তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল কেএফসিতে। আমি আমার বান্ধবী কাম জিএফকে নিয়ে গিয়েছিলাম শহরের অভিজাত রেস্টুরেন্টে হাল আমলে রাজধানীর গতর জুড়ে যত্রতত্র বেড়ে ওঠা ক্লাস মেইনটেইন করতে। সে তার বন্ধু কাম বিএফকে নিয়ে এসেছিল কিশোরের শরীরের কানাচে ভরে গঁজিয়ে ওঠা চুলের মত নতুন প্রজন্মের ট্রেন্ড ফলো করতে।
আমি আমার বান্ধবীকে নিয়ে বসেছিলাম কেএফসির বার্নিশ করা চকচকে দেয়ালের কোণ ঘেষে সাজানো পার্টেক্সের টেবিলে। সে তার বন্ধুকে নিয়ে বসেছিল আমাদের ঠিক এক রো সামনে, কৌণিক কলামে। আমাদের টেবিলে আমার সামনে আমার বান্ধবী বসেছিল, তাদের টেবিলে তার সামনে তার বন্ধু। আমি আর সে কোণাকোণি। কাজেই আমি তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম আর, সে আমাকে। বিপরীত দিকে বসার কারণে আমার বান্ধবী তাকে দেখতে পাচ্ছিল না, আর তার বন্ধু আমাকে।
আমার বান্ধবী যখন খাবারের অর্ডার নিয়ে ব্যস্ত, ভাবছে কত দামি আইটেম অর্ডার করে আমার পকেট খসাবে, আমার সাথে শোয়ার সম্ভাবনা জাগিয়ে রেখে কয়দিনে কতকিছু খাবে আমার কাছ থেকে, সেই অবসরে আমি কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। তার বন্ধু যখন খাবারের অর্ডার নিয়ে ব্যস্ত, ভাবছে কত দামি খাবার অর্ডার করে তাকে চমকে দিয়ে হিরো সাজবে তার সামনে, মনে মনে তার সাথে সর্বদা সঙ্গমস্বপ্নে বিভোর থেকে, সেই অবসরে সে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
তার সাথে আমার চোখাচোখি হল। আমি একবার আড়চোখে দেখে নিলাম আমার বান্ধবীকে। তারপর আবার ফোকাস করে তার দিকে তাকালাম। সে দেখে নিল আড়চোখে তার বন্ধুকে। তারপর আবার আমার চোখে চোখ রেখে তাকালো। আমি হাত তুলে বৃদ্ধাঙ্গুলির সাথে তর্জনী মিলিয়ে বিউটিফুল সাইন দেখালাম তাকে। সে মুচকি হাসল। এমন এক হাসি এটা যা আমাকে মোনালিসার ছবির কথা স্মরণ করিয়ে দিল।
আমার বান্ধবীকে আমি বললাম, তুমি অর্ডার করো, আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।
আমি উঠলাম। তাকে ইশারায় ওয়াশরুমের দিকে ইঙ্গিত করলাম। তার টেবিল অতিক্রম করে যাওয়ার সময় আহবানের চোখে তাকালাম। চোখাচোখি হল আবার। আমি ওয়াশরুমের কোরিডোরে চলে এলাম। একদম ফাঁকা। কেউ নেই এদিকে। আমি আয়নায় নিজের দিকে চেয়ে দেখলাম। আমার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছিল।
প্রায় এক মিনিট পরে আমি দূর থেকে দেখলাম, সে উঠে দাঁড়িয়েছে, ঘুরে হাটছে এদিকে। আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। কোরিডোরের সামনে যখন সে চলে এল, কাছাকাছি, হাত দিয়ে বাঁপাশের চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে লাজুকচোখে আমার দিকে তাকালো। আমি তাকে বললাম, আপনার হাসি মোনালিসার মত রহস্যময়।
সে অবাক হল। কোরিডোরের বাতির আলোটুকু সরাসরি তার মুখের ওপরে পড়ছিল। আমি গভীর চোখে তার চোখের গভীরে তাকালাম। মনে মনে বিড়বিড় করে বললাম, আইজ লাইক নেস্ট!
সে বিভ্রান্ত হল, বলল, মানে?
আমি বললাম, পাখির নীড়ের মত চোখ আপনার!
সে হাসিমুখে বিরক্তির ভাণ করে বলল, আপনি কি পাগল নাকি?
