বিশ্বায়নের (গ্লোবালাইজেশন) যুগে সাম্রাজ্যবাদ ব্যাপারটা কেমন সেটার সাথে আমাদের মত তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের সাধারণ মানুষের একটা বোঝাপড়া জরুরি বটে। দুনিয়াজোড়া অবাধ বাণিজ্য, পণ্যের বাজার বিস্তার, মুনাফা ইত্যাদি শব্দবন্ধ আমাদের মত দেশের মানুষের কাছে কল্পিত স্বর্গরাজ্যের (ইউটোপিয়া) কুহক রচনা করেছে। তবু এসবের আড়ালে কিভাবে দুনিয়ার মাতব্বর রাষ্ট্রগুলো অন্যান্য প্রজা রাষ্ট্রসমূহে হত্যালীলায় মত্ত থেকে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করে, সেসবের সাথেও সম্যক পরিচয় থাকা অপ্রয়োজনীয় নয় আমাদের জন্য। ইতিহাস কারখানা সিরিজের দ্বিতীয় কান্ড আদমবোমা নাম্নী গ্রন্থে সলিমুল্লাহ খান দুনিয়ার ইতিহাস আশ্রয় করে সাম্রাজ্যবাদের খুনে রাঙা হাতের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন।
সন্ত্রাসবাদের বিরূদ্ধে ন্যায়যুদ্ধ নামে ফিলিস্তিন এবং আফগানিস্তানে ইউরোপের হামলা এবং অবলীলায় নিরপরাধ মানুষকে হত্যার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব কায়েম, এবং প্রেক্ষিতে ফিলিস্তিন ও আফগানিস্তানের মানুষের প্রতিরোধ সংগ্রামই আদমবোমা বইয়ের মূল উপজীব্য।
সাম্রাজ্যবাদ কি বস্তু? খান বলছেন, সাম্রাজ্যবাদকে ধর্মের সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। প্রাচীন যুগে এক দেশের রাজা অন্য দেশ জয় করিলে তাঁহার ‘সাম্রাজ্য‘ গড়া হইত। নয়া জমানায় এক দেশের হাতে আর দেশ ধরা পড়িলে লোকে ‘সাম্রাজ্যবাদ‘ কথাটা যোগ করে।… পরদেশদখল ব্যবসায়ের অন্দরমহলে এই অসামান্য পরিবর্তনটা ঘটিয়া গিয়াছে খ্রিস্টের ১৯ শতকে।
আমরা একসময় বৃটেনের উপনিবেশ ছিলাম। ১৯৪৭ সালে উপনিবেশ ব্যবসায়ের সমাপ্তি ঘটেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ তার উপনিবেশভুক্ত নানা রাষ্ট্রকে স্বাধীনতা দিয়েছে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ শেষ হয়নি। প্রমাণ হিসেবে সলিমুল্লাহ খান সেই সময়েই নতুন ইউওরোপীয় উপনিবেশ হিসেবে ফিলিস্তিনে নতুন এসরায়েল রাষ্ট্র কায়েমের উদাহরণ দাখিল করেছেন। সাম্রাজ্যবাদের সাথে হিটলারের নাৎসি দলের মৌলিক সাদৃশ্যও বর্তমান, একথা স্মরণে রেখেছেন তিনি। হিটলারের বাড়তি অপরাধ শুধু এই যে, তিনি উপনিবেশ গড়ার নেশায় দখলের দড়িটি খোদ ইউরোপে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেজন্যই তাকে ইউরোপের এত ঘৃণা। কিন্তু খোদ ইউরোপ সেই একই কাজ দুনিয়াব্যাপী জারি রেখেছে। হিটলারের আত্মা ইউরোপের শরীরে নয়াজনমলাভ করেছে।
