বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং বুদ্ধিজীবী ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, ছিলেন চলমান বিশ্বকোষ। তাই বলা হতো তাঁকে। তাঁর জ্ঞানের পরিধি ছিল বিস্তৃত বিশেষত প্রাশ্চ্যতত্ত্ব,ইতিহাস ও রাজনীতিতে। তিনি “শিক্ষকদের শিক্ষক ” হিসেবে অভিহিত হতেন। “যদ্যপি আমার গুরু” বইটি ছাত্র আহমদ ছফার রচনা, পদার্ঘ্য হিসেবে।
আহমদ ছফা আব্দুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে ছিলেন প্রায় সাতাশ বছর। সম্পর্কে ছাত্র -শিক্ষক হলেও মনে হয়নি তাদের সম্পর্কটায় আদৌ কোনো ফর্ম্যালিটি ছিল। এত দীর্ঘ সময় ধরে কাউকে গুণমুগ্ধ করে রাখা কিন্তু খুব কঠিন ব্যাপার। কিন্তু আব্দুর রাজ্জাক পেরেছিলেন, শুধু ছফা নয়,সমসাময়িক অনেক প্রতিভাবানেরাই তাঁকে গুরুর আসনে আসীন করেছেন। অথচ অগাধ জ্ঞানী এই মানুষটি কখনও নিজে কিছু লেখেননি। আব্দুর রাজ্জাক স্যার কেন লেখেননি এই ব্যাপারেও আহমদ ছফা তাঁর বইয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আহমদ ছফা তাঁর ব্যাখ্যাতে বুঝিয়েছিলেন যে আব্দুর রাজ্জাক, যে মানুষটি তাঁর সমকালীনদের গন্ডি পেরিয়ে এতোটাই উপরে উঠেছিলেন যে তাঁদের কাতারে নেমে আসা হয়তো একটু মুশকিল হতো তাঁর জন্য। আব্দুর রাজ্জাক স্যারকে সমালোচনাও কিন্তু কম শুনতে হয়নি। উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের মতো এই মানুষটি তথা আব্দুর রাজ্জাক স্যারের ব্যক্তিজীবন ছিল খুবই অদ্ভুত। খাঁটি ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলতেন,পোশাকেও ছিল না কোনো আড়ম্বর, খেতেও ভালবাসতেন যা কিছু বাঙালি।
আহমদ ছফার সাথে আব্দুর রাজ্জাকের পরিচয় পিএইচডি করতে গিয়ে।শেষ পর্যন্ত ডক্টরেট তো লেখকের করা হয়ে ওঠেনি, তবে দেখা পেয়েছিলেন এমন এক মানুষের যিনি লেখকের নিজের সত্ত্বাকে খুঁজে পেতে মশালের মতো পাশে ছিলেন। যাঁর মনন,যাঁর প্রজ্ঞাকে ধরে রাখতেই লিখেছেন এই বই “যদ্যপি আমার গুরু “।
আহমদ ছফার কলমে জীবন্ত হয়ে উঠেছে জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের জীবন, চিন্তার প্রসার,রাজনীতি – অর্থনীতি -সমাজনীতি,ধর্ম, বিজ্ঞান,শিল্প,সাহিত্য নিয়ে তাঁর মতামত।” যদ্যপি আমার গুরু ” যে বইয়ের প্রতিটি লাইনের প্রতিটি অক্ষর সৃষ্টি করেছে নতুন সত্যের আলোড়ন। এ বইয়ের পাতায় পাতায় জেনেছি কিভাবে অজানাকে জানতে হয়,বুঝেছি জানা জ্ঞানকে কিভাবে বা কতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়।
তবে এই বইটি পড়ার সময় যতটা আব্দুর রাজ্জাককে দেখেছি বা বুঝেছি তাঁর থেকে বেশি নজর রেখেছি আহমদ ছফার প্রতি।কারণ, সাতাশ বছর – এত দীর্ঘ সময়ের নানা কথোপকথন থেকে আহমদ ছফা যে বিষয়গুলোকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন তা আসলে আমি মনে করি আব্দুর রাজ্জাককে নয়,আহমদ ছফাকেই বেশি সংজ্ঞায়িত করে। যে বিষয়গুলোতে তাঁর মুগ্ধতা বেশি ছিল,স্যারের যে৷ কথাগুলো তিনি ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন সেগুলোই তুলে এনেছেন তার বইতে। ১১০ পৃষ্ঠার একটি ছোট্ট বই।যেখানে ছিল অনেক অনেক রেফারেন্স, অনেক অনেক তথ্য। প্রতিটি শব্দে, লাইনে যেন মুক্তো ঝরছিল। এই বইয়ের সব কিছুই পাঠককে বিমোহিত করতে বাধ্য।
“যদ্যপি আমার গুরু ” বইটি পড়ার পর শুধু মনে হয়েছিল, বইটি আরো আগে কেন পড়ি নি। এই বইটা পড়ার পর নিজের চিন্তার জগতটাই পালটে গেল।জীবনে একবার হলেও পড়া উচিত। আপনারাও পড়ুন “যদ্যপি আমার গুরু “। আর জানুন জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাথে কাটানো আহমদ ছফার স্মৃতিময় মুহূর্তগুলো।
বই – যদ্যপি আমার গুরু লেখক – আহমদ ছফা প্রথম প্রকাশ – ১লা ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৮ পৃষ্ঠা – ১১০ মূল্য – ১৭৫টাকা।
অনাবিলা অনা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ১ম বর্ষ নেত্রকোনা সরকারি কলেজ।