জোনাকি না অন্যকিছু তাও বুঝলাম না। সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, ভাই মুখে কী? একটু এগিয়ে গিয়ে অনুমানে তিনফুট মত দূরত্ব বাজায় রেখে বললাম,কি হল? এখানে শুয়ে আছেন কেন? আমি যেমন দেখতে পারছি না মুখটা, লোকটাও হয়ত আমাকে তেমনই দেখছে,আগের বার মনে হয়ে ছিলো সে ফিরে তাকিয়েছিলো এখন মনে হলো ফিরেও দেখেনি।
অস্বস্তি লাগল লোকটার এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখে। যেন আমি ওখানে থেকেও নেই। ও কিছু শুনতেই পাচ্ছে না। ভাবলাম… হয়ত আমার ভাষা বোঝে না, কিংবা… এই নির্জন জায়গায় ঠিক ভরসা পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ চুপ করে দেখলাম, কোনও পরিবর্তন হ’ল না। ওই একই ভাবে উবু হয়ে শুয়ে আছে। হঠাৎ এমন একটা ধাক্কা খেলাম… ছিটকে পড়েছি,কি হলো বুঝতে পারলাম না। লোকটার মুখ দেখতে পাইনি…তবে দৌড়টা স্পষ্ট দেখলাম। হার্টবিটের মতন এলোপাথারি পা ফেলে অন্ধকারে হারিয়ে গেল লোকটি।লোকটা এতক্ষণ যেখানে শুয়েছিল,খেয়াল করলাম আমি লোকটার জায়গায় শুয়ে আছি। হাত পায়ের কোথাও কোথাও হয়ত ঘসা লেগেছে মরিচের মত জ্বলছে কিংবা একটু আগে দেখা নীল আলোটার মতন।
হঠাৎ পাশ থেকে কেউ গম্ভীর গলায় বলে উঠল এখানে শুয়ে আছেন কেন? চমকে উঠে দেখলাম, পাশে একটা লম্বা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পুরোনো ঘরের মতো গোমট গন্ধ,অপলক তাকিয়ে রইলাম, কী বলব বুঝতে পারলাম না। লোকটা হাত বাড়ালো। কিন্তু মুখ দেখতে পারছি না। লোকটা বিড়বিড় করে কিসব বলতে শুরু করল। কিছুই বুঝতে পারছি না। মনে হলো গালাগালি করছে। তারপর বলল, “আপনিও তো কোনও কথা বলছেন না এবার কি আপনিও দৌড় লাগাবেন নাকি?” কথাটা শুনে চমকে গেলাম,মনে হ’ল এতক্ষণ কাছাকাছিই ছিল লোকটা, সব কিছু লক্ষ্য করছিল… অথচ খেয়ালই করিনি!দিনের সব কোলাহলেই কি তবে রাতের অন্ধকারে থেকে যায়? চমকে গেছি, ঘাবড়ে গেছি… হয়ত ভয়ও পেয়েছি। কিন্তু বুঝতে দিলাম না… গম্ভীরভাবেই জিজ্ঞেস করলাম আপনি বাড়ির বাইরে কেন? আমার কুঁচকে থাকা ভুরু নিয়ে আপাত বিরক্তিটা লোকটা বোধহয় দেখতে পেল না। একই রকম গম্ভীর গলায় বলল কী আবার? ওই যে রাতের খাবার শেষ করে মনে হলো বারটা দিন ঘরবন্ধী যাই একটু মোড় থেকে ঘুরে আসি,এত রাতে রাস্তায় নিশ্চয় কেউ নেই,ঘুটঘুটে অন্ধকার নিস্তব্ধ শহর,রাস্তায় মানুষ আর মানুষ অথচ কোথাও কোনো শব্দ নেই এমনকি শ্বাসের শব্দও পাচ্ছি না নিজেরটা ছাড়া, আমিও তো ওই আর একটু দেখি সামনে,আর একটু দেখি করতে করতে অ্যাদ্দুর এলাম দেখেই চলেছি, দেখেই চলেছি… হেঁটেই চলেছি, হেঁটেই চলেছি। তারপর দেখলাম এখানে গলা শোনা যাচ্ছে।
উঠে দাঁড়ালাম, লোকটার মুখটা দেখতে চাইলাম কিন্তু আদতে কিছুই দেখতে পেলাম না অন্ধকার ছাড়া। হাঁটতে লাগলাম,রাস্তায়… যেন আমি একাই আছি। দু’টো অ্যাম্বুলেন্স চলে গেল শোঁ শোঁ করে। খানিকটা এগোতেইে একটা পুলিশ ভ্যান আমার সামনে এসে দাঁড়ালো, একজন নেমে এসে সামনে দাঁড়ালো, কী ব্যাপার লক ডাউন চলছে জানেন না? এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন, আপনাদের কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই না? উত্তরটা দিতেই যাবো গাড়ির ভেতর থেকে ভেসে এলো স্যার চলুন,হাসপাতাল ভাঙচুর শুরু হয়েছে। আমার কথা না শুনেই পুলিশটি গাড়িতে উঠে বসলো, গাড়ি স্টার্ট নিয়ে নিয়েছে, বাতাসে উড়ে এলো টুকরো টুকরো কিছু শব্দ-যান, যান বাড়ি যান শহরটাকে বাঁচান।
-কত দূর যাবেন?
-ওই… যতদূর যাওয়া যায়।
-ফিরতে হবে যে!
-ফেরা?
‘ফেরা’ শব্দ টা বলেই ছায়াটি বিটকেল একটা হাসি দিলো। আমি একেবারেই হাসলাম না। হাঁটাও থামালাম না। লোকটা কেমন অদ্ভুতভাবে আমার সঙ্গে পা মিলিয়ে এগোচ্ছে। একেবারে আমার সঙ্গে,… না একটু পিছিয়ে, না সামান্য এগিয়ে। অথচ, এখনও ওর মুখটা ভাল করে দেখা হ’ল না। সংশয় থাকা উচিৎ, সন্দেহ থাকা উচিৎ… ভয় পাওয়ার কথা। কিন্তু এসব কিছুই হচ্ছে না আমার। কেমন একটা বিরক্তি, এই রাতের অন্ধকারের মতই গায়ে লেপ্টে রয়েছে। যে ক’টা দোকান এই রাস্তায় পড়ে, সবই বন্ধ। বন্ধ থাকাই স্বাভাবিক রাত প্রায় একটা বাজে।
“রাত কত হ’ল?”, প্রতিটা শব্দ খুব টেনে টেনে বলল লোকটা, কেমন যেন ফিসফিস করে। একই রকম বিরক্তি নিয়ে বললাম, “একটা বেজে গেছে”। ততক্ষণে বুঝে গেছি, এ পিছু নেওয়া ছাড়বে না। থেমে পড়লাম সেখানেই। কোনও মানে নেই এই ভাবে হেঁটে চলার। কোথায় চলে এলাম হাঁটতে হাঁটতে, তা-ই বুঝতে পারছি না। কুকুর ডাকছে, লরি আর ট্রাকের আলোয় দেখছি, দল বেঁধে থাকা কুকুর। আর ফুলশার্টের ছায়া। দাঁড়াতেই ঠাণ্ডা হাওয়ায় গা’টা আবার শিরশির করে উঠল।
লোকটাও থেমে গেল। “থেমে গেলেন যে?” এই প্রথম ওর গলায় যেন একটা বিরক্তির আভাস পেলাম।
-“এদিকে আর কিছু নেই।
-“তাহলে?
-“তাহলে আবার কী!
-“এতদূর এলাম কেন?
-“আপনাকে কে আসতে বলেছে? আপনিই তো পিছু নিয়েছেন তখন থেকে!
-“কখন থেকে?
অস্বস্তিটা চরমে চলে গেল। কেমন ছায়ার মত হয়ে গেছে লোকটা, কিংবা রাতের মত… ছাড়ছেই না! ইচ্ছে করছে ঘা কতক লাগিয়ে দিই এখনই, গা ঘিন ঘিনে লোকটাকে অন্ধকারেই থেঁতলে দিই। মাথার ভেতর শিরশির করছিল। রক্তস্রোত। বোধহয় একদম চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম।
“খুব গা জ্বলছে! কিন্তু কেন বলুন তো?” আমি চুপ করে রইলাম। চেষ্টা করেও অন্ধকারে লোকটার মুখটা দেখতে পাচ্ছি না। চড়টা মারব কি মারব না ভাবছি। এত রাগ যে কেন হচ্ছে, তাও বুঝতে পারছি না। “আমার সব কিছুই এরকম!”, সামনে থেকে আবার বাঁ পাশে সরে গেল লোকটা। কিছুতেই মুখোমুখি দাঁড়াবে না।
-আশ্চর্য।
-হ্যাঁ… কি আশ্চর্য বলুন দেখি! এই যে চারপাশে এতকিছু ঘটছে এটা সেটা। সব কিছুর পেছনেই একটা কারণ আছে। যেন ওটা সেই ঘটনার ভাষা। আর তার মধ্যেও কেমন আমরা নিজেদের খুঁজে পাই!সেই খোঁজটাই আমরা।
-“এমন দর্শন দেখতেই রাতদুপুরে চড়ে বেড়ান নাকি?
-“যা বলেছেন শালা! চারিদিকে দর্শন! আর রাত হলে সব কিছু কেমন স্পষ্ট হয়ে যায়।
ততক্ষণে আবার ফিরতি পথে হাঁটা শুরু হয়েছে। কেন যে গেলাম, কেন যে আছি রাস্তায় এত রাতে। সিগারেট এর ইচ্ছেটাও আর ফাঁকি দিচ্ছে না। লোকটাকে কাটানোর জন্য সোজা বলে দিলাম, “সিগারেট পাওয়ার আর চান্স নেই। আমি চললাম।” লোকটা হ্যাঁ, না, আচ্ছা… কিছুই বলল না। আমার সঙ্গেই এগোতে লাগল। যেদিকে আমি যাচ্ছি। কুমতলব কিছু থাকলে এতক্ষণে কাজ হাসিল করেই নিতে পারত। অন্ধকারে অন্য শাগরেদরা থাকলে তাদেরও এতক্ষণ লাগার কথা নয়। ওর হাতে কিছু নেই,এবারে রীতিমত রুখে দাঁড়িয়ে বললাম, “আমার কাছে কিন্তু কিছুই নেই… ঘড়ি পরি না, মোবাইলটা বেশ পুরনো, বেচে দাম উঠবে না আর পার্সে তেমন কিছুই নেই। সুতরাং ফালতু সময় নষ্ট করে লাভ নেই!
লোকটা দার্শনিকের মতো হাসলো,পার্সেও মালকড়ি নেই?… “তা… পার্সটা আছে তো?!
ওর কথাগুলো শুনে কেমন লাগল। পার্সটা পকেটে আছে কি না দেখতে গিয়ে দেখলাম পকেট খালি! যে পকেটে মোবাইল ছিল সেটাও খালি। দেশলাই বাক্সটাই নেই। গেল কোথায় সব! কোথায় পড়ল? কে নিলো?!
এতক্ষণে কেমন একটা ভয় করতে শুরু করল। এর নাগাল থেকে বেরনো যেন একটা রাতের লড়াই! বেরোতেই হবে এর নাগালের বাইরে। কিন্তু পালানো যাবে না। পালানো যাচ্ছে না। একদম ছায়ার মত লেগে আছে। কতরকম তো শোনা যায়। মানসিক ভারসাম্যহীন অপরাধী। রাতে বেরিয়ে কারণ ছাড়াই খুন করে বেরায়। তাদের কেউ নয় তো? এরকমই অসংলগ্ন কথা বলতে বলতে হয়ত… গা-টা শিরশির করে উঠল। রগ বেয়ে ঠাণ্ডা ঘাম গড়াচ্ছে। হয়ত এই বেড়াল-ইঁদুরের খেলাটাই খেলবে। আমি যেই দৌড়টা শুরু করব, পেছন পেছন ধাওয়া করে এসে এক রডের ঘা! নাহ্… ওর হাতে সেসব তো কিছু নেই। রড নয়… তাহ’লে পকেটেই কিছু থাকবে। শিকার করার মত নিশানা করে মারবে… তাড়া করে মারবে পেছন থেকে!
লোকটা হাসতে হাসতে হঠাৎ থামল। এই প্রথম আমার থেকে দূরে এগিয়ে গেল খানিকটা, তারপর পেছনে ফিরে বলল “কখনও চোখের সামনে কাউকে মরতে দেখেছেন?” আমি পুরো বোবা হয়ে গেলাম। এ নির্ঘাৎ সাইকো কেস্! এবার সাংঘাতিক কিছু একটা করবে। এর জন্যেই এতক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছিল। এবার মোক্ষম সময় উপস্থিত। আমার শরীরের সমস্ত পেশি সজাগ করে রাখার চেষ্টা করলাম, যাতে মোকাবিলাটা অন্ততঃ করতে পারি… আত্মরক্ষার চেষ্টা। আর চোখে ওই অন্ধকারেই খুঁজতে লাগলাম… কাছাকাছি টপকে আড়াল হওয়ার মত পাঁচিল, সাহায্যের চিৎকার পৌঁছে দেওয়ার মত দরজা, ভারি পাথর কিংবা ইট। লোকটা সেই মিহি গলাতেই আবার জিজ্ঞেস করল, “কী? দেখেছেন?… কাউকে মরতে?” আমি চুপচাপ মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলাম না। লোকটা থেমে থেমে বলতে লাগল-
“আমি দেখেছি বুঝলেন। আমি না… দেখেছি। মানে… এই কয়েকমাসে। এক আধবার নয়… মাঝে মাঝেই। জলজ্যান্ত লোকগুলো একদম মরে যায়। আর মরা লোকগুলো হেঁটেচলে বেড়ায়, কথাবলে, গপ্পো করে, বসে থাকে… যেন কিছুই হয় নি! ওই যে… ওই যে আপনি বললেন না… আমার কিচ্ছু নেই। তাদেরও কারও কিচ্ছু নেই। একবার মরে গেলে আর কিছুই থাকে না। থেকেও থাকে না।
ভূত-টুত কোনওদিন মানি না। মনে হ’ল লোকটা স্রেফ মাইন্ড গেম শুরু করেছে এবার আমার সঙ্গে। যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত করে বললাম, “তো এখন দাবীটা কী? এখানে কেউ মারা গেছে… নাকি মরবে?
-“সে কী আর কেউ বলতে পারে?… কত খুন… কত মৃত্যু… কখন… কোথায়… কীভাবে?
-“বলতে পারে না যখন… ভেবে কী হবে?
-“ভেবে কী হবে?… তা তো জানি না! ভাবি কি?… কোথায় ভাবলাম? হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে?
-“যে?
-“এই কিছুদিন আগে। একটা ছেলে চুপচাপ বসেছিল। ওই ভাবে বসে থাকা দেখেই বুঝতে পারলাম বেঁচে নেই। জানতে পারলাম, বান্ধবী ঠগিয়েছে ব্যস্… ওই দেখেই! পরে খবরের কাগজে দেখলাম ছেলেটা বোম্বের নায়ক!
-“ওই জন্য ছেলেটা সুইসাইড করে নিলো? বাহ্!
-“না না… সুইসাইড্ তো নয়… রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছিলো আমার মুক্তি…। কিন্তু বুঝতে পারলাম। বেঁচে নেই।
-“রাবিশ!”
-“অ্যাঁ? রাআআআবিইইশ?… ওই ঘষে ঘষে যাওয়া ট্রাকগুলো, হুশ করে চলে যাওয়া প্রাইভেট কার, ঝনাৎ করে বুকে বসে ছলাৎ করে রক্ত টেনে নেওয়া ছোরা,জীবন থেকে হেরে সুইসাইড বা আলটপকা ছুটে যাওয়া ওয়ানশটার… এর বাইরেও মৃত্যু হয়।
-“হতেই পারে
-“কত মরে যাওয়া লোক… ছেঁড়া চটি, খালি বুক পকেট, কপালে চারটে ভাঁজ, আর কত কিছু নিয়ে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে।
-“আপনার দাবী টা কী… আপনি মরে যাওয়া লোকদের আশে পাশে ঘুরে বেড়াতে দেখেন?
-“কেন? আপনি দেখেন না?… এই যে আমাদের আশেপাশে কত লোক… সবাই কি বেঁচে আছে… উঁহু। ওই তো দেখুন কত লোক… আসছে, যাচ্ছে, দাঁড়িয়ে-বসে… দেখতে পাচ্ছেন না?
ওর কথার প্রতিক্রিয়াতেই চারিদিকে তাকালাম, বলার কথা ‘কোথায় কি!… ফাঁকা রাস্তা!’। কিন্তু সে আর বলা হ’ল না। গভীর রাতের সুনসান রাস্তায় হঠাৎই দেখলাম কোথা থেকে লোকজন এসে গেছে চারিদিকে! সকালের ব্যস্ত রাস্তার মত… লোকজন হাঁটছে, কথা বলছে…অপেক্ষা করছে। অথচ এতক্ষণ শুধু আমরা দু’জনই ছিলাম… আর কেউ ছিল না, কেউ না!
মুখ থেকে অস্ফুটে বেড়িয়ে এলো হাউ ক্যান দিস বি পসিব্ল… স্ট্রেঞ্জ!… এতরাতে… এতক্ষণ
“রাত কোথায় স্যার… ভোর রাত বলুন, ভোর রাত।” বলে আবার খ্যাস খ্যাস করে হাসতে লাগল লোকটা।
সব কিছু দেখতে দেখতে কেমন ঘোর লেগে গেল। এরা কারা? এতক্ষণ কোথায় ছিল? সারা রাত তো এদের দেখিনি… তাহ’লে এখনই বা দেখতে পাচ্ছি কেন? অস্বাভাবিক… ভীষণ অস্বাভাবিক… কিন্তু ভয় করছে না কেন এখন আর? সিনেমার দৃশ্যের মত চারপাশের ওই লোকগুলোকে দেখছিলাম… সবাই আছে, অথচ থেকেও নেই। যে অপেক্ষা করে, তার অপেক্ষা শেষ হয় না। যে হেঁটে চলে তার হাঁটা থামে না। যে কথা বলা, তার কথার শেষ নেই।
অনেকক্ষণ এই ভাবে তাকিয়ে দেখতে দেখতে পাশের লোকটার কথা বেমালুম ভুলেই গেলাম! সামনের আকাশে আসতে আসতে আলো ফুটছে। কুয়াশা নামছে গাছেদের গা বেয়ে। সেই ভিড়ও দেখলাম কুয়াশার মাঝে পাতলা হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। একটা দু’টো করে মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে… ভিড় সরে আবার নেমে আসছে শূন্যতা।
“থাকে না… দিনের আলো ফুটে এলে আর থাকে না।”, মিহি গলার আওয়াজটা শুনে আবার লোকটার কথা মনে পড়ে গেল। যেদিক থেকে আওয়াজটা এলো, সেদিকে তাকালাম। সেই লম্বা ছায়া… এখনও মুখটা বোঝা যাচ্ছে না। হ্যাঁ… এখন আলো ফুটে গেছে, তাও বোঝা যাচ্ছে না। শুধু একটা লম্বা ছায়া… তার বাতাসে ওড়া ফুল-শার্টও ছায়া… মুখও। আস্তে আস্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। মিলিয়ে যেতে যেতে মিহি গলায় বলল, “আসলে সবটাই অভ্যেস। যা করা হয়েছে… দিনের পর দিন… বছরের পর বছর, অভ্যেসগুলো থেকেই যায়। অভ্যেসগুলোই ছায়া, অভ্যেসগুলোই অস্তিত্ব। কী বেঁচে থাকা… আর কী মরে যাওয়া! সবই দর্শন!
“সবই দর্শন!”… “সবই দর্শন!”… “সবই দর্শন!
কথাগুলো যেন প্রতিধ্বনির মত বাজছিল কানে। একটা আস্ত রাত কী ভাবে হুস করে শেষ হয়ে গেল… বুঝতেই পারলাম না।
পকেট, দেশলাই, সিগারেট, পথ; সবটাই অভ্যেস। ভোরের আলোয় খেয়াল করলাম, আমিও আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে যাচ্ছি। পকার দোকান খুলে গেছে, সকালের প্রথম চা ও সিগারেটের জন্য বেশ ভিড় ওর দোকানে, ভিড় ঠেলতে ইচ্ছে করলো না, রাস্তায় দাঁড়ালাম, যেখানে দাঁড়িয়েছি সেখান থেকে আমার বাড়ি স্পষ্ট দেখা যায়,হঠাৎ খেয়াল করলাম বাড়ির বাইরে এম্বুলেন্স,পুলিশ,ব্যালকনি, জানালা থেকে ঝুলছে প্রতিবেশির মুখোশে ঢাকা মুখ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কানে এলো পকা যেন কাকে বলছে-জ্বল জ্যান্ত ছেলে লকডাউন শুরুর কয়দিন আগে সিগারেট নিয়ে গেলো,বললো লকডাউন উঠলে ভোরে চা খেতে আসবে, দেখো আজ লকডাউন শেষে দোকান খুললাম ছেলেটা গতরাতেই করোনায় মরে গেলো!