২৫ মার্চ ১৯৭১, সূর্য ডুবল পাঁচটা বেজে চুয়াল্লিশ মিনিটে। ঠিক এক মিনিট পরেই ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া সোজা এয়ারপোর্ট চলে গেলেন। এর আগেই বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া সিরিজ বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যায়। পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট বিমানে করাচী পাড়ি দিলেন। শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাঙালী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে পালালেন। ২৫ শে মার্চের কালো রাত – স্বাধীনতার ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত গা হিম করা এক রাত! এই রাতের প্রতিমুহূর্ত জানার অদম্য কৌতূহল কাজ করে স্বাধীনতা প্রিয় এবং এখনও অন্তরে পাকিস্তান প্রিয় সবার ভেতরে। অনেক আলোচনা, তথ্য উদঘাটন, ইরফরমেশন ডায়াগনসিস হয়েছে এই রাতের কুখ্যাত-বিখ্যাত ঘটনাগুলো নিয়ে। তার ভেতরে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ছিলো সেই রাতে পাকিস্তান আর্মির হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আটক হওয়া নিয়ে। সেটা কি আত্নসমর্পন না গ্রেফতার ছিলো? সেটা কিভাবে ঘটেছিলো ?
এই নিয়ে খোদ সেই ঘটনার ভিলেন পাকিস্তানী আর্মির ব্রিঃ জেনাঃ জহিরুল আলম খান নিজেও বই লিখেছেন “দ্য ওয়ে ইট ওয়াজ”। সিদ্দিক সালিকের বই , মুসা সাদিকের টিক্কা খানের সাক্ষাৎকার নেয়া অনেক কিছুই হয়েছে ২৫শে মার্চের ইনফরমেশন ডায়াগনসিস করতে গিয়ে। তাই বিষয়টা নিয়ে আর জানার কিছু নেই ভেবে ক্ষান্ত দিয়েছিলাম। কিন্তু নানাভাবে সেদিন রাতের ঘটনাগুলোর টুকরো টুকরো প্রামান্যের সাথে পরিচিত হতে হতে মনে হলো এগুলো একসাথে করে জানালে ২৫শে মার্চ ১৯৭১ এর একটা পরিষ্কার অবয়ব পাওয়া যাবে। তবে সবগুলো ঘটনাকে সাজাতে গিয়ে শেষ অনুসিদ্ধান্তটি আসলো শেখ মুজিবের নেতৃত্ববীর্য কে ম্লানকরাই ছিল এর মূল লক্ষ্য।
ঢাকার পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলে বঙ্গবন্ধুকে শুভাকাঙ্ক্ষীরা বাসা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়ার অনুরোধ করেছিলেন। তাঁর জন্য হেলিকপ্টারও প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কিন্তু বাঙালির নেতা জানতেন, পাকিস্তানি বাহিনী তাকে না পেলে কোনো বাঙালিকে বাঁচতে দেবে না। সে রাতে তাকে না পেলে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়া হতো পুরো শহর। এদিন জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে ইয়াহিয়া বলেছিলেন, ‘মুজিব এ দেশের অখন্ডতা ও নিরাপত্তার ওপর আঘাত হেনেছেন। এ অপরাধের জন্য তাকে শাস্তি পেতেই হবে। দেশের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য আজ আমি দেশব্যাপী রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
জবাবে এদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ইয়াহিয়া খান সমস্যা সমাধানের জন্য সামরিক ব্যবস্থা বেছে নিলেন আর এখানেই পাকিস্তানের সমাপ্তি হলো !