১৯৪৮ সালে তুরস্কের ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের ফিলিস্তিন অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এসরায়েল রাষ্ট্র, ইহুদি জাতির সমন্বয়ে। কেন ইউরোপ থেকে ইহুদিদের এনে রাষ্ট্র পত্তন করতে হল মুসলিম অধ্যুষিত ফিলিস্তিন অঞ্চলে? ১৯৩০ সালের পর থেকেই ইউরোপে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ইহুদি বিরোধী আন্দোলন। তখন থেকেই ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত তুরস্ক চলে যায় ইংরেজ সাম্রাজ্যের অধীনে। এবং অতঃপর ইহুদি রাষ্ট্রপরিকল্পনা পশ্চিমের শক্তিশালী দেশগুলোর সমর্থনে বাস্তবায়িত হয় ফিলিস্তিন অঞ্চলে। এই ঘটনার পর থেকেই অনবরত উত্থিত ফিলিস্তিন জাতির আত্মপরিচয়ের দাবিকে ইউরোপ কোন পাত্তা দেয়নি। এটা তাঁদের কাছে ছিল স্রেফ ‘আরব শরণার্থী সমস্যা‘। অন্তত বিশ বছর আর্তচিৎকারের পর ফিলিস্তিন মুক্তিসংঘ বা পি.এল.ও যখন বিদ্রোহ শুরু করল তখন এটা একটা প্রকৃত সমস্যা বলে প্রতিভাত হল পশ্চিমের কাছে, তার আগে নয়। বিশ শতকের একদম শেষ বছর পর্যন্ত অহিংস সংগ্রামের পরও কোন ফল উৎপন্ন না হওয়ার পরেই আবির্ভাব ঘটেছে আত্মঘাতী বোমা হামলার। সলিমুল্লাহ খান তালাল আসাদের বিশ্লেষণ আমল করে এই জিনিশের নাম রেখেছেন, আদমবোমা।
আদমবোমা নিয়ে কথা বলার আগে কার্ল মার্কসের শ্রেণীবিভেদ অনুযায়ী একথা পুণরায় স্মরণ করা প্রয়োজন যে পৃথিবীটা প্রকৃত প্রস্তাবে দুই ভাগে বিভক্ত। রাজা-প্রজা; শাসক-শোষিত; সাদা-কালো অথবা মনিব-দাস। এর আরো সমার্থক শব্দ হাজির করা সম্ভব। খান বলছেন, আমরা- সারা পৃথিবী জুড়ে- আজ যে রাজনীতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি সে রাজনীতি শুভ অশুভের নয়। এ যুদ্ধ খ্রিস্টান পাশ্চাত্যের সঙ্গে এলসামি প্রাচ্যের নয়। এ রাজনীতি শেষ বিচারে প্রভু ও ভৃত্যের। দাস-মনিবের মিথস্ক্রিয়া বর্ণনায় সলিমুল্লাহ খান দু’জন তত্ত্বজ্ঞানীর নাম নিয়েছেন। হেগেল এবং ফ্রানতস ফানোঁ। হেগেলের মতে দাস কর্মমুখি, কাজেই তার মুক্তি, কাজ করে বলেই অর্জিত জ্ঞানে ভর করে সময় পরিক্রমায় দাস মনিবকে অতিক্রম করে যায়, কারণ, মনিব কাজ করে না, দাসকে দিয়ে কাজ করায়। বিপরীতে ফানোঁ বলছেন, দাস কাজের মধ্যে মুক্তি খোঁজে না, খোঁজে খোদ মনিবের মধ্যে, সে মনিব হতে চায়। ফানোঁর এই প্রস্তাব মাথায় নিয়ে অগ্রসর হলে আদমবোমারুর মগজে বিচরণ সহজতর হবে। শুদ্ধ ইরাক বা ফিলিস্তিন বা লেবাননকে দাস হিসেবে ধরে নিতে হবে।
কেন ফিলিস্তিনের মানুষ আত্মঘাতী হচ্ছে? অথবা, দুনিয়াতে সন্ত্রাস তো কম হয় না, ফিলিস্তিনের আত্মঘাতী বোমাবাজিকে কেন ইউরোপ এত গুরুত্ব দিয়ে দেখে? আত্মঘাতককে জব্দ করার কোন উপায় আত্মঘাতী রাখে না বলে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কেও জানা সম্ভব হয় না। সে কি নিজে মৃত্যুবরণ করার জন্য অন্যকে মেরেছে নাকি অন্যকে মারার জন্যই নিজে মৃত্যুবরণ করেছে? বলার উপায় থাকে না। এ তো গেল বোমাবাজের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার অক্ষমতার ব্যাপার, এমনকি তাকে ক্ষমা করে তুষ্টিলাভ থেকেও বঞ্চিত করে যায় বোমারু।এখানেই আদমবোমারু রাষ্ট্রের আইনসঙ্গত শাস্তিবিধান বা বিচারিক ক্ষমতায় আঘাত করে।