আমি বললাম, আগামীকাল এই সময়ে আমি কেএফসিতে আসব। একা। আপনার জন্য।
তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে ঝলমল করে উঠে সে বলল, আরে, আমি কি জন্য আপনার সাথে দেখা করতে আসব?
আমি বর্তমান যুগের আবৃত্তিবাজদের মত অভিনয়ের সুরে বললাম, কারণ, ‘ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন, থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’
সে বাম হাতের তালু কপালে ঠেকালো, শিশুরা যখন তখন মাতৃদুগ্ধ পান করার জেদ ধরলে মায়েরা যেভাবে স্নেহপ্রবণ হতাশা ব্যক্ত করে, সেরকম একটা ভাব ধরে হেসে হেসে বলল, এ কোন লেভেলের কবি!
আমিও হেসে ফেললাম, বললাম, যে নারীকে আমি কোনদিনও দেখিনি, অথচ যার মুখের রূপকে ভালবেসেছি আজীবন, সেই নারীর মত আপনার মুখ!
সে উঁকি দিয়ে দেখে নিল একবার ওদিকটা। বলল, আমি গেলাম। টেবিলে ফিরে আপনি উল্টোদিকে বসবেন, যাতে আমাকে দেখতে না পান। আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবেন না।
আমি আর কিছু বললাম না। সে চলে গেল তার টেবিলে। এক মিনিট পরে চোখেমুখে পানি ছিঁটিয়ে আমিও ফিরে গেলাম টেবিলে। উল্টোদিকে বসার প্রশ্নই আসে না। আমি পূর্ববৎ কৌণিক দৃষ্টিসীমায় আসন গ্রহণ করলাম। সুযোগ বুঝে একবার দেখলাম তার দিকে। সে একটা রাগী ভাব ধরে রেখেছে চোখে। আমি আত্মসমর্পনের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইলাম। সে আবার সেই মুচকি হাসি দিল। আমার আবার মোনালিসার ছবির কথা মনে পড়ে গেল।
আমার বান্ধবীকে বললাম, কী অর্ডার করেছ?
সে বলল, সিলেক্ট করে রেখেছি, এখানে তো আগে পেমেন্ট করতে হয়। এক্সকিউজ আস্?
সে মডারেট কণ্ঠে ডাক দিল ইউনিফর্ম পরা রেস্টুরেন্টের কর্মীকে। কী সব ছাইপাশ অর্ডার করল। সেসব টুকে নিয়ে লোকটা বলল, এগারশো বিশ টাকা স্যার।
আমি কোনো কথা না বাড়িয়ে টাকাটা দিলাম। লোকটাকে বললাম, খাবারটা দ্রুত দিতে হবে। তাড়া আছে।
আমার বান্ধবী বলল, কোথাও যাবে নাকি? খাবারটা তোমার পছন্দ হবে। এই কম্পোজিশনটা আমার ফেবারিট ।
আমি মনে মনে বললাম, ফেবারিট না ছাই! এইসব ভিনদেশী ফ্যাকাশে খাবার আমি ঘৃণা করি রাক্ষুসী! মুখে বললাম, হ্যাঁ, একটু অফিসে যেতে হবে। একটা ফাইল রেখে এসেছি।
বান্ধবী আমার হাতটা তার হাতে তুলে নিল। সামনের দিকে ঝুঁকে এসে আমার হাতে চুমু খেল। ওর টপসের বড় গলা ঝুলে পড়ায় আমার চোখ ওর ধবধবে বুকের ক্লিভেজে পতিত হল। আকাশী নীলরঙা স্পঞ্জের ব্রার মাঝখানের খাদ ক্রমশ গভীরতায় নেমে গিয়েছে। হাতে চুমু খেয়ে ও বলল, তুমি আর আমাকে আগের মত টেক কেয়ার কর না।
আমি হাত দিয়ে বাচ্চাদের মত ওর থুঁতনিতে নাড়া দিয়ে বললাম, প্রতিটি মানুষেরই স্বনির্ভর হওয়া দরকার। টেক কেয়ার দরকার শিশুদের। তুমি তো শিশু না।
ও বলল, ধ্যাৎ, তুমি একদম রোমান্টিক না।
আমি বললাম, জানু, আমার এখন এসব হট ডগ, বার্গার খেতে মন চাইছে না। আমার এখন তোমাকে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। ফর গড্স শেক, হোল্ড ইওর টাঙ, এন্ড লেট মি কিস।