দেখা যাক সেদিন রাতের ঘটনাক্রম:
সন্ধ্যা ৬:০০ :
সুপরিচিত পাকিস্তানী সাংবাদিক তারিক আলীর পিতা মাজহার আলী এবং রেহমান সোবহান শেখ মুজিবের সাথে দেখা করেন এবং তাকে জানান মিলিটারী ক্র্যাকডাউন আসন্ন।
[সূত্র: বাংলাদেশের অভ্যুত্থান এবং একজন প্রতক্ষ্যদর্শীর ভাষ্য , রেহমান সোবহান, ভোরের কাগজ প্রকাশনী , ১৯৯৪]
শেখ মুজিব এরপর ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকেন। এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১জন সংবাদবাহক স্থানীয় এবং বিদেশী সাংবাদিকদের মাঝে ১টি প্রেসনোট বিলি করেন যেটিতে উল্লেখ করা হয়: “প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনা চুড়ান্ত হয়েছে, ক্ষমতা হস্তান্তরের মতানৈক্য হয়েছে এবং আমি (বঙ্গবন্ধু) আশা করি প্রেসিডেন্ট তা ঘোষনা করবেন“। এবিষয়ে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বলেন: “আমার দুঃখ হয় , এই নির্বুদ্ধিতা সম্পর্কে আমার কোন মন্তব্য নেই”
[সূত্র: রেপ অব বাংলাদেশ, অ্যান্থনি মাসকারেনহাস, অনুবাদ মযহারুল ইসলাম ,১৯৭৩ , পৃষ্ঠা:১১৩ ]
২৫ শে মার্চ ইয়াহিয়া এবং ভুট্টোর ভেতর ৪৫ মিনিটের ১টি মীটিং হয়।
শেখ মুজিব পূর্বঘোষনা অনুযায়ী ২৫শে মার্চে ইয়াহিয়ার ভাষনের জন্য অপেক্ষা করেন।
সন্ধ্যা ৬:০০ টা পরবর্তী:
ইয়াহিয়া করাচীর উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। তার এই ঢাকা ডিপারচার এর প্রতক্ষ্যদর্শী ছিলেন ২ জন বাঙালী সামরিক কর্মকর্তা।
১. ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে এটি প্রতক্ষ্য করেন লে. কর্নেল এ. আর চৌধুরী।
২.বিমানবন্দরে এটি প্রতক্ষ্য করেন এয়ারফোর্সের গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খোন্দকার।
শেখ মুজিব তখনো ১ টি ফোনকলের অপেক্ষায় ছিলেন।এবং ডঃ কামাল হোসেন কে বার বার জিজ্ঞেস করছিলেন কোন ফোন এসেছে কিনা। প্রতিবারই ডঃ কামালের উত্তর ছিলো না সূচক। ফোনটি আসার কথা ছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেঃ জেনাঃ পীরজাদার কাছ থেকে। কারণ ইয়াহিয়া বলেছিলো তার ভাষন প্রচারের আগে পীরজাদার সাথে শেখ মুজিবের ১টি ছোট বৈঠক হবে। সেই ফোনকল আর আসেনি কোনদিন।শেখ মুজিবও বুঝতে পারেন সব আশা শেষ। ইয়াহিয়া ধোঁকা দিয়েছে।
[সূত্র : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, জীবন ও রাজনীতি, ১ম খন্ড, সম্পাদক মোনায়েম সরকার, বাংলা একাডেমী ২০০৮ পৃষ্ঠা:৪৪৭ ]
রাত ৮:০০:
এরকম একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে এইচ এম কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম শেখ মুজিবের সাথে দেখা করে চলে যান। শেখ ফজলুল হক মনি ২৫ শে মার্চ সন্ধ্যায়ই টুংগীপাড়া চলে যায় এবং শেখ কামাল রাত ৯টায় ধানমন্ডী ৩২নং ছেড়ে যান।
[সূত্র : শেখ মুজিব, এস.এ. করিম, ইউপিএল, ২০০৫, পৃষ্ঠা ১৯৫]
রাত ৯:০০:
ডঃ কামাল হোসেন এবং ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম ৩২নং থেকে বিদায় নেন।
রাত ৯:১০:
ঠিক এই সময়েই প্রথমবারের মত গোলাগুলির শব্দ শুনেছেন জানান রেহমান সোবহান। [সূত্র : প্রাগুক্ত]
রাত ১০:৩০:
ইস্ট পাকিস্তান শিপিং কর্পোরেশনের এম.ডি. ক্যাপ্টেন রহমান এবং ২ জন এক্স নেভাল অফিসার কমান্ডার ফারুক এবং লে. মতিউর রহমান শেখ মুজিবের সাথে দেখা করতে আসেন। এ সময় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ প্রধান আব্দুর রাজ্জাক এর ১টি ফোন আসে শেখ মুজিবের কাছে এবং “ইপিআর কে ডিসার্মড করা হয়েছে” শেখ মুজিব কে এতটুকু বলতে না বলতে লাইন কেটে যায়।
[সূত্র : শেখ মুজিবের বাসভবনে সে সময় অবস্থানরত পারিবারিক কর্মচারী মমিনুল হক খোকা, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা – ৪৪৭-৪৮]
রাত ১১:০০:
আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ প্রধান আব্দুর রাজ্জাক শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাত করে তাঁকে আত্মগোপন করার অনুরোধ জানালে, শেখ মুজিব তাকে জানান তিনি বাসা ছেড়ে যাবেননা , মরতে হলে সেখানেই মরবেন।
[সূত্র : আর্চার ব্লাড, দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ, ইউপিএল, ২০০৬, পৃষ্ঠা ১৯৮]
রাত ১১:০০:
সিরাজুল আলম খান, আ.স.ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজের শেখ মুজিবের সাথে দেখা করে ধানমন্ডী ৩২নং ত্যাগ করেন। ওয়াজেদ মিয়ার বক্তব্য অনুসারে এটাই ছিলো শেখ মুজিবের সাথে কারো ঐ রাতে শেষ বৈঠক!
