স্মৃতি অনেকটা বাতের ব্যথার মত। অমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমায় যেমন বাতের ব্যথা ভার হয়ে শরীর ভেঙে আসে, ঠিক তেমনি উপলক্ষ্য পেলে স্মৃতিও একরাশ ব্যথা হয়ে এসে বুক ভেঙে দিয়ে যায়। বাতের ব্যথা থেকে মানুষ মুক্তি চায় এবং সুচিকিৎসায় মুক্তি মেলেও। কিন্তু স্মৃতি থেকে মানুষের মুক্তি নেই। এ বড় ভয়ানক হৃদয়গ্রাসী অসুখ। যে অসুখের কোনো চিকিৎসা নেই, কেননা কোনও মানুষই স্মৃতির অসুখ থেকে সেরে উঠতে চায় না। স্মৃতি বড় আদরের নীলপাখি। তারে মানুষ খুব যতন করে পুষে রাখে। পালকে পালকে দুঃখ রাঙানো সেই পোষাপাখির ডানা কিংবা ঠোঁটে হাত বুলিয়ে মানুষ এক অদ্ভুত আনন্দ পায়।
হাওয়া বেগমের বাত এবং স্মৃতি দুই ধরনের ব্যথাই আছে। বাতের ব্যথা বেশি হলে সে সরকারি হাসপাতাল থেকে দেয়া বড়ি খায়। স্মৃতির ব্যথা সারাবার ওষুধ কোন হাসপাতাল দেয় তার জানা নেই। তাই সেই ব্যথা তার সারে না। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর তাই স্মৃতির ব্যথা নিয়ে বেঁচে আছে সে। যেকোনো কারণেই সেই ব্যথা জেগে উঠে তার। কখনো কখনো কোন কারণও লাগে না। হুটহাট বিষাদে আকাশ কালো করে আসে।
মার্চ অথবা ডিসেম্বর মাসে হাওয়া বেগমের দুঃখরা যেন আয়োজন করে আসে। চারদিকে জানান দিয়ে, ঝাঁক বেঁধে সৈন্যদের মত মার্চ করতে করতে হাজির হয়। যেভাবে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে কোনো এক দুপুরবেলা একদল পাকিস্তানি সৈন্য এসেছিল তাদের বাড়ির উঠোনে। হাওয়া বেগমের স্বামী হোসেন মিয়ার ছিল পাটের ব্যবসা। ধান আর সরিষার ব্যবসা। মৌসুমের সময় এ পাড়া ও পাড়া ঘুরে ঘুরে ধান পাট সরিষা সংগ্রহ করত সে। ঘোড়ার গাড়িতে করে সেসব বাড়িতে আসত। সব জমা হতো উত্তরের বড় ঘরটাতে। তারপর এক সময় কাছারি বাড়ির ঘাট থেকে নৌকায় করে সেসব ধান পাট নিয়ে নিরুদ্দেশ হতো হোসেন মিয়া। একমাস, দুইমাস এমনকি তিনমাস পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ থাকত না।
তারপর একদিন সন্ধ্যেবেলা হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই ঢাকি ভর্তি দুনিয়ার বাজার সদাই নিয়ে হাজির হতো মানুষটা। শাড়ি চুড়ি থেকে বিশাল সাইজের বোয়াল কিংবা কাতল – কী না থাকত সেই সদাইয়ের ঢাকিতে!
ভালো কামাই করত বলে সব সময় ভালো খেতে পছন্দ করত লোকটা। সেদিন সকালে কাজে যাবার আগে বলে গিয়েছিল লাউ দিয়ে শোল মাছ, আর নতুন আলু দিয়ে যেন মোরগের ঝোল রান্ন হয়। বাড়ি থেকে বের হবার আগে নিজ হাতে পালের মোরগটা জবাই করে দিয়ে গিয়েছিল। পরম যত্নে সব নিজের হাতে রান্না করে রেখেছিল হাওয়া বেগম। কাজ থেকে ফিরে বলেছিল, হাওয়া, ভাত দেও।
দিতাছি। আপনে গুসুলডা দুইয়া আইতে থাকুইন। উত্তরে বলেছিল হাওয়া।
গুসুল পরে করমু। আগে চাইড্ডা খাইয়া নই। ম্যালা খিদা নাগছে রে!
