রুমা বাবা মায়ের সাথে ঢাকায় থাকে। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী এবং সবচেয়ে বড় শহর। তাই ঢাকা শহরকে বলা হয় ‘মেগাসিটি’। ঢাকার এক ক্লিনিকে দশ বছর আগে রুমার জন্ম। বলতে গেলে ঢাকাই রুমার জন্মস্থান। রুমার বাবা আনোয়ার হোসেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সুইপার। পুরো নাম আনোয়ার হোসেন হলেও সবাই তাকে আনার বলে ডাকে। খুব ছোট্ট চাকরি। সারাদিন ডিউটি করতে হয়। ময়লা আবর্জনা নিয়ে কাজকর্ম। খুব দুর্গন্ধ। কিন্তু এখন নাকে সব সয়ে গেছে। আনারের বেশি লেখাপড়া নাই। ফাইভ পাশ মাত্র। তবে বাংলা পড়তে পারে। ইংরেজি বর্ণগুলো চেনে, বানান করেÑ তবে উচ্চারণ করতে পারে না। আনারের এ চাকরিটি বেশি দিনের আগের নয়। বছর তিনেক হলো সে এখানে এসেছে। আগে মিরপুরের কালসিতে থাকত। বিহারি ক্যাম্পের পাশের বস্তিতে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আটকেপরা বিহারিরা আর তাদের দেশে ফিরতে পারে না। ভারতীয় উপমহাদেশের বিহার অঞ্চলের অধিবাসীদের বলা হয় বিহারি। এদেশে তাদের থাকার জন্য জাতিসংঘের অনুরোধে মিরপুরে একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়, এই ক্যাম্পের নাম বিহারি ক্যাম্প।
সে এক যুগ আগের কথা। তখনও আনার বিয়ে করে নাই। ব্যাচেলর জীবন। সারাদিন রিক্সা চালিয়ে রাতের বেলা ঘরে ফিরত। ঘরে আসবাবপত্র বলতে তেমন কিছুই নেই। একটি সেকেন্ডহ্যান্ড চৌকি, পাশে একখানা টেবিল। চেয়ার নাই। চৌকিতে বসেই চেয়ারের কাজ চলে। স্টোভ, থালাবাসন, একটি মাটির ব্যাংক, মেটে কলসি, ফুটপাত থেকে কেনা জামাকাপড়, চাল, ডাল, মরিচ, লবণ, তেল এই সব গৃহস্থলি সামগ্রী। তবে আনার অন্যদের থেকে একটু আলাদা। পান, সিগারেট খাওয়াÑ এসব বাজে অভ্যাস তার নেই। তবে একটি শখ তাকে আপ্লুত করত। সেটা হলো মাটির ব্যাংকে টাকা জমানো। তার ইচ্ছে এই ব্যাংকটি যখন ভরে যাবে ঠিক তখনই সে…। কথাটা কেমন মুখে আটকে যায়। আর ভাবতে পারে না। খুব লজ্জা লাগে। বড্ড লাজুক স্বভাবের ছেলে আনার। তবে ওর স্বপ্ন একদিন সত্যি হয়। বাবা মায়ের পছন্দের মেয়ে কুলসুমকে সে বিয়ে করে ঢাকায় নিয়ে আসে। হাসপাতালের এক ডাক্তার সাহেব আনারকে এই চাকরিটি দেয়। একমাত্র মেয়ে রুমাকে নিয়ে তাদের সংসার। আনার নিজে লেখাপড়া শেখে নাই। তার ফল সে ভোগ করছে। কিন্তু মেয়েকে সে ডাক্তার বানাতে চায়।
রুমা মিরপুর আদর্শ স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। এখন গ্রীষ্মকাল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গরমের ছুটি চলছে। কিন্তু আনারের কোনো ছুটি নেই। মেয়ে তা বোঝে না। অন্য বন্ধুদের সবার বাবার ছুটি হয়, তার বাবার ছুটি হয় না কেন ? মেয়ের এমন প্রশ্নে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আনারের আর কিছুই বলার থাকে না। মেয়ের কথার অবাধ্য সে হতে চায় না। কারণ গরমের ছুটিতে অনেকেই তাদের গ্রামে দাদা বাড়িতে বেড়াতে যায়। গ্রামের কথা মনে হতেই আনারের মনের মধ্যে কেমন হাহাকার করে ওঠে। আজ কত বছর হলো তাদের গ্রামে যাওয়া হয় না! মানে যেতে পারে না। অথবা গ্রামে যাওয়ার জন্য সে সামর্থ্য দরকার সে সামর্থ্য তার নেই। বিভিন্ন অজুহাতে নিজেকে নিবৃত রাখে। কিন্তু মেয়েটি কেমন গো ধরেছে সে গ্রামে যাবেই। গ্রাম দেখবে। নদী, মাঠ, ধানক্ষেত, সবুজ ফসলের মাঠ-এসব দেখে অনেক ছবি আঁকবে। মেয়ের আবদান অমূল নয়। ওর জ্ঞান হবার পর থেকে বলতে গেলে আনার তেমন একটা গ্রামে যেতে পারেনি। তার বুড়ো বাপ-মা এখনও জীবিত। তাদের দেখার জন্য মনটা আইঢাই করে। তাই আনার সিদ্ধান্ত নেয় সে যেভাবেই হোক এবার গ্রামে যাবেই। প্রয়োজনে বড় সাহেবের হাতে পায়ে ধরে পাঁচ দিনের ছুটি নেবে। সঙ্গে শুক্র ও শনিবার- এক সপ্তাহের ট্যুর।
রুমা বাবা-মায়ের সাথে দাদা বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে। রুমাকে পেয়ে দাদা-দাদি তো মহাখুশি। তারা সারাক্ষণ রুমার সাথে খেলা করে। কত রকমের গল্প যে তারা রুমাকে শোনায়! বলে শেষ করা যাবে না। বিকেল ও সন্ধ্যাবেলা রুমা পাড়ার অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে খেলা করে। সেদিন খেলতে খেলতে সে দেখতে পেল, ছোট পাখির মত কি যেনÑএকটা মরা ডালের ওপর এসে বসে আছে। একটি নয়, দুটি নয়, অসংখ্য। এদের ছোট্ট দুইটি রঙিন পাখনা। কী সুন্দর রং! পাখিগুলো একটু পরপর এখান থেকে ওখানে ছোটাছুটি করছে। দেখতে কী যে ভালো লাগছে সে কথা বলে বোঝানো যাবে না। রুমা সাবধানে পাখিটি ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু ও পাখিটি ভারি দুষ্ট আর চালাক। ধরার সময় রুমাকে ফাঁকি দিয়ে উড়ে যায়। ধরতে গিয়েও সে ধরতে পারে না। রুমার প্রতিবেশী এক চাচাতো বোন রিমি এগিয়ে এসে বলে, ওটা ধরো না। ওটা পাখি নয়, ওর নাম প্রজাপতি। রুমা ধরতে গিয়ে এবারও ব্যর্থ হয়। রিমি বলে, রুমা আপু তোমার চেয়ে ঐ প্রজাপতিগুলো বেশি চালাক।
একদম ঠিক বলেছ রিমি! কিন্তু আমিও কম চালাক নই। দেখে নিও আমি ঠিক ওদের ধরে ফেলবো। তখন দেখবে মজা।
গত দুইদিন রুমা প্রজাপতির পেছনে খুব দৌঁড়ালো। কিন্তু একটিও ধরতে পারল না। পাছে সবই টের পেয়ে যায়, তাই আগেভাগেই রিমিকে বলল, জানো প্রজাপতি ধরা ভালো কাজ নয়। স্কুলের সাজেদা মিস বলেছেন, আমাদের মতো তাদেরও জীবন আছে। আনন্দ-বেদনা আছে। ঘর আছে। সংসার আছে। বাচ্চাকাচ্চাও আছে। ওদের ধরা মানেই ওদের জীবন শেষ করে দেওয়া। মিস আরও বলেছেন, যারা ফড়িং আর প্রজাপতি ধরে তারা পঁচা। কারণ, ফড়িং আর প্রজাপতি আমাদের বন্ধু। আমি তাই কখনো প্রজাপতি ধরব না। কারণ আমি খুব ভালো মেয়ে।
রিমির একটু বুদ্ধি কম। ছোট বেলায় ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে ওর মেধাশক্তি কিছুটা লোপ পেয়েছে বলে অনেকের ধারনা। তখন রিমি বলল, রুমা আপু তাহলে আমি খুব পঁচা মেয়ে। আমি অনেক ফড়িং আর প্রজাপতি ধরে মেলে ফেলেছি। আমার খুব খারাপ লাগছে।
তখন রুমা বলল, আজ থেকে তুমি আর ওদের ধরবে না। কেমন ! তাহলে তুমিও আমার মতো ভালো মেয়ে হতে পারবে। ঠিক আছে।
রিমির দুটি চোখ যেন আনন্দে নেচে উঠল। সে বলল, আচ্ছা। আজ থেকে আমিও তোমার মতো ভালো মেয়ে হয়ে যাব।