আরো সমস্যা আছে। দুনিয়া জুড়ে যত আদমবোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে সব ঘটনায় সাম্রাজ্যবাদি শক্তি সমান বিচলিত হয় না। রবার্ট পেপ নামক জনৈক পশ্চিমা পন্ডিতের বরাত দিয়ে খান উল্লেখ করেছেন, ১৯৮০ সাল থেকে ২০০১ সালের মধ্যে পৃথিবীতে যত আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটেছে তার প্রায় অর্ধেক ঘটিয়েছে তামিল টাইগার্স নামক শ্রীলঙ্কান দল। অমুসলিম বলে এসকল কর্মকান্ড মনিবকুলের ধর্তব্যের মধ্যে আসে নাই। মধ্যপ্রাচ্যের যেসব অঞ্চলে মার্কিন শক্তি অন্যায় অসম ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এবং তার প্রেক্ষিতে যখন মানুষ অকাতরে প্রাণদান করে, মারে এবং মরে, তখন মনিবের টনক নড়ে, সে আরও ধ্বংসে মেতে ওঠে।
খানের ভাষ্যে, প্রশ্ন হইতেছে আত্মহত্যা- বিশেষ সফল আত্মহত্যা- শাস্তিযোগ্য অপরাধ নহে কেন? আপনি তাহাকে কোথায় পাইবেন? অতয়েব প্রমাণ করা চাই: আত্মহত্যা যে করিয়াছে আত্মহত্যা সে করে নাই, কেহ না কেহ তাহাকে দিয়া করাইয়াছে। অতয়েব তাহাদিগকে ধর, মার কাট, পোড়াও। ইহাই বিশেষ এসরায়েল রাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার চিন্তাধারা।
এই সন্ত্রাসবাদ দমন করার জন্য দেশে দেশে মার্কিন শক্তি যুদ্ধ ঘোষণা করে অগণিত নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। সন্ত্রাসবাদ আর যুদ্ধের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? কেন পশ্চিমের অভিযান ন্যায়যুদ্ধ আর মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিরোধ সংগ্রাম অন্যায় সন্ত্রাসবাদ?
গবেষক মে জায়ুসির বিচার অনুযায়ী সলিমুল্লাহ খান দেখাচ্ছেন, আত্মঘাতী বোমার উৎপত্তি ঘটেছে ফিলিস্তিনি জাতির মুক্তির সম্ভাবনা সুদূরপরাহত করে তোলা অসলো চুক্তির পর থেকে। ইসরায়েলের নিপীড়ন ও অপমানজনক ব্যবহার থেকেই ফিলিস্তিনিরা ক্রোধান্বিত হয়ে আত্মঘাতে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়েছে। আদমবোমার মূল নিহিত রয়েছে এই সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসের গভীরেই। স্বাধীনতার স্পৃহা এখানে মূখ্য হয়ে উঠেছে, জীবন নয়। খান বলছেন, যখন আইনসঙ্গত রাজনীতির পথ বন্ধ করিয়া দেওয়া হয় তখন রাজনীতির পানি রক্তপাতের পথেই আপনার পথ করিয়া লয়।
