অপার মুগ্ধতা। এটা শরৎ শেষে হেমন্ত কালের সরল নদীর মনের কথা। সকালে নতুন আলো সাদা বালির বিশাল বিস্তৃত অঞ্চলে আলতোভাবে পড়েছে।
কিছুদূরে সবুজ আঁকাবাঁকা ক্ষেত। তারপর একটি পথ সাপের মত বেঁকে চলে গেছে দূরের গ্রামের দিকে।
তার পায়ের সন্নিকট দিয়ে জলের ধারা মধুর নহরের মতো চুয়ে যাচ্ছ। সেই মধুর মত জল পান করার জন্য কয়েকটি নরম হলুদ ঠ্যাং ওয়ালা পরিযায়ী পক্ষি ডানা মেলছে শূণ্য আকাশে। হয়তো এখনই নেমে পরবে জলের হালকা বুকে। পাহাড়-পর্বতের মত বালির স্তুপ পার হয়ে মাছ শিকারের জাল হাতে গকুল ধারালো বেগে ছুটে আসছে। সে জানে প্রথম সকালের দিকে কিছু মাছ জল থেকে বালির ঠান্ডা পরশ পাবার আশায় কিনারের ধার ঘেঁষে শুয়ে থাকে। নদীর শরীরের কাছে পৌছে সে পানিতে নামার আগে আবারো টাইট করে নিলো লুঙ্গির কাছা। তারপর গাছমা কোমরের সাথে প্যাঁচ দিয়ে আরও শক্তভাবে বেঁধে নেমে পড়ল হেমন্ত নদীতে। প্রথমে ডুব না দিয়ে ঠেলা জাল ঠেলে, হাতরে অনেক প্রকার মাছ ধরলো। তারপর নদীর ভেতর থেকে জাল ছুড়ে মারলো ডাঙায়। তারপর ডুব দিয়ে জলের গভীরে বালির সাথে মিশে শুয়ে থাকা আইড় মাছ ধরলো কয়েকটি।
কালো সাদা রঙের বড় কাঁটাযুক্ত লম্বা পাখনাওয়ালা ছোট বড় কয়েকটি মাছ ধরে সে ভীষণ প্রীত হলো। ভাবলো এমন সুন্দর মাছ জীবনে কমই ধরতে পেরেছে। তারপর জল থেকে বালির ভুবনে উঠে মাছগুলো বাঁশের তৈরি ঝুড়িতে রেখে আবার লাফ দিলো জলে। তারপর পানকৌড়ির মত একের পর এক ডুব দিয়ে একটি একটি করে মাছ ধরে জলের উপর শুশুকের মত ভুস করে ভেসে উঠতে থাকলো। কয়েকবার কয়েকটি মাছ ধরার পর তার বাবা হারা ছুটে এসে বলল, তুই আর কত মাছ ধরবিরে বেটা। স্কুলে যেতে হবে। তোর মা বাড়িতে ডাকছে।
‘যাচ্ছি বাবা। আজকে বড় বড় আইড় মাছ পায়ছি। স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না।
মনে হচ্ছে যতো ডুব দেব ততো মাছ পাবো। তুমি যাও। আমার আসতে দেরী হবে।’
বাবা তার কথা শুনে শুকনো নদীর তীরে অসহায় পুরাতন ভাঙা পড়ে থাকা তরীর মত দাঁড়িয়ে থাকল। সে ছেলের উপর রাগ করতে পারে না। তিনটা সন্তান পরপর মরে যাবার পর গকুল তাঁর কৃপায় টিকে গেছে। তবু তার কাছে মাঝে মাঝে এটা একরকম অসহায়ত্ত্ব মনে হয়।