জ্বালাধরা রোদ। গনগন করছে গড়াইয়ের জল। অসহনীয় তাপে মাঠের গরুসব গা ডুবিয়েছে জলে। হাবাগোবা নগেন গরুর মতই গলা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নদীতে। শিমুলের ডালে উড়ে এসে বসেছে একটি শকুন। একদল কাক গরমে ছটফট করতে করতে চক্কর কাটছে। বাবা সেই দিকে তাকিয়েই নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজছে। দিনের মতি গতি নিয়ে হা-হুতাশ করছে হারেস মুন্সী। বাবা মাঝেসাঝে হু হা করছে। ঘাটের এক কোনে বউ ঝিয়েরা কাপড়ে সাবান মাখছে। কেউ ছাইমাটি দিয়ে বাসন মাজছে। প্রখর তাপে জলে দাঁড়িয়ে সব ঘামছে।
ওদিকের মাঠ ধরে বাক্স পেটরা নিয়ে কয়েকজন এদিকেই আসছে।
উত্তর গাঁয়ের সুশীল ঘোষের দুই ছেলে মনু আর সনু। সঙ্গে পরিবার। প্রায় অনেক বছর তারা ঢাকায় থাকে। ঘাটের কাছাকাছি এসে ওরা থামে। ছোটবড় সকলের হাতেই ছোট বড় ব্যাগ-পুটলি। সনু বললো ‘কে আছ একটু জল খেতে দাওগো।’ ছাই দিয়ে বাসন মাজছিল হারানের বউ। সে এক বাটি জল এগিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। ঢকঢক করে সবাই পিপাসা মিটালো। বাবা জিজ্ঞাসা করলো, কি গো অনেকদিন পর! কোন পরব আছে নাকি? তা কয়দিন থাকা হবে?’ বিশাল মাঠ পেরিয়ে সকলেই এত ক্লান্ত যে মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। পরে সব বলবে বলে সামনে ছুটে যায়।
সকলকে কৌতুহলী রেখে ওরা বাড়ি পথে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে মাঠের শেষ প্রান্তে যেখানটায় আকাশ ডালিমের রঙ ছড়িয়েছে সেদিকেই হারিয়ে যায়। গড়াই ব্যস্ত হয়ে উঠে তার মত। যারা খানিক বিরতি টেনেছিল তারা আবার কাজে মন দেয়। অর্ধেক জল আর অর্ধেক স্থলে থাকা কাঠের গুড়িতে কাপড় খচার ধপধপ ঠাসঠাস শব্দ দুপুরের নির্জনতা ভাঙ্গে।
ঝাঁক বাঁধা কাকগুলো কা কা করতে করতে ছটফটিয়ে এমাথা ও মাথায় চক্কর কেটে যায়।
কাশিনাথপুরের উত্তরে গড়াই নদী, পুবে মাজদিয়া, পশ্চিমে গোবিন্দপুর, দক্ষিনে ছাইভাঙ্গা। চার গাঁয়ের মধ্যবর্ত্তী বড় আখড়া। গাঁয়ের যে কোন জমায়েত আঁখড়াতেই হয়। কীর্ত্তণ শেষ অনেকক্ষণ। হিন্দু মুসলমান সকলেই এসে বসেছে আখড়ার সামনের খোলা উঠোনে। কুপির মৃদু আলোয় তাদের মুখমন্ডল স্পষ্ট দেখা যায় না। তবে ঠাহর করতে অসুবিধা হয়না যে সকলে অধির আগ্রহ নিয়ে বসে আছে।
একটি টোলে মধ্যমনি হয়ে বসেছে মনু ঘোষ। সনু বড় ভাইয়ের পাশের বেঞ্চে বসে। দুজনের পরনে মাড় দেয়া টানটান ধূতি। ধবধবে সাদা ফতুয়ায় ফুলতোলা পকেট। দীর্ঘদিন শহরে থেকে থেকে সাহেবদের মত দেখতে হয়ে গেছে। কথা বলার ছাঁচও বদলেছে অনেকটা। দুপুরে যে ক্লান্ত শ্রান্ত দেখাচ্ছিল এখন তার অনেকখানিই কেটে গেছে। তবু দুশ্চিন্তার ছায়া স্পষ্ট। ঢাকা শহরে গন্ডগোল