অন্যায্য যুদ্ধকে যতই ধর্মীয় পোশাকে বিশেষায়িত করে ন্যায্য করে তোলার পায়তারা করা হোক না কেন তা আদতে অন্যায়ই। তালাল আসাদের বিশ্লেষণ হাজির করে সলিমুল্লাহ খান বলছেন, আদমবোমা এসলাম ধর্মের অন্তরে প্রোথিত চিরিস্থায়ী সত্য নহে… মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানে যে অসম যুদ্ধ চলিতেছে কলাকৌশলে তাহা নবীন হইলেও চরিত্রে আগেকার যুগের ঔপনিবেশিক বা পররাজ্যলোভী দখলদারী যুদ্ধেরই হুবহু নতুন সংস্করণ। সলিমুল্লাহ খান পরিহাসের সুরে বলছেন, এই বোমাবাজি শুদ্ধ ইতিহাসের বিশেষ পর্যায়ের বা পরাধীন মুসলমান সমাজের পরাধীনতার প্রকাশ মাত্র। পরাধীনতা দূর হইলে আদমবোমা জিনিসও ফরাসি কিংবা মার্কিন দেশে বিমা করিয়া জাদু প্রদর্শনীতে পাঠানো সম্ভব হইবে। কারণ, খানের জবানে, আত্মঘাতী বোমা অসহায়ের শেষ সহায়, ভাষাহীনের শেষ ভাষা মাত্র। এসলামের হৃদপিন্ডে বোমা নাই- বোমা বাঁধা নিছক ইতিহাসের কোমরবন্ধে।
মনিব, তুমি আমদের স্বাধীনতা দাও, আমরা পরাধীন। আমাদের তুমি পরাধীন করে রাখতে পারো না।
আফগানিস্তান আক্রমণেরও গোড়ার কথা সাম্রাজ্যবাদ। ওয়ান ইলেভেন অর্থাৎ ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার ফলেই সন্ত্রাসবাদের বিরূদ্ধে ন্যায়যুদ্ধ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে মার্কিন শক্তির অভিযান, এমন যুক্তি ঘটনার অবলম্বন মাত্র। প্রকৃত কারণ, খানের মতে, আফগানদের বিদ্রোহ। খানের ব্যাখ্যা তুলে দেখি, আফগানরা একদিন মার্কিন দেশের মিত্র ছিল। এখন বিদ্রোহ করছে। এ বিদ্রোহ মেনে নেয়া যায় না। আফগানিস্তানের মতন নগণ্য দেশ জোটের বাইরে গেলে ছাইপাঁশ আসে যায়। কিন্তু উদাহরণের শক্তি অপরিমেয়। ক্ষুদ্র আফগান দেশ যদি উদাহরণ স্থাপনের সুযোগ পায়, তো কাল বড়সড় দেশ সৌদি আরবও যে সেই পথ ধরবে না তার কসম কোথায়? … দুনিয়ার আর দশ দেশকে শিক্ষা দেওয়াই মার্কিন যুদ্ধের প্রধান কারণ।
এই ব্যাখ্যার পেছনে শক্তি সঞ্চয় করতে খান ইতিহাস থেকে প্রমাণ হাজির করেছেন। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার বলেছিলেন, যা কিছু ঘটে পুণরাবৃত্তি, পার্থক্য কেবল প্রকরণে। গ্রিক ইতিহাসবিদ থুকুদিদিসের লেখা আমল করে খান আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার প্রকৃত কারণ উদঘাটন করতে সচেষ্ট হয়েছেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ এবং ৪৮০ সালে ইরানের সাথে গ্রিক জাতির যুদ্ধ হয়। এথেন্স ছিল এই যুদ্ধের নেতৃত্বে। যুদ্ধে ইরান পরাস্ত হয় গ্রিক জোটের কাছে। তবে জয়ী জোট ভেঙ্গে যায় না। ১৫০ টি ছোট ছোট রাষ্ট্র এথেন্সের অধীনে জোটবদ্ধ থাকতে বাধ্য হয়। এই জোটের ক্ষুদ্র রাষ্ট্র মিলেতুনি একসময় এই জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে এথেন্স মিলেতুনির ওপর আক্রমণ করে। মিলেতুনিও নতি স্বীকার না করে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং পরাজয় বরণ করে। একই নিয়তি নেমে আসে জোটের আরও এক জোট মেলোসের ওপর। পরাজয়ের পরে মেলোসের সকল পুরুষকে হত্যা করা হয়, নারি ও শিশুরা হয় দাস। এথেন্স আর মেলোসীয় প্রতিনিধিদের বাকবিতন্ডার চমৎকার উদ্ধৃতি সহযোগে বিস্তারিত লিখেছেন খান। এই ইতিহাসের সাথে মার্কিন শক্তি কর্তৃক আফগান হামলার মৌলিক চরিত্রের মিল আমল করে ভৃত্য জাতের স্বাধীনতা স্পৃহার বিরূদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের চিরাচরিত আগাসনকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন খান।
স্রাম্রাজ্যবাদ নিয়ে কথাবার্তা বললে ততটা বিপদ নেই যতটা আছে আফগানিস্তানে অথবা ফিলিস্তিনে বা লেবাননে বা ইরাকে ইউরোপের হামলা বিষয়ে আলাপ তুললে। খান বলছেন, বিপদটা মূলত অপবাদের, পাছে বিরোধীতাকারী দেশ ইসলাম অথবা তালেবান সমর্থক হওয়ার অপবাদে আক্রান্ত হয়। খান মনে করেন, সাম্রাজ্যবাদের এই অসম আগ্রাসনের বিরোধীতা করে এর মুখোশ উন্মোচন করার জন্য তালেবান সমর্থক হওয়ার প্রয়োজন নেই। যুদ্ধটা মূলত ইউরোপের প্রভুসুলভ সাম্রাজ্যের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের ভৃত্যরূপী স্বাধীনতাকামী জনমানুষের। এই উপমহাদেশের ওয়াহাবি আন্দোলনের সাথে যথেষ্ট সাদৃশ্য উদ্ধার করে দেখিয়েছেন সলিমুল্লাহ খান। কার্ল মার্কসের শ্রেণীসংগ্রামী চরিত্র ওয়াহাবি আন্দোলনে বিশেষরূপে বিরাজমান ছিল না, একথা কে বলতে পারবে? শুধু তা-ই নয়, খান জানাচ্ছেন, জার্মানির ১৬ শতাব্দীর কৃষক বিদ্রোহ, ১৭ শতকিয়া ইংলন্ডের পিউরিটান বিপ্লব এবং চিনদেশের ১৯ শতকিয়া তাইপিং বিদ্রোহের ইতিহাসও একই চরিত্রের। আমরা এখন এসব বিদ্রোহ ও বিপ্লবের ইতিহাস যত পারি তত কম জানার সংগ্রাম করছি। কারণ এসব বিদ্রোহ আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এখনকার স্বার্থের অনুকূল নয়। ভুলে যাওয়ার চেষ্টাও শ্রেণী সংগ্রামের অংশ। একে যদি শ্রেণী সংগ্রাম না বলি তো শ্রেণী সংগ্রাম কি গাছে ধরে না বাঁশে ধরে? আমরা চাই বা না চাই শ্রেণী সংগ্রাম দীর্ঘজীবী হয়েছে।
দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদের গুঢ় কার্যকৌশল নিয়েও আলোচনা করেছেন সলিমুল্লাহ খান। বিশেষত, সংস্কৃতির ওপর পরদেশ দখলদার সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসন নিয়ে বিস্তারিত আলাপ উঠে এসেছে তার লেখায়। সাম্রাজ্য শুধু দখলিকৃত দেশের অর্থ বা বাণিজ্যের ওপরেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হয় না। বিজিত দেশের সংস্কৃতিকেও সংস্কারে উদ্যোগী হয়। কারণ দেশের জাতীয় সংস্কৃতি বিকাশের বিপরীতে সাম্রাজ্য অধিপতির সংস্কৃতিকে দাঁড় করাতে না পারলে জাতীয় বিদ্রোহ ঘটার ক্ষেত্র তৈরি হয়। একারণেই তারা অধিকৃত দেশে নিজেদের সহযোগী শ্রেণী তৈরিতে মