একথা বলা যুক্তিসঙ্গত হবে যে, একটি দেশ এবং একটা জাতির উন্নতির প্রয়োজনে ‘সংগঠন’ উপাদানটি খুবই প্রয়োজন। সংগঠনের হাত ধরেই একটা জাতি হাঁটতে শেখে এবং জাতীয় উন্নতির সোপানগুলো পাড়ি দিতে হয় এই সংগঠনের কাঁধে ভর দিয়েই। সমাজের প্রত্যেক মানুষই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে কোন-না-কোন সংগঠনের সাথে যুক্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, একটি যৌথ পরিবার বাবা-মা, ভাই-বোন নিয়ে তৈরী একটি সংগঠন; পাড়া-মহল্লার স্পোর্ট ক্লাবটিও কিশোর-যুবকের একটি সংগঠন। এভাবে ভাবলে দেখা যায় একটি রাষ্ট্রের মধ্যে ছোট-বড় অসংখ্য সংগঠন থাকে। মূলত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে তৈরী বৃহৎ সংগঠনটির নাম হচ্ছে রাষ্ট্র। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাস পরাধীনতার ইতিহাস। ১৯৭১ সালে জাতির ইতিহাসে বাঙালি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেলেও সাংগঠনিক ব্যর্থতায় জাতি আজও প্রত্যাশিত সেই দেশ থেকে যোজন যোজন দূরে। রাষ্ট্র নামের এই আকাঙ্ক্ষিত সংগঠনটি সার্থক হয়নি কারণ যে সংগঠনগুলোর সার্থকতার ওপর রাষ্ট্রের সার্থকতা নির্ভর করে সেগুলোর ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। আর এইসব সংগঠনগুলোর ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে পরাধীনতা, রাজনৈতিক ব্যর্থতা, বাঙালির নিচু মানসিকতা, অলসতা, অক্ষমতা, পরনির্ভরশীলতা, পরশ্রীকাতরতা, স্বাস্থ্যহীনতা ইত্যাদি। সাংগঠনিক এই ব্যর্থতার দৃষ্টিকোণ থেকে বাঙালি জাতির এক মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ রয়েছে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের লেখা ‘সংগঠন ও বাঙালি’ বইতে।
রাষ্ট্রের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সংগঠনগুলোর সাফল্যের ওপরই রাষ্ট্র-সংগঠনের সাফল্য নির্ভর করে। শিল্প-সাহিত্যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে বাঙালি জাতির সামর্থের প্রমাণ পাওয়া গেলেও সাংগঠনিকভাবে এ জাতি যে অনেক অনেক পিছিয়ে তা আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার প্রয়োজন পড়ে না। এই পিছিয়ে পড়া বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গিয়ে লেখকের মন-নদীতে বেশকিছু প্রশ্ন শুশুকে মতো ভেসে উঠেছে:
‘এদেশে দুজন মানুষ অংশীদার হয়ে ব্যবসা করতে গেলে দু-বছরের মাথায় তা ভেঙে যায় কেন? কেন তারা দুজন দুজনকে খুন করার জন্যে রাতের অন্ধকারে ছুরি হাতে একা-একা ঘুরে বেড়ায়? কেন আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতার দ্বন্দ্বে এমন ক্ষতবিক্ষত এবং রক্ষাক্ত? কেন এত সংকীর্ণতা ও অসহিষ্ণুতা আমাদের চরিত্রে? কেন রাষ্ট্রকে আমরা কিছুতেই স্থিতিশীল করতে পারছি না? এসব দেখে একটা কথাই থেকে-থেকে মনে হয়: সংগঠন তো সমষ্টিস্বার্থের প্রতিভু, জীবনের ‘বড় আয়োজন’; তা হলে কি আমাদের চরিত্রে ব্যক্তিস্বার্থের এমন কোন সংকীর্ণ ও আত্মঘাতি গহ্বর রয়েছে যা আমাদের সমষ্টিগত স্বার্থবুদ্ধির তুলনায় অনেক ধ্বংসাত্মক- যা ছোট স্বার্থকে তৃপ্ত করলেও বৃহত্তর স্বার্থের জায়গায় আমাদের ব্যর্থ করে রেখেছে? আমরা কি যতটা সমষ্টিগত তার চেয়ে বেশি আত্মগত? কিংবা যখন সমষ্টিগত হই তখনও তা হই আত্মগত কারণেই। আমরা কি কেবলি ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আর আত্মসর্বস্বতার ভেতর আমাদের খণ্ডিত ও অশ্রুময় নিয়তিকে অন্বষণ করি? আমাদের নৈতিকতা কি চিরকালই কিছুটা নিচুমানের? আমাদের চাউনি কি সবসময় একটু বেশিরকম লোভ-চকচকে? শক্তির জায়গায় কি আমাদের কোনও জন্মগত দুর্বলতা রয়েছে? ‘বিচার যাই হোক, তালগাছটা আমার’- এই কি আমাদের শেষ কথা? ন্যয্যমূল্য না দিয়ে সবকিছু হাতিয়ে নিতে বা লুট করতে চাওয়া- এ কি আমাদের সহজাত প্রবণতা? ন্যায়নীতি নেই, সমষ্টিকল্যাণ নেই, পরহিত নেই, নিজের উচ্চতর স্বার্থও নেই; কেবল আমি আর আমার সংকীর্ণ চাওয়া- এই সীমিত চেতনার মধ্যেই কি আমরা আমাদের উচ্চতর স্বার্থকে বিক্রি করে চলি?’
উপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর কি হবে তা লেখক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ জানেন এবং পাঠকেরও সেগুলো অজানা নয়। এদেশের পারিবারিক, সামাজিক, দাপ্তরিক এবং সাংগঠনিক কাজ-কর্মে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কিংবা যে কোন সচেতন পাঠকের উত্তর যে লেখকের উত্তরের সাথে মিলে যাবে তাতে অন্তত আমি নিঃসন্দেহ। এখন প্রশ্ন হল, বাঙালির বৈশিষ্ট এমন কেন? কি কারণে বাঙালি এরকম আত্মঘাতী চরিত্র বয়ে বেড়ায়? সমষ্টিস্বার্থের অবজ্ঞার ফলে যে ব্যক্তিস্বার্থ ভূলুণ্ঠিত হয়, বিসর্জিত হয় এই সহজ সত্যকে বুঝবার মতো শিক্ষা কি আমরা পাচ্ছি না? স্কুল, কলেজ; জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়- এগুলো থেকে কি কেবল কেরানি তৈরী হচ্ছে, দেশের আত্ম-উন্নয়নে কি কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে না? শত শত এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রীধারীরাও কি বাঙালি-বৈশিষ্ট থেকে বের হতে পারছে না? পারছে না । কিন্তু কেন? এই ‘কেন’ এর উত্তর খুঁজতে লেখক বাঙালির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন। খুঁজেছেন ‘কেন’ এর পিছনে এ জাতির ঐতিহাসিক এবং ভৌগোলিক কোন কারণ আছে কি না তা-ও।
ক্লাইভ বেল তার লেখায় সভ্যতার ক্রমবিকাশ দেখিয়েছেন এভাবে: অসভ্য, অর্ধসভ্য, সভ্য এবং সুসভ্য। ইতিহাস বলে কয়েক হাজার বছর আগে জাতি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে বাঙালি। এই একবিংশ শতাব্দীতেও বাঙালি সভ্যতার প্রথম স্তর পার হতে পারল কি না তা নিয়ে যে-কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে। পারে কারণ, মাত্র পাঁচ-দশ হাজার টাকার জন্যে বাঙালি মানুষ খুন করে; ধর্ম অবমাননার উস্কানিদাতা ভেবে শুধুমাত্র গুজবে কান দিয়ে দিনে-দুপুরে জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারতে পারে। কুসংস্কার এবং সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ পেরুতে না পারলে সভ্যতার প্রথম স্তর পেরোও কীভাবে? শুধুমাত্র রঙ-চঙে পোশাক বিবেচনা করলে অবশ্য হিসাবটা ভিন্ন। মূল্যবোধ সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট। প্রতিদিনই পথে-ঘাটে বাঙালির বিকৃত মূল্যবোধের নজির পাওয়া যায়। ব্যপারটা দুঃখজনক তবুও খুবই সত্য যে যেখানে মূল্যবোধ সৃষ্টি করার কথা সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এমনকি তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকমণ্ডলিও মূল্যবোধের মূল্য বোঝে কি? মূল্যবোধহীনতার বেশ কিছু উদাহরণ উল্লেখ করে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, ‘বাঙালি-যে আজ পর্যন্ত সাংগঠনিকভবে শাক্তিশালী হতে পারেনি, তার চরিত্রের এই আত্মপরায়ণপ্রবণতা এর একটা বড় কারণ। তার ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থলিপ্সা আজও তার সংঘবদ্ধতার স্বপ্নের চেয়ে শক্তিশালী।’
পরাধীনতা একটা জাতিকে আত্মকেন্দ্রিক এবং স্বার্থপর করে তোলে। হাজার বছর ধরে বাঙালি জাতি ছিল পরাধীন। প্রায় তিন হাজার বছর আগে বহু উত্তরের নিস্ফলা তৃণভূমি থেকে উঠে আসা যুদ্ধপ্রিয় আর্যবাহিনী, পরবর্তীতে সেন, পাল, মুঘল, বেনিয়া ব্রিট্রিশ এবং সবশেষে পাকিস্তানীরা বাঙালি জাতিকে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে মুক্ত হতে দেয়নি। এমনকি সংখ্যালগিষ্ঠ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়রা এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৈশ্য, শুদ্র এবং তথাকথিত অস্পৃশ্যদের করে রেখেছিল কোণঠাসা। কাজেই যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার নিয়তি বাঙালি জাতিকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হবার রসদ জুগিয়েছে। সংগঠন গঠন এবং তার সুফল সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অন্ধকারে থেকে গেছে এদেশের নিপিড়িত, অত্যাচারিত মানুষ।
পরশ্রীকাতরতা বাঙালির আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট। পরের যাত্রা ভঙ্গ করতে নিজের নাক কাটতেও দ্বিধাবোধ করে না এ জাতি। ঐতিহাসিকভাবে এ জাতি ব্যর্থ আর ব্যর্থরাই পরশ্রীকাতর হয়ে ওঠে। তথাকথিত শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সবাই অন্যের ভালো দেখলে দুঃখ পায় না এমন একজন বাঙালি পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। একক প্রচেষ্টায় সমাজের ভালো করতে পারাটা বেশ কঠিন। সহজ, দশজন মিলে কোন একটা সংগঠনের মাধ্যমে। এদেশে দশজনের কোন একটি সংগঠন তৈরী হবার সাথে সাথে সংগঠনটির মধ্যে অন্তত পাঁচটি উপদল তৈরী হয়ে যায় যেসব উপদলের অধিকাংশ সদস্যই থাকে মোটামুটি নিস্ক্রিয়। দুএক জন সত্যিকার অর্থেই সংগঠনটি থেকে সুফল পেতে চাইলেও বাকীদের থাকে গাছাড়া ভাব। লেখক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতে চতুর্থ দলে থাকে ক্রিটিকরা যারা কেবলই বলতে থাকে, ‘ভালো হত আরও ভালো হলে’। ‘আর পঞ্চম দলটি একেবারেই আমাদের স্বকীয়। এরা ঘাতক; কিলার। প্রতি দশজনে এরা দুজন। আমাদের জাতিগত অক্ষমতা, অসহায়তা, হীনমন্যতা এবং অমানবিক জীবন-পরিস্থিতির ভেতর থেকে জন্ম নিয়ে, জাতির প্রতিটা উদ্যামকে পেছন থেকে ছুরি মেরে মাটিতে শুইয়ে দেবার জন্যে এরা আড়ালে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে। সাংগঠনিক বিকাশের মূল আততায়ী এরাই।’
কথায় বলে, ‘পেট ভালো যার জগৎ ভালো তার’ কিংবা ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’। কথাগুলো আমরা জানি। মানি কি? স্বাস্থ্য মানে শরীরে পর্যাপ্ত মাংস থাকা নয় কিংবা দুপুরে ভাত-ঘুম দিয়ে ভুড়ি বাড়ানো নয়। স্বাস্থ্য মানে সুষম খাদ্যাভাস এবং নিয়মিত শরীরচর্চার মাধ্যমে সুস্থ, স্বাভাবিক এবং রোগমুক্ত থাকা। সুস্থ দেহ সুস্থ চিন্তা আনে, কর্মক্ষমতা বাড়ায়, উদ্যোমী করে তোলে। কিন্তু স্বাস্থ্য নিয়ে কমবেশি সব বাঙালিই উদাসীন। এমনকি আমি এই যে কথাগুলো বলছি এই আমিও স্বাস্থ্যকে খুব একটা গুরুত্ব দিই না। জানি সুস্বাস্থ্য আমাকে আরও চিন্তাশীল করে তুলতে পারে, তবুও। আহমদ ছফা’র মতে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান অতুলনীয় তার একটি অন্যতম কারণ শারীরিক এবং মানসিকভাবে তিনি অন্য বাঙালি সাহিত্যিকদের চেয়ে ছিলেন অনেক বেশি সুস্থ। এই যে জানার পরেও আমি মানি না তার কারণ আমিও বাঙালি। আমাদের মানসিকতা এমনই। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি জাতির অক্ষমতা, নিস্ক্রিয়তা, ভিরুতা, নেতিবাচক মনোভাব, হীনমন্যতা, অসহায়তা, অবসন্নতা আর উদ্যমহীনতার জন্য এই স্বাস্থ্যহীনতাকে দায়ি করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি-যে বাঙালির আত্মপরতার কথা বলেছি, আমার ধারণা, এরও প্রধান কারণ স্বাস্থ্যহীনতা। নির্জীব স্বাস্থ্যের কারণে সে এমন নিস্প্রাণ ও গৃহপালিত, এমন ‘অন্নপায়ী বঙ্গবাসী’। এর জন্যেই তার জীবন হয়ে রয়েছে সীমিত- কত ছোট কুঠুরির ভেতর জীবনকে গুটিয়ে কীভাবে টিকে থাকা যায় এ-ই তার চেষ্টা।’
হতে পারে সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয়ভাবে কখনই আমাদের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সচেতন করানো হয়নি, হয় না। তাতে কি? ব্যক্তিগতভাবে তো আমরা সচেতন হতে পারি। তা-ও হই না। আর হলেও যে আমরা পুরোপুরি সুস্থ থাকতে পারতাম তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। কারণ বাঙালির স্বাস্থ্যহীনতার পেছনে ঐতিহাসিক এবং ভৌগোলিক কারণও আছে। নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিল দ্রাবিড় এবং এই দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মানুষেরা ছিল শারীরিকভাবে গড়পড়তা ধরণের। শক্তি, সামর্থের বিবেচনায় তারা আর্য, আফ্রিকান কিংবা পাকিস্তানীদের সমপর্যায়ের ছিল না। কাজেই আমরা যে শারীরিক গঠনে ও সামর্থে ইউরোপিয়ান, আফ্রিকানদের মতো হবো তার কোন ঐতিহাসিক কারণ নেই। এছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থানকে বিবেচনা করলে দেখা যায় বাংলাদেশ নামের এই ভূখণ্ডটিকে অসংখ্য নদ-নদী সাপের মতো পেঁচিয়ে রেখেছে। এইসব নদী-নালা সারা বছরই, বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে তাদের উৎপত্তিস্থল থেকে শুরু করে বিভিন্ন শহর, জনপদ থেকে দুষিত জল বয়ে আনে এ-ভূখণ্ডে। বর্ষার পলি এদেশের ফসলি জমি উর্বর করলেও দূর্বল করে দিয়েছে এ-জনপদের বাসিন্দাদের। লেখক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, ‘দুষিত পানিবাহিত সবরকম রোগ, যেমন টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, আমাশয়, জন্ডিস, কলেরা, জিয়ারডিয়া ইত্যাদি আদিকাল থেকেই বাঙালির বিধিলিপি। এসব স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি রোগ বাঙালির স্বাস্থ্যের ওপর মারত্বক মরণ-ছোবল হেনেছে বলেই মনে হয়। হাজার হাজার বছর এতে অসংখ্য মানুষ যে শুধু প্রাণ হারিয়েছে তাই নয়, প্রায় প্রতিটি মানুষ বেঁচে থেকেছে রুগণ নির্জীব ও স্বাস্থ্যহীন হয়ে।’
২০২১ সাল, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপিত হচ্ছে বাংলাদেশে। কালের ইতিহাসে পঞ্চাশ বছর খুব বেশি সময় নয়। তবে এই বছরগুলো ছিল একান্তই আমাদের। এদেশের রাজনীতি, শিক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতি, স্বাস্থ্যনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি যেগুলো একটি জাতির উন্নয়নে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করে সেগুলো ছিল সম্পূর্ণভাবেই আমাদের নিয়ন্ত্রণে তবুও আমরা প্রত্যাশিত উন্নয়নের দেখা পাইনি। শুধু পাইনিই না কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেন আমরা আরও পিছিয়েছি। আর এই পেছানোর কথা ভাবতেই মনে হয় যেন আমাদের ‘লাভের গুড় পিঁপড়ায় খেয়েছে।’ খুব স্পষ্ট করে বললে বলতে হবে পরাধীন বাঙালির মানসিকতার যতটুকু পুঁজি ছিল স্বাধীন বাঙালি যেন সেটুকুও হারিয়েছে। কারণ হিসেবে বলা যায় রাষ্ট্র নামের সমন্বিত সংগঠন থেকে প্রত্যাশিত ফল পেতে হলে যে সুস্থির রাজনীতি প্রয়োজন তা আমরা আজও পাইনি। অস্থির রাজনীতির কলুষিত ছায়াতলে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো প্রয়োজনীয় আলোর অভাবে বেড়ে ওঠেনি, উপরন্তু বাঙালির নিচু মানসিকতার চাবুকেও হয়েছে রক্তাক্ত। এই সবকিছুরই এক নির্মোহ আত্মসমালোচনামূলক বিশ্ল্বষণ করেছেন সংগঠক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। খুঁজে ফিরেছেন বাঙালির সাংগঠনিক ব্যর্থতার মূল-শেকড়। বাঙালিমানসের এক গভীর বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন তাই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ’র ‘সংগঠন ও বাঙালি’ বইটি।
শেখ সুজন আলী, অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।