জুলাই-২০২৩ এ প্রকাশিত হয়েছে কবি অনন্ত উজ্জ্বলের অনুবাদ গ্রন্থ কানাডিয়ান কবি মার্গারেট অ্যাটউডের কবিতা । বইটি প্রকাশ করেছে স্বদেশ শৈলী প্রকাশনী।
মার্গারেট অ্যাটউড কবি, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক, ছোটগল্পকার এবং প্রাবন্ধিক। এর বাইরে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত নারীবাদ, পরিবেশবাদ, সামাজিক ন্যায় বিচার এবং মানুষ হিসেবে মানুষের বেঁচে থাকার যে অধিকার এইসব বিষয়ে আন্দোলনকারী হিসেবে। কানাডার অটোয়া শহরে ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণকারী অ্যাটউড টরেন্টো ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথাক্রমে বিএ এবং এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি কানাডার জীবিত লেখকদের মধ্যে অন্যতম সেরা লেখক। তাঁর লেখা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং তাঁর নিজ দেশের সমালোচকদের কাছে প্রসংশিত হয়েছে। সাহিত্যে সম্মানজনক পুরস্কারের প্রায় সবগুলো পুরস্কারই তিনি পেয়েছেন। আন্তর্জাতিক বুকার প্রাইজ, আর্থার সি ক্লার্ক পুরস্কার-এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। অ্যাটউডের বই সব সময় বেস্ট সেলারের তালিকায় থাকে এবং তাঁর কাহিনির উপর ভিত্তি করে বেশ কয়েকটি সিনেমা ও টেলিভিশন সিরিজ তৈরি হয়েছে।
১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতার বই Double Persephone. জীবন ও শিল্পের মধ্যে যে নাটকীয় বৈসাদৃশ্য আছে তা এই কাব্যগ্রন্থের বিষয়বস্তু। এই বইটি সে সময়ের খুবই গুরুত্বপূর্ণ E.J. Pratt Medal জিতে নেয়। এরপর ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় The Circle Game নামের আরো একটি জনপ্রিয় কবিতার বই। এই বইটি গভর্নর জেনারেল পুরস্কার অর্জন করে। তাঁর কবিতার এই বই দুটি তাঁকে কবি হিসেবে সকলের মাঝে পরিচিত এবং গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।
অ্যাটউডের রয়েছে প্রবলভাবে একদিকে শিল্পের প্রতি অন্যদিকে জীবনের প্রতি টান। অ্যাটউড সব সময় তাঁর অবস্থানের অন্যদিক সম্পর্কে সচেতন থাকেন। তিনি কবিতায় দ্বৈততাকে কখনো কখনো বিচ্ছেদ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এই বিচ্ছেদ তাঁর চরিত্রগুলোকে একে অপরের থেকে এমনকি প্রাকৃতিক জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে। অ্যাটউড এমন কিছু বিষয় কানাডিয়ান সাহিত্যে উপস্থাপন করেছেন যা কিনা আমেরিকান এবং ব্রিটিশ সাহিত্য থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি বলেন, ‘একজন লেখককে অবশ্যই তাঁর দেশের সাহিত্য ঐতিহ্যের ভিতর থেকে কাজ করতে হবে’ এবং সেভাবেই তিনি তাঁর লেখালেখি করে আসছেন।
নারীদের অবস্থান, অসহায়তা, সংগ্রাম এই বিষয়গুলো বারবার তাঁর রচনার বিষয় হয়ে এসেছে। তাঁর অনেক রচনায় নারীই প্রধান চরিত্র তারপরও তিনি কখনোই বিশ্বাস করেন না, নারীরা যা করেন তার সবই ঠিক, যা বলেন তা কখনোই ভুল না। এটা পরিস্কার নারীবাদ তাঁর রচনায় ‘বুঝতে চাওয়া এবং বুঝাতে চাওয়া’ এমন এক নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হয়েছে।
অ্যাটউডের জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে। তাই তাঁর দেখায়, বলায়, বলতে চাওয়ায়, সর্বোপরি লেখায়, যুদ্ধের এমন এক বাতাবরণ তৈরি হয়, সেখান থেকে আমরা বুঝতে পারি এ যুদ্ধ যতটা না বাইরে তার থেকেও অনেক বেশি ভিতরে― নিজের সঙ্গে!