চলছে। মনুরা যে ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতো তার সামনের একটি ফ্ল্যাটে গতকাল হামলা হয়েছে । লাঠি, বুলেট, টিয়ারগ্যাস আর মিলেটারী। যেখানে সেখানে মানুষকে মেরে ফেলছে। শহর জুড়েই তুফান। সে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। তাই, ব্যবসা গুটিয়ে তারা গাঁয়ে চলে এসেছে। কোন পরব টরব নেই। যতদিন শহর শান্ত না হয় ততদিন তারা গাঁয়েই থাকবে।
আমাদের বাড়ির মুখেই পদ্মপুকুর। পুকুরের দক্ষিনে মাঝ বরাবর আটচালা ঘর। এই ঘরটিতে বড় ঠাকুমা মানে আমার বাবার জেঠি, আমার নিজের ঠাকুমা ও বিধবা পিসিমা থাকেন। পশ্চিমের ঘরে থাকেন খুড়ো-খুড়িমা ও ভাই বোনেরা। উত্তরের ঘরে আমরা। পাশেই গোয়াল ঘর, কাজলী ধবলী তাদের ছানাপোনা নিয়ে দিব্বি সংসার করছে। দক্ষিণে মোষের ঘরে নবাব সদ্য কিনে আনা সখির সাথে হ্রিহ্রিহ্রি করছে। মোষের ঘর আর আমাদের ঘরের মাঝামাঝি রান্নাঘর। রান্নাঘরে যখন রান্নাচলে আমরা সকলে বারান্দায় বসে কিচ্ছা শুনি। তাতে রান্না ও রাত দুটোই গড়িয়ে যায়।
ছাতিফাটা গরম শেষে এখন মৃদু হাওয়া বইছে। আমরা ভাইবোনেরা শুইয়ে আছি, পিসিমা তালপাতার পাখায় বাতাস করছে। বড় ঠাকুমা গল্প বলছেন। পাতালপুরী রাজকন্যার গল্প। একটার নটে গাছ মুড়োয় তো আর একটি উঁকি দেয়। কিচ্ছার আশ তবু ফুরোয়না। ঘুমে ঢলছি, গল্পও ঢুলছে তখনই বাবা ও খুড়ো এসে ঢুকলেন। আসর ভেঙ্গে গেল। খুড়িমা-মা উঠে রান্না ঘরে চলে গেল। পিসিমা লন্ঠন গামছা নিয়ে কুয়োপাড়ের দিকে গেলেন। ওরা হাত পা ধুইয়ে খেতে বসলেন। দুজনেই চুপচাপ। খুড়িমা জিজ্ঞাসা করলেন‘ কিগো ঠাকুরপো অমন তড়িঘড়ি কই গেলা?
‘মনু-সনুরা চলে এসেছে ঢাকা থেকে। আখড়ায় সবাই বসেছিলাম।’ বাবা এইটুকু বলে থামলেন। খুড়িমা পাল্টা কোন প্রশ্ন না করে সকলের পাতে তরকারী তুলে দেয়ার ব্যস্ত হলেন।
গাঁয়ে কে এল, কে গেল তা দিয়ে অন্দরমহলে তেমন কৌতুহল নেই। তিন বেলা কি রান্না হবে, কে কি খাবে, কখন গরু-মোষের আধার দিতে হবে, সন্ধাবাতি জ্বালবে, দুধ দোয়াবে, ঘর নিকোবে, বাড়ির ছেলেমেয়েদের খাওয়া ঠিকঠাক হলো কিনা এসব ছাড়া অন্যকোন কিছু বুঝে উঠার মত সুযোগ তারা কোনদিন পাননি। তাই মনু সনুদের ফিরে আসার কথাবার্তা এগিয়ে নিতে আগ্রহী হলেন না। তিনি ডালের বড়ি দিয়ে কুমোরের ঘন্টাঁ কেমন হয়েছে, আরো একটু নিবে কিনা সেই নিয়েই বেশি আগ্রহী।
