সীমানা-পাঁচিলের উপর একটা ঘুঘু আনমনে ডেকে চলেছে। রিয়াদের বুকের ভেতরটা হুহু করে ওঠে। মায়ের জন্য মন কেমন করে। ঘামে ভেজা মায়ের মুখটা দেখতে ইচ্ছে করে। ওর সাথের সবার শেষ হলেও রিয়াদের এখনো ৬ পারা মুখস্থ করা বাকি। কোরআনটা মুখস্থ হয়ে গেলে বাড়ি যাওয়ার প্রসঙ্গ হয়তোবা তোলা যাবে। তার আগে বললে পিঠের উপর বেতের বাড়ি পড়বে। খুব কষ্ট হয় রিয়াদের। মা বলেছে, কোরআনে হাফেজ হলে বেহেশতে যাওয়ার পথ সহজ হয়। সেখানে কোনো অভাব-অনটন নেই। যখন যা খুশি খাওয়া যাবে। সুন্দরী হুর থাকবে। শুধু আনন্দ আর আনন্দ। রিয়াদ অবশ্য সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, সে শুধু মাকে চাইবে। এসব হুর-টুর তার চাই না। মা তো হেসেই অস্থির, তখন কি আর আমাকে ভালো লাগবে? বেহেশতের হুরিরা যে অনেক সুন্দর! রিয়াদ কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, বেহেশতে তার সৎ বাবা আর সৎ ভাইবোনেরা থাকবে কীনা! এর কোনো উত্তর দেয়নি মা। অসহায় চোখে তাকিয়ে থেকে রিয়াদকে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে রেখেছিল। থরথর করে শুধু কাঁপছিল। ওকে দেখলেই মা শুধু কাঁদে। রিয়াদের ইচ্ছে করে সারাক্ষণ মায়ের কাছে থাকতে। ওর সৎ ভাইবোনেরা সে সুযোগটা পায়। রিয়াদ পায় না। কারণ, রিয়াদের বাবা নেই। রিয়াদকে বাধ্য হয়ে মাদ্রাসায় থাকতে হয়। মাদ্রাসায় থাকতে একটুও ভালো লাগে না। একথা বললেই মা বেহেশতের গল্প শোনান। ক্ষণিকের এই পৃথিবীর স্বচ্ছন্দ্য, আনন্দ এসব নিতান্তই তুচ্ছাতিতুচ্ছ। পরকাল হবে অনন্তকাল। সেই অনন্ত সময়ে বেহেশত লাভের চেষ্টাই প্রকৃত মোক্ষ।
মা এতো সুন্দর করে বেহেশতের গল্প করেন, যেন তিনি নিজ চোখে সব দেখেছেন। রিয়াদের খুব ভালো লাগে। আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু মাকে ছেড়ে যেতে প্রতিবারই মনে হয়, মায়ের কাছে থাকার জন্য বেহেশত ছাড়তে পারবে অনায়াসে। খাবারের লোকমা মুখে তুলে দিতে দিতে কতো যে গল্প করেন মা। বিকেল হলেই অস্থির হয়ে যান রিয়াদকে বিদায় দিতে। কাজ শেষে সৎ বাবা ফেরার সময় হয়ে আসে। ওই সময়টায় মায়ের উপর অভিমান হয়। বুকটা ভার হয়ে যায়। চোখ ফেটে কান্না আসে। কিন্তু কাঁদে না। কদিন পরেই বারো বছর পুর্ণ হবে রিয়াদের। মা বলেছে, এতো বড় ছেলের কাঁদতে নেই। পৃথিবীর সব কষ্ট যেন শুধু রিয়াদের জন্যই। ওর সৎ ভাইবোনেরা কেন মাদ্রাসায় থাকে না, ওদের কি বেহেশতে যেতে হবে না! রিয়াদ তো বেহেশত চায় না। শুধু মাকে চায়। মা বিব্রত হন ওর কথায়। রিয়াদ তাই আজকাল আর এসব প্রশ্ন করে না। ঘুঘুটা উড়ে যায়। গুটিগুটি পায়ে হোস্টেলের দিকে যায় রিয়াদ। তপ্ত দুপুরে বিছানায় শুয়ে মন ভালো করার চেষ্টা করে। মা’র কথামতো বেহেশতের অপূর্ব সুন্দর হুরিদের কথা ভাবার চেষ্টা করে। দেখে, সত্তরজন হুরির মুখেই ওর মায়ের মুখটা বসানো। আচমকা পিঠের ওপর বেতের আঘাতে কেঁদে ওঠে রিয়াদ, মা, মা-গো!