কবি অনন্ত উজ্জ্বলের অনুবাদ গ্রন্থ কানাডিয়ান কবি মার্গারেট অ্যাটউডের কবিতা বই থেকে তিনটি কবিতা চাতাল এর পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।
পোড়া বাড়িতে সকাল বেলা
পোড়া ঘরের মধ্যে আমি নাস্তা খাচ্ছি।
তুমি জানো: এখানে কোনো ঘর নেই,
এখানে কোনো নাস্তাও নেই,
অথচ আমি এখনো এখানে আছি।
যে গলিত চামচ দিয়ে বাটি ঘষছি
সেই বাটিও গলে যাচ্ছে
তার আশেপাশে কেউ নেই।
কোথায় গেছে তারা,
ভাই বোনেরা,
মা-বাবা;
নিঃসঙ্গ তীরের দিকে গেছে কি?
সম্ভবত ঘরের মধ্যে
এখনো তাদের জামাকাপড় ঝুলছে౼ হ্যাংগারে।
তাদের খাবার পাত্রগুলো স্তুপাকারে পড়ে আছে
সিঙ্কের পাশে,
সিঙ্কটা কাঠের চুলার পাশে-
তার সঙ্গে পড়ে আছে একটা ঝাঝরি
আর কালিমাখা একটা কেটলি।
প্রত্যেকটি বিষয়ের বর্ণনা স্পষ্ট,
টিনের কাপ এবং একটি ঢেউ খেলানো আয়না।
সবকিছু দিনের আলোর মতো ঝকঝকে কিন্তু সুরহীন,
হ্রদে নীল রঙের পানি,
তার পাশে ౼ জেগে আছে বন।
পূর্ব দিকে
পোড়া কালো রুটির মতো মেঘ,
নীরবে উড়ে যাচ্ছে।
আমি অয়েলক্লথের উপর দেখতে পাচ্ছি সেই ঘূর্ণায়ন,
আমি গ্লাসের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি তার ভুলক্রটি,
সেই অগ্নিশিখায় আঘাত করছে সূর্য!
আমি আমার নিজের হাত-পা দেখতে পাচ্ছি না
আমি জানি না; এটা কোনো ফাঁদ ౼ নাকি আশীর্বাদ,
এখানেই খুঁজে ফিরি নিজেকে, কোথায় সেই সবকিছু?
এই বাড়ি অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে,
কেটলি আর আয়না, চামচ আর বাটি,
আমার শরীরসহ,
আমার তখনকার শরীরসহ
আমার এখনকার শরীরসহ
মনে হচ্ছে আমি যেন সকালে এই টেবিলে বসে ছিলাম,
একা এবং আনন্দে,
ঝলসে যাওয়া ফ্লোরবোর্ডে শিশুর খালি পা
সম্ভবত আমি দেখতে পাচ্ছি;
আমার পোশাকে আগুন, পাতলা সবুজ জামা
এবং নোংরা হলুদ টি-শার্ট
এখনো পুড়ছে, অস্তিত্বহীন অবস্থায়
দীপ্যমান মাংসপিণ্ড, দ্যুতিময়।
ছায়ার কথা
আমার ছায়া আমাকে বলে:
কী হয়েছে?
চাঁদের আলো কি তোমার জন্য যথেষ্ট না
তাহলে কেন
অন্যের শরীরের কম্বল
তোমার প্রয়োজন হয়
যার আদরে কোনো উৎস নেই
পিকনিক টেবিলের চারপাশে ౼
সামান্য দূরে
উজ্জ্বল গোলাপী হাতে ধরা আছে স্যান্ডউইচ
মাছি ভনভন করছে তার উপরে
তুমি কী জানো সেই কম্বলে কি আছে?
