‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।/ এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে/ জীবন্ত হৃদয়- মাঝে যদি স্থান পাই।’ রবীন্দ্রনাথ তার প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা থেকে এই পঙক্তি লিখেছেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই চমৎকার পরিবেশ বড়ই বেমানান কারন খাল বিল নদী নালা সাগর আকাশ বাতাস সহ প্রকৃতির সব উপাদান আজ দুষিত। এবং এই দুষন মানুষের অতি মুনাফার লোভ লালসার কারনেই বর্তমান সময়ে অধিক জনসংখ্যার ফলে মানুষের বিচরণ যেমন বেড়েছে তেমনি তার ধ্বংসকরার প্রবনতাও তৈরি হয়েছে প্রচন্ড ভাবে। কারন এই পরিবেশে টিকে থাকার জন্য নিত্যনতুন আবিষ্কারের নেশায় যততত্র কলকারখানা নির্মান, বন পাহাড় নদী সমস্ত জায়গা দখল দুষন করতে হচ্ছে। ফলে কলকারখানার তাপমাত্রায় ভূমন্ডলে প্রভাব ফেলছে। এর ফলে প্রকৃতি হারাচ্ছে তার চিরাচরিত রুপ, বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র ও বৈশ্বিক আবহাওয়া এবং প্রভাব পরছে জলবায়ু পরিবর্তনের। ফলে মানুষের চিন্তা জগতে পরিবর্তন আসছে। নানা রকম রোগ বালাই জীবানু ভাইরাসের আক্রমণের পথ খোলে যাচ্ছে
আমরা যদি দেখি আমাদের চার পাশের পরিবেশের বর্তমান অবস্থা তাহলে প্রধান উপাদান গুলোর মধ্যে বন, বায়ু, পানি ও মাটির ভয়াবহ অবস্থা। বৃক্ষ বা বনের কি রুগ্ন অবস্থা। কিছুদিন আগেইএক জরিপে আমাদের বনাঞ্চলের বর্তমান চিত্র বনবিষয়ক এক প্রতিবেদনে (দ্য স্টেট অব গ্লোবাল ফরেস্ট-২০১৯) বলেছে, বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের সাড়ে ১২ শতাংশ বনভূমি। তবে এক বা দুই শতাংশ সমাজিক বনায়নের মাধ্যমে বাড়তে পারে। তবে যাই হোক যেখানে বনভূমি থাকার কথা ২৫ শতাংশ সেখানে মাত্র ১৩ শতাংশ। এরমধ্যেই আবার চলে বন ধ্বংসের নানারকম পায়তারা।ফলে পরিবেশে গাছপালা কমে যাওয়ায় বায়ু দূষণ বাড়ছে এবং কমে যাচ্ছে অক্সিজেনের চাহিদা ও বৃষ্টি না হওয়ার প্রবনতা। ফলে মরুকরণের এই চক্রে বায়ুর মান নিম্নমুখি।যত্রতত্র অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়ন, কলকারখানা,ইটভাটা, পরিবহনের কালো ধোয়ায় দুষিত হচ্ছে আকাশ বাতাস।তাই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশগুলোর মধ্যে প্রথমে রয়েছে বাংলাদেশ, যার গড় বায়ু দূষণ ৮৩ দশমিক ৩০ পিএম২.৫। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দূষিত দেশের স্থান ধরে রেখেছে। বাংলাদেশে দূষণের পরিমাণের আশপাশে নেই অন্য দেশগুলো।এতো গেলো বায়ুদূষণের অবস্থা। অন্য দিকে আমাদের প্রায় ৪০০ নদ নদীর অবস্থা আরো শোচনীয় । মূলত নদীগুলোর তীরে গড়ে ওঠা বেশির ভাগ শিল্পকারখানা তাদের বর্জ্য পরিশোধন যন্ত্র থাকলেও তার বেশির ভাগই চালানো হচ্ছে না। কৃষিকাজে ব্যবহৃত হওয়া মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশকও সেচের পানির সঙ্গে ধুয়ে নদীতে পড়ছে। হাটবাজার, শহর ও বস্তি এলাকার গৃহস্থ বর্জ্য ফেলার সবচেয়ে বড় ভাগাড়ও এই নদী।এসব নদীতে ক্রোমিয়াম, আয়রন ও জিংকের মতো ভারী ধাতু পরিমানের তুলনায় বেশি পাওয়া গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে এই মাত্রা প্রতি লিটারে দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে নদীতে পাওয়া গেছে প্রতি লিটারে দশমিক ৮ থেকে ৮ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম।
ফলে নদ নদী–জলাশয় রক্ষা করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সেখানে আমরা দেখছি, আমাদের নদীগুলো দূষণের পর্যায় থেকে এখন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর নদী মরে যাওয়ায় মানুষের খাওয়ার পানি, মাছ ও জলজ প্রাণীর বাসস্থান হারিয়ে যাচ্ছে। বর্ষাকালে এর পানি আমাদের কৃষিজমিতে পরে মাটি দুষণ হচ্ছে অন্যদিকে প্লাস্টিক ও কাচ যেখানে-সেখানে ফেলা, শিল্পজাত বর্জ্য সরাসরি ভূমিতে নিষ্কাশন, অতিরিক্ত পরিমাণ বনভূমি ধ্বংস, আগাছানাশক, কীটপতঙ্গ ধ্বংসকারী কীটনাশক, সারের প্রয়োগ, ইট ভাটার ছাই, ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, বালাইনাশক প্রভৃতি কারণে দুষিত হচ্ছে মাটি ফলে মাটিতে উৎপাদিত ফসল শরীরে ঢোকার ফলে নানা রকম রোগ বালাই তৈরি হচ্ছে ব্যহত হচ্ছে আমদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা। তাই দেশের সার্বিক পরিবেশ যদি দেখি তাহলে বেশ নাজুক অবস্থায় আছি। বর্তমানে দেশের পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় শত্রু, অর্থাৎ দূষণকারীরা বেশ ক্ষমতাবান।
ফলে এর থেকে উত্তরণ ঘটবে যদি আমরা দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো জনবলকাঠামো ও সমাজে ব্যপক মাত্রায় জনমত ও সামজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারি তাহলে সমাধান সম্ভব এছাড়াও পরিবেশ ও বন রক্ষার সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করতে হবে। তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। নয়তো অন্যদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার নৈতিক অধিকার তাদের থাকবে না। ২০১১ সালে দেশের সংবিধানের ১৮(ক) ধারায় বনভূমি, জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে দেওয়া হয়েছে।তাই মানুষের অতিমাত্রায় মুনাফা ও সাময়িক আনন্দের জন্য যে মাত্রায় পরিবেশকে নষ্ট করছি কিংবা দুষণ করছি তাতে আমাদের দীর্ঘ মেয়াদি একটা প্রভাব পরবেই। ফলে আমাদের যা কিচ্ছু করতে হবে এখন থেকেই সেটা সম্ভব। আমরা শুধু আশপাশের পশুপাখি, বনবাদাড়, জলাভূমি, নদ–নদী, খাল–বিল, বিল-হাওর-বাঁওড়, অভয়ারণ্য, সাগরসৈকত, বেলাভূমি, দ্বীপাঞ্চল, গভীর সাগর, পাহাড়ি ঝরনা, বৃক্ষকুল আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ প্রকৃতির দিকে একটু ভালোবাসা মেশানো রক্ষা ও শুভদৃষ্টি ফেরাই এবং আমাদের ভবিষ্যতের নির্মল আনন্দের কথা ভাবি তাহলেই যে কোন দূষণ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া সম্ভব।