বিরক্ত হয়ে ও বলল, পুরুষমানুষ শরীর ছাড়া কিছু বুঝে না।
আমি বললাম, বাদ দাও। ঐ যে খাবার চলে এসেছে, চলো, আমরা ভক্ষণকার্য সম্পন্ন করি। বান্ধবী আমার খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।
খেতে খেতে আমি আড়চোখে তার দিকে তাকালাম। দেখলাম, তার বন্ধুটি তার হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে কি যেন বলছে তাকে। সম্ভবত ডেট ফিক্স করছে। আমার দিকে একফাঁকে তাকালো সে, তাকে কিছুটা বিব্রত মনে হল। হাতটা ছাড়িয়ে নিল বন্ধুর হাত থেকে। অস্বীকার করার উপায় নেই, আমার একটু হিংসে হল।
আমাদের খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই তারা উঠে পড়ল। যাওয়ার সময় মাত্র একবারই নির্লিপ্ত চোখে দেখে নিল আমাকে। আমারটার মতই, মনটা তার খারাপ, মনে হল। এই নির্লিপ্ত মুখটা একটা অখন্ড নীরবতার মত আমার ভেতরে গুনগুন করে বেজে চলল অনেকক্ষণ। আমার বান্ধবীকে বিদায় দিয়ে আমি অনেকক্ষণ উদ্দেশ্যহীন হাঁটলাম লেকের পাশের ফুটপাত ধরে। সিগারেট টানলাম কয়েকটা। রবীন্দ্র সরোবরের সিঁড়িতে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। চারিদিকে সুন্দর সব যুবক যুবতীর জুটি। নানা সাজে, নানা রঙে রাঙা। ধানমণ্ডির এই লেকে উচ্চবিত্তদের দখলদারি। অবশিষ্ট এক টুকরো ক্ষয়িষ্ণু প্রকৃতি। আমি ভীড়ের সকল নারীর মুখে তার চেহারা খুঁজলাম, তাকে পাওয়া যাবে না জেনেও। রাতের শহরে যাযাবর পথিকের ভূমিকা পালন শেষে ফিরে এলাম একাকী ঘরে।
পরদিন যথাসময়ে হাজির হলাম কেএফসিতে। সে আসবে, আমি জানতাম। কিন্তু তাকে পেলাম না। অপেক্ষা করলাম, অনেকক্ষণ, একই টেবিলে বসে। প্রায় চল্লিশ মিনিট বসে থেকে যখন আমি ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য উঠলাম, দেখলাম একদম কোরিডোরের কাছের টেবিলেই একজোড়া চোখ মেন্যুকার্ডের আড়াল থেকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি বসে পড়লাম তার টেবিলে। বললাম, আপনি এসেছেন, তো আমাকে ডাকলেন না কেন?
সে চোখে কৌতুকের আবহ এনে বলল, কে আপনি?
একটা সবুজ একরঙা জামা পড়েছে সে, আনুষাঙ্গিক সাজগোজে সবুজের ছায়া। ছোট্ট টিপ, ছোট্ট কানের দুল, অন্যান্য অর্নামেন্টস সবুজে ঘেরা। মনে হল আমার সামনে একটা আস্ত অরণ্য তার সব সবুজ আর অন্ধকার সাজিয়ে নিয়ে বসে আছে। আমি বললাম, আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন।
সে গাঢ় চোখে আমার চোখে তাকিয়ে বলল, এতদিন কোথায় ছিলেন?
বললাম, ধানমণ্ডিতেই ছিলাম। কিন্তু এখানে মোনালিসা থাকে সেটা জানতাম না, দেখতেও পাইনি। আচ্ছা, এখানে না বসলে হয় না? শহরের চাকচিক্যময় শীততাপনিয়ন্ত্রিত রেস্তোরায় মৌলিক বাতাসের বড় অভাব। হেতায় তোরে মানাইছে না রে টাইপের ব্যাপার! আমরা একটু খোলা হাওয়ায় ঘুরে আসতে পারি।
সে বলল, এই শহরে বিশুদ্ধ বাতাস নেই কোথাও। বাতাসে সীসার বসবাস। তবু যাওয়া যেতে পারে। কোথায় যাবেন?
বললাম, রিকশায় করে, লেকের পাড়ে, তারপর অন্ধকার নেমে এলে লেকের মধ্যেই, কৃত্রিম পা চালিত বোটে!
