অধিদর্শনের গ্রাফিতি
চাবিকথা
মার্জিনের মাঝে ঘুমিয়ে ছিলো কবি। প্রত্নযুবক এসে পৃষ্ঠা উল্টাতেই ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়লো শব্দের ব্যাস ও ব্যাসার্ধ; ভেঙে পড়লো টলটলে তন্দ্রা। শুরু হলো হাওয়ার বিস্ফোরণ, মচমচে বৃষ্টিপাত।
যখন রাত নামলো-নদীর মতো শাড়ী খুলে শুয়ে থাকা রাত; শিয়রে তার নক্ষত্রের পৈতা। দেখা গেলো, কবি ওক গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আকণ্ঠ পান করছে সবুজাভ জোছনা। তার চারপাশে গোলাকার ব্যাস তৈরী করে আত্মগুঞ্জনে মগ্ন অসংখ্য ডোরাকাটা প্রজাপতি। কবির মুখে শাদা দাড়ি, যেন গুচ্ছ গুচ্ছ পলায়নপর কাশফুল। চোখে তার প্রজন্মের বিদ্যুৎ, জ্বেলে রেখেছে আযৌবনা ঝিলিক বিতৃষ্ণা।
―বলো নাটকীয় কবি, বলো, জীবনের সঠিক কার্যকারণ কী? মৃত্যুরই কোনো মহৎ উদ্দেশ্য আছে কি?
এ প্রশ্নের উত্তরে কবির জাফরানরঙা চাহনি বেয়ে নেমে আসতে থাকলো চকিত আলোর ধারা। আর সেই আলোর ঝর্ণা থেকেই শুরু হলো কসমো জিজ্ঞাসা, শুরু হলো প্লানচেট কথোপকথন…
এক.
পাখিদের ফেসবুকের ইমোজিগুলো ঘুমিয়ে পড়লে পৃথিবীর চোখে রাত নামে। রাতের কোনো নিজস্ব রঙ নেই; সমস্ত অন্ধকার ধার করেছে বনলতা সেনের চুল থেকে। তাই পৃথিবীর সকল রাতই জীবনানন্দর প্রতিনিধিত্ব করে।
আমি বললাম―স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোয় অন্ধকার হয় না। মাঝরাতেও সেখানে সূর্য দেখা যায়।
―ওখানকার পাখিগুলো ইনসমনিয়ায় ভোগে। তাই ওরা সারারাত ফেসবুকিং করে।
―পৃথিবীতে ইনসমনিয়ার জন্ম হলো কিভাবে?
―ইনসমনিয়ার জন্ম লোভের জরায়ু থেকে। যার যত বেশি লোভ সে তত বেশি ইনসমনিয়ায় ভোগে।
―লোভহীন কোনো মানুষ কি পৃথিবীতে আছে?
―পৃথিবীর সবাই লোভী। তাই পৃথিবীর সবাই কমবেশি ইনসমনিয়ায় ভোগে।
―তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইনসমনিয়ার রোগী কে?
আকাশের দিকে তাঁকিয়ে সে জবাব দিলো―ঈশ্বর।
দুই.
ঈশ্বর এক ঘুমন্ত চুল্লী; চোরাগলির কসমো ল্যাম্পপোস্ট। অস্তিত্বহীনতা যার ডাকনাম, অমরতা তার প্রধান ভান।
আমি বললাম―অস্তিত্ব এক নীলশঙ্খ। একমাত্র মৃত্যুই তাকে ফুঁ দিয়ে বাজিয়ে তোলে। আর তা থেকে যে হ্রেষাধ্বনি উৎপন্ন হয়, তাকে বলা হয় প্রেম।
―প্রেম একপ্রকার আত্মবিপ্লব। প্রত্যেক প্রেমিকই মনে মনে একজন বিপ্লবী।
―বিপ্লব এক সংক্রামক ব্যাধির নাম। নির্যাতন যার কার্যকারণ, নৈরাশ্য তার প্রধান লক্ষণ।
―সকল নৈরাশ্যই কোনো না কোনো ভাবে ইতিহাসের বাহক। কেননা ইতিহাস মাত্রই সংক্রামক।
―পৃথিবীর ইতিহাস বিপ্লবেরই ইতিহাস।
―প্রত্যেক বিপ্লবীই পৃথিবীতে একেকটি সংক্রামক ব্যাধি হয়ে বেঁচে থাকে।
―তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংক্রামক ব্যাধির নাম কি?
করতলের চুমু বাতাসে উড়িয়ে সে বললো―মা।
তিন.