আত-পাওড়া অন্তত দুইয়া বহুইন।
এহন কিছুই দুবার পামু না। ভাত দেও। খাইয়া নইয়া সব দুমুনি। উঠোনের শেষ মাথায় কাঁঠাল কাছের তলে, শুধু ছাউনি দেয়া পাকের ঘরে পিঁড়ি টেনে নিয়ে বসতে বসতে কথাগুলো বলে হোসেন মিয়া।
হাওয়া বেগম স্বামাীর কথা শুনে মুখ টিপে হাসে। কিবা জ্যান্দর মানুষ অইছুইন গো আপনে!! ফুলতোলা টিনের থালায় বেশ খানিকটা ভাত তুলে দেয় সে। বাটিতে করে নামিয়ে রাখে মুরগি আর মাছের তরকারি। নতুন আলু আর কচি মোরগের সাথে লাল মরিচের টকটকে লাল তরকারি দেখে হোসেন মিয়ার খিদে যেন আরো বেশি করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ভরা গ্লাস কাত করে সে কাঁঠাল গাছের গোড়ায় হাতটা ভেজায়।
তারপর ভাত ভর্তি থালা হাতে নিয়ে তাতে উলটে পালটে লবণ মেখে নেয়। এক ফাঁকে মুরগির সালুন পাতে তুলে দেয় হাওয়া বেগম। কিন্তু হোসেন মিয়া খাওয়া শুরু করতে পারে না। তার আগেই হঠাৎ ঝুপঝাপ করে একদল পাকিস্তান আর্মি বাড়ির ভেতর ঢুকে পরে। ওদের দেখে দুজনরেই গলা শুকিয়ে আসে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে ধীর ভঙ্গিতে মানুষ দুজন উঠে দাঁড়ায়। পাকিস্তান আর্মিদের সাথে একজন বাঙ্গালি দাঁড়িয়ে আছে। সে হাত উঁচিয়ে ইশারা করে হোসেন মিয়াকে কাছে ডাকে। হোসেন মিয়া ভীত পায়ে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় । রান্না ঘরে খুটি ধরে দাড়িয়ে থাকে হাওয়া বেগম। বাঙ্গালি লোকটাকে পাকিস্তান আর্মিদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে দেখা যায়।
ঠিক তার পরমূহূর্তেই একজন সৈন্য হোসেন মিয়ার বুকের বাঁ পাশে রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি করে। একটাই মাত্র গুলি। সাথে সাথে হোসেন মিয়া মাটিতে লুটিয়ে পরে। চোখের সামনে খুব দ্রুত নিস্তেজ হয়ে আসে তার শরীর। ঘটনার আকস্মিকতায় হাওয়া বেগম যেন পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যায়। সে চিৎকার করতে ভুলে যায়। সে কান্না করতে ভুলে যায়। সে ভুলে যায় কীভাবে ছুটে যেতে হয়। হায়েনার দলটা চলে যায় দ্রুতই। হতবিহ্বল হাওয়া উদাস পায়ে হেঁটে স্বামীর মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে বসে থাকে নিশ্চুপ। উঠোনের ধূলো কাদা করে দিয়ে বয়ে যেতে থাকে তাজা রক্ত। ঘাতক বুলেটের খোসাটি পরে ছিল কাছেই। কী যেন কী মনে করে সেটি হাতের মুঠে তুলে নেয় সে। তারপর থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে জিনিসটা রয়ে গেছে তার কাছে। এই দীর্ঘ সময় সেটি বড় যত্ন করে, নিরাপত্তা দিয়ে আগলে রেখেছে। পাতাঝড়া দুপুর, কুয়াশা জড়ানো ভোর, তুমূল বর্ষণে ডুবে যাওয়া রাত-এভাবেই নিয়ম করে, সবার অগোচরে সে জিনিসটা বের করে এনেছে লোহার ছোট সিন্দুক থেকে। গুলির খোসাটি চোখের সামনে আসলেই হাওয়া বেগম যেন ফিরে যায় পঞ্চাশ বছর আগে। দূর অতীতের সেই সব দিনগুলো তার অশ্রু ঝরায়। সেইসব দিন, সেইসব রাত, সেইসব মানুষের কথা তার মনে পড়ে।
হাহাকার করতে থাকা বুকে সে বুলেট চাপা দেয়। বুলেটের খোসাটি বুকের সাথে চেপে ধরে রাখে। তার স্বামীর ঘাতক বুলেটটি ছিল যে খোসাটির আশ্রয়ে, সেই খোসাটির প্রতিই যেন তার মমতা উপচে পরে। বারবার স্পর্শ করে, শত সহস্রবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেও যেন নয়ন ভরে না। কোন অজানা বাঁধনে হাওয়া বেগম বাঁধা পরেছে এই শূন্যতার সাথে তার জানা নেই। প্রতিবার হাতের মুঠিতে নিয়ে বসে থেকে স্মৃতি রোমন্থন আর অশ্রু বিসর্জনের পর রুমালে জড়িয়ে বুলেটের খোসাটি আবার চুপচাপ নামিয়ে রাখে সে গোপন সিন্দুকে। তারপর ঘোলা হয়ে আসা দু‘চোখ আঁচলে মুছে সে ভাবে, মানুষ মূলত বুলেটেরেই মত। বুলেটের মত ছুটে গিয়ে মানুষটি একসময় হারিয়ে যায় অনেক দূরের অন্ধকারে। বুলেটের পরে থাকা খোসার মতো শুধু তার স্মৃতিটুকু পরে থাকে আঙিনায়।
হেমন্ত হাসান-টাঙ্গাইল। প্রকাশিত গ্রন্থঃ কিশোর উপন্যাস বন্ধু বাহাদুর এবং সামাজিক উপন্যাস অনন্ত আগুন।