শিশুর বন্দুকের গুলির সঙ্গে বেঁকে যাচ্ছে
বাইরের গাছগুলো। তাদের কথা বাদ দাও।
তারা তো খেলছে তাদের নিজস্ব খেলা।
আমি পরিস্কার পানি এবং রুটি দেই
তোমার শিরায় প্রবাহিত করে
তোমাকে চলমান রাখার জন্যে
এর থেকে অধিক কোনো কিছু করার নেই।
তুমি আমার হাত ধরো
তুমি আমার হাত ধরলে
আর আমি একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে চলে গেলাম,
এইভাবে চলছে তো চলছেই
কেন তোমার প্রতি আমার এই মুগ্ধতা?
আমরা ধীরে ধীরে নাচলাম
সজীব বাতাসের মধ্যে অকৃপণভাবে
আমরা সাক্ষাৎ করেছিলাম ౼
সারি সারি টবে লাগানো গাছের পেছনে
তুমি ভুল গন্তব্যের দিকে যাচ্ছিলে
অন্য মানুষেরাও চলে যাচ্ছিল
কিন্তু আমি সব সময় শেষের জন্য অপেক্ষা করি
আমি টাকা পরিশোধ করেছি,
এখন আমি দেখতে চাই এর পরে কী হয়
সুযোগ পেলেই বাথটাবে
তুমি আমি একাকার হয়ে যাবো
ধুয়া হয়ে ౼
গলিত সেলুলয়েডের মতো
আসক্তের মতো শেষ পর্যন্ত আমাকে
এর মুখোমুখি হতে হবে,
পুরাতন পরা কাপড় এবং পপকর্নের গন্ধ
কয়েক সপ্তাহ ধরে থাকে।
অনন্ত উজ্জ্বল-কবি ও অনুবাদক। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঝিনাইদহে।
প্রকাশিত বই : মোট প্রকাশিত বই ৯টি। ছায়া নীরবতা (কবিতা, ২০১৪), অনুবাদ গ্রন্থ- পোল্যান্ডের কবি কামিল নরভিদের কবিতা (অনুবাদ, ২০১৫), অস্ট্রিয়ার কবি গেওরগ ট্রাকলের কবিতা (অনুবাদ,২০১৬), পোল্যান্ডের রূপকথা (অনুবাদ, ২০১৮), পাতাহীন বৃক্ষ অথবা কালো গাছ-কঙ্কাল, পোল্যান্ডের নোবেল জয়ী কবি ভিসওয়াভা সিম্বোরস্কার’র কবিতা (অনুবাদ, ২০১৯), মঙ্গোলিয়ান কবি হাদা সেন্দোর কবিতা চাঁদের আলোয় যাযাবর গান (অনুবাদ, ২০২০), কানাডিয়ান কবি মার্গারেট অ্যাটউডের কবিতা (অনুবাদ,২০২৩) ইত্যাদি। সম্পাদিত ছোটকাগজ– ঢোলসমুদ্দুর।
তিনি ২০১৭ সালে ‘চতুর্থ আন্তর্জাতিক পোলিশ লিটারেচার ট্রান্সলেটরস কনগ্রেসে’ অংশগ্রহণ করেন। যা পোল্যান্ডের ক্রাকোভ শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সেসময়ে তিনি পরিচিত হন পোল্যান্ডের তরুণ, প্রতিশ্রুতিশীল কবি-লেখক ও অনুবাদকদের সাথে। কবি অনন্ত উজ্জ্বল ভ্রমণ করেছেন এশিয়া-ইউরোপ, আমেরিকাসহ ২০টিরও বেশি দেশ। তিনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের উপপরিচালক হিসেবে ঢাকায় কর্মরত।