কবি কিংবা কবিতা-ভাব তো অনেকেরই থাকে। কেউ কেউ সেই ভাবকে বাজিয়ে দেন, জীবনে ও যাপনে কবিতাকেই পাথেয় করেন। বোধে ধারণ করেন। কেউ আবার সমূহ সব সম্ভাবনাকে মুক্তোর মতো শুক্তির ভেতর পুষে রাখেন। কবিসত্তাকে চৌকাঠের এ-পাশেই বেঁধে দেন। চুপচাপ নিজের ভেতরে বাঁচেন। কিন্তু কবি কি আদতে সেটা পারেন? পান কি কবিতার আশ্রয় থেকে মুক্তি? কবি চন্দন সাহা রায়ও পারেননি। কবিকে তাই নিজের মাটিতে দাঁড়িয়ে কবিতার আশ্রয়েই জীবন ও সময়কে লিখতে হয়েছে। কবিতার জমিনেই বুনতে হয়েছে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বমানস। পরিভ্রমণ করতে হয়েছে মগড়া থেকে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত।
কবিকে লিখতে হয় চক্ষু দিয়ে। চোখ না থাকলে কবিতা লিখা যায় না। চোখ না থাকলে নিজের কোনও পৃথিবী থাকে না। নিজস্ব ভূগোলে দাঁড়িয়েই কবি চন্দন সাহা রায় লিখেছেন তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘নগর তামাশা’। জল-হাওরে শৈশব-কৈশোর কাটানো কবি বহু নদীর মিতালী ঘুরে হাঁটতে হাঁটতে উঠে এসেছেন নাগরিক আলিঙ্গনে। একটা পাখি জীবন চেয়েও রাষ্ট্র-প্রহসনের হাটে হাতঘড়ির নির্ভরতায় জীবনকে ছুড়ে দিয়েছেন কবি। তবু কবিতার প্রতিভাসেই কবি বারবার ধরতে চেয়েছেন ট্রেনের লম্বা বাঁশি। বিরুদ্ধ যাপনে বেলী-চামেলীর ঘ্রাণ।
গ্রন্থটির প্রতিটি কবিতাকেই কবি ‘প্রতিকবিতা’ হিসেবে পরিচয় করিয়েছেন। কেন প্রতিকবিতা, সেই ব্যাখ্যাও করেছেন। কবির বক্তব্য স্পষ্ট- ‘চেনা গন্ডির বাইরে থেকে কবিতাকে দেখার প্রবণতাই প্রতিকবিতা।’ শিল্পের এই প্রাচীন আঁতুড়ঘরকেই নতুন রূপে অপরিচিত ঢঙে হাজির করেছেন কবি। প্রতিটি কবিতার শিরোনামের আগে তিনি ‘প্রতিকবিতা’ শব্দটি খুব সচেতনভাবে জুড়ে দিয়েছেন। এ যেন সানগ্লাস খুলে উন্মুক্ত চোখের রোদ ও ছায়া পান। কবি পরিচিতিতেও এনেছেন বৈচিত্র্য। কবি নিজেকে ‘আদতে এক পাখি’ সম্বোধন করতে চাইলেও বাস্তবের রূঢ়তায় বিচিত্র তামাশায় এখন ডানা হারিয়ে গোত্তা খাচ্ছেন অস্থির নগরে। হারিয়েছেন চেনা আকাশটাও। তবু পকেট ভর্তি নগর ও নাগরিক তামাশা নিয়েই কবিকে প্রতিদিন ঘরে ফিরতে হয়। লিখতে হয় ‘নগর তামাশা’র কাব্য।
বোঝাপড়ার গণিতটা আলমিরাতে রেখেই কবিতা লিখতে হয়। সঙ্গে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির অংকটাও। পাঠক সেই কবিতার সামনে নত হয়। কবি নিজেও। আর তখন হরেক ফুলের ঘ্রাণ শুকতে শুকতে সকাল-সন্ধ্যার জীবন মুখস্থ করা যায়। আত্মা আর বিবেকের ছিদ্রগুলো সেলাই করা যায়। চোখ দুটিকে কাঁটাতারহীন পৃথিবীতে ছুড়ে দেয়া যায়।
কবি চন্দন সাহা রায়ের ‘নগর তামাশা’ তেমনই এক কবিতার কিতাব। যেখানে কবি সাজিভর্তি ফুল নিয়ে বাংলা কবিতার পাঠকের দ্বারে হাজির হয়েছেন। উপহার দিতে চেয়েছেন বিচিত্র চিন্তন ও ঘ্রাণ। প্রতিটি কবিতায় এক অসাধারণ গতিময়তা এনেছেন। যা পাঠককে পাহাড়ি ছড়ার শীতলতা দেয়ার পাশাপাশি কবিতা পাঠেও উস্কে দেয়। সবগুলো কবিতা এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতে বাধ্য করে।