তবে চাওয়া না চাওয়ার বিষয় নয়, এই আলোচনাটাই চারদিকে জমে উঠলো। ঘোষদের পরিবারের সাথে গাঁয়ে ঢুকলো ভয়। এবার দীর্ঘদিন ট্রাঙ্কবাক্সে আটকে থাকা রেডিওটা বাইরে বেরিয়ে এল। গাঁ থেকে খসে পড়লো ধুলোর আস্তর। বৈঠক ঘরে একটি জলচকির উপরে রেডিও ঘিরে সান্ধ্যআড্ডা জমে। হাঁট থেকে ফিরত আসা লোকটি গরম গরম খবর নিয়ে রেডিওর মত মধ্যমনি হয়ে বসে। মুক্তিবাহিনী ও রাজাকারদার নিয়ে সদ্য শোনে আসা খবর সকলকে জানায়। সন্ধ্যার পর তাই আমাদের বাড়িটা বেশ জমজমাটই থাকে। ভয় কম হয়। কিন্তু কথায় কথায় রাত বাড়লে আসর ভাঙ্গে। কেউ যেন বাড়ি যেতে চায়না। সকলে একসাথে বসে থাকতে চায়। বিপদে একসাথে থাকলে ভয় কমে। তবু বাড়ি ফিরতে সকলে উঠে। অন্ধকারে টর্চেও আলো ফেলে দলবেঁধে ইশ^রের নাম নিতে নিতে বাড়ি ফিরে।
শুধু ঢাকা নয়, সমগ্র দেশে মিলেটারী পৌঁছে গেছে। ঝিনাইদহ্ওে পাকিস্তানিদের ক্যাম্প হয়েছে। যুদ্ধটা দেখতে কেমন আমরা বুঝতে পারছিনা, বন্দুকটাই বা দেখতে কেমন তাও জানীনা। তবে এপাড়া ও পাড়ায় বাঁধা গন্ডগোলের চেয়ে ভয়ঙ্কর। মাঝেসাঝে ভুমমম ঠাসসসস ধ্রুমমমধ্রুমমম শব্দের আবছা আওয়াজ ভেসে আসে। এতদূও, তবু এমন এমন বিকট শব্দ! কাছে থেকে সেটি কতটা আর্তনাদের ভেবেই সকলে হায়হায় করে!
আমাদের পাঠলাশা বন্ধ হয়ে গেছে। দিদিদের বাইর বাড়িতে যাওয়া নিষেধ করা হয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার ধূমধাম কমে গেছে বাড়িতে। কিচ্ছার আসর বন্ধ। হঠাৎ করে সবকিছু কেমন মনমরা লাগে। দিনকে মনে জাপটে ধরে থাকি। ভাবি রাত না এলেই ভালো হতো। রাত এলে ভাবী, ঘুমথেকে জেগে যদি দেখতে পেতাম সব আগের মত ঠিকঠাক। যুদ্ধ টুদ্ধবলে কিছুই বাঁধেনি। কোনকিছুই চাওয়া অনুযায়ী হয়না। সূর্য উঠে, বাড়ি যায়। বাড়ি গিয়ে চাঁদকে পাঠায়। চাঁদ ফিরে সূর্যকে। যুদ্ধ কেবল দেশ থেকে যায়না। সে এগোতে এগোতে কাশিনাথপুরের কাছে চলে আসে।
ঠাকুমা পূজা দিচ্ছিল। এমন সময় পাশের গ্রামে আগুন জ¦ালিয়ে দিয়েছে। দাউদাউ করে জলছে। গরু ছাগল মানুষের আর্তনাদ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এলোপাথারি ছুটছে সবাই। শিশুদের এলোপাথারি কান্নার সহ্য করা যাচ্ছেনা। আগুনের ফুলকি উড়ে আকাশ লাল হয়ে গেছে। সে আঁচ এসে আমাদের গায়েও লাগছে। ওদিকে ইসমাইল মুন্সির মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না। উত্তরের গাঁয়ের ভাঙ্গার মাঠে ছয়জন জোয়ানকে একসঙ্গে গুলি করে মেরে ফেলেছে পাকিস্তানিরা। ওরা নাকি মুক্তিবাহিনীর খাতায় নাম লিখিয়েছিল। প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত কেবলই মৃত্যু আর ভাঙনের খবর আসছে। বাবা খুঁড়োরা বলাবলি করছেন, মোড়ল থাকতে আমাদের কিছু হবে না। ঐ শয়তানদের তিনি কোন এক কৌশলে আমাদের গ্রামে অন্তত ঢুকতে দেবেনা। তবে এ ভাবনা কাউকে নিশ্চিন্ত করেনা।
গ্রামটি ক্রমশ শ্বশ্মানের মত ছমছমে হয়ে গেল। সন্ধ্যাকালে যে খোল করতাল বাজিয়ে কীর্ত্তন হত সেটিও বন্ধ হয়ে গেল। মসজিদের আযান হচ্ছে কিন্তু হুজুরের সুরেও বেদনার কান্না।
জৌষ্ঠ্য মাস। আম কাঁঠালে রং ধরেছে মাত্র। কাঁচা পাকা গন্ধময় রাত। খুড়ো এসে হুরমুর করে বাড়ি ঢুকলেন। ঠাকুমা উঠানে কাঁথা সেলাই করছিল। খুড়োর চঞ্চলতা দেখে তিনি থামলেন।
‘মা গুছিয়ে নেন। যেতে হবে কাল। এবার আর থাকা যাবেনা।’
ব্যাস, ঠাকুমা কান্নাকাটি শুরু করলেন। সকলে ছুটে এলো। বাবাও দাঁড়িয়ে আছে। সকলেই মনমরা। কেউ লুকিয়ে চোখ মুছছে তো কেউ সামানেই হাউমাউ করছে। শুধু আমরা নই সমগ্র গ্রামেই কাঁদছে। নিজের ভিটেতে নিজে থাকতে পারবেনা এমন দিনতো কস্মিনকালেও মনে আসেনি। বাবা তাড়া দিলেন। প্রয়োজনীয় সব গোছগাছ করে নিতে হবে আজকের মধ্যে। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ থামলে ভিটে ফিরে পাব। প্রাণটা চলে গেলে ভিটে থাকলেও কোন লাভ নেই।
গোলার ধান গোলায় থাকলো। খেতের ধান খেতে। পুকুরের মাছ রইলো পুকুরে। ঝাঁপির খই ঝাঁপিতে। চাল ডালসবজির জমি সব রইলো। রাতভর যেটুকু নেয়া সেইটুকু কেবল পুটলি হলো। আমরা ছোটরা ছাড়া কেউ ঘুমালো না।
ভোরে যখন ঘুম ভাঙলো তখন অচেনা ঠেকছিল সব। ঘরের সব আসবাব পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বেলায়েত চাচাদের বাড়ি। বেলায়েত চাচা আমার সহপাঠী মোবারবের মামা। সম্পর্কে তিনি বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বাড়ি মাজদিয়ায়। তিনি বলেছিলেন যেন মাজদিয়ায় আমরা থেকে যাই। খুড়ো বললেন, আমরা তো বাঁচবোইনা, শেষে আমাদের জন্য তোদের প্রাণটাও যাবে। তাই জিনিসপত্রগুলো চাচার বাড়িতে রেখে আপতত আমরা যাই, পরে সব থামলে ফিরে আসবো।
আধাঁর করা সন্ধ্যায় কাশিনাথপুর থেকে একটি বিশাল ছায়ার মিছিল বের হলো। যাদের সামর্থ আছে তারা গরুর গাড়ি নিল। মালপত্র, বউ-ঝি ও শিশুরা আশ্রয় পেল সে গাড়িতে। বাকীরা পদব্রজে যাত্রা করলো। শত শত মানুষ আশেপাশের গ্রাম থেকে এসে মিশলো সে মিছিলে। ভিটে হারাদের কান্নার মিছিল। দ্বীর্ঘশ্বাস-উৎকন্ঠা-সর্বস্ব হাড়ানোর ব্যাথায় জর্জরিত যাদের একমাত্র চাওয়াই একটু নিরাপদ ঠাঁই।
কাশীনাথপুর পার হয়ে শৈলকুপা। শৈলকুপা উপজেলায় সিএমবি পথে তখন মিলেটারী ক্যাম্প হয়েছে। বিশাল পথে জিপের হেডলাইট দানবের মতই হুসহাস করে চলে যায়। বুকের ভীতরটা ধুকপুকিয়ে উঠে। সকলে জমির আইলে লুকিয়ে পড়ে। হ্যাডলাইটের আলো ম্লান হয়ে যখন হারিয়ে যায় তখন আবার সকলে সড়কে ওঠে আসে। হাঁটতে হাঁটতে বির্স্তিন এক মাঠের নাগাল মেলে। মাঠটি পেরুলে নদী। নদীর ওপারে মাইল দুয়েক হাঁটাপথ, তারপর ইন্ডিয়া।