হঠাৎ করে থেমে গেল ঢাকা ! নেমে এলো কবরের নিস্তবদ্ধতা ! দানবের অশুভ শক্তির পদভারে কাঁপছিল পুরোদেশ। মানুষের রক্তের স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল সাঁদা মাটি। গন্ধ মিলিয়ে গেল হাসনাহেনার| এই দিনে রোদে পোড়া নগরীতে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চৈত্রের হাওয়ার দাপট বেড়ে চলছিল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিপ ও ট্রাক বোঝাই অস্ত্র এবং ট্যাঙ্কসহ অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে পাক সেনারা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। তারা ছক অনুযায়ী পজিশন নিচ্ছিল। গোলন্দাজ, সাঁজোয়া ও পদাতিক তিন বাহিনী থেকে বাছাই করা তিন ব্যাটালিয়ন ঘাতক অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়ন করতে সেনানিবাস থেকে বেরিয়েছিল। ঢাকায় সৈন্যরা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল ঘিরে ফেলে। হোটেলের অর্ভ্যথনা কেন্দ্রে কালো বোর্ডে চক দিয়ে একজন ক্যাপ্টেন লিখে দিয়েছিল বাইরে বেরুলেই গুলি। বিদেশি সাংবাদিকরা বেরোতে না পেরে রেডিও ধরলেন। কার্ফ্যুর ঘোষণা নেই। তবে বাইরে ট্যাঙ্কের শব্দ। সবাই ১২ তলায় ওঠেন। কিন্তু মেশিনগানের গুলি ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। ঢাকা-করাচি টেলিপ্রিন্টার লাইন কাটা। বন্ধ বেতারের সম্প্রচার। বাইরের পৃথিবী থেকে ঢাকা একেবারেই বিচ্ছিন্ন।
‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়নে রাত ১২টার কিছু পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছিল ট্যাঙ্ক ও সেনাবোঝাই গাড়ি। ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হলে মধ্যযুগীয় কায়দায় চলে হানাদারদের হত্যাযজ্ঞ। চলল বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত মচ্ছব। প্রতিটি রুমে ঢুকে ঘুমন্ত ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে পাক সেনারা। গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল জগন্নাথ হলের ১০৩ হিন্দু ছাত্রকে। হলের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে ঢুকে স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের একে একে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।
ওই রাতে মানুষরূপী ক্ষুধার্ত শকুনরা শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা রাতে বাবার সামনে মেয়েকে আর ছেলের সামনে মাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। কাউকে কাউকে বাঁচিয়ে রাখে নিহতদের কবর খোঁড়ানোর জন্য। তাদের দিয়েই একে একে লাশগুলো মাটিচাপা দেয়া হয়। কাজ শেষে তাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। সেদিন রাতে একযোগে ইকবাল হল ও রোকেয়া হলে তান্ডব চালায় পাক জল্লাদরা। তাদের হাত থেকে রক্ষা পাননি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও। ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিভিন্ন বিভাগের ৯ শিক্ষককে হত্যা করা হয়। হানাদাররা চলার পথে রাস্তার দুই পাশে ব্রাশফায়ার করে মেরেছিল অসংখ্য নিরীহ মানুষ। মেডিকেল কলেজ ও ছাত্রাবাসে গোলার পর গোলা ছুড়ে হত্যা করা হয়েছিল অসংখ্য মানুষ। চারদিকে রক্ত আর রক্ত, সারি সারি শহীদের লাশ। সেদিন হিংস্র পাক সেনাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে রোকেয়া হলের প্রায় ৫০ ছাত্রী ছাদ থেকে লাফ দিয়েছিল। নরপশুরা সেদিন হত্যা, ধর্ষণ, লুট, জ্বালাও-পোড়াও করেছিল শহরের সব জায়গায়।
এদিন রাতে রাজারবাগে পুলিশ সদর দফতরে পাক সেনাদের সাঁড়াশি অভিযানের মুখেও বাঙালি পুলিশ সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু ট্যাঙ্ক আর ভারি মেশিনগানের ক্রমাগত গুলির মুখে মুহূর্তেই গুঁড়িয়ে যায় সব ব্যারিকেড। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয় পুলিশ সদর দফতরে। ঝরেছিল ১১০০ পুলিশ সদস্যের রক্ত। মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চের রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সে রাতে সাত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার করা হয় আরও তিন হাজার লোককে। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘরবাড়ি, দোকানপাট লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক–শিয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।’
পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তানি সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয় : ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’ ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানি জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে নিরীহ বাঙালি বেসামরিক লোকজনের ওপর গণহত্যা শুরু করে। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ সব সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা।
অভিযানের ভিত্তিঃ
পাকিস্তানী পরিকল্পনাকারিদের গৃহিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অপারেশনের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন অংশ এবং স্বশস্ত্র বাহিনীর যারা সামরিক শাষনকালে আওয়ামী লীগকে সমর্থন জুগিয়েছে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। অপারেশনের সর্বোচ্চ সার্থকতার জন্য ধুর্ততা, চমকে দেয়া, প্রবঞ্চনা, এবং দ্রুতগতি ইত্যাদি বিষয়ের উপর জোড় দেয়া হয়। নির্বাধ এবং সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। সাধারণ জনবসতি এবং হিন্দু এলাকাগুলোতে অনুসন্ধান এবং আক্রমণের কর্তৃত্বও প্রদান করা হয়।
সাফল্যের শর্তঃ
- সমগ্র প্রদেশে একই সময়ে অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
- সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা ও ছাত্রনেতা এবং শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে যারা চরমপন্থী তাদের গ্রেফতার করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতাদের গ্রেফতার করতেই হবে।
- ঢাকায় অভিযানের ১০০% সাফল্য অর্জন করতেই হবে। এর জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল ও তল্লাশি করতে হবে।
- ক্যান্টনমেন্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ক্যান্টনমেন্ট আক্রান্ত হলে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যাপকতর ও স্বাধীনতর ব্যবহার করা যেতে পারে।
- আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সকল যোগাযোগ বন্ধ করতে হবে। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, রেডিও, টিভি, টেলিপ্রিন্টার সেবা, বিদেশী কনসুলেটের ট্রান্সমিটার বন্ধ করতে হবে।
- পূর্ব পাকিস্তানী সেনাদের নিষ্ক্রিয় করতে হবে, অস্ত্রাগার ও গোলাবারুদের নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষার দায়িত্ব পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের নিতে হবে। একই কথা খাটবে বিমানবাহিনী ও পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস [EPR] এর ক্ষেত্রেও।
এই কাল রাত ছিল আসলে পাকবাহিনীর গণহত্যা কার্যক্রমের শুরু। এরপর ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামে আবির্ভূত হয় মুক্তিকামী বাঙালি। এই দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধে অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রম গেছে, প্রাণ হারিয়েছেন অসংখ্য নিরীহ বাঙালি। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মধ্য দিয়ে এ ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে। এখনো পৃথিবীর ইতিহাসে বর্বরতম গণহত্যাগুলোর একটি মানা হয় এই ২৫ মার্চকে। তাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের জন্য ২৫ মার্চকে ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত একটি দিবস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবও মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে। আন্তর্জাতিকভাবেও দিবসটি পালনের জন্য ইতোমধ্যে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে যা খুব ইতিবাচক।