আমি আমার হাতটা বাড়িয়ে দিলাম, তার দিকে। সে কয়েক মুহুর্ত আমার দিকে চেয়ে রইল, তারপর তার হাতটা এগিয়ে দিল। আমরা বেরিয়ে গেলাম। রিকশায় উঠে বসলাম। গায়ে গা ঘেঁষে, হাতে হাত রেখে। তার আঙুলগুলো লম্বা, মাংসল এবং নরম। আমি হাত দিয়ে তার হাতে চাপ দিলাম। সে আমার হাতটা শক্ত করে ধরল। আমি বললাম, ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে ছিলাম, পৌষের রাতে, কোনোদিন জাগব না জেনে, কোনদিন আর!
সে সেই ভুবনমোহিনী হাসি দিল আবার। বলল, তাহলে কেন জাগলেন? ঘুমিয়ে থাকাই তো ভাল।
বললাম, আপনার সাথে দেখা হয়ে গেল বলেই তো জেগে উঠলাম। আপনার হাসিটার জন্যই নিদ্রাভঙ্গ হল। আমার এখানে কোনো দোষ নেই।
সে একটু দুঃখ পেল মনে হল। বলল, বেশ, দায় চাপানোর প্রয়োজন ছিল না কোনো। মানুষ কি জীবনের দাবি নিয়ে কখনও কখনও দাঁড়িয়ে যেতে পারে না মানুষের মুখোমুখি?
আমি বললাম, তোমাকে দেখার মত চোখ নেই, তবু, গভীর বিস্ময়ে আমি টের পাই, তুমি আজও এই পৃথিবীতে রয়ে গেছ!
সে মৃদু হাসল। আমরা লেকের পাড়ে নামলাম। রবীন্দ্র সরবরের সিঁড়িতে বসে বাদাম খেলাম, ভ্রাম্যমান চা বিক্রেতার কাছ থেকে প্লাস্টিকের ছোট গ্লাসে পান করলাম চা। আমি সিগারেট ফুঁকলাম একটা। তাকে বললাম জীবনানন্দের প্রতি আমার দূর্বলতার কথা। সে আমার কাঁধে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে গাইল, ‘তুমি কি কেবলই ছবি? শুধু পটে লেখা? ঐ যে সুদূর নীহারিকা… ’
সন্ধ্যা নেমে এলে আমরা এগিয়ে গেলাম বোটের কাছে। পা দিয়ে সাইকেলের প্যাডেলের মত ঘুরিয়ে চালাতে হয় এই জিনিশ। আমরা একটা বোট নিলাম। দুজনে পাশাপাশি বসলাম। মৃদুগতিতে লেকের মাঝে বয়ে চলল আমাদের ক্ষুদ্র জলযান। আমি তাকিয়ে রইলাম তার পাখির নীড়ের মত চোখে। অন্ধকার ঘনীভূত হল। আমরা লেকের নির্জনতার মধ্যে এগিয়ে চললাম। আমি তার ঠোঁটে ঠোঁট রাখলাম। পুরু এবং মাখনের মত নরম সেই ঠোঁট। সে যখন আমার আহবানে সাড়া দিল, নিমগ্ন হয়ে গেলাম আমরা, একটা তপ্ত সমুদ্রের ভেতর ডুবসাঁতারের মত। আমি তার বুকে মুখ লুকিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। উষ্ণতা, শীতে আগুনে তাপ পোহানোর মত। ধানের মৌসুমে গ্রামের মেঠোপথে জমে থাকা সোঁদা গন্ধ তার বুকে!
আমরা যখন ফিরে এলাম ঘাটে, উঠে পড়লাম পথে, হেঁটে চললাম লোকালয়ের দিকে, হাতে হাত রেখে, আমরা কোন কথা বলতে পারলাম না। লেকের রাস্তা শেষ হয়ে এল, আমরা শহরের মূল সড়কে এসে গেলাম। সে একটা রিকশা থামালো। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, বলল, আমি যাই তাহলে, ভাল থেকো তুমি।
আমি, বিদায়ের চিরায়ত বেদনায় বুঁদ হয়ে যেতে যেতে বললাম, ‘আমাদের পাখায় পিস্টনের উল্লাস!’
সে বলল, আমাদের স্তদ্ধতা, আমাদের শান্তি!
আমরা দুজনে দুদিকে হারিয়ে গেলাম।
সত্যিই অসাধারণ, আমার মনে হল আমি একই সাথে অনেকজন লেখকের কাব্য নিমগ্ন হয়েছিলাম।