প্রত্যেক কবি নিজেকেই লিখেন। মন ও মননের ঘাত-প্রতিঘাতের সংবেদই কবিতা। কবি চন্দন সাহা রায়ও এই নগর জীবনে বসে বুনতে চেয়েছেন হাওরের মিহি বাতাস। প্রাণের টানে ফিরতে চেয়েছেন মায়ের হাতে লাগানো পেঁপে গাছের তলায়। সেই পেঁপে গাছের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন ভ্রূণ হত্যার ইতিহাস। সেই পেঁপে গাছের নিচে বাঁচতে চেয়ে পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে বলেছেন-
‘পেঁপে গাছের নিচে দাঁড়ালেই মনে হয় মায়ের হাতের নিচে বেঁচে আছি।’ (প্রতিকবিতা : পেঁপে)
‘রূপবান’ কবিতায় নগরচিত্র এঁকেছেন কবি। ক্লান্ত, বিষণ্ন, নিঃস্ব মানুষের চোখের সাথে অন্ধকারে লেগুনার হেডলাইটের তুলনা করেছেন। সাফ বলে দিয়েছেন-‘এই শহরের মানুষ সূর্য দেখে না।’ গ্রন্থের এমন আরও অনেক কবিতায় রয়েছে সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, বিশ্বনীতি এমনকি সাপের আদলে মানুষের প্রকৃতিকেও জাগিয়ে তুলেছেন কবি। কবি পাড়াগায়ের ছোট্ট জোনাক নিয়েই খেলতে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন খালি পায়ে হাঁটতে। আর এই হেঁটে যাওয়ার মাঝেই বাবার রেডিওটাকে নিয়ে ভাবতে ভালোবাসেন। একে একে বিদায় নেয়া টেপ রেকর্ডার, সাদা কালো টেলিভিশন, পুরোনো ক্যাসেটের ফিতার ভাঁজে মিশে থাকা স্মৃতি, জাদুর বাক্সকে ঘিরে মানুষের উত্তেজনা, কোনো কিছুই কবির স্মৃতিকে প্রতারিত করতে পারেনি। সময়ের বহু পথ মাড়িয়েও বাবার রেডিওটাকে ফেলতে পারেন না কবি। ছবির ভেতর থেকে বাবা যেন বলে উঠেন-
‘এটা স্বাধীন বাংলা বেতার,
ফেলে দিলেই কি চলে যাবে রে?‘ (প্রতিকবিতা : রেডিও)
নগরসভ্যতার কাঠগড়ায় প্রতিদিন গুম হচ্ছে সত্য, স্বপ্ন ও জীবন। এই নগরের আলো-ছায়াতে বসেই মাংস বিক্রেতা সকাল-সন্ধ্যা খিলখিল করে হাসেন। এই নগরেই নিয়ন আলোয় রাত নামে অদ্ভূত বিভীষিকায়। অথচ কবি নাগরিক যাতনা থেকে দূরে আরও দূরে বহু দূরের কেরোসিন তেলের বাতিতে খুঁজেন সত্যজন। গতরের ঘাম আর মানুষের দিনলিপি। ঠাকুরমার আদর, বৃষ্টির তোড়ে মায়ের ওমে ঘুমিয়ে যাওয়া, খুজলি-পাঁচড়ার স্মৃতিরোমন্থনে কবি গলা উঁচিয়ে ফিরে তাকান বিগত শৈশবে। এখন সেইসব দিনরাত্রি কেবলই স্বপ্নে আসে। ঘুম ভেঙে জেগে ওঠেন কবি। কেরোসিনের গন্ধে ভরে যায় ঘর। স্মৃতি, আহা সেই সব দিন কোথায় হারায়।
‘এখন আমি শহরে থাকি। আমার খুজলি-পাঁচড়া হয় না।
আমার সন্তানেও হয় না। কারোর হয় না।
কিন্তু প্রায়ই আমি স্বপ্নের মধ্যে জেগে উঠি
আমার মনে হয় ঘরজুড়ে কেরোসিনের গন্ধ
আমার নাকমুখ গলে বের হচ্ছে লাল-সস্তা কেরোসিন।’ (প্রতিকবিতা : খুজলি-পাঁচড়া)
সময়চেতনাই প্রত্যেক কবিকে রাজনীতিসচেতন করে তোলে। পাপ-পূণ্যের এই নগরীতে, রাজ দরবার থেকে খানিক দূরে ঘুরতে ঘুরতে কবি চন্দন সাহা রায়ও রাষ্ট্রচিত্রটা দেখে ফেলেছেন। ইতিহাস ও বর্তমানের গর্ভ থেকে তুলে এনেছেন রাষ্ট্রের বায়োস্কোপ। তাই কবিকে বলতে হয়-
রাষ্ট্র মানে ভয়ের কিছু না!
রাষ্ট্র মানে, অশান্ত পাহাড়
ভয়ে কেউ তার নাম বলব না। (প্রতিকবিতা : রাষ্ট্র)
‘প্রতিকবিতা : জাতিসাপ’, ‘প্রতিকবিতা : বুদ্ধিজীবী’, ‘প্রতিকবিতা : সীমান্ত’, ‘প্রতিকবিতা : হাত’, ‘প্রতিকবিতা : ডাব’, ‘প্রতিকবিতা : শসা’, ‘প্রতিকবিতা : গুম’ কিংবা ‘প্রতিকবিতা : রাস্তা’ কবিতাগুলোর মধ্য দিয়েও কবি ইতিহাস, সমাজ দর্শন, নাগরিক অসঙ্গতির অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন। ‘প্রতিকবিতা : পাখি’ কবিতার মধ্য দিয়ে সহজ স্বীকারোক্তিতে কবি পাখিজন্ম, মাতৃত্ব ও মুক্তির ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছেন।
নাগরিক জীবনের ব্যবচ্ছেদে কবিকে ছুটে যেতে হয় অকৃত্তিম প্রকৃতির কোলে। বাস্তবতারও আরও গভীর বাস্তবতা খুঁজে নিতে হয় বৃক্ষতলে বসে। ধ্যানের পৃথিবীতে কবিকেও বৃক্ষ হতে হয়। ‘প্রতিকবিতা : গাছ’ কবিতায় গাছের সঙ্গেই কবিরও কথোপকথন হয়-
‘তোমার কি খুব জ্বর এসেছে, প্রিয় গাছ?
ভেতরে ভেতরে জ্বর বায় এমন,
একটা কাঠঠুকরা ডাকি, ঠোঁট দিয়ে তুলে নেবে সমস্ত তাপ।‘
অর্জুনগাছের শিকড় থেকে যখন প্রাণ জেগে উঠে, কবি তখন জন্মের উত্তরাধিকারে প্রাণ ও প্রতিশোধ অনুভবে মূলে ফেরায় তাড়িত হন। কবির প্রেম কবির স্মৃতিচারণ কখনোই যেনো শেষ হয়ে যায় না। কবি হাওয়ায় ভেসে বেড়াতে চান। অর্জুন গাছের গল্পের মতো সব গল্পও একদিন শেষ হলেও একদিন ফেলে আসা উঠোনেও প্রাণ ফিরে আসে। মানুষ শেকড়ের টানে ফেরে। হয়তো ফিরতে চায় বলেই। লিখেন-
‘কিন্তু দীর্ঘ স্পৃহা নিয়ে গোপনে বসে আছে অর্জুনগাছের শিকড়।
সেখানে কত কত বছর পর মাটির গভীরে শিকড়ের গায়ে
সকালের রোমের মতো হেসে উঠেছে দুটি কচি পাতা।
পরিত্যক্ত উঠানে,
পা না ফেলা এক জনপদের মধ্যে
আবার যেন প্রাণ ফিরে এসেছে।
আমি জানি না, মানুষ এমন প্রাণ
ফিরে পেতেই শিকড়ের কাছে
ফিরে যেতে চায় কি না?
আমি জানি না, এমন প্রাণ, প্রতিশোধ
ফিরে পাওয়া মানেই শিকড়ে, মূলে ফেরা কি না?’ (প্রতিকবিতা : অর্জুন)
বলপেনের নিপেই কবির কণ্ঠ বাঁধাই থাকে। সেই কণ্ঠ গলে বের হয় কণ্ঠরোধের প্রতিধ্বনি। বনসাইয়ের পরিমিতিবোধের গভীরে কবি লিখেন বাকস্বাধীনতার গল্প।
‘আমাদের ঘরে কথার বনসাই।
কেউ বলতে পারবে না আমরা কথা বলি না
বা কথা বলতে দিই না।
কথা বলো, কথা বলো…’ (প্রতিকবিতা : বাকস্বাধীনতা)
মূল বা শিকড়ই মানুষের প্রকৃত আশ্রয়। কবিও সেই আশ্রয়কে অস্বীকার করতে পারেন না। কবিকে নিজের মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজেকেই লিখতে হয়। নিজের মাটিকেই লিখতে হয়। মানুষকেই লিখতে হয়। কবি চন্দন সাহা রায় নিজস্ব সেই পথ ও পণে প্রথম কবিতাগ্রন্থেই অগ্রগামিতা দেখিয়েছেন। বাংলা কবিতার পথিক এ পথে হাঁটবেনই।