মায়ের স্তনের নীচেই সৃষ্টি হয় মানুষের প্রথম স্বৈরাচার। শৈশবে ফেলে দেয়া নির্বিশেষ ধারাপাতে লেগে থাকে কাঁচা দুধের গন্ধ। তাই পৃথিবীর সকল নামতার সৃষ্টিই মায়ের হৃদস্পন্দন থেকে।
আমি বললাম―নামতা একটি পদ্ধতিমাত্র। মানুষ বেঁচে থাকে সংখ্যায় আর বয়সের গণনায়।
―বয়স একটি রেসের ঘোড়া। তার খুড়ের শব্দে আমরা মাতাল হই। জেগে থাকি ভবিষ্যতের নেশায়।
―ভবিষ্যত মানেই অতীতের কসাইখানা; সম্প্রসারিত বর্তমান।
―জাতিস্মরের কোনো ভবিষ্যত থাকে না, সবই নস্টালজিক অতীত।
―অতীত একটি বহমান গুজব। তার থেকে যে গল্পের জন্ম হয় তাকে আদর করে ডাকা হয় ভাগ্য।
―ভাগ্য এক গোলকধাঁধা। পরিহাসের মাঝেই তার স্বার্থকতা।
―তাহলে ভাগ্য নিয়ে সবচেয়ে স্বার্থক পরিহাস করেছেন কে?
হাতের রেখার দিকে তাঁকিয়ে সে বললো―মহামতি কিরো।
চার.
ভাগ্য দেখলে হাহাকার বাড়ে। প্রতিবার ভাগ্য গণনায় পৃথিবীর নাভিতে জমা হয় ৩৭৩৭টি শীতকাল। পৃথিবীতে তাই শীতপ্রধান ভূখন্ডের সংখ্যাই বেশি।
আমি বললাম―শীতকালেই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ফুল ফোটে। তাহলে কি ফুলের জন্ম হাহাকার থেকেই?
―ফুল নিজেই একপ্রকার হাহাকার।
―পৃথিবীর সকল মৃতদের হাহাকার একেকটি ফুল হয়ে ফোটে।
―কিন্তু ফুলেরওতো হাহাকার থাকতে পারে।
―ফুলেরও নিজস্ব কিছু হাহাকার আছে।
―একেকটি ফুলের হাহাকারে পৃথিবীতে একেকজন কবির জন্ম হয়।
―তাহলে রক্তকরবীর হাহাকারে কোন কবির জন্ম?
স্মিত হেসে সে বললো―রবীন্দ্রনাথ।
পাঁচ.
রবীন্দ্রনাথ এক সম্ভ্রান্ত কাবাব। সবাই তাঁর গন্ধ ঠিকই পায় কিন্তু স্বাদ নেয় গোটা কয়েকজন।
আমি বললাম―রবীন্দ্রনাথ এক নদীর নাম। সে নদীর জলে যারা নামে তারা আজীবন মনে মনে সন্যাসব্রত পালন করে।
―সন্যাস একটি চিরন্তন অসুখ, কবিরাই সেই অসুখের প্রধান বাহক।
―কবি মাত্রই মেধাবী জননেন্দ্রিয়, কবিতা হলো সেই জননেন্দ্রিয় থেকে টুপটাপ খসে পরা ফুল।
―কবিতা হলো জলন্ত অ্যালজেব্রা, যার উত্তাপে জন্ম নেয় পৃখিবীর সমস্ত বিষণ্ণতা।
―বিষন্নতা একটি সম্ভাবনার নাম।
―একমাত্র বিষণ্ণতায় ভোগা মানুষেরাই শুদ্ধ মানুষ।
―তাহলে পৃথিবীর শুদ্ধতম মানুষের নাম কি?
নক্ষত্রপানে তাকিয়ে সে বললো―জীবনানন্দ।
ছয়.
বনলতা সেনের চোখ থেকে জীবনানন্দের চিল উড়ে গেলে শুরু হয় মানুষের আদমশুমারি। কেননা মানুষ মনে মনে সর্বদা একটি পাখিজীবনই কল্পনা করে।
আমি বললাম―বন্দুক আবিষ্কারের আগে পৃথিবীর সকল মানুষ মনে মনে একটি পাখিজীবনেই বাস করতো।
―বন্দুক একটি রাগী কোকো গাছ, বুলেট তার থেকে তৈরি সাজোয়া চকলেট।
―বুলেট আর কবিতা যমজ ভাই। দুজনই ম্যাগাজিনে থাকে।
―কবিতাই পৃথিবীতে একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যা। বেঁচে থাকার অনিবার্য রসদ।
―বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যই অজানা রহস্য উন্মোচন।
―রহস্য এক ঝুলন্ত পেইন্টিং।
―তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রহস্য কী?
দূর আকাশের পানে তাকিয়ে সে বললো―নারী।
সাত.
