১৯৬৫ সাল। মেট্রিক পাস করেছি মাত্র। একটা চাকরিও পেয়ে যাই তখন। দিনাজপুরের হাউজিং অ্যান্ড স্যাটেলমেন্ট অফিসের ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট। কয়েক মাসের মধ্যেই আমার বিয়ে দেয় সবাই। কিন্তু সে আনন্দ বেশিদিন টিকে থাকেনি। প্রজেক্ট শেষ হওয়ায় বছর দেড়েকের মধ্যেই চাকরি হারাই। কেউ তখন পাত্তা দেয় না। ফলে কাজের সন্ধানে চলে আসি চট্টগ্রামে। লোকমুখে একদিন পুলিশে লোক নেওয়ার খবরটি পাই। লাইনে দাঁড়াতেই শরীরের মাপে ফিট। মেট্রিক পাস শুনতেই নিয়ে নিল। পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল হিসেবে যোগ দিলাম। ব্রাশ (বডি) নম্বর ছিল ১৯৯।
হালি শহরে ছয় মাস ট্রেনিং। অতঃপর পোস্টিং হয় কুমিল্লায়। পরে পুলিশ টেলিকমিউনিকেশন কোর্সের জন্য আমাকে পাঠানো হয় রাজারবাগে। ১৯৭১-এ ছিলাম ওখানকার ওয়ারল্যাস অপারেটর।
৭ মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণটি দেন রেসকোর্স ময়দানে। এরপর থেকেই রাজারবাগের পুলিশ ব্যারাকের অবস্থা বদলে যেতে থাকে। ওখানে অবাঙালি পুলিশ সদস্য যেমন ছিল, আবার বাঙালি হয়েও স্বাধীনতার বিপক্ষের লোকও ছিল। খেতে বসলেই ওরা অহেতুক আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতো। আগে এটা আমরা সহ্য করতাম। কিন্তু শেখের ভাষণের পর হাতাহাতি হতে থাকল।
রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুকুর পাড়ে আলোচনায় বসতাম। সিদ্ধান্ত হয় যা-ই ঘটুক আমরা প্রতিহত করব। কিন্তু কীভাবে? তা-ও জানা ছিল না! ভয়ও ছিল। কারণ তখন আমাদের বিপক্ষে ছিলেন এআইজি টেলিকমিউনিকেশনের প্রধান এসএম নবাব এবং ডিএসপি (ট্রেনিং) বজলুর রহমান মজুমদার।
২৫ মার্চ ১৯৭১, সকালবেলা। ঢাকা শহর থমথমে। পাকিস্তানি সেনারা হেভি মেশিনগান নিয়ে মেইন রাস্তাগুলো টহল দিচ্ছে। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।
আমাদের আবাসন ছিল মৌচাক মার্কেটের পাশে, ২০৬ নিউ সার্কুলার রোডের বাড়িটিতে। রাত তখন ৮টা ৩০ মিনিট। খবর আসে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি আর্মিরা যেকোনো সময় ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গা আক্রমণ করবে। তাই পোশাক পরে দ্রুত রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে চলে আসি।
তখন রোলকল হচ্ছিল। খবরটা তুলতেই সবাই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এর আগেই পালিয়ে যায় অবাঙালি পুলিশ সদস্যরা। আমরা ২০-৩০ জন ইন্সপেক্টর মফিজ উদ্দিনের কাছ থেকে চাবি এনে মেইন অস্ত্রাগার খুলে দিই। কমান্ড বলতে তখন কিছু ছিল না। উচ্চপর্যায়ের কেউ সাহায্যও করেননি।
থ্রি নট থ্রি রাইফেলসহ ম্যাগজিনভর্তি গুলি নিয়ে দু-তিনশ সদস্য পুলিশ লাইনসের ব্যারাক, প্রশাসন ভবনের ছাদ, পুকুর পাড়, রোডের পাশে ও মানুষের বাড়ির ছাদে পজিশনে চলে যায়। সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় তারা ব্যারিকেড দেয় মৌচাক, মালিবাগ, শান্তিনগর ও চামেলীবাগের ডন স্কুলের সামনে (বর্তমান ইস্টার্ন প্লাস মার্কেট)। ওই স্কুলের ছাদেও পজিশন নেয় ২০-২৫ জন পুলিশ সদস্য।