ধূ ধূ মাঠে অপেক্ষায় সব। কালো নাগিনীর মত ফুসফুস করছে মেঘ। যেন ছোঁ মেরে গিলে খেয়ে নিবে সব। সকলের চেষ্টা একটাই। যে করেই হোক ঝড়ের আগে দিগন্ত পাড়ি দেয়া চাই। সেই আশাতেই দিগবিদিক হয়ে সবাই ছুটছে। মিছিলটি যখন মধ্যমাঠে তখনই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। পিঁপড়ার ঢোলে ঢিল পড়লে যেমন প্রাণপনে ছুটতে থাকে সবে, তেমনিই সবাইকে ছুটিয়ে দিয়ে বৃষ্টির ঘূর্ণি ঘুরতে থাকলো। থেকে খেকে আগুন চমকাচ্ছে আকাশে । তারপর ভুমমমমম ভুমমমমমম শব্দ ফেটে পড়ে জমিনে। মায়ের কাঁখে ছুটকি আর হাতে রুমকি দুজনেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে ভয়ে। ঝড়োবাতাসে উড়ে আসা ধূলি আমাদের চোখে মুখে নাকে আছড়ে পড়ে। শরীরটাকে সামনে হাঁটতে দেয়না। গরু দুটি ভয়ে লাফাচ্ছে আর কাঁদছে। ঝড়োহাওয়া, বোনদের কান্না আর গরুর হাম্বারব মেঘের গর্জনের সাথে মিলেমিশে প্রলয়ংকরী ঝড় নামিয়ে দিল।
বিরামহীন সেই ঝড়। ঠাম্মাদের বহন করা গরুর গাড়িটা ভিজছে। মাঠ ভিজেছে, ঘাট ভিজছে। শরীর-মন, খাবার-কাপড় সব ভিজে গেছে। বৃষ্টির আর চোখের জল ভিজে ভিজে ঝিমিয়ে গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার আর ধোঁয়া উঠা বৃষ্টিতে কেউ কারো মুখ দেখছিনা। কেবল একটি শক্ত হাত ধরে আছি। সেই হাতটি ভিজে কেমন নেতিয়ে পড়েছে যেন। ভিজে আঁচল দিয়ে মা ছোট বনুকে জাপটে ধরে আছে। মেজোকে কোলে নিয়ে আছে বাবা।
ভীষণ বৃষ্টি ভিজতে ভিজতে কে যে কোথায় ছিটকে গেল।
কেউ কেউ থামলো না। ঝড় মাথায় নিয়েই ছুটলো। কেউ অপেক্ষায় থাকলো বৃষ্টি ধরে এলেই ছুটবে। কেউ কেউ ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে থেমে গেল। আমরা সেই থেমে যাওয়ার দলে। বৃষ্টিতে ছুটে এসে আশ্রয় নিয়েছি একটা গ্রামে। যেখানে থেমেছি সেই গ্রামে বোধহয় লুট হয়েছে। ঘরদোর ফাঁকা। না আছে মানুষ, না আছে জিনিসপত্র। শূণ্য ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গৃহীর ভাঙাচোরা এটাওটা। ফুল ফল পাতারা গৃহলক্ষ্মী হয়েই শূণ্য উঠোন পাহারা দিচ্ছে। অন্ধকারে ওরা যেন আমাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, কোথাও কেউ নাই। তোমরা থাক।
সারারাত অচেনা বাড়িতেই কেটে গেল। শূণ্য একটি বাড়ি। না আছে কুপির আলো, না আছে মানুষ। আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে আমরা একজন অন্যজনের মুখ দেখি। সকলের কাপড় গেছে ভিজে। সেগুলো খুলে ঘরের বেড়ায় গুজে ছড়িয়ে দিয়েছে মা। পুটলির কাপড় ভেজা তাই গামছা চিপে পরে থাকলাম। বড়দের সে সুযোগও নেই। বোনু মায়ের কোলে ঠান্ডায় কাঁপছে। অন্ধকারে সে ভয়ও পাচ্ছে। মা ওকে দুধ খাওয়ানের চেষ্টা করছে কিন্তু সে কেঁদেই যাচ্ছে।
ভয়ার্ত একটা রাত এভাবেই সকলে পাড়ি দিলাম। ভোরের আলো ফুটলে খুকি ঘুমালো তবে ওর জ¦র এসেছে। সারারাতে আমাদের ভেজা কাপড়গুলোও কিছুটা টানটান হলে আমরা সেগুলো পরে নিলাম। বৃষ্টির লাগাম নেই। সে ঝরছে তো ঝরছেই। কোথা থেকে দুটো মুরগী জুবুথুবু ভিজে ছুটে এসে বারান্দায় ওঠে বসলো। একজনের পাখার রং খয়েরী কালো মিশেল, অন্যজনের সাদা কালো, মাথায় একখানা লাল ঝুঁটি। আমাদের দেখে ওরা অবাক হলো খানিক। কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে, এরপর একছুটে বারান্দার কোণের দিকে চলে গেল। ওদিকটায় বিশাল একখানা খরের গাদা। ওখানে কিছুক্ষণ ঠোঁট গুজে একজন পেখম ছড়িয়ে বসে গেল। আর লাল ঝুঁটির মুরগীটা ডাকতে ডাকতে ভিতর বাড়ির দিকে গেল। বোঝাই যাচ্ছে এই বাড়িতে তাদের দখলদারী রয়েছে। গৃহীদেরই ওরা খুঁজছে।
খরের মধ্যে বসে থাকা মুরগীটা হঠাৎ কোক্কোকোউ কোক্কোকোউ করে ডেকে উঠলো। কিছুটা কান্নার মতই যেনো। খুড়ো এগিয়ে গেল মুরগীটার দিকে। খুড়োকে দেখেই সে থেমে গেল। আমি আর বোনু গিয়ে খুড়োর কাছ ঘেষে দাঁড়ালাম। খুড়ো আপন মনে কি একটা দেখছে। মুরগীটা বসেই আছে। ওর চোখে ভয়ডর কিছু নেই। খুড়োকে দিখে বরং সে কিঞ্চিত বিরক্ত। খুড়ো তবু দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় খুড়িমা ডাকলো আমাদের। শুকনো চিড়া-গুড় ছিল সাথে তাই খেতে ডাকছে। আমরা চলে এলাম।
বৃষ্টির ত্যাজ বেড়েছে। খুড়ো ওখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়েই আছে। বৃষ্টির ছাঁটে তিনি কিছুটা ভিজেও যাচ্ছেন। তবু দাঁড়িয়ে আছেন। পেখম ছড়িয়ে বসে থাকা মুরগীটাকে দেখছেন। ভিতর বাড়িতে যাওয়া লাল ঝুঁটিওয়ালা কাউকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে এলো। খরের গাদার কাছে আগন্তুককে দেখে সে এমন চিৎকার শুরু করলো যে খুড়ো আর টিকতে পারলেন না। তিনি ফিরে এলেন।
ধূতিতে জমা জল চিপে ফেলতে ফেলতে বড় ঠাকুরমার কাছ ঘেষে দাঁড়ালেন। ‘বেশ বড় একটা ডিম দিলগো মুরগীটা।’ বলতে বলতে তিনি খানিক হাসলেন। ঠাম্মা বেশ বিরক্তি নিয়ে খুড়োর দিকে তাকায়। খুড়ো সেদিকে না তাকিয়েই বলে, যাই হবার হবে; বৃষ্টিটা ধরলেই গাঁয়ে ফিরে যাবো মা।
খুড়োর কথা শুনে ঠাম্মার চোখ ঝুমকো ফুলের মত নেচে উঠলো।
জয়শ্রী সরকার-নেত্রকোনা সাহিত্য সমাজসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠনেও তিনি সম্পৃক্তত। বহুবছর ধরে যুক্ত আছেন উদীচীর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে।
প্রকাশিত গ্রন্থ :
কাব্যগ্রন্থ : শূন্যাতা (২০০৬), ছোট গল্পগ্রন্থ: ফিরে আয় মাটির পুতুল (২০১৬ ), গবেষণাগ্রন্থ: প্রান্তবাসী হরিজনদের কথা (২০১২), বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্রে সহকারী নারী অভিনয় শিল্পীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার তুলনামূলক চিত্র, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছর, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, তথ্য মন্ত্রণালয়।
উপন্যাস: অম্বা আখ্যান (২০১৫)।