চৈত্রের তখন মাঝরাত। চারপাশ নিরব হয়ে আছে। কখনো কখনো ঝিঁ ঝি পোকা ডেকে যাচ্ছে। আচমকা ডেকে যাচ্ছে নিঃসঙ্গ কোনো এক কোকিল। চৈত্র মাসের মাঝামাঝি হলেও গ্রামে তখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শীত। মাঝরাতে তার দাপট আরো বেড়ে যায়। ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে কদিন ধরে। কিশোগঞ্জের রূপপুর গ্রামের মানুষ গুলো প্রতিটা রাত পার করছে ভয়ে বিছানায় গুটিসুটি মেরে পড়ে থেকে। পরিবার বাঁচাতে বয়স্ক লোকদের চোখে ঘুম আসে না। জীবনটাকে হাতের তালুতে রেখে তাদের বেঁচে থাকা। হঠাৎ মুক্তিদের ঘরের উপর দিয়ে ডেকে গেলো শ্মশানকুলি পাখি। কেমন ধরফরিয়ে উঠলো অসীম রায়ের বুকের ভেতরটা। চারপাশে মানুষের চিৎকার শুনতে পেলেন-ডাকাত পড়েছে, ডাকাত। তা শুনে তিনি বেড়ার ফাঁক দিয়ে রাস্তায় তাকালেন, দেখলেন রেললাইন পার হয়ে বিশাল বটগাছ ছাড়িয়ে একদল মানুষ এগিয়ে আসছে তাদের বাড়ির দিকে। হাতে বড় টর্চ লাইট। লাইটের আলোতে ঝলমল করছে রামদা গুলো। কি করবেন অসীম বাবু বোঝে উঠতে পারছেন না। তখনো নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে আছে ছোটো ছেলে সজল, মেজো মেয়ে মুক্তি, দুবছর বয়সের সুপ্তি আর স্ত্রী রেণু। খুব কাছে চলে এসেছে ডাকাত দল। তাড়াহুড়া করে স্ত্রীকে ডেকে তুললেন। পেছন দরজায় তখন শব্দ হলো, অনীল ডাকছে- দাদা, তাড়াতাড়ি ঘর ছাড়ো, ডাকাত পরেছে। ততক্ষণে রেণু ছেলে মেয়েকে তুলে দরজা খুলে বাইরে পাঠিয়েছেন। ছোটো মেয়েকে কোলে করে অসীম বাবুর সাথে তিনিও বাড়ির পেছনের জঙ্গলের দিকে ছুটলেন। ঠিক যতোটা ভেতরে যাওয়া যায়। অনীলও তার বউ ছেলে-মেয়ে নিয়ে বাঁশঝাড়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে। দুই ভাই তাদের সংসার নিয়ে চৈত্রের ভোর রাতে অসহায়ের মতো বসে রইলো গভীর জঙ্গলে। শীতে সবার কাঁপছে শরীর। নেই, কিছু করার নেই কারো। আশেপাশে কোনো বাড়ি নেই। অনেক দূরে দূরে মুসলমানদের বাড়ি । আছে কেবল জঙ্গল, চাষের জমি আর খাল। আর বাড়ির সামনের দিকে পুকুর পাড়ে দুটো হিন্দু বাড়ি। কিন্তু এতো মুসলমানের ভিড়েও বেশ ভালোই ছিলেন অসীম অনীল দুই ভাই। কেউ তাদের কোনো ক্ষতি করেনি কোনোদিন। অসীমবাবু হোমিও ডাক্তার আর অনীল পুলিশে চাকরি করতো। যেদিন থেকে দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো, তাদের শান্তিও শেষ হলো। অনীল পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে এলো।
ভোরের আলো দেখা দিয়েছে রূপপুরের বুকে। ঝাঁকে ঝাঁকে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে পাখি। চারপাশের কোলাহল নিরব হয়ে এলো। ডাকাত দল চলে গেছে। জঙ্গলের গভীর থেকে বের হয়ে এলো দুটি পরিবার। অসীমবাবুর মুখে চিন্তার রেখা। মেয়ে মুক্তি বললো- বাবা চিন্তা করো না, চলো বাড়ি গিয়ে দেখি কি অবস্থা। বিশ বছর বয়েসী ছেলে সজল হতভম্ব, বাবা তাকে আগলে রাখে। একমাত্র ভরসা সজল না থাকলে কি করবেন তিনি। বড়ছেলে-মেয়ে আসাম থাকে। সজল ছাড়া আর কি আছে তার। কিন্তু তিনি জানেন মেয়ে মুক্তি ছেলের থেকেও বুদ্ধি আর সাহসে এগিয়ে। আগলে রাখেন, অসীমবাবু তার ছানা দুটোকে পালকে ভেতর লুকিয়ে রাখেন। কেউ যেনো তাদের ছুঁতেও না পারে।
বাড়িতে ঢুকে দেখতে পেলেন সবকিছু ছাড়খার হয়ে আছে। ধান-চাল প্রায় সব লুট হয়ে গেছে। লুট হয়ে গেছে আরো অনেক কিছু। টাকা পয়সা, থালা-বাসন কিছুই আর নেই। অনীল বললো- দাদা এসব সিদ্দিক রাজাকারের কাজ। ওই তার দলবল নিয়ে ডাকাতি করেছে। রাজাকারে নাম লিখিয়ে দিন দিন সাহস বাড়ছে ওর। পুরো গ্রামটাকে শেষ করে দিচ্ছে।
কী বলবেন অসীমবাবু, এ গ্রামে তার নাম ডাক আছে, জমি জমাও আছে বেশ, ভাই পুলিশের লোক, রাজাকারের দলের এ বাড়ির উপর নজর যুদ্ধ শুরু হওয়া থেকে। অনীলের দুটো ছোটো বাচ্চা, এক ছেলে আর মেয়ে। বউ অল্প বয়েসী। দেখতেও সুন্দরী। নাম পহেলী। তার ফর্সা মুখটা বিষণ্নতার ছায়া নিয়ে কেমন নিস্তেজ হয়ে আছে। ঘরে ফিরে কোনো কাজে তার মন বসছে না। কি আছে কি নেই সে সব ছাড়িয়েও ভয় তাকে জড়িয়ে রেখেছে।
মুক্তি মায়ের সাথে সাথে কাজ করছে। হঠাৎ সে বলল-বাবা, বাসন বেশি কিছু নিতে পারেনি। কয়েকদিন আগে রাস্তার ওপারে হিন্দু বাড়িতে যখন ডাকাতি হয়েছিরো তারপর ভবতুষকে নিয়ে সব কাঁসার বাসন আমি বস্তায় ভরে কুঁয়োয় ফেলে দিয়েছিলাম। ও গুলো সব আছে। অসীমবাবু বললেন- মারে, বাসন কোসনের চেয়ে জীবন বাঁচানোই তো বড় দায়। কি যে করবো। দায়, সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাই এখন বড় দায়।
রেণু রান্না বসালেন। ডেকচি পাতিল গুলো আছে কিন্তু খাবারের থালা গুলো সব নিয়ে গেছে। অভুক্ত বাচ্চা গুলো ক্ষিদেতে কাঁদছে। তা সহ্য করতে পারছেন না তিনি। খেতে তো সবাইকেই হবে। না খেয়ে তো আর থাকা যাবে না। ঘরে যা পেয়েছেন তাই ফুটিয়ে নিয়ে কলাপাতা কেটে এনে সবাইকে খেতে দিয়েছেন। মনে মনে বললেন- এমন দুর্যোগ জীবনে আসবে কোনোদিনও ভাবিনি।
না বাংলাদেশের মানুষ কেউ কোনোদিন ভাবেনি ঘর ছেড়ে তাদের ছুটতে হবে, কেবল ছুটতে হবে। ভিটে ছেড়ে আপনজন ছেড়ে দেশ ছেড়ে শরণার্থী হতে হবে। কে জানতো এমন ভাবে উলট পালট হয়ে যাবে দেশ। তবু মুক্তি আসুক। মুক্ত হোক দেশ। স্বাধীন দেশে নিঃশ্বাস নিতে পারুক প্রতিটি মানুষ এই কেবল আশা সবার।
দুপুরের আকাশ তখন রোদে ভাসছে। একে একে লোক জড়ো হলো অসীমবাবুর বারান্দায়। হিন্দু মুসলিম সবাই এক হয়ে এসেছে। গ্রামে বোঝদার মানুষের খুব অভাব, পড়াশুনা জানা মানুষের ও। এই সময়ে কি করা উচিত তার পরামর্শ করার জন্যইে এসেছে সবাই। অনেকে খোঁজ নিতেও এসেছে ডাকাতির। অসীমবাবুর ঘরে সারাবছর কাজ করে কয়েকজন মুসলিম। তাদের কারো কারো বাড়ি জঙ্গলের ওপারে। কারো বা রেলের ব্রিজের পারে। তাদের মধ্যে ইসমাইল আর রমজান অসীমবাবুর ঘনিষ্ঠজন। ইসমাইল বললো- বাবু সিদ্দিক হিন্দুদের বাড়িত হামলা করে প্রতি রাইতে। অল্প বয়েসী মেয়ে বউদের ধইরা নিয়ে যায়। কোন ভরসায় বাড়িত থাকবাইন। বইলা ফিরতাছে মিলিটারি আইলো বইলা। পুলডার কাছে ক্যাম্প করছে। দিন রাইত মিলিটারির গাড়ি আইবো। বাবু বাড়ির থাহনডা নিরাপদ না। রাইতে আমরার বাড়িত ঘুমাইবাইন। কোনো সমস্যা অইতো না। ইসমাইলের বাবা চাচারাও এসেছিলো, তারাও ইসমাইলের কথায় সায় দিলো।
আরো অনেকেই সেই প্রস্তাব দিলো। অসীমবাবু বললেন- দেখি আর কয়েকটা দিন ইসমাইল। তাছাড়া ঘর থেকে তো ব্রিজটা দেখা যায়, গাড়ি আসলেও শব্দ শুনবো। এভাবে প্রতিদিন ঘর ছেড়ে থাকা কি সম্ভব। দেখি আর কয়েকদিন। বেশি বিপদ হলে তো ঘর ছাড়তেই হবে। না কি বলিস অনীল। তার চেয়ে প্রতিরাতে প্রতি ঘর থেকে একজন করে পাহারা দেওয়া যাক। বিপদ বুঝলে ঘর ছাড়লেই হবে। সকলে সে কথায় রাজি হলো। মুক্তিযুদ্ধে রূপপুর গ্রামে বিপদ হিন্দুদের বেশি হলেও মুসলিমরাও তাদের সে বিপদে একা ছেড়ে দিলো না। তারাও সাথে থাকার প্রতিশ্রুতি দিলো। রূপপুর গ্রামে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি বরাবরই ছিলো। কেবল রাজাকার গুলো ছাড়া এই সম্প্রীতিকে আরো দৃঢ় করে দিলো মুক্তিযুদ্ধ।
কয়েকদিন কেটে গেলো এভাবে। রাজাকারের দল একটু নিবর হয়ে রইলো। অসীমবাবু কেবল ভাবেন, আতঙ্ক চিন্তা কোনোটাই পিছু ছাড়ে না। প্রতিরাতে পাহারা দেয় সবাই। কোনোদিন অসীমবাবু কোনোদিন অনীল, কখনো সজল। এভাবে চলছে রাত গুলো। চৈত্র তখন শেষ দিকে। বিকেল থেকে বৃষ্টি হচ্ছিলো। সে রাতে অনীলের পাহারা। অসীমবাবু ঘরে থাকলেও রাতের বেশি সময় জেগেই কাটান। নানা চিন্তায় ঘুম আসে না তার। রাতে বৃষ্টি কমে গেলো। পাহাড়া দিতে বের হলো সকলে। রাত তখন দুটো। পুরো গ্রাম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। অসীমবাবুও জেগে থেকে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। রাস্তার ওপারে রেলের ব্রিজের কাছে সিদ্দিকদের ক্যাম্পে দুটো গাড়ি এসে থামলো। নিরব হয়ে থাকা গ্রামের প্রহরীরা চমকে উঠলো। মিলিটারি এসে ঢুকেছে গ্রামে, আর তো রক্ষা নেই। মাটির রাস্তা বরাবর বড় বাড়িটাই হিন্দু অসীম রায়ের বাড়ি। সিদ্দিক রাজাকার মিলিটারি নিয়ে প্রথমে এই বাড়িতেই আসবে। এসবের কোনো খোঁজ রাখেন না অসীমবাবু। তিনি অঘোরে ঘুমাচ্ছেন। রাস্তায় নামলো মিলিটারি। সাথে সিদ্দিক রাজাকারের দলবল।তাদের পায়ের আওয়াজে কাঁপছে নিরিহ গ্রাম। যে যেদিকে পারলো খবর দিতে অন্ধকারে রাতের বুকে চিৎকার করতে করতে ছুটলো- মিলিটারি আইছে, মিলিটারি আইছে। বাড়ির সামনের বট গাছের নিচ থেকে দৌঁড়ে এলো অনীল। দাদা দাদা বলে চিৎকার করতে থাকলো। উঠো মিলিটারি আসছে, উঠো দাদা। কিন্তু দাদার কালঘুম ভাঙে না। মিলিটারির পায়ের শব্দ আরো কাছে শুনতে পেলো অনীল। দরজায় বারবার শব্দ করার পর রেণু আর পহেলীর ঘুম ভাঙলো। কেমন আঁতকে ওঠলেন অসীমবাবু, তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন। পহেলী বাকি সবাইকে নিয়ে কাপড়ের পুটলি সহ জঙ্গলের পথ ধরলো। ডাকাতির পর থেকে ঘরের মূল্যবান জিনিস নিয়ে এমন কয়েকটা পুটলি বেঁধে রেখেছিলো মুক্তি আর পহেলী। ওরা সব ছুটছে বাড়ির পেছন দিকে আর মিলিটারির দল এসে ঢুকছে ওদের বাড়ি। সে রাতে জঙ্গল পার হয়ে আরো গভীর অন্ধকারে পালালো সবাই। ছোটো ছোটো বাচ্চা গুলোর মুখও চেপে ধরে রাখতে হয়। কখন কেঁদে ওঠে। হায়, সময় মানুষকে কতো অসহায় করে তোলে। এই গভীর অন্ধকার আজ সবার আপন হয়ে উঠেছে। রূপপুর গ্রামের হিন্দুরা যে যেভাবে পেরেছে অন্ধকারে ঝাড় জঙ্গলে প্রাণ বাঁচাতে ছুটে গেছে। জীবন গুলো পাখির মতো উড়ছে। পালাবার পথও কেমন আটকে ধরে। বিপদের সময় বুদ্ধি তো কাজ করে না। অসীমবাবুও কেমন বুদ্ধিহীন হয়ে যাচ্ছেন। যে টুকু বুদ্ধি দিচ্ছে তা মুক্তি আর অনীল। ঘোর অন্ধকারে বাঁশ ঝাড়ের নিচে বসে রেণু ফিসফিস করে অসীমবাবুকে বললেন-
সিদ্দিক রাজাকারের দল বল অচেনা শত্রুদের দলে ভিরে চেনা মানুষদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে। কি করে পারছে ওরা । এতো বছরের সামাজিক সম্পর্কর কি কোনো দাম নেই ওদের কাছে। চাচি চাচি বলে কতোই তো আমাদের বাড়ি এসেছে, খেয়েছে। আজ সব ভুলে গেছে। আমরা হিন্দু বলে আমাদের বাড়ির পথ দেখিয়ে মিলিটারি এনে ঘরে তুলছে। কিসের এতো রাগ সিদ্দিকের আমাদের উপর।
মুক্তি বলে উঠলো-কথা বলো না মা। চুপ করে থাকো। এখন কথা না বলাই ভালো।
সারাটা রাত ওদের এভাবেই জঙ্গলে কাটলো। পহেলী একবার অজানা আতঙ্কে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। অনীল কি বলবে ওকে, কি বলে ভরসা দেবে। কেবল ঘুম ভেঙে ওঠে অনীলের কোল থেকে পাঁচ বছর বয়েসী ছেলে অভি বললো- কাঁদছো কেনো মা, কি হয়েছে। অনীল বললো- কিছু হয়নি। তুমি ঘুমাও বাবা। সজল চুপচাপ এক কোণে বসে আছে। কি করবে ও। মুক্তি বাহিনীতে যেতে চেয়েছে, বাবা-মা দেয়নি। এভাবে চোরের মতো বেঁচে থাকতে লজ্জা করে ওর।
সকাল হয়েছে রূপপুর গ্রামে। জঙ্গলে আলোর রেখা দেখা দিয়েছে। সজল বললো- বাড়ি চলো বাবা, সকাল হয়েছে। অসীমবাবু বললেন-আরেকটু বেলা হোক, তারপর যাই। বেলা বাড়লে বাড়ি গেলো সবাই। দেখা গেলো- গোয়াল ঘর থেকে গরু ছাগল নিয়ে গেছে সব। লুটপাট করতে করতে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। কেবল প্রাণ মুঠোয় করে বেঁচে আছে দুটো পরিবার। সেই সাথে অন্য হিন্দু পরিবার গুলোও। অসীমবাবু কি করবেন, কি ভাবে চালাবেন সংসার। ঘরে অল্প চাল-ডাল আর পুকুরের মাছ ছাড়া কিছুই তো আর রইলো না। ঘরের কর্তা হয়ে তিনি কিভাবে অভুক্ত রাখেন সবাইকে। কেবল ইসমাইলের কাছে দুটো ষাঁড় ছাড়া আর কিছু নেই তার। ডাক্তারি নেই, ঘরের ধান তো আগেই লুট হয়ে গেছে। এমন সময় ইসমাইল আর রমজান এলো বাড়িতে। সবাইকে নিরাপদে দেখে ওরা স্বস্তি পেলো। ওরা বললো- বাবু আমরা এখনো বাইচচা আছি। আর এ ও বললো- বাবু এবার থেকে রাইতে রাইতে ছোটো ছোটো বাচ্চা গুলোরে নিয়ে জঙ্গলে না দৌঁড়াইয়া রাতের খাওন খাইয়া আমাদের বাড়িত গিয়ে থাকুইন। মিলিটারি নিয়া সিদ্দিক প্রতিরাতওই হামলা করবো। কতদিন এমুনভাবে চলবে। অসীমবাবু রাজি হলেন। তবে এতো গুলো মানুষকে একসাথে রাখার জায়গা রমজান বা ইসমাইলের ঘরে নেই। সে জন্য অনীলকে বাড়ির পেছনে রমজানের বাড়িতে আর তারা ইসমাইলের বাড়িতে থাকার সিন্ধান্ত নিলেন। সেই থেকে বাড়ি ছাড়া হলো সব। সারাদিন বাড়িতে থেকে রান্না খাওয়া করে কচুরিপানায় বাসন লুকিয়ে সন্ধ্যার আগেই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতো। রেলের ব্রিজের পাশেই ইসমাইলদের বাড়ি। পাশে বিশাল পাট ক্ষেত। মিলিটারির গাড়ি এলে মুক্তিরা সব পাট ক্ষেতে লুকিয়ে পড়তো। যদি ওরা টের পেয়ে যায় তবে তো আর রক্ষা নেই। ইসমাইলের পরিবার সব টুকু দিয়ে সাহায্য করেছে মুক্তিদের। তার বাবা-চাচা সবাই অসীমবাবুর বাড়িতে কাজ করেছে। কিন্তু বিপদে নিজেদের আপনজনের মতোই সবাইকে আগলে রাখতেও চেয়েছে। রূপপুর গ্রামে মিলিটারি আসার পর থেকে প্রতিটি মুসলমান বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে হিন্দু পরিবার গুলো। কেউ নিজেদের বিপদের কথা না ভেবেই আশ্রয় দিয়েছে। সবাই সিদ্দিক রাজাকারের মতো অমানুষ হয়ে যায় নি। সিদ্দিকের দলবল সন্ধ্যার পর থেকে গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে ঘুরতো। কে কোথায় আছে খোঁজ নিতো। ঘরে পেলে ধরে নিয়ে যেতো হিন্দু যুবক ছেলেদের। হাত পা বেধে ক্যাম্পে ফেলে রাখতো। তারপর যখনি মিলিটারির গাড়ি আসতো, বন্দিদের নিয়ে যাওয়া হতো খালের পাড়ে, ওখানেই গুলি করে মারা হতো সবাইকে। সিদ্দিক মিলিটারিদের কাছে প্রচার করেছিলো অনীল মুক্তিবাহিনীর লোক আর অসীমবাবু মুক্তিয়োদ্ধাদের আশ্রয়দাতা। তাই মিলিটারিদের এই বাড়ির দিকে রাগ ও নজর দুটোই ছিলো সবচেয়ে বেশি।
ইসমাইলদের বাড়িতে দেখতে দেখতে কেটে গেলো তিন মাস। তবুও অসীমবাবু দেশ ছাড়েন নি। ভেবেছিলেন সব ঠিক হয়ে যাবে। রেণু বারবার বলেছেন-চলো ছেলে মেয়ের কাছে আসামে চলে যাই, দেশের অবস্থা ভালো না। সজল আর মুক্তিকে নিয়েই আমার চিন্তা। তাছাড়া পহেলীটাও ভয়ে ভয়ে থাকে। অসীমবাবু স্ত্রীকে সাহস দিতেন-ভয় পেয়ো না, সব ঠিক হয়ে যাবে সুমিতের মা। সুমিত উনার বড় ছেলে, আর স্মৃতি বড় মেয়ে।
বিপদ কখনোই পিছু ছাড়ে না। ইসমাইলদের বাড়িতে অসীমবাবুরা আছেন সে খোঁজ পেয়ে গেলো রাজাকার বাহিনী। সে বিকেলে ইসমাইল ছুটে এলো অসীমবাবুর বাড়িতে। বললো-বাবু, সিদ্দিক জেনে গেছে আপনেরা আমাগো বাড়িত আছুইন। আমার সাথে দেখা হইছেলো, কইলো-বাবুরা তোগোর বাড়িত আছে না রে ইসমাইল। মরবি, তুই ও মরবি কিন্তু। আপনাদের কষ্ট হইলেও আজ থাইককা রমজানের বাড়ি থাহুন বাবু। না অইলে জানে বাঁচতানইন না। অসীমবাবু ইমমাইলকে অভয় দিলেন। সেদিন থেকে রমজানের ছোটো ঘরেই গাদাগাদি করে থাকতেন অনীল আর অসীমবাবুর পরিবার। আসে না, সুদিন আর আসে না দেশের বুকে। অসীমবাবু রাত জেগে জেগে ফেলে আসা দিনের কথা ভাবেন। ঘুম আসে না তার। ভাবেন সিদ্দিক কিভাবে এমন শত্রু হয়ে গেলো। চিরকালের চেনা ওদের পরিবার। ময়নাখালি রেল স্টেশানের সিদ্দিকের বাড়ি। পাশের বাজারে অসীমবাবুর ফার্মেসী। পথে আসতে যেতে সেই ছোটো থেকে সিদ্দিককে দেখছেন। ওর বাবা কতো ভালো মানুষ ছিলেন। চিরকালের চেনা মানুষ গুলো দেশের খারাপ সময়ে দেশের মানুষের পাশে না থেকে পাকিস্তানিদের গোলাম হয়ে গেছে। ভাবেন, অসীমবাবু কেবল ভাবেন, কোনো কূল খোঁজে পান না আর। দেখতে দেখতে রমজানদের বাড়িতেও দুইমাস কেটে যায়। বিপদ শেষ হয় না কারো। বেঁচে আছেন এই যেনো বেশি। কতো চেনা মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে সে খবর পান। দিনে দিনে গ্রামটাকে নরকে পরিণত করেছে সিদ্দিক। প্রতিদিন অসীমবাবুর বাড়িতে আসেন, কেবল তাদেরকেই এখনো ধরতে পারছেন না।
অবশেষে পরিবারের কথায় অসীমবাবু দেশ ছাড়তে রাজি হলেন। দেখলেন চেনা জানা সব হিন্দুরাই দেশ ছাড়ছে। তিনি একা থাকবেন বিপদ মাথায় নিয়ে কেমন করে আর। কিন্তু কারো কারো বিপদ যেনো পিছু ছাড়ে না। তাদেরও ছাড়ছে না। সীমান্ত পারি দিলেও তো টাকা লাগে। কিন্তু হাতে তো কোনো কিছুই নেই। রমজান ইসমাইল আরো অনেকের সাহায্য নিয়ে চলছেন। এমন করে আর কতোদিন। ভাবলেন ইসমাইলের কাছে যে দুটো ষাঁড় আছে তাই বিক্রি করে দেবেন। ইসমাইলের বাবা ষাঁড় দুটো নিয়ে দূরের বাজারে বিক্রি করতে যায়। সজলও যায় তার সাথে। ভাবে গ্রামের থেকে অনেক দূরের বাজারে গেলে সিদ্দিক তো আর টের পাবে না। কিন্তু রাজাকাররা যে তাকে ধরার জন্য বসে আছে সজল তা জানলো না। বাবার বারণ করা সত্তেও সে বাজারে গেলো। দুটো ষাঁড় বিক্রি হলো আড়াইশো টাকায়। যুদ্ধের বাজার, সব কিছুই দাম কম। বাজার থেকে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। এদিকে চিন্তায় অস্থির হলেন রেণু আর অসীমবাবু। রমজানও ঘর বার করছে। কিন্তু বিপদ যে মাথার উপর, কি করবেন অসীমবাবু। অনীল নির্বাক। বারবার মানা করেছিলেন সজলকে। কেনো গেলো সজল। যা হবার ছিলো হলোও তাই। সিদ্দিক রাজাকারের দলবলের সামনে পরে গেলো সজল। রূপপুরের বুকে তখন অন্ধকার নেমেছে। শিকার হাতের কাছে পেয়ে গেলো সিদ্দিক। সজলকে ডাকলো দাঁড়াতে। সজল আর কোনো উপায় না দেখে দৌঁড় দিলো। রাজাকারের দলও ছুটলো তার পিছে। প্রাণ বাঁচাতে সজল ছুটছে। সিদ্দিক পিছন থেকে বলছে-সজল দ্বারা, নইলে গুলি করমু। কিন্তু সজল ছুটছে, প্রাণ পণে ছুটছে সে। বড় রাস্তা থেকে ছোটো রাস্তায় নেমে এলোপাথারি দৌঁড়ে তাদের বাড়ির পার হয়ে সজল ছুটছে। আর পারছে না সে তবু ছুটছে। জানে ধরা পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু। বাঁচার চেষ্টা করে সে। সজল তাদের বাড়ি পার হয়ে জঙ্গল পার হয়ে খালে গিয়ে পরে। যুবক সজল নিজেকে বাঁচতে মরিয়া হয়ে ওঠে। আর সিদ্দিক তাকে ধরতে। খালে ডুব সাঁতারে সে ওপারে যেতে চায় রমজানের বাড়িতে। যেখানে তার পরিবার আছে। সিদ্দিক তাকে ধরতে না পেরে অবশেষে গুলি ছোঁড়ে। ডুব দেবার কারণে কোনো গুলি আর তার গায়ে লাগে না। কিন্তু সিদ্দিক তার লোকদেরও খালে নামিয়ে দেয়। সজল যখন ওপারে সাঁতরে ওঠে বাকিরাও ওঠে। আর পালাতে পারে না সজল। বাবা বলে ডাকতেও পারে না। সিদ্দিক যদি জানতে পরে তবে তার সাথে সবাই শেষ। তার সাথে পরিবারকে বিপদে ফেলতে চায় না সজল। বাবা মার কথা না শুনে কী ভুলই না করেছে সে। সিদ্দিকের দল সজলকে ধরে নিয়ে হাত পা বেঁধে ক্যাম্পে ফেলে রাখে। রাতে মিলিটারির গাড়ি এলে হত্যা করা হবে সজলকে। আহা, সিদ্দিকের আনন্দের শেষ নেই। এতোদিনে মনের ইচ্ছা পূরণ হয়েছে তার । তবে সজলের বাকি পরিবারও আছে এদিকেই কোথাও। ইসমাইলের চাচা ইসমাইলকে নিয়ে রমজানের বাড়ি যায় । সমস্ত খুলে বলে। দুঃখের ছায়া নামে দুটো পরিবারে। পারলেন না, অসীমবাবু তার একমাত্র সম্বলকেও বাঁচাতে পারলেন না। কান্নার রোল উঠলো নিরবে। গলা ছেড়ে কাঁদতেও পারছে না রেণু। কতো অসহায় আজ তারা। নিজের গ্রামের মানুষেরা তাদের কতো ক্ষতি করে দিলো। কিন্তু তারা তো কখনো কারো কোনো ক্ষতি করেন নি। বিপদে পড়লে কারো মাথাই আর কাজ করে না। ওদেরও কারো করে নি। ইসমাইলই বললো- বাবু আপনের বড় ছেলের বন্ধু মোক্তার উদ্দিন তো মিলিটারিদের লগে মিশছে, তারে ক্যাম্পে ধরে নিছিলোগা। হাতে পায়ে ধরে জীবন বাঁচাইছে, বলছে খবরা খবর সব দিবো তাগোর। হে তো আসলে ওগোর লগে থাহে ঠিকি কিন্তু মিলিটারিরা কই যায় না যায় সে খবর মুক্তিবাহিনীর কাছে পাঠায়। হেরে ধরে দেহন যায় কিছু করতে পারে কি না। সবার সম্মতিতে ইসমাইল রমজানরে নিয়ে মোক্তার উদ্দীনের কাছে ছুটলো। তার বাড়ি রূপপুর থেকে অনেকটা দূরে। কিন্তু ভাগ্য ভালো তাকে কাছাকাছি যেতেই পেয়ে গেলো। সব শুনে মোক্তার উদ্দীন বললো চার-পাঁচশো টাকা নিয়ে ইসমাইল যেনো তার বাবা-চাচাকে নিয়ে ক্যাম্পে আসে । সে যাচ্ছে ওখানে। যে করেই হোক সজলকে ছাড়াবে। নয়তো রাতে মিলিটারি চলে এলে ওকে আর বাঁচানো যাবে না।
ইসমাইল আবার ছুটলো। কিন্তু অসীমবাবুর কাছে তো এতো টাকা নেই। শেষ সম্বল ষাঁড় বিক্রির আড়াইশো টাকা আছে। ইসমাইলের চাচা সবুর মিয়া আর বাবা সবুজ মিয়া দুজনে মিলে বাকি টাকা দিলেন। কৃতজ্ঞতায় নুয়ে এলো অসীমবাবুর মাথা। সারা জীবন যারা তার বাড়িতে কাজ করেছে তারাই আজ আপনজনের মতো পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সাহায্য করছে নিজেদের সব টুকু দিয়ে। তিনি সবুজ মিয়ার হাত ধরে বললেন- আমার ছোটো ছেলেটারে ফিরিয়ে এনে দাও সবুজ। তোমাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ইসমাইলদের বাড়ির পাশেই ক্যাম্প। বারবার তাদের রমজানদের বাড়িতে আসা যাওয়ায় সন্দেহ হলো রাজাকারদের। তবে কি ওরা সব রমজানদের ওখানেই আছে।
সিদ্দিকের সে চিন্তা শেষ হবার আগেই মোক্তার উদ্দীনের সাথে সবুজ মিয়া আর সবুর মিয়া গিয়ে হাজির হলো ক্যাম্পে। হাত পা বাঁধা সজলকে দেখে চোখে জল এলো তাদের। ওরা ওকে মারধর করেছে বেশ। সিদ্দিকের সাথে মোক্তার উদ্দীনই কথা বললো সজলকে ছেড়ে দিতে । কিন্তু সিদ্দিক রাজি হয় না। বলে- মিলিটারিরা আইসা যদি দেখে বন্দি নাই তাইলে আমারে শেষ কইরা দিবো মোক্তার ভাই। মোক্তার সিদ্দিকের দলের সামনে সিদ্দিকের হাতে পাঁচশো টাকা তুলে দিয়ে বললো- চাচার একমাত্র সম্বল সজল। আমার কাছে টাকা দিয়ে পাঠাইছে, উনার আর কোনো কিছু নাই। ছাইড়া দে ওরে । মিলিটারি গো আমি যে ভাবেই হোক বোঝাইবো। পাঁচশো টাকা যুদ্ধের বাজারে অনেক। টাকা পেয়ে সিদ্দিক আর অমত করে না। ছেড়ে দেয় সজলকে। নতুন জন্ম পেয়ে সজলের উত্থলে আসতে থাকে কান্না। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছে সে। সবুজ মিয়াদের সাথে রমজানের বাড়ি ফিরে সজল। আর এদিকে মিলিটারির গাড়ি আসে রোজ রাতের মতো বন্দিদের ধরে নিয়ে হত্যা করার জন্য। কিন্তু আজ এসে আর কাউকে না পেয়ে খুব খেপে যায় ওরা। সিদ্দিকের কাছে জানতে চায় বন্দি কোথায়। সিদ্দিক যখন আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যায় তখনই মোক্তার উদ্দীন বলে- স্যার, ওই সামনের হিন্দু বাড়ির পোলাডাই তো। ময়নাখালী খালের নিচে দেইখ্যা আইছি মইরে পরে আছে। সিদ্দিকেরাই তো গুলি করে মারছে ওরে। আমি নিজে দেইখ্যা আইছি স্যার। বাজারে গেছলাম ফেরার পথে দেখলাম। সিদ্দিকও মোক্তারের কথায় সায় দেয়। সে বারের মতো সজল বাঁচলেও মিলিটারিরা ক্ষেপে থাকে অসীম অনীল দুই ভায়ের উপর। বলে রাতের মধ্যে ওদের দুজনকে ধরে আনতে। না হলে সিদ্দিককে শেষ করে দেবে।
মোক্তার উদ্দীন এটা ওটা বলে ক্যাম্প থেকে বের হয়। ইসমাইলের চাচাতো ভাই মনিরুলকে পায় রেলের পারে। ওকে দিয়ে খবর পাঠায় দ্রুত যেনো ইউনিয়ন ছাড়ে অসীমবাবুর পরিবার। তা না হলে আর রক্ষা নেই। মনিরুল খবর নিয়ে যায় রমজানের বাড়িতে। সব জানায় অসীমবাবুকে। রমজান বললো- বাবু দ্রুত চলেন, রূপপুর আর থাকা যাইবো না। আমি কিছু টাকা দেই, আর তাড়াতাড়ি দেশ ছাড়ার চেষ্টা করুইন। ইসমাইলেরা ওখানেই ছিলো। ইসমাইলের বউ মোক্তার উদ্দীনের সব কথা শুনেছিলো ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে। সে তার জমানো একেবারেই অল্প কিছু টাকা বড় ছেলেকে দিয়ে খুব সাবধানে পাঠায়। জানে বাবুদের হাত খালি। অসীমবাবু কি করবেন আর। জানেন না এ ছুটার শেষ কোথায়। রমজান তাদের সাথে রওনা হলো। ইউনিয়ন পাড়ি দেওয়া অল্প সময়ে সম্ভব নয় বলে জানায় সে। তবে গ্রামের শেষে তার এক আত্মীয়ের বাড়ি আছে, ওখানে নিয়ে যাবে সবাইকে। ওখানেই তাদের রেখে এসে আরো টাকা পয়সার ব্যবস্থা করে পাঠাবে।
সজলকে ধরে নিয়ে গেছে শুনে ভবতোষ এসেছিলো মাকে নিয়ে। সাত বছরের নমশুদ্র ছেলে ভবতোষ। তার আরো সাত ভাই আছে। ছোটো থেকেই মুক্তিদের বাড়িতে থাকে ও। মুক্তিকে খুব ভালোবাসে। নিজের বোন নেই, মুক্তি যেনো ওর নিজের বোন। মুক্তিও খুব আদর করে ওকে। ভবতোষের মা ওকে অসীমবাবুর সাথে দিয়ে দেয়। বলে-বাবু, ওরে নিয়া যান, আপনেরা বাঁচলে ও বাঁচবো। অসীমবাবু সাথে নিলেন ভবতোষকে। নিজেদের বিপদেও স্নেহের টান উপেক্ষা করতে পারলেন না। সে রাতেই রূপপুরের আশ্রয় শেষ হলো তাদের। হাঁটতে হাঁটতে কতো রাস্তাই আর পাড়ি দেওয়া যায়। বিপদে যেনো রাস্তার দূরত্ব্ও বেড়ে যায়। পথ শেষ হয় না। এতো গুলো মানুষের দায়িত্ব অসীমবাবুর কাঁধে। তিনি ছুটছেন। প্রাণ পণে ছুটছেন। ছোটো মেয়ে সুপ্তি রমজানের কোলে আর কাঁধে অনীলের ছেলে অভি। মেয়েটা অনীলের কোলেই। বাকি সবার কাছেই কাপড়ের পুটলি। ভবতোষ মুক্তির সাথে সাথে যাচ্ছে। তার মাথায়ও একটা পুটলি। সবাই ছুটছে অজানা এক গন্তব্যে। এ চলার শেষ নেই যেনো। পুরো বাংলাদেশটা ছুটছে তাদের সাথে। দেশের আজ এক রূপ, একি দুর্যগ। কেবল রূপপুর নয়, বাংলাদেশটাই যেনো দুঃখে যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। কতো সব ভাবনা মাথায় করে চলেছেন অসীমবাবু। অবশেষে রমজান এসে পৌঁছায় গ্রামের শেষে সলিমদ্দির বাড়িতে। ওখানেই তাদের রেখে আবার বাড়ির পথ ধরে রমজান। খাওয়া নেই, জীবন বাঁচানোটাই সব থেকে বড় এখন। বাচ্চা গুলো খিদে পেলে কাঁদে। সলিমদ্দিরা নিতান্তই গরীব। এতো গুলো মানুষকে খাওয়ানোর ক্ষমতা তাদের নেই। অসীমবাবুরাও খেতে চাইলেন না। তিন দিন তিন রাত কাটলো। সলিমদ্দির বউ চাল ভেজে দিলেন খাওয়ার জন্য। বাচ্চা গুলোকে নিয়ে মুক্তি খেলো। আর সবাই অভুক্ত। হায় সময়, কতো বিত্তশালীকেও এমন নিঃস্ব করে দিয়েছে। কিন্তু বিপদ যেনো তাদের পিছু ছাড়বে না বলে ঠিক করেছে। রাজাকারের দল আবার উঠে পরে লেগেছে তাদের খোঁজে। ওরা যে সলিমদ্দির বাড়িতে আছে তাও টের পেয়ে যায়। ইসমাইল আর রমজানের জন্য অপেক্ষা করছেন অসীমবাবু। দশ-বিশ টাকা নিয়ে তো আর দেশ ছাড়া যায় না। ওদিকে অভুক্ত সব। ইসমাইল আসে অল্প টাকা নিয়ে। ওরা সব গরীব চাষী। সবার কাছে এতো টাকা কোথায়। এটা ওটা বিক্রি করে দিয়ে টাকার জোগার করে ইসমাইল গেলো সলিমদ্দির বাড়িতে। নিজেদের প্রাণ তুচ্ছ করে দিয়ে ওরা পাশে থাকছে। এর থেকে আর কি আছে পাওয়ার। ইসমাইল এসে জানালো সিদ্দিক দল বল নিয়ে বড় রাস্তা ধরে আসছে। সে অন্ধকারে ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে দৌঁড়ে এসেছে। এখন আবার কোথায় ছুটবেন তারা। শরীরের শক্তিও কমে আসছে। আর তো পারছেন না। অনীল বললো- দাদা, সাতগাঁও সুমিতের এক বন্ধু ছিলো না, পাগল হয়ে যায় মাঝে মাঝে। সাদেক, সাদেকের বাড়ি চলো। সাতগাঁও দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে তারপর সীমানা পার হওয়া যাবে। চলো, ওখানেই চলো।
কিন্তু আবার ছোটো বাচ্চা গুলোকে নিয়ে এই চার পাঁচ মাইল হাঁটা তো সহজ কথা নয়। কি করবেন অসীমবাবু। ইসমাইল চললো সাথে। চলুন বাবু, আর বইসা থাকবাইন না। ওরা তো আসলো বইলা।
আবার ছুট শুরু হলো। রেণু, পহেলী ওরা কেমন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। সজল ও চুপচাপ। জানে না কেউ এর শেষ কোথায়। পারবেন তো সীমানা পাড়ি দিতে। মুক্তি ইসমাইলকে কুঁয়ো থেকে বাসন গুলো তুলে তাদের বাড়ি নিয়ে রাখতে বললো। আর কোথায় কি আছে সব বলে দিলো। ইসমাইলের সাথে এই শেষ দেখা , আর তো দেখা হবে না। অসীমবাবু বললেন-ইসমাইল বাড়ি ঘর দেখিস, জমি জমা সব রমজানকে নিয়ে চাষ বাস করিস। সাবধানে থাকিস সব। আমাদের জন্য যা করলি আর কি বললো তোদের। দেবদূতের মতো তোরা বিপদে এসে হাজির হয়েছিস বারবার। পথ চলতে চলতে কতো কথাই হলো। ভোর রাতে ইসমাইল তাদের পৌঁছে দিলো সাদেকের বাড়ি। সাদেকের বউ মরিয়ম তাদের পরম যত্নে আগলে রাখলো কয়দিন। তাদের চাল ডাল দিয়ে দিলো যেনো নিজেরাই রান্না করে খেতে পারে। সাদেকের মাঝে মাঝেই পাগল হয়ে যাবার সমস্যা। এ নিয়ে ভয়ে থাকেন মরিয়ম। তার নিজের ছয়টা ছেলে মেয়ে। পাগলের সংসার খুব সুখেরও নয়। নিজেও খুব একটা স্বচ্ছল নয় তারা। তবু সবাইকে যতোটা পেরেছে যত্ন করেছে সে। একবেলা খাবার তুলে দিয়েছে মুক্তিদের পরিবারে। অসীমবাবুকে সে বাবা ডাকে। শ্রদ্ধা করে। সাদেকের সাথে কয়েকবার গিয়েছেও তাদের বাড়ি। রেণু কতো যত্ন করেছে তাকে। কতো কিছু দিয়ে পাঠাতো একে ওকে দিয়ে। সে সব ভুলে যায় নি মরিয়ম। এই বিপন্ন সময়েও কৃতজ্ঞতা মরে যায় নি একেবারে।
অসীমবাবু টাকার চেষ্টা করছেন। অনীল চাকরি ছেড়ে খালি হাতেই বাড়ি ফিরেছিলো। তখন থেকেই সব সামলাচ্ছেন অসীমবাবু একাই। জমানো টাকা পয়সা যা ছিলো ডাকাতেরা নিয়ে গেছে। বাকি টাকা ছেলেকে ছাড়াতে চলে গেছে। নিজেকে বড়ো অসহায় লাগে তার। পরিবার নিয়ে অন্যদের দয়ায় খেয়ে না খেয়ে বেঁচে থাকা। সাদেকের বাড়ি আছেন বেশ কয়েকদিন হলো। অল্প টাকায় ভরসা করে দেশ ছাড়তে পারছেন না। বাড়ির কোনো খবর আর পান না। ইসমাইল রমজান ওরা কেউ আসে না। খুব অভিমান হয় তার ওদের উপর। কিন্তু তিনি জানেন না ওদের গতিবিধির উপর নিয়মিত লক্ষ্য রাখছে রাজাকারের দল। ভেবে ভেবে কোনো কূল পান না তিনি। রেণু বারবার করে বলছেন- চলো আগে ও দেশে যাই, ছেলে মেয়ে আছে সমস্যা হবে না কোনো।
বিপদ তো সত্যিই এই পরিবারের পিছু ছাড়ছে না। একটু নিরাপদ আশ্রয়ও যেনো থাকতে নেই। সময় খারাপ গেলে এভাবেই যায়। অসীমবাবুর পরিবার জানে না রাজাকারের দল তাদের এই সন্ধানও যোগার করে ফেলেছে। সাদেক পাগল, মাঝে মাঝেই তার পাগলামি বাড়ে। কথায় কথায় কার সাথে সে বলেছে তার বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া অসীমবাবুদের কথা। সে খবর চলে গেছে সিদ্দিকদের কাছে। সাদেকের এই কান্ড মরিয়ম টের পেয়ে যায়। তাদের বাড়িতে সন্ধ্যায় যে মিলিটারি হামলা করবে তাও সে জানতে পারে। কি করবে সে, আশ্রিতদের কিভাবে আর নিরাপদে রাখবে। নিজেদেরই নিরাপত্তা কোথায়। তখন শ্রাবণের সন্ধ্যা। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। মরিয়ম যায় অসীমবাবু কাছে, তার পা ধরে বলে- বাবা, আপনেরা চলে যান, আমাদের আর বিপদে ফেলায়েন না। দয়া কইরা চইলা যান। আমি পাগলের সংসার করি, কোন সময় সে কি কইরা বসে ঠিক নাই। চইলা যান বাবা।
মরিয়মের এই ব্যবহার সবাইকে অবাক করলো। অসীমবাবু খুব কষ্ট পেলেন। যাদের আশ্রয়ে আছেন তারা এমন ব্যবহার করে চলে যেতে বলছে। চলে তো তিনি যাবেনই, কেবল কিছু টাকার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ভাবলেন কালই চলে যাবেন। কিন্তু মরিয়ম নাছোড়বান্দা। আজকেই চলে যেতে হবে। মরিয়মদের বাড়ির পেছনে বিশাল বিল। ও বিলে সব সময় নৌকা থাকতো। মানুষ এই বিল দিয়েই দেশ ছাড়তো আচস্মিতা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প হয়ে। বৃষ্টিও বাড়ছে। এদিকে মরিয়ম চলে যাবার তাগিদ দিচ্ছে। রেণুরও রাগ হলো। তিনি বললেন- কি হয়েছে বউমা, আমায় বলো তো শুনি। তুমি হঠাৎ এমনভাবে চলে যেতে বলছো কেনো।
মরিয়ম তখন বললো- মা, আপনেরা যে এই বাড়িতে আছুইন সে খবর পাঞ্জাবিরা পায়ালাইছে। ওরা নাকি সন্ধ্যায় আইবো। তাই কইতাছি আপনেরা যাইন গা।
আর দেরি করলেন না অসীমবাবু। সবাইকে তারা দিলেন উঠতে। যা হয় হোক, যা আছে তাই দিয়েই চলে যাবেন। আর থাকা নিরাপদ নয়। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। ওরা যেকোনো সময় চলে আসতে পারে। মরিয়ম নিজের কিছু টাকা লুকিয়ে দিয়ে দিলেন মুক্তির হাতে। ওরা জানলে হয়তো নিতে চাইবে না। মুক্তি তখন যুবতী, শাড়ি পরে সব সময়ই। ওকে নিয়েই বেশি চিন্তা করেন অসীমবাবু। বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার বাইরে। সজল বাড়ির পেছনে বিলে গিয়ে একটা নৌকা দাড় করিয়ে এসেছে। বেশ বড় নৌকা। আরো লোক আছে তাতে। এই দুর্দিনে সবাই তো সবার সমব্যথি। মাঝি লোকটি তাড়াতাড়ি আসতে বলে নৌকা দাঁড় করালো। বললো- বেশি সময় দাঁড়ানো নিরাপদ নয়। সজল এসে বের হতে বললো সবাইকে। ওরা যখন বের হচ্ছে, তখনই রাস্তায় মিলিটারিদের পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেলো। আঁতকে উঠলো সবার বুক। খুব বেশি দূরে নয় ওরা। মরিয়ম বলে উঠলো- আপনেরা তাড়াতাড়ি দৌঁড় দেইনা কেরে। ঘরের পিছেই তো নৌকা। যাইন তাড়াতাড়ি। ওরাও যন্ত্র চালিতের মতো দৌঁড়ালো। বারান্দা পার হয়ে ঘরের পিছন দিয়ে গিয়ে বহু কষ্টে সব নৌকায় উঠলো। আলো জ্বালাবার কোনো পথ নেই। অন্ধকারই এখন একমাত্র বাঁচার উপায়। যতো অন্ধকার ততো সুবিধা। নৌকায় উঠেই অসীমবাবু বললেন-মাঝিরা, তাড়াতাড়ি নৌকা বিল পার করাও। এ বাড়ি মিলিটারিতে ভরে গেছে। এদিকে আসলে আর রক্ষা নেই। সবার বুকের ভিতর গুলো ভয়ে ডিবডিব করছে। কেউ জানে না কি হবে তাদের সাথে । আতঙ্ক তো পিছু ছাড়ছে না। অসীমবাবু ভাবলেন- নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে পড়তে পড়তে বহুবারই বেঁচে গেলেন। ঈশ্বরের মতো কেউ না কেউ এসে বাঁচিয়ে দিয়েছে তার পরিবারকে । এবার আর দেশ ছাড়তে কোনো বিপদ হবে না।
ওদিকে সাদেকের ঘর ভরে গেলো মিলিটারি আর রাজাকারে। সবাই ওদের খুঁজছে। সিদ্দিক বললো- ওরা সব কই, এহানেই তো আছিলো। মরিয়ম বললো- ওরা আছিলো ঠিকি কিন্তু আইজ সকালেই গেছে গা। সাদেক তখন বাড়ি নেই। এসবের খোঁজ সে রাখে না। সিদ্দিক মরিয়মের কথা বিশ্বাস করে মিলিটারি বাহিনীকে বুঝিয়ে বললো। ওরা চলে গেলো আপসোস করতে করতে।
নৌকার গন্তব্য লক্ষীগঞ্জ বাজার। সেখান থেকে হেঁটে আচস্মিতা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। নৌকা চলছে। প্রাণপণে মাঝিরা নৌকা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাত তখন বারোটা। সুনসান নিরবতার মধ্য দিয়ে নৌকা লক্ষীগঞ্জের ঘাটে ভিরে। একটু গেলেই ক্যাম্প। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো যাত্রীরা। কিন্তু বিপদ যে কোনো ভাবেই যাচ্ছে না অসীমবাবুদের পরিবারের উপর থেকে। সবাই নেমে যখন হাঁটছে তখন আবার ডাকাত দলের হামলা হলো সমস্ত যাত্রীদের উপর। সবার মাথায় কাপড়ের পুটলি। কেড়ে নেওয়া হলো যা কিছু ছিলো। কেবল ভবতোষের পুটলিটা বেঁচে গেলো। আর বেঁচে গেলো মুক্তির পেটিকোটে লুকিয়ে রাখা টাকা আর গয়না। সজলের মাথার পুটলি টান দিয়ে নিতে পারেনি বলে ওর মাথা বরাবর রামদার কোপ বসিয়ে দিলো কেউ এক জন। অন্ধকারে পুটলি বরাবর ঘেসে কোপটা চলে গেলো। আবারো প্রাণ বেঁচে গেলো সজল। এই চিৎকার চেচামেচি শুনে মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ফায়ার করতে করতে এগিয়ে এলে পালিয়ে যায় ডাকাত দল। ততক্ষণে যে টুকু সম্বল ছিলো কাপড় চোপর টাকা সমস্তই আবার হারালো অসীমবাবুর পরিবার। নিঃস্ব হতে হতে তারা আরো নিঃস্ব হয়ে গেলো। তবু আবার মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচলো ছেলেটা। এই যা শান্তি অসীমবাবুর পরিবারের সকলের। অসীমবাবু কেবল ভাবছেন, আজ বাংলাদেশের কোনো অংশই আর মানুষের জন্য নিরাপদ রইলো না।
সারারাত আচস্মিতা স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে কাটলো তাদের। খাওয়া নেই। বাচ্চা গুলো কেমন নেতিয়ে পরেছে। কথা বলার মতো শক্তি নেই কারোর। পরদিন সকালে ক্যাম্প থেকে কয়েকজন লোক সমস্ত শরণার্থীদের নিয়ে রওনা হয়। কিছুদূর গিয়ে ওরা বিন্দু ডাক্তারের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সারাদিন ওখানেই কাটে। ডাক্তারের বাড়ি থেকেই খাবার জোটে সবার। অনাহারি মানুষ গুলো কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে । রাত দশটায় নৌকা ছাড়ে। কতো নদী হাওর পেরিয়ে সারারাত নৌকা চলছে। অসীমবাবু নৌকার এক কোণে চুপচাপ বসে আছেন। মুক্তি তাকে ভরসা দিচ্ছে- বাবা, চিন্তা করো না, আমার কাছে টাকা আছে নাও। কিন্তু তিনি বললেন- তোর কাছেই রাখ, দরকারে চেয়ে নেবো। টাকা আছে মুক্তির আছে। কিছুটা সাহস পেলেন অসীমবাবু। নৌকা গিয়ে পরদিন সকালে পৌঁছায় কুমিল্লায়। ওখানে নারইরের নুরু মেম্বারের বাড়িতে উঠে সবাই। তাদের মতো হাজার হাজার মানুষ নুরু মেম্বারের বাড়িতে। কোথাও দাঁড়াবার জায়গাটুকুও নেই। থেকে থেকে বৃষ্টিও হচ্ছে। আবার নৌকা ছাড়বে রাতে। সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছে নিজেরা পারলে খাবারের ব্যবস্তা করে নিতে। এখানে আর খাবার পাওয়া যাবে না। রেণুর শাড়ির গিটে অল্প কিছু টাকা ছিলো। অসীমবাবুকে সে টাকা দিয়ে তিনি চাল-ডাল-লাকরি আনতে বললেন। ভবতোষের পোটলায় একটা তাওয়া ছিলো, ওটা নিতে পারেনি। অসীমবাবু অনীলকে নিয়ে বের হয়ে এসব কিনে আনলেন পাশের দোকান থেকে। তারপর ইট পেতে রেণু চাল আর ডাল ফুটিয়ে নিলেন। সজল কোথা থেকে কলাপাতা জোগার করে আনলো। জায়গা নেই, বারান্দার ঢালে দাঁড়িয়ে সেই খাবারই অমৃতের মতো খেলো পুরো পরিবার। এই অজস্র মানুষের কোলাহলে অসীমবাবু দেখলেন, আজ সবাই সবার আরো আপন হয়ে উঠেছে। দুঃখ সবাইকে সঙ্ঘবদ্ধ করেছে। এই বিপদ যেনো সবার বিপদ। আবার রাতের বেলায় যাত্রা শুরু হলো। এর যেনো শেষ নেই কোথাও। যাবার পথে বিশাল একটা ব্রিজ পরে। তার উপর টহল দেয় মিলিটারিরা। সারা পেলে ব্রিজের উপর থেকে ব্রাশ ফায়ায় করে সব শেষ করে দেয় ওরা। সজলদের নৌকার মাঝি বারবার করে বলেছে যেনো কেউ শব্দ না করে ব্রিজের নিচে দিয়ে যাবার সময়। পরপর চারটা নৌকা। প্রথমেই সজলদের নৌকা পার হয়। তারপর আরেকটা নৌকা পার হয়। তারপরের দুটো নৌকাতে একটিতে সব পুরুষ আরেকটিতে সব মহিলা ছিলো। পুরুষদের নৌকা যেই ব্রিজের নিচে এলো তখনি মিলিটারির গাড়ি এলো টহল দিতে। ছোটো একটি ছেলে বাবার কোলে ঘুমিয়ে ছিলো। ঘুম ভেঙে মা বলে চিৎকার করে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে উপর থেকে ব্রাশ ফারায় হলো। সব শেষ। একটি প্রাণিও আর বাঁচলো না সেই নৌকায়। মহিলাদের নৌকাটি আর এগুলো না। মিলিটারি দল চলে যেতেই কান্নার রোল উঠলো। সজলদের নৌকা তখন অনেকটা দূরে। ওদের বুকের ভিতর কি হচ্ছে সে কেবল ওরাই জানতো। ভয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠলো এ নৌকার মহিলারা। রেণু কাঁদতে গিয়ে বললেন- আর যে কি করতে সইতে হবে কে জানে। অসীমবাবুর কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। ভাবলেন তাদের নৌকায়ও তো ঘটতে পারতো ঘটনাটা। কি দৃশ্য দেখলেন তিনি। বারবার ভাগ্যই তাদের প্রাণে বাঁচিয়ে দিচ্ছে হয়তো।
নৌকার মাঝি গুলো মৃত সঙ্গীদের জন্য কাঁদছে । এক বৃদ্ধ মাঝি বলছে-ইস, শেষ বয়সে কি দৃশ্যডাই না দেহাইলো আল্লাহ। চোখের সামনে এতো গুলান মানুষ মাইরা ফেলাইলো। কতোকালের চেনা মাঝি গুলোও মইরা গেলো। কইলাজ বিন্দে,সইয্য অয় না আর। কিছুই তো করতে পারলাম না। কি দাম এই জীবনডার। যে কোনো দিন মাইরা ফেলাইবো হালারায়। পক্কির মতন মানুষ মারতাছে। কি দোষ করছে দেশের মানুষ। হারাডা জীবন পাকিস্তানীরা আমাগো পায়ের তলে রাখতে চাইছে। অহন শেখ মুজিবরে মুক্তির ডাক দিছে, মানুষ ঝাপাইয়া পড়ছে যুদ্ধে। মুজিবরেরও হুনচ্ছি কোনো খবর নাই। আল্লাহ দেশটারে হালারা ছাড়খার কইরা দিতাছে, তুমি এর বিচার কইরো। আর যেনো এমুন দৃশ্য দেহন না লাগে।
রাতের অন্ধকার কেটে কেটে নৌকা চলছে তার গতিতে। কতো দুঃখ শোক আর রক্ত জমা পরে থাকছে নৌকার পাটাতনে, গলুইয়ে, বৈঠায় গায়। কোনো দিনও যা মুছে যাবার নয়। নদীর জল রক্ত দেখতে দেখতে বালিতে মুখ লুকোতে চায়। মুক্তি আসুক, মানুষ বেঁচে থাকুক স্বাধীন দেশে এই চাওয়া সম্বল করে প্রতিদিন দেশ ছাড়ছে হাজার হাজার মানুষ। লম্বা হচ্ছে দুঃখের স্মৃতি, সময়টা যদি এই বর্বরতাকে এক তুড়িতে শেষ করে দিতো।
অবশেষে ভোর বেলায় মাঝিরা তাদের গন্তব্যে পৌঁছালো। যে দায়িত্ব তাদের কাঁধে তা নিজেদের জীবন দিয়ে পালন করছে তারা। এতো গুলো মানুষকে নিরাপদে পৌঁছে দিতে পারাটা কম সুখের নয় আজ তাদের কাছে। নৌকা ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে ভিরলো মাধবদি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সবাই। এখানে সবাই নিরাপদ। আর কোনো ভয় নেই। অসীমবাবু এখনো চুপ হয়ে আছেন। রাতের সেই দৃশ্য এখনো লেগে আছে তার চোখে। ভুলতে পারছেন না সেই নৃশংসতা। সবাই যখন নামছে বৃদ্ধ মাঝিটি তাকে বললো- বাবু নামেন অহন। আর কুনু ভয় নাই। হারাডা রাইত তো কেমুন গুম অইয়া বইয়া রইছেন আমি দেখছি। কষ্ট অওনেরই কথা। অসীমবাবু তাকে বললেন- মিয়া নিরাপদ জায়গার জন্য দৌঁড়ালাম গত কয়টা মাস। শুধু ভাবছি এতো কালের চেনা নিজের দেশটা আর আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। এর চেয়ে আর কষ্ট কী হতে পারে। নিজের ভিটায় কবে ফিরতে পারবো তাও তো জানি না।
সবারই যাবার তাড়া। কেউ সঙ্গী ছাড়ছে না। একা হলে আবার কোন বিপদে পড়ে। অনীলের ডাকে অসীমবাবু মাঝিকে সবাধানে থাকতে বলে চলে এলেন। এবার হাঁটার পালা। কোনো যানবাহন নেই। মাধবদি থেকে তিন মাইল হেঁটে সবাই আগরতলা পৌঁছায়। সেখান থেকে যে যার মতো চলে যায়। অসীমবাবু একদিন বিশ্রাম নিতে চাইলেন পুরো পরিবার নিয়ে। কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখলেন কলেরার মহামারী। মানুষ মরছে । কান্নায় বাতাস ভারি হচ্ছে। এই শোক যেনো থামার নয়। শান্তি কোথায় মানুষ। কিছুতেই যেনো শান্তি নেই। অসীমবাবু আর দেরি করলেন না। তাকে পরিবার নিয়ে নিরাপদে যেতে হবে। ছোটো ছোটো বাচ্চা গুলোকে বাঁচাতে হবে। অসীমবাবু অনীলকে পাঠালেন কিভাবে যাওয়া যায় তা দেখার জন্য আর নিজে একটু চাল ডাল কিনতে গেলেন। নিরাপদ জায়গায় রেণু আবার ইটের উপর তাওয়ায় চাল ডাল ফুটালেন। তা সবাই খেয়ে যাবার জন্য তৈরি হলো। অনীল একটা ট্রাকের ব্যবস্থা করলো। ট্রাকে উঠেই সবাই আসামের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। ওখানে অপেক্ষা করে আছে অসীমবাবুর বড় ছেলে সুমিত আর মেয়ে স্মৃতি। যাচ্ছেন, অবশেষে তারা নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছেন। অসীমবাবুর ছেলে মেয়ে ভেবেছিলো কেউ আর বেঁচে নেই। দেশ থেকে সবাই আসে কেবল তাদের পরিবারই আসে না। ছেলে সুমিত প্রতিদিনি তাদের খুঁজতে যেতো বড় রাস্তায়। এই বুঝি এলো তার পরিবার। কিন্তু প্রতিদিন নিরাশ হয়ে ফিরতো সে। কিন্তু যেদিন সত্যিই তার পরিবারকে খুঁজে পেলো সে আনন্দ আর দেখে কে। ভাই বোনে বাবা-মাকে পেয়ে আনন্দে কাঁদলো। বেঁচে আছে, ওরা সব বেঁচে আছে।
আসামে অসীমবাবুদের ছয়মাস কাটলো। মেয়ে জামাইয়ের ঔষধের ফামের্সী ছিলো। তিনি নিজেও বসে থাকলেন না। তার মেয়ে জামাইয়ের ফার্মেসীতে বসতেন। রোগি দেখতেন। তার হাত প্রসিদ্ধ ছিলো। টাকা পয়সার আর অভাব হলো না। আসলে এতো গুলো মানুষ নিয়ে মেয়ের উপর তিনি বোঝা হতে চাইলেন না। এভাবেই কাটছিলো দিন। বহু নদীর বুক রক্তে ভাসিয়ে, বাংলাদেশটাকে কেটে ছিঁড়ে, যুদ্ধও একদিন কালের নিয়মে শেষ হলো। এবার ফিরতে চাইলেন অসীমবাবু। মেয়ে আর ছেলের অনুরোধে থেকে গেলেন আরো মাস তিনেক। কিন্তু তার মন পড়ে থাকে রূপপুরে। কেবল ভাবেন, না জানি কে কেমন আছে। চেনা মানুষ গুলোকে গিয়ে যেনো দেখতে পান এই তার আশা। ঘর বাড়ির কি হাল হয়েছে কে জানে। রমজান, ইসমাইল ওরা কেমন আছে তা জানার জন্য ছটফট করেন তিনি। ওদের জন্যই তো আজো বেঁচে আছেন পরিবার নিয়ে।
তখন ফাল্গুন মাস। শীত পার হয়ে বসন্ত এসছে দুই বাংলাতেই। রক্তের দাগ হৃদয়ে রেখে নতুন করে দাঁড়াচ্ছে দেশ। এবার ফিরে যাবার জন্য তৈরি হন অসীমবাবু। আর দেরি করবেন না। ছেলে মেয়ের কাছে বিদায় নিয়ে তিনি আবার যাত্রা করলেন কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে। বহুকালের চেনা তার রূপপুর গ্রাম, তার আপনজনদের কাছে। যেতে যেতে কেবল ভাবেন না জানি কতো দূর আর রূপপুর। কেনো শেষ হয় না পথ।
পুরো পবিবার নিয়ে অসীমবাবু চিরোচেনা ময়নাখালী স্টেশনে নামলেন। আহা, কতো দিন পর তিনি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন। বড় শান্তি পেলেন যেনো। তিনি সবাইকে নিয়ে স্টেশান থেকে চেনা পথ ধরলেন। ফাল্গুনের সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে। সন্ধ্যা নামছে। পিছন থেকে কে যেনো বাবু বলে ডাকলো। সে ডাকে পেছন ফিরলো সবাই। অল্প আলোতে দেখা গেলো কেউ একজন দৌঁড়ে আসছে তাদের দিকে। তার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। সে কাছে এসে বাবু বলে অসীমবাবুর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। অসীমবাবু ইসমাইল বলে তাকে আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। এই যুদ্ধ মানুষকে মানুষের আরো আপন করে দিয়েছে। উঁচু নিচুর ভেদ ভুলিয়ে দিয়েছে। ইসমাইল, অসীমবাবুর বড় স্নেহের ইসমাইল। আবেগে আনন্দে প্রিয় মানুষদের কাছে পেয়ে কিছুক্ষণ নিরব হয়ে রইলো ইসমাইল। তারপর হেঁটে যেতে যেতে জানালো গ্রামের খবর। অসীমবাবুদের একটি ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে রাজাকারেরা। বাকি ঘরের চাল ছাড়া আর কোনো কিছু নেই। ঘরের আসবাব তো দূর বেড়া গুলোই নেই। অঘ্রাণের ধান সে আর রমজান মিলে করেছে। বাড়ি গেলে দিয়ে যাবে সেই ধান চাল। গ্রামের জীবিত মৃত সবার খবর দিলো সে। স্কুল মাস্টার নিখিল সরকার আর তার ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে খুব দুঃখ পেলেন অসীমবাবু। নিখিল তারচে বয়সে ছোটো ছিলো, কিন্তু ভালো সম্পর্ক ছিলো তার সাথে । সেই নিখিল নেই। এতো দিনের কথা জমা পরে আছে ইসমাইলের। কোনটা রেখে কোনটা বলবে সে।
কিছু দূর এগিয়ে তিন রাস্তার মোড়ে একটি নতুন কবর দেখতে পেলো সবাই। কবর দেখে অসীমবাবুর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। তিনি ইসমাইলের দিকে তাকালেন। কিছু বলছে না সে। কেবল মুচকি হাসছে। কিছুটা বিরক্তই হলেন অসীমবাবু। কিছু না বলে কেনো হাসছে ইসমাইল। তিনি আবার কবরের দিকে মনযোগ দিলেন, দেখলেন কবরের উপর একটি সাইনবোর্ডে দেওয়া আছে। সেই আলো আঁধারিতে দূর থেকে বড় ঝাপসা ঠেকছে সাইনবোর্ডে লেখা অক্ষর গুলো। যতো এগুচ্ছেন তত স্পষ্ট হচ্ছে। অবশেষে খুব কাছ দিয়ে যেতে যেতে দাঁড়ালেন অসীমবাবু। দাঁড়ালো সবাই। আর অবাক হয়ে দেখলেন সাইনবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লেখা- আমি সিদ্দিক রাজাকার। এই কবরের মাটিও আমাকে ক্ষমা করেনি…
অথই নীড়-কবি। প্রকাশিত বই-নিঃসঙ্গ রাতের ঝিনুক।