দুটো রাইফেল নিয়ে আমি আর মনির ওয়্যারলেস বেজ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণে থাকি, প্রশাসন ভবনের নিচতলায়। ওয়্যারলেস সার্কিটে বসে অপেক্ষায় আছি ওয়্যারলেসে কোনো ম্যাসেজ আসে কি না।
রাত তখন ১০টা ৩০ মিনিট। একটা মেসেজ পাই। তেজগাঁও এলাকায় পেট্রলে থাকা ওয়্যারলেস অপারেটর আমিরুল মেসেজ দেন।
বলেন: ‘চার্লি সেভেন ফর বেইস, হাউ ডু ইউ হেয়ার মি, ওভার।’
আমি প্রত্যুত্তরে বলি: ‘বেইস ফর চার্লি সেভেন, ইউ আর লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার, সেন্ড ইউর মেসেজ, ওভার।’
তখন তিনি বলেন: ‘চার্লি সেভেন ফর বেইস, অ্যাবাউট থার্টি সেভেন ট্রাকস লোডেড উইথ পাকিস্তানি আর্মি আর প্রসিডিং টুওয়ার্ডস ঢাকা সিটি ফ্রম দা ক্যান্টনমেন্ট।’
প্রায় ছয়-সাত শ লোক ছিল রাজারবাগে। একজন গিয়ে পাগলাঘন্টা বাজায়। ফলে বাকি পুলিশ সদস্যরাও আরেকটি অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্র নিয়ে পজিশনে চলে যায়।
রাত ১১টা ৩০ মিনিট। সর্বপ্রথম পাকিস্তানি আর্মির বহর শান্তিনগর পার হয়ে চামেলীবাগের ব্যারিকেডের সামনে এসে থামে। ব্যারিকেড সরাতে ১০-১২ জন গাড়ি থেকে নামতেই ডন স্কুলের ছাদ থেকে পুলিশ সদস্যরা থ্রি নট থ্রি রাইফেলে গুলি চালায়। পাকিস্তানি সেনাদের ওপর ওটাই ছিল প্রথম আক্রমণ, যা শুরু করেছিল পুলিশ সদস্যরাই। পাকিস্তানি সেনাদের এলএমজি, এমএমজি, এইচএমজি, মর্টারগুলোও তখন গর্জে ওঠে।
হঠাৎ পাশের বিল্ডিংয়ে কামানের একটা গোলা এসে পড়ে। ফলে বিদুৎ চলে যায়। টেলিফোন লাইনও কাটা। কী করা যায়? আক্রান্ত হওয়ার খবরটি সারা দেশের সবাইকে জানাতে পারলে হয়তো অনেকেই আত্মরক্ষা করতে পারবে এ চিন্তা থেকেই নিজ উদ্যোগে একটা ওয়্যারলেস বার্তা ট্রান্সলেট করে সারা পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর প্রস্তুতি নিই।
রাত ১২টা বাজার তখনো তিন-চার মিনিট বাকি আছে। রাজারবাগে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের প্রথম ওয়্যারলেস বার্তায় আমি বলি:
ÒBase for all station of east Pakistan police, very very important massage for you, keep note, keep listening, watch. We are already under attacked by Pak army, try to save yourself, over and out.Ó
১৯৭১-এ রাজারবাগে প্রথম ওয়্যারলেস মেসেজ প্রদানের ইতিহাসটি এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল মো. শাহজাহান মিয়া। তার বাড়ি নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার বাট্টা গ্রামে। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই চলে আলাপচারিতা।
বীর মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল মো. শাহজাহান মিয়া। ছবি: সালেক খোকন
এরপর কী ঘটল?