ওদিকে সময় মত ছেলেকে বাড়িতে নিতে না পারলে তার মায়ের বকাঝকা শুনতে হবে। তবু ছেলেকে সে কিছু বলতে পারবে না। গকুলও বাবা-মার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মাছ ধরা থেকে শুরু করে লম্বা আকাশ ছোঁয়া নারকোল গাছের কাঁচা ডাব ছেঁড়া, সারাদিন পাড়ার ছেলেদের সাথে পুকুরে পুকুরে সাঁতার কেটে চোখ লাল করা কিংবা মোবাইলে সারারাত গেম খেলে দিনে ঘুমানো কোনোটায় বাদ দেয় না। আবার সময় পেলে মটরবাইক নিয়ে রকেট গতিতে ভ্যাঁ-ভুঁ, প্যাঁ-পু করে কালো ধোঁয়া ছেড়ে পথচারীদের অস্তির করে তোলে।
সপ্তাহে অন্তত সে তিন দিন স্কুলে যায়। বাকি দিনগুলো বন্ধুদের সঙ্গে খেলার মাঠে ক্রিকেট খেলে, বাজারে বাজারে আড্ডা ঠুকে, ঝাল মুড়ি ফাস্ট ফুড খেয়ে কেটে যায়।স্কুলগামী ছাত্রী দেখলে তার বন্ধুদের সাথে মিলে ঠোঁট বাঁকিয়ে শীষ দিতে ভয় পায় না। মাঝেমধ্যে মেয়ের পরিবারের কাছ থেকে অভিযোগ আসে। সেগুলো সামাল দেন তার বাবা। তবু কোন ভাবেই বাবা ছেলেকে কারো কাছে অপমানিত করাতে চান না। প্রায় দুপুরের দিকে গকুল জল ছেড়ে ডাঙায় উঠলো। তখনো বাবা রোদের মধ্যে গরম বালির উপর স্থির দাঁড়িয়ে ছিল। সে তাকে মাছের ঝুড়ি ঠেলা জাল ধরিয়ে দিয়ে বলল, হাঁটো। তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে হাঁটো। খুব ক্ষুধা পেয়েছে। ভাত খেতে হবে। প্রথমে তারা তপ্ত বালুর পথ পেরিয়ে ধানমাঠের সবুজ ক্ষেতের পাশে দিয়ে গ্রামের ভেতরের রাস্তায় উঠলো।
বাড়িতে পৌছার আগেই একটি কাঁঠাল গাছ দেখে গকুল বলল, বাবা দেখ কত বড় বড় বার মাসি কাঁঠাল ধরেছে। কন্তিু মেঘ আঙ্কেল আমাদের একটি কাঁঠালও খেতে দেয় না। মনে হচ্ছে মগ ডালের বড় বড় গুলো পেকেছে। মাছি উড়ছে। বাতাস ম ম গন্ধ ছড়াচ্ছ। তার বাবা তার মনোভাব বুঝে বলল, আমি বাজার থেকে তোমার জন্য কাঁঠাল কিনে আনব। এখন বাড়ি চল।
সে বলল, না, আগে একটা কাঁঠাল পারবো তারপর বাড়ি যাবো। কথা শেষ না হতে মুখের মধ্যে কিছুটা থাকতেই সে এক লাফে গাছে উঠে পড়লো।
বাবা বলল, মেঘ হারকিপ্টে লোক। ও তোর আবেগ বুঝবে না। সারা গাঁয়ের লোক ডেকে আমার বিচার করবে। ‘করুক গে। তুমি সেটা বুঝবে। আমার এখন কাঁঠাল খেতেই হবে।’ অতি দ্রুত সে গাছের মগডালে উঠে লম্বাটে ডালের নিচে পরপর ঝুলে থাকা পাঁচটা কাঠাল টিপে বলল, সবগুলো পেকে গেছে।’ ‘তা পাকুক। তুই একটা পার বাবা। মেঘ আমাকে তছনছ করে ফেলবে।’
