আমি যে শহরটায় থাকি, সেই শহরকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে এক নদী। বর্ষা এলেই রূপের সবটা সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে কয়েকদিনের জন্যে হাজির হয়, বছরের অন্য সময় জঞ্জাল বুকে নিয়ে কংকালসার হয়ে পড়ে থাকে। দখলে বেদখলে এর পাড় যেমন ক্রমাগত সংকুচিত হয়েছে-হচ্ছে, তেমনি পৌর নাগরিকদের একটা বড় অংশ ময়লা-আবর্জনা ফেলার উপযুক্ত (!) জায়গা হিসেবে এটিকেই বেছে নিয়েছেন! এ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমসহ সামাজিক মাধ্যমে বহু লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি! নদীটির নাম মগরা,শহরটির নাম নেত্রকোনা। নেত্রকোনা ও মগরার মতো জড়াজড়ি করে না হলেও দেশের অধিকাংশ শহরই গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করেই এবং বর্তমানে মোটামুটি একই চিত্র সব নদীর অর্থাৎ সেই শহরের মানুষেরাই আবার নানা অজুহাতে শোষণ নিপীড়ন চালিয়ে গলা টিপে হত্যা করেছে নদীকে।
‘নদীও নারীর মতো কথা কয়’ বলেই কিনা নদীর মতো নারীও হরহামেশা নির্যাতন অত্যাচার ধর্ষণ হত্যার শিকার হচ্ছে ।
এ দু’য়ের মধ্যে কোথায়ও কি কোন সম্পর্ক আছে?
সমাজতত্ত্ববিদ-গবেষকগণ বলেন, আছে এবং তা গভীরভাবেই আছে। তারা আরও একটু এগিয়ে গিয়ে বলেন, নারী ও নদী তথা প্রকৃতি একে অন্যের প্রতিরূপ এবং একে অপরের পরিপূরক।
সম্পর্ক নির্ণয়ের মধ্যেই থেমে থাকেনি বিষয়টি; এই সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ‘মানবী নিসর্গবাদ’ আন্দোলন, যার পরিচিত নাম ‘ইকোফেমিনিজম।’ মানবী নিসর্গবাদী’ বা ইকোফেমিনিস্টরা বলেন,
‘নারী নিপীড়নের সঙ্গে প্রকৃতি ধ্বংসের একটা নিবিড় যোগ আছে। যৌনতা ও লালসা মেটানোর জন্যে নারীদেহ-এর প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে প্রকৃতির উপর আধিপত্য বিস্তারের একটা সম্পর্ক আছে। মানবসমাজে আমরা যে বর্ণবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ, গোষ্ঠীবিদ্বেষ, স্পৃশ্য ও অস্পৃশ্য এবং অন্যান্য সামাজিক অসাম্য দেখি তারও মূল নারীদেহের উপর অত্যাচার ও নির্বিচারে প্রকৃতিকে ধ্বংসের মধ্যে লুকিয়ে আছে।’
এটা তো আমরা দেখছিই বর্তমান ধনতান্ত্রিক সমাজে পুরুষ শুধু নারীর উপর আধিপত্য করছেনা, এই ব্যবস্থা বিশ্বায়নের নামে নারী ও প্রকৃতি উভয়ের উপরেই আধিপত্য বিস্তার করছে এবং এটা সম্ভব হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা সক্রিয় থাকার কারণে। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় ধনী দেশগুলো তথা পশ্চিমী দুনিয়া তৃতীয় বিশ্বের উপর এমনভাবে শোষণ চালাচ্ছে যে, যার ফলে বন-জঙ্গল, নদ-নদী-জলাশয়, জীব-জন্তু-পশু-পাখি সবকিছুই প্রাণময়তা হারাচ্ছে। কর্পোরেট দুনিয়া শুধু মুনাফা খোঁজে। যে কারণে এরা কৃষিকেও কব্জা করে ফেলতে চাইছে পুরোপুরিভাবে। এর ফলে মুষ্টিমেয় কয়েকটি গোষ্ঠী যা বলবে, বৃহৎ কৃষক সমাজকে তা মানতে হবে অর্থাৎ কখন কোথায় কি চাষ করবে, তা নির্ধারণ করবে ঐ কয়েকটি গোষ্ঠী। প্রাকৃতিক শিল্পী কৃষক হয়ে যাবে তার উৎপাদিত দ্রব্যের মতোই কেবলই পণ্য।
এই কর্পোরেট গোষ্ঠী গার্মেন্টস ব্যবসার মাধ্যমে আমাদের দেশের নারীর শ্রম সস্তায় কিনে নিয়ে যাচ্ছে। আবার লক্ষ লক্ষ নারী গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করার ফলে কিছুটা হলেও যে আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছে, এর সুবিধা অন্য সবাই ভোগ করলেও এর ফলে পরিবারে ও সমাজে যে অস্থিরতা বা ভাংচুর হচ্ছে, তার সবটা দায় বহন করতে হচ্ছে নারীকেই।
কথায় কথায় আলোচনা অনেকদূর চলে এসেছে। নদীর প্রতি এতো অবহেলা, এতো অন্যায় যে করা হয় এবং এর সাথে যে অনেককিছু জড়িয়ে আছে, তা কিছুটা অনুধাবনের জন্যেই আলোচনাকে কিছুটা বিস্তৃত করা হয়েছে। বিশ্বব্যবস্থার আমূল বদল ছাড়া যে এই নদী, গাছ, সবুজ বাঁচানো যাবে না, হয়তো সাময়িক ঠেকা দেওয়া যাবে, এই সত্যটি আমাদের বুঝতে হবে এবং এর জন্যে কাজও করতে হবে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, জীবকুল ও পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে যারা ভাবছেন তাদেরকে বলা হচ্ছে ডিপ-ইকোলজিস্ট বা নিবিড় নির্সগবাদী। ডিপ-ইকোলজিস্টরা মনে করেন প্রকৃতির দাবী সবার আগে। সকল ধরনের আসক্তি ত্যাগ করে মানুষকে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা বোধ করতে হবে। এর জন্যে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। প্রকৃতির সহনশীলতা আর নারীর সহনশীলতা এই প্রসঙ্গে সমীকৃত। ডিপ-ইকোলজিস্টরা নৈতিক দিক থেকে প্রকৃতিকে দেখতে চেয়েছেন, তাই তারা মনে করেন প্রকৃতিকে নিংড়ে না নিয়ে প্রকৃতিকে বাঁচানো জরুরি। নারী ছাড়া যেমন প্রজন্ম বা প্রজনন থেমে যাবে, তেমনি প্রকৃতি ছাড়া প্রাণী জগৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
তাই নারী স্বাধীনভাবে বাঁচুক, নদীও নদীর মতো বাঁচুক, প্রকৃতি হোক মুক্ত, এমন এক ব্যবস্থার জন্যে কাজ করাটাই এখন প্রধান কাজ ।
এটি একটি রাজনৈতিক আন্দোলন তো বটেই, চূড়ান্ত অর্থে সাংস্কৃতিক আন্দোলনই; মানবী নিসর্গবাদ কিংবা নিবিড় নির্সগবাদ যে নামেই ডাকি না কেন।