প্রতিটি সন্ধ্যায় নারীদের বুকে জমা হয় একটি করে মেরুন আকাশ। আসন্ন আফিমরাতে জোড়াস্তনে ঢালে হৃদপিন্ডের বেদনা।
আমি বললাম―আকাশ মূলত একটি চতুর্মাত্রিক সিনেপ্লেক্সের পর্দা। দৃশ্যের আড়ালে সেখানে ঘুমায় পৃথিবীর সকল ধর্মদেবতা।
―ধর্ম হচ্ছে অসীমের দিকে ফেরানো সুস্বাদু সর্বনাশ।
―ধর্মের প্রকৃত অপরাধ হচ্ছে মানুষকে তার কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত করা।
―মানুষের ইতিহাস বঞ্চিতের ইতিহাস, দুঃখের ইতিহাস।
―দুঃখের গল্পের মাঝেও সুখের অনুপুঙ্খ থাকে।
―নিজের দুঃখের গল্প বলে যে অন্যদের সুখ দিতে পারে সে-ই আদর্শ শিক্ষক।
―তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে আদর্শ শিক্ষক কে?
লাঠিতে ভর দিয়ে টুপিখোলা অভিবাদনে সে বললো―চ্যাপলিন।
আট.
পৃথিবী এক কৌতুকময় রঙ্গশালা, মানুষের হাটবাজার। মানুষ এখানে মানুষ কেনে, মানুষ বেচে।
আমি বললাম―সুন্দরী পাত্রীর অভিভাবক ও বেশ্যার দালাল একই সূত্রে গাঁথা। কেউই টাকা ছাড়া তাদের মেয়েকে ছাড়তে চায় না।
―টাকা হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্যারাসিটামল।
―টাকা একটি ধারণামাত্র। টাকা আবিষ্কারের পূর্বে পৃথিবীর সকল মানুষই সমান ছিলো।
―সমতা একটি জমকালো মরিচিকা।
―পৃথিবীর যাবতীয় সমতা আঁকা রয়েছে কবরস্থানে।
―সকল বৈষম্যের মাঝে থেকেও যে সাম্যের গান গায় সে-ই আর্দশ মানুষ।
―তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে আদর্শ মানুষ কে?
চোখবন্ধ নীরবতা নিয়ে সে বললো―গোরখোদক।
নয়.
কবরই পৃথিবীর বিশুদ্ধ ব্যাচেলর। মৃত্যুর সাথে সাথেই মুছে যায় মানুষের সকল যূথকাল।
আমি বললাম―কফিনের ব্যাবসাই পৃথিবীর সফল ব্যবসা। সকল ব্যবসাতেই কোনো না কোনোভাবে প্রতিদ্বন্দীর মৃত্যু কামনা করা হয়।
―মৃত্যু একটি বিষণ্ণ চৌবাচ্চা।
―মৃত্যু মানে সংযোগ সেতু; পরবর্তী জীবনের লিংক রোড।
―জীবন একটি পাঠশালার নাম।
―পাঠশালা মানেই আদর্শের শিক্ষা।
―আদর্শ হত্যা সবচেয়ে বড় হত্যা।
―তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হত্যাকারী কে?
বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সে জবাব দিলো―দ্রৌনাচার্য।
দশ.
হত্যাই পৃথিবীতে একমাত্র পরাধীন ঘটনা। বেঁচে থাকা মানেই মৃত্যুর বশ্যতা স্বীকার করা।
আমি বললাম―মৃত্যু একটি ব্যক্তিগত ভ্যাকসিন। মানুষের জন্ম তার পিতা-মাতার যৌনকামনার ফল ছাড়া আর কিছু নয়।
―যৌনতা এক হাওয়াই গন্ধম; রাজকীয় সর্বগ্রাস। পৃথিবীতে সঙ্গমই একমাত্র চিরন্তন অভ্যাস।
―সঙ্গম মানে প্রবৃত্তির স্বাধীনতা।
―স্বাধীনতা হচ্ছে স্বায়ত্বশাসনের সফল আত্মনিগ্রহ।
―আত্মশাসনের আকাক্সক্ষা থেকেই স্বাধীনতার জন্ম।
―পৃথিবীর কোনো স্বাধীনতাই চূড়ান্ত নয়।
―তাহলে চূড়ান্ত স্বাধীনতা বলতে কি বোঝায়?
ধীর পায়ে হেঁটে যেতে যেতে সে বললো―আত্মহত্যা।
শেষ সংলাপ
ভেঙে যাওয়া শব্দের ব্যাসার্ধ ছেড়ে কবি হেঁটে চলেছে। চোখে তার প্রজাতির পৌনঃপুনিকতা। পেছনে প্রত্নযুবক। ফেলে যাওয়া মার্জিনরেখায় অপসৃয়মান হয়ে বাজছে ইনসমনিয়ার গান। সে হেঁটে যাচ্ছে-তার পদধ্বনি নিঃশব্দ কিন্তু সুরেলা; তার চাহনি নিস্পৃহ কিন্তু অর্থবহ; তার ভঙ্গি অহৃত কিন্তু রাজকীয়; যেন এই গ্রহের কাউকেই সে চেনে না। তার কোনো পিছুটান নেই, কোনো অনুপুঙ্খ নেই; আছে কেবল অস্তিত্বের নির্বাণ। কেননা সব বেচে থাকাতেই চন্দ্রবিন্দু থাকে না। বেঁচে থাকার অর্থ যখন বহমানতা…