গকুল সবচে বড় কাঁঠালের বোঁটা ডান হাত দিয়ে ছিড়তে গেল। অনেকক্ষণ টানাটানি করল। কন্তিু কিছুতেই ছিড়তে পারল না। সে বিরক্ত হয়ে কাঁঠালের উপরের অংশের পুরুট ছাল তুলে কোষ বের করে টপাটপ খাওয়া শুরু করল। হারা তার ছেলের কাঁঠালকান্ড দেকে বলল, যতটুকু পারিস খেয়ে নেমে আয়। কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হবে। সে বাবার কথা কেয়ার না করে গভীর মনোযোগ দিয়ে খেয়ে চলল।
মধ্য দুপুর বলে আশপাশে কোন মানুষ ছিল না।
রাস্তায় হঠাৎ মটরসাইকেলের আওয়াজ শোনা গেল।
হারা আবার বলল, নেমে আয় বাবা। যথেষ্ট খাওয়া হয়েছে। মনে হচ্ছে কে যেন আসছে। ‘না বাবা। এখনো পেট ভরেনি। আরেকটু খেয়ে নামবো।’সে খেতে খেতে একটা বড় কাঁঠালের প্রায় অর্ধেক অংশ খেয়ে ফেলল। তখনও বাবা তাকে বলেই যাচ্ছে নেমে আয় বাবা। গকুল বলল, তুমি সরে যাও। এখন কাঁঠাল ছিড়ে পরবে।
তার কথা ভাল করে বুঝে ওঠার আগেই কাঁঠালের অর্ধাংশ ছিড়ে বাবার মাথায় পড়লো। সমস্ত শরীর রসে ভিজে গেল। তবু সে ছেলের উপর রাগল না।
এ দৃশ্য গকুল উপর থেকে দেখে রেগে মগডালে বসে অন্য পাকা কাঁঠালগুলোকে একের পর এক লাথি মেরে রাস্তার উপর ফেলে দিলো।
কাঁঠালের রসে কোষে সমস্ত রাস্তা ভিজে আলাদা দৃশ্য হয়ে উঠল। সে খুব সর্তকতার সাথে আস্তে আস্তে গাছ থেকে নেমে বলল, বাড়ি চল।
‘বাড়ি-তো যাব। কন্তিু তুই যে অঘটন-ঘটালি এ গাঁয়ে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।’
তারা কিছু আগে মটরবাইকের যে শব্দ শুনতে পেয়েছিল তা সত্যি হলো। খেয়াল করে দেখল মেঘ মটরবাইক নিয়ে তাদের দিকে আসছে।
গকুল তাকে দেখে বলল, বাবা আমি চললাম। তুমি পরে আস।
বলেই সে মাছ ফেলে এক দৌড়ে পালিয়ে গেল পাশের ঝোপের ভেতর দিয়ে জঙ্গলের দিকে। মেঘ কাঁঠাল গাছের নিচে এসে কাঁঠালের দুরবস্থা দেখে বলল, এ কাজ কে করেছে? তোর ছেলে পালালো কেন? হারার মুখে কোন কথা নেই। সে মাটির মত নিশ্চুপ হয়ে আছে। মেঘ আবার বলল, আমাকে এখনও বল, আমার গাছের কাঁঠাল কে ছিড়ে রাস্তায় ফেলেছে? তুই না বললে এখনই তোকে কাঁঠালের ডাল ভেঙে পশুর মত পিটাবো। তবু তার মুখে কোন কথা নেই। মেঘ তখন পাশের ছোট গাছ থেকে একটা কাঁচা মোটা ডাল ভেঙে হারার পিঠের উপর সবচে শক্তি দিয়ে আঘাত করল।
তখন সে ভয়ে বলে উঠলো, আমার ছেলে তোর কাঁঠাল ছিড়েছে ।
মেঘ আরও ক্ষেপে গিয়ে চোখ দুটি মধ্য দুপুরের সূর্যের মত লাল টকটকে করে বলল, তোর ছেলের কত বড় সাহস, আমার গাছের কাঁঠাল রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে। তার নামে বিচার বসাব। সারা এলাকায় জুতার মালা পরিয়ে ঘুরাব।