শাহজাহান বলেন- ‘ওয়্যারলেস মেসেজ পাঠানোর পর প্রশাসন ভবনের চারতলার ছাদে অবস্থান নিই। সেখানে ছিল আরও ৪০-৫০ জন। আমরা পাঁচজনের একটা করে ট্রুপস করি। আমার ট্রুপসে ছিল মনির, গিয়াসউদ্দিন, আবু সামাদ, সালাম প্রমুখ। মূল ভবনের ওপর থেকে প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে পজিশনে যাই। আর্মিরা ভেতরে ঢুকলেই ঠেকাব।
রাত তখন ৩টা হবে। ট্যাংকের সাহায্যে ওরা রাজারবাগের মেইন দুটি গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকেই টিনের ব্যারাকে আগুন দেয়। বেরোতে না পেরে অনেকেই সেখানে পুড়ে মরে। ছাদ থেকে আমরা গুলি চালালে ওরা ব্রাশফায়ার করতে থাকে। দেখলাম পুলিশের শত শত লাশ পড়ে আছে। ভোর ৪টার পর ৮-১০ ট্রাক এনে ওরা লাশগুলো তুলে নিয়ে যায়।
আমাদের গুলি তখন শেষ। ২০-২৫ জন পুলিশ সদস্য ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নিচে নেমে পেছন দিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু আমরা বেরোতে পারিনি। ফজরের আজানের পরে পাকিস্তানি সেনারা ছাদে আসে। ওরা রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে আমাদের বের করে আনে। শুরু হয় ভয়াবহ নির্যাতন। রাইফেলের বাঁট আর হকিস্টিক দিয়ে মারতে মারতে আমাদের নিচে নামিয়ে আনে। ওদের বুটের লাথিতে রক্তে লাল হয়ে জমাট বেঁধে যায় আমাদের খাকি পোশাক। বন্দি ছিল দেড়শ’র মতো। ভেবেছিলাম মেরেই ফেলবে!
২৮ মার্চ ১৯৭১। বেলা তখন ৩টা। তালিকা করে আমাদের হস্তান্তর করা হয় এসপি এমাজ আহমেদ চৌধুরীর কাছে। ১০ জন করে গ্রুপ করে চিকিৎসার জন্য ছাড়া হয়। পরে রির্পোট করতে হবে মিল ব্যারাক পুলিশ লাইনসে। রির্পোট না করেই পালিয়ে চলে যাই এক আত্মীয়র বাড়িতে, উলুনে। পরে আমি চলে আসি বাড়িতে, নেত্রকোণায়।
যারা পুলিশ ব্যারাক থেকে বের হয়ে গিয়েছে তারা যেন অনতিবিলম্বে যোগদান করে। তাহলে সাধারণ ক্ষমা করা হবে। তা না হলে রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিবে।’ রেডিও পাকিস্তান থেকে এমন ঘোষণা দেওয়া হলেও শাহজাহান দুই ভাইসব চলে যান ভারতের মহেশখোলায়। মুক্তিযুদ্ধ করেন এগারো নম্বর সেক্টরে।
একাত্তরের সাহসিকতার জন্য ১৯৭৩ সালে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস্-এর প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়া পুলিশের কাউকেই খেতাব দেওয়া হয়নি। ফলে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা প্রবলভাবে উপেক্ষিত হয়েছে বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান। দেশের উন্নতি ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তরুণ প্রজন্মের জেগে ওঠা দেখলে ভালো লাগে এই যোদ্ধার। কিন্তু খারাপ লাগে স্বাধীন দেশে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি দেখলে।
পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে স্বপ্নবিভোর হন মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল মো. শাহজাহান মিয়া। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে, বুকভরা আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘প্রথমে হল দেশপ্রেম। তোমরা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত থেকো। নিজের মাকে যেভাবে ভালোবাস, তেমনি দেশের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে নিজের কাজটুকু করো। তবেই দেখবে দেশটা বদলে যাবে।’
সালেক খোকন-লেখক ও গবেষক। জন্ম ঢাকায়। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। তাঁর রচিত যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মৌলিক গবেষণাগ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক’ পুরস্কার লাভ করে।
প্রকাশিত গ্রন্থ ২২টি। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- ৭১-এর আকরগ্রন্থ, অপরাজেয় একাত্তর, দেশে বেড়াই, বিদ্রোহ-সংগ্রামে আদিবাসী, ১৯৭১: রক্ত, মাটি ও বীরের গদ্য, ১৯৭১: যাঁদের ত্যাগে এলো স্বাধীনতা, আদিবাসী বিয়েকথা, ১৯৭১: রক্তমাখা যুদ্ধকথা, ১৯৭১: যাঁদের রক্তে সিক্ত এই মাটি, যুদ্ধাহতের ভাষ্য, রক্তে রাঙা একাত্তর ইত্যাদি।