দুই জনের হাতে দু’কাপ সস্তা চা, রঙ চা বা লাল চা, যে যেটা বলেন। অনেকদিন পর দেখা হলো, সেই ২৮ তারিখ অর্থাৎ বইমেলার শেষক্ষণে দেখা হয়েছিলো, কথা হয়েছিলো। বইমেলার একদম শেষ পর্যন্ত ছিলাম আমরা, বইমেলায় রাত ন’টায় লাইট অফ হয়ে যাবার পরও আমরা অ-নে-ক ক্ষণ ছিলাম। সেইদিন অন্ধকারে চলে আসার পর আজও অব্দি আর ওই উদ্যানে যায়নি, বইমেলা ছাড়া ওটাকে আমার ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়।
শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে গল্প করলাম, কতোগুলো মেয়ে আসলো, সবার হাতে প্লেকার্ড। ওখানে বিভিন্ন লেখা। “শক্তি” নামে একটা সংগঠন ধর্ষণ বিরোধী মানববন্ধনের আয়োজন করেছে। আমরা দু’জন ওখানে দাঁড়িয়ে সাম্প্রতিককালে মহামারী আকারে বেড়ে যাওয়া ধর্ষণ নিয়ে কথা বলছি, ঘুরে ফিরে আমি কবিতায় চলে আসলাম।
সাম্প্রতিক সময়ে কবিতায় বাঙলাদেশের অবস্থান নিয়ে কথা বলছি। কথা বলতে বলতে গণগ্রন্থাগারের ভিতরে ঢুকে পড়লাম, হাঁটতে হাঁটতে শওকত ওসমান মিলনায়তনের সামনে চলে গেলাম, এখানে প্রায় দিনই কোনো না কোনো প্রোগ্রাম লেগে থাকে, আজ দরোজা বন্ধ। মানে কোনো প্রোগ্রাম নেই।
দেয়ালে হেলান দিয়ে কথা বলছি। আশেপাশে আরো অনেক লোক, সবাই আড্ডায় ব্যস্ত। পাশে কারা যেনো ফুলের তোড়া নিয়ে এসেছে। একটা ছেলে বসে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। ওদিকটায় আমার তেমন নজর নেই, কারণ এখানে পবিত্র কবিতার কথা চলছে। কবিতায় ডুবে আছি আমরা দু’জন।
মুহূর্তকালেই আকাশ কালো হয়ে এলো। খর-রৌদ্রের বৈশাখ হলেও গত ক’দিন ধরে ঢাকায় টানা ঝড়-বাতাস ও বৃষ্টি চলছে। বলতে না বলতেই ধূলাবালি উড়িয়ে গাছের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বাতাস এসে গেলো আমাদের চোখেমুখে।
সবার মতো দৌঁড়ায় গিয়ে আমরা দু’জন শওকত ওসমানের ছবির কাছে অবস্থান নিলাম। জোরেশোরে বৃষ্টি এসে গেলো, বৃষ্টির ফোটা বড়ো থেকে আরো বড়োতর হচ্ছে। আমি বৃষ্টির ভিতর খুব ছন্দ খুঁজে পাচ্ছি, মন ভরে বৃষ্টি দেখছি। আশেপাশে সব লোকে লোকারণ্য। আমার পিছনে হলুদ জামা পড়া একজন মেয়ে খোলা চুলে দাঁড়িয়ে আছে, কখন থেকে সে মেয়ে আমার পিছনে আছে আমি দেখিওনি, খেয়ালও করিনি। যখন চোখ পড়লো, আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। মেয়েদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা ব্যাপক, ঈশ্বর প্রদত্ত। আমি না তাকাতে চাইলেও মনের অবাধ্য নয়নদ্বয় বারবার কিশোরীর দিকে চলে যাচ্ছে।
হলুদ জামা আর খোলা চুলে কিশোরীকে মনে হচ্ছে আকাশ থেকে বৃষ্টি হয়ে কোন মেঘপরী আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। পিছন থেকে বৃষ্টিযুক্ত বাতাস এসে আমার শার্ট ভিজে গেছে। চোখ শুধু কিশোরীর দিকে যেতে চায়। লক্ষ্য করলাম কিশোরীও আমার দিকে তাকাচ্ছে। কথার ফাঁকে আমার মন কিশোরী বন্দনাগীত গাইছে। গলে যাওয়া বরফের মতো মনটাও ক্ষণেক্ষণে গলে যেতে চাইছে।
ল্যাম্পপোস্টের আলো ছুঁয়ে পড়া বৃষ্টির ফোটাগুলো আমায় পলকেই স্বর্গে নিয়ে যেতে চাইছে। মুগ্ধ হয়ে আমি বৃষ্টি, বৃষ্টির বিশেষ গুণ হলো বালিকাদের মতো এটাও আমাকে খুব করতে পারে। ঠিক চাঁদের আলোর মতো। আমি কোন লেখায় জানি লিখেছিলাম- “চাঁদের আলো এবং বালিকা দু’টোই আফিম, মাঝরাতে খুব নেশা ধরে।”
আজকে মনে হলো সেই নেশার মাঝে বৃষ্টিও যোগ হলো। ষোড়সী রুপবতী বালিকার নূপুরধ্বনির ন্যায় বৃষ্টি আমাকে হৃদয়ে লাগছে, হৃদয়ের অন্তস্থলে প্রেমিকার চুমোর মতো ছুঁয়ে যাচ্ছে।
বালিকাদের গায়ে যে সুগন্ধি আছে, পৃথিবীর কোন সুগন্ধি উৎপাদন কোম্পানি আজো অব্দি এমন হৃদয়ভরা সুগন্ধি তৈরী করতে পারেনি। এটা তাদের ব্যর্থতা নয় বরং বালিকাদের ঈশ্বর প্রদত্ত মোহমায়া, যেটা বালিকাদের করেছে পৃথিবীর সবচে’ মারাত্মক আবেদনময়ী। এ গন্ধ মস্তিষ্কে ধারণ করেই যুদ্ধজয়ী সেনাপতি তাঁর প্রেমিকার কাছে ফিরে আসে। এ গন্ধ বুকে ধরে রাখতেই প্রেমিকজন সারা মাস কষ্ট করে টিউশনের ইনকাম দিয়ে পেটভরে কিচ্ছু না খেয়ে তার প্রেমিকার কাছে গিয়ে গাছের আবডালে চুমো খায়। এই চুমো স্বাস্থ্যবান না হলে মনোবান। একটা লিপস্টিক কিনে দেয়, এক ঝুড়ি লাল চুড়ি কিনে দেয়, বাদাম কিনে রাস্তার ধারে আড্ডা মারে-এই আড্ডার কোন বিষয়বস্তু থাকেনা, থাকে নিরাপদ চাহনি, মনোমুগ্ধকর কথার ডালা, ভালোবাসার কীর্তন, দু’জনে উদাস হবার মনোবাসনা।
বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই। কোথা থেকে আগন্তুকের মতো একটা প্রাইভেট গাড়ি এসে থামলো, সেটাতে হেলান দিয়ে আমি মনের মতো বৃষ্টি দেখছি। আমার পাশে থাকা মানুষটা মনে হয় আরো বেশি আবেগী। হলুদ জামা পরা বালিকা আমার খুব কাছে না হলেও কাছেই। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় কিন্তু না, বালিকাদের হাত দিয়ে নয় মন দিয়ে ছুঁতে হয়। মন দিয়ে একবার ছুঁতে পারলে তাদের মনে মহাবিশ্ব পরিমাণ জায়গা করে নেয়া যায়, বালিকারা একবার যাকে মন দিয়েছে তাকে সব দিয়েছে। বালিকাদের মন জয়ের জন্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ করা লাগলেও মন জয়ের পরে আর কোন শান্তিযজ্ঞ করা লাগেনা। একথা উপলব্ধি করে হয়তো নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন–
“হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোরে
মন বাড়িয়ে ছু্ই।”
বালিকারা কাঁচের চেয়েও বেশি ভঙ্গুর, এরা যে কি আঘাতে ভেঙে যায় আর কিসে আনন্দ পায় সেসবের তালিকা হয়তো স্বয়ং ঈশ্বরও নির্ণয় করতে পারেননি।
হলুদ জামা পরা বালিকাটার নয়ন দেখতে মায়াবী, বিড়ালের চোখের মতো। আমি বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে সেই মায়াবী নয়নদ্বয় দেখছি। চোখাচোখি হলেই আমি চোখ ফিরিয়ে নিই। বালিকাদের ঠোঁটের চেয়ে নয়ন বেশি সংবাদ বহন করে।
বিকেল বয়ে গেলো, সন্ধ্যা। অন্ধকার। ল্যাম্পপোস্টের আলোকে দূরের কোন আলোকবর্তিকা মনে হচ্ছে। পাশে থাকা হলুদ জামা পরা মেয়ে আমার আরো কাছে চলে আসলো, আমি ঘুরে জোরে নিশ্বাস ছাড়লে বালিকার খোলা চুলে গিয়ে পড়বে।
পাশে একটা কুকুর, বৃষ্টির ফোটা কুকুরের গায়ে লাগছে তাই সেটা বারবার পায়ের খুব কাছে চলে আসতে চাচ্ছে আর বালিকা এতে ভয় পাচ্ছে। জাস্ট আমার পিছনে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার, চেয়ারটা ফাঁকা পড়ে আছে অথচ কেউ ওটাতে বসছে না। সবাই হয়তো মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টি মানুষের বেদনা সংবরণ করেছে। বৃষ্টি দেখে মানুষ বেদনা লুকায়, বৃষ্টি দেখে মানুষ প্রেমে পড়ে আবার বৃষ্টি দেখে মানুষ অসহ্য হয়।
বৃষ্টি থামার কোন আভাস পাচ্ছি না, একেই কি মুসলধারে বৃষ্টি বলে? হয়তো তাই। মুখ তুলে সোজা উপরে তাকালাম, পাকা ছাদ ছাড়া আর কিছু দেখলাম না। কিশোরী আমার নয়ন ফাঁকি দিতে পারেনি, রেখেছি তারে নয়নে নয়নে। একে একে লোক কমতে শুরু করলো। সর্বসাকুল্যে আট-দশজন আছি আমরা, একজন ছাতা নিয়ে এসে আরো একজনকে নিয়ে গেলো। কয়েকজন ছেলে বুকের বাটন খুলে দিয়ে ভিজতে ভিজতে চলে গেলো। বাকি আছি আমরা তিনজন, কিশোরী মোবাইল হাতে নিয়ে কারসাথে কথা বললো। একটুপর একজন রিক্সা নিয়ে এলো, আমি সবকিছু ভালোভাবে লক্ষ্য করছি। রিক্সা থেকে মধ্য বয়সী একজন লোক নামলো, কিশোরী পা বাড়ালো, চলে যাচ্ছে আমার পাশ দিয়ে। আমাকে ক্রস করে একটু সামনে গিয়ে ডানপায়ে ভর দিয়ে ঘুরে এদিকে তাকালো। চোখ দু’টো মিটমিট করে পৃথিবীর সব সংবাদ বহন করে চলছে, আমাকে চোখ চোখ পড়তেই মনে হলো তার চোখ থেকে অগ্নি বেরিয়ে এলো। পরক্ষণে অস্তনিমিত সূর্যের মতো চোখ নামিয়ে নিলো। এর মধ্যে আমার মনে দু’দফা ভূমিকম্প হয়ে গেলো। নিজেকে গাঁধা গাঁধা লাগছে। ধুর! আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা। নাহ্। কিচ্ছু হবেনা। চোখ নামিয়ে চলে যাবার সময় কিশোরী বলে গেলো-“কেউ কিছু বলতে চাইলে বলতে পারে।” এই কথা শোনার পরে এমন অনুভূত হলো আমার হৃদয়ে যা পূর্বে আর কখনো হয়নি। রিক্সা চলে যেতে লাগলো, রিক্সার দূরত্ব যতো বাড়ছে আমি ততো নির্বাক হচ্ছি। এই মেয়েগুলো অদ্ভূদ হয়, একমিনিট আগে বললেই পারতো, রিক্সাটা অন্ধকারে ঢুকে গেলো, আর দেখা যাচ্ছে না। অদ্ভূদ স্বভাবের কিশোরীটা আমায় এক গামলা হতাশা দিয়ে পইপই করে চলে গেলো। কেউ একদিন তাকে কিছু বলে দিবে ঠিক আমার “কিছু” আর বলা হবে না। আমার কিছু বলাটা মাটি চাপা পড়ে গেলো রিক্সা বিলীন হবার সাথে সাথে। কিছু বলতে পারিনি, আমার কিছু বলা হয়নি। হয়তো তাকে কোনদিন কিছু বলা হবেনা। এই মনোহারিণী কিশোরী গুলো আলোড়িত হোক পৃথিবীর বাতাসে আর মুগ্ধ হোক প্রেমিকের ঠোঁটে। কিশোরীরা মুখে ফসকে বলে ফেলুক কাউকে “কিছু”। কিছ না বলা কথা ভালোবাসাময় হয়ে থাকুক পৃথিবীজুড়ে।