হারা তার কথা শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে বলল, দেখ্ মেঘ, আমার ছেলেকে এত বড় অপমান করিস না। ও খুব সেন্টিমেন্টাল। আমি ওকে কখনো রাগ করি না। ওকে অপমান করলে ও মানতে পারবে না। প্রয়োজনে আমি গোপনে ধান বিক্রি করে তোকে ক্ষতিপূরণ দেব।
মেঘ বলল, তোর কোন কথায় কাজ হবে না। সে আমাকে বহুত জ্বালাইছে। এর আগে রাতের অন্ধকারে বন্ধুদের সাথে করে এক বিঘা জমির কলাগাছ কেটে দিয়েছিল। তখনও তোর জন্য ওকে শাস্তি দিতে পারিনি। এবার ওকে কোন ছাড় দেওয়া হবে না।
‘সেটি ছিল তোর মিথ্যা অনুমান। আমার ছেলেকে আমি সবচে ভাল জানি। ওতো বড় সাহস ওর এখনও হয়নি। তোর শত্রুরা এ কাজ করেছিল। পরের মাসে গ্রামের মানুষ সেই ঘটনার সত্য প্রমাণ পেয়েছিল।
আমার ছেলে এখনও যা করে সম্পূর্ণ আবেগের ঘোরে। বন্ধুদের সাথে নিয়ে মজা করে। তুই এগুলো এত কঠিনভাবে নিস কেন?’
‘তুই বেশী কথা বলিস না। চুপ করে বাড়ি চলে যা। আবার যদি বেশী বাড়াবাড়ি করিস, তোদের একঘরে করব।’
সে মেঘের হাতে মার খেয়ে, গালিগালাজ শুনে, হুমকি পেয়ে মাথা নিচু করে বাড়ি ফিরছে। ফাঁকা রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় ভাবল তারও তো বড় বংশ, লাঠিয়াল, লোক-লষ্কর, শহরের কোর্টে উকিল ব্যারিষ্টার সব আছে। সে যদি মনে করে মেঘের সাথে তুমুল যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে।
কন্তিু তার অন্তর একাকার হয়ে আছে গকুলের অন্তরের সাথে। সন্তান হারানোর বেদনা সে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে। প্রথমে তিনটা সন্তান চলে যাবার পর তার স্ত্রী পাগল হয়ে গিয়েছিল।
তাকে বড় শহরে নিয়ে একটানা তিন বছর চিকিৎসা দেবার পর সুস্থ হয়েছে।
আত্মীয়-অনাত্মীয়রা বলত, তোর কপাল পোড়া। না হলে তিন-তিনটা সোনার মত সন্তানকে হারাতে হয়! ওই কালো কপালে আর সন্তান নেই।
তারপরও বিধাতা শেষ পর্যন্ত তাকে নিরাশ করেননি। মানব সমাজে মুখ রেখেছেন।
তবে পুরনো কষ্টগুলো মনে পড়লে এখনও তার চোখে জল নেমে আসে। সে অস্থরি হয়ে ওঠে। নিজেকে সামলাতে পারে না। ভাবে যত ঝড় নিজের উপর দিয়ে যাক। গকুল ও তার মাকে বুঝতে দেবে না।
বাড়ির খুব কাছে এসে কষ্টকে আড়াল করার জন্য সে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে। পুকুরের ঘাটে যেয়ে হাতে মুখে পানি দিয়ে নিল।
তার চোখ লাল টক্টক্ করছে সেজন্য ভাবছে কারো চোখের দিকে তাকাবে না। কন্তিু পিঠের দাগ কিভাবে লুকাবে?
সে বাড়ির ভিতরে ঢোকা মাত্র গকুলের মা ছুটে এসে বলল, গকুল কোথায়? সেই সকাল থেকে তার জন্য অপেক্ষা করছি। সারাদিন কিছু খায়নি। তোমাকে আনতে পাঠিয়েছি সকালে। এখন দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে।
তোমার এ অবস্থা কেন? কেমন যেন অসুস্থ দখোচ্ছে। কি হয়েছে সত্য কথা বল।
সে বলল, তোমার ছেলে আসার পথে মেঘের গাছের কাঁঠাল ছিড়েছিলো। মেঘকে আসতে দেখে ঝোপের ভেতর দিয়ে জঙ্গলে পালিয়েছে।
‘তুমি তাকে না নিয়ে আসলে কেন?’
‘ও চলে আসবে? আমার শরীরটা বিশেষ ভাল লাগছে না।’
সে ঘরের ঢুকে শার্ট না খুলে বসে পড়ল। কারণ শার্ট খুললে তার পিঠে মারের দাগ সবাই দেখে ফেলবে।
তখন মেঘের বিরুদ্ধে ঝড় শুরু হয়ে যাবে। এজন্য ভাবছে যত কষ্ট সব হজম করবে। তবু গ্রামে অশান্তি হতে দেবে না।
গকুলের জন্য তার মা অপেক্ষা করতে থাকল। কখন সে বাড়ি আসবে। অপেক্ষা করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল এসে গেল। তবু তার বাড়িতে ফেরার ভাব দেখা যাচ্ছে না।
শেষ পর্যন্ত হারা আবার বাড়ি থেকে বের হচ্ছে তাকে খুঁজতে।
তাকে বের হতে দেখে গকুলের মা ছুটে এসে বলল, কি ব্যাপার তুমি না খেয়ে একা কোথায় যাচ্ছ? তোমাকে খুব চিন্তিত দখোচেছ। আমার কাছে কি কিছু লুকাচ্ছ?
‘না, কি লুকাব? আমি ঠিক আছি। তুমি বাড়িতে থাক। আমি ওকে ডেকে নিয়ে আসি।’
এর মধ্যে গকুলের দাদির সাথে পাশের বাড়ি থেকে দু একজন নিকট প্রতিবেশী এসে পড়ল।
গকুলকে খুঁজতে যাওয়া দেখে তারা বলল, সারাদিন তাকে দেখছি না। কোথায় গেছে?
বাড়িতে থাকলে সমস্ত পাড়া সে মাত করে রাখে। ছোট বাচ্চাদরে সাথে খেলাধুলা হৈচৈ করে। দেখতে খুব ভাল লাগে।
তার দাদি বলল, আমার গকুল কত সুন্দর। ওর মত লম্বা গৌর লাবণ্যমাখা ছেলে এ গাঁয়ে একটাও নেই।
সবাই ওর রুপে আকৃষ্ট হয়। তার গুণও আছে। সে ভাল পড়াশুনা করে। স্কুলে কত সুনাম।
গ্রামের অনেকের কাছে তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ থাকলেও দাদির কাছে সে সবচে ইনোসেন্ট।
হারা হাঁটতে হাঁটতে প্রথমে গেল গ্রামের শেষ মাথায় ছোট জঙ্গলের কাছে। সেখানে অনেক রকম ফলের গাছ রয়েছে। সেখানে সে গকুলের কয়েকজন বন্ধুকে পেল কন্তিু তাকে পেল না।
তারপর গেল স্কুলের মাঠে। সেখানে যেয়ে দেখল অনেক ছেলেমেয়ে এক সাথে খেলা করছে। এক দল ক্রিকেট, অন্য দল দৌড় ঝাপ করছে। তাদের কেউই গকুলের কথা জানে না।
সে আবার ছুটতে ছুটতে গেল নদীর কাছে। যেখানে সে সকালে মাছ ধরতে ছিল। সেখানেও নেই।
সে কষ্টমনে নদী থেকে ফিরছে। চিন্তা করছে গকুলকে কোথায় গেলে পাওয়া যাবে।
ততক্ষণে বিকেল নেমে পড়েছে। সূর্য সারাদিন আলো দান শেষে ক্লান্ত হয়ে নিভে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশে।
ফাঁকা মাঠ, হেমন্ত নদী, তার পাশের জঙ্গল থেকে হেমন্তের হালকা ঝড়ের মত পাতলা বাতাস এসে খেলা করছে।
প্রকৃতিতে আনন্দ থাকলেও তার মনে বেদনা। অতি আদরের সন্তানকে সে খুঁজে পাচ্ছে না।
গকুলের প্রকৃতি অস্থরি হলওে বাবার মনের কাছে সেই পৃথিবীর সবচে স্থরি। শান্ত স্বভাবের।
সে বাড়িতে না ফিরে গেল বাজারে। যে দোকানে বসে গকুল মাঝেমধ্যে বন্ধুদের সাথে আড্ড দেয়। চা পান করে। সেখানে যেয়ে দেখল অনেক মানুষ বসে হাসাহাসি করছে।
সে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, গকুল এসেছিলো?
‘না, ও গতকাল থেকে একবারও আসেনি। কি হয়েছে?’
‘না। কিছু হয়নি। ওকে খুঁজে পাচ্ছি না।’
‘সে-তো গ্রামের বাইরে কোথাও যায় না। কোথাও বন্ধুদের সাথে খেলা করতে পারে। খুঁজে পাবেন নিশ্চয়।’
তার কথায় হারা একটু হলেও মনের আরাম পেল।
দোকানদার আবার বলল, চা পান করেন। ভাল লাগবে।
‘না। চা খেতে ইচ্ছে করছে না। আগে তাকে খুঁজি। পরে এসে চা পান করে যাব।’
হারা বাজারের দোকানে, পাশের রাস্তায়, একটু দূরের বাসষ্ট্যান্ডে, সব জাগায় খুঁজল। কন্তিু কোথাও পেল না। সে ভাবছে বাড়িতে ফিরে তার মায়ের কাছে কি জবাব দেব।
বিকেলও চলে যাবার মুহূর্ত এসে যাচেছ। একটু পরে অন্ধকার ডানা মেলবে পৃথিবীতে। সারাটা দিন চলে গেল। তবু তাকে পাওয়া গেল না।
সারাদিন আলো ছিল, ভালো ছিল। আলো আনন্দের। অন্ধকার বেদনার, কষ্টের, ভয়ের। রাত নেমে এলে কোথায় খুঁজব গকুলকে?
সে বুঝতে পারছে না কি করবে? বাড়িতে ফিরে যাবে? নাকি আরও খুঁজবে? বাড়ির সবাইতো খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। কখন সে গকুলকে সাথে নিয়ে ফিরে আসবে বাড়িতে।
সে বাজারের ভেতর দাঁড়িয়ে পথের দিকে তাকাচ্ছে। যে পথে শত শত হাজার হাজার মানুষ আসা যাওয়া করছে। গকুলের বয়সী অনেক ছেলে আসছে। কাজ শেষ করে আবার বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে।
তাকে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার চাচাত ভাই ছুটে এসে বলল, কি হয়েছে? তুমি এত চিন্তিত কেন? কেউ কি খারাপ কিছু বলেছে?
‘না। কে-কি বলবে? গকুলকে খুঁজে পাচ্ছি না। বাড়ির সবাই খুব কষ্টে আছে। সন্ধ্যা হয়ে গেল। তবু তার দেখা নাই।’
‘তুমি বাজারে একটা মাইকিন কর। ওতো পাশের গ্রামে খেলতে যেতে পারে।’
‘বাড়ির বাইরে বলতে বাজার, স্কুল, নদী পর্যন্ত যায়। পাশের গ্রামে ওর কোন বন্ধু নেই।’
সে তার ভায়ের কথা শুনে বাজারের মানুষের মাঝে প্রচার করল গকুলকে দুপুরের পর থেকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। তার কথা কানে কানে কানাকানি হতে হতে বাজার থেকে বাড়ি বাড়ি তারপর সমস্ত গ্রাম এমনকি পাশের সব গ্রামে পৌছে গেল।
আস্তে আস্তে অন্ধকার রাত নেমে ইলেকট্রিক বাতি গুলো আলো দিতে আরম্ভ করেছে। সে বাড়িতে যেয়ে দেখল প্রচন্ড কান্নাকাটি চলছে।
তার মা, বউ, আত্মীয় পরিজন শিশুর মত কাঁদছে। পাড়া বাসিরা তার উঠান ভরে গেছে। সবাই আতঙ্কিত দুখিত। গকুলের মত একজন উদিয়মান কিশোর মুহূর্তের মধ্যে নাই হয়ে গেল।
রাত বেশী হওয়ার সাথে সাথে তার বাড়িতে নিজ গ্রাম ছাড়াও পাশের গ্রামের লোকজনের ভিড় বাড়ছে। কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নাই।
মনে হচ্ছে যেন তার জীবনের সবচে মূল্যবান কোন কিছুকে হারিয়ে ফেলেছে। সে মাটিতে বসে মাটির দিকে তাকিয়ে অঝর বৃষ্টির ধারার মত কাঁদছে।
কোনভাবেই নিজেকে বোঝাতে পারছে না। তার বিশ্বাস হচ্ছে না গকুল আবার কোন দিন ফিরে এসে তাকে বাবা বলে ডাকবে।
গকুলের মা উঠানের অন্যপাশে কাঁনতে কাঁনতে জ্ঞান হারিয়ে প্রতিবেশীর কোলের উপর কাত হয়ে পরেছে। তার মাথায় তাল পাখার বাতাস ও ঠান্ডা তেল মালিশ চলছে।
গ্রামের লোকজন তাদের দুরবস্থা দেখে বলল, হারার তিন সন্তান পরপর মারা যাবার পর গকুল হয়েছিলো। বিধাতা অনেক দয়া করে তাকে দান করেছিলো। সেও যদি সত্যি হারিয়ে যায় তার পরিবার হবে পৃথিবীর দুখী পরিবার।
তারা হারার কাছে জানতে চাইলো নদী থেকে আসার পথে কি ঘটেছিলো।
সে বলল, মেঘের গাছে পাকা কাঁঠাল দেখে গাছে উঠে কোষ খেয়ে কয়েকটি কাঁঠাল রাস্তার উপর ফেলে দিয়েছিলো।
তারপর মেঘকে গাছের দিকে আসতে দেখে ভয়ে ঝোপের ভেতর দিয়ে জঙ্গলের দিকে পালিয়েছে। তখন থেকে বাড়ি আসেনি। তারপর থেকে তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তার কথা শুনে গ্রামের লোকজন বলল, আমরা এখন তাকে খুঁজতে বের হব। যেভাবেই হোক খুঁজে বের করব।
তাদের কথা শুনে হারা, গকুলের মা, দাদি, আত্মীয়-স্বজন সবাই আশান্বিত হয়ে ভাবল এবার তাকে পাওয়া যাবে।
সমস্ত গ্রামবাসী সারারাত বালুর চরে, হেমন্ত নদীতে, ঝোপে জঙ্গলে, ধানমাঠে, তার স্কুলের পেছনের ছাতিম বাগানে সব জায়গায় খুঁজল।
খুঁজতে খুঁজতে ভোর হয়ে গেল। একটু পরে সকালের নতুন আলো ফুটবে।
তারপর দিন এসে চলে যাবে রাতের দিকে।
আবার রাতটা সময়মত অন্ধকার হারিয়ে মিশে যাবে দিনে।
অন্যদিনের মত স্বাভাবিকভাবে প্রাত্যহিক কাজ কর্ম চলবে। কন্তিু মেঘকে কখন কোথাও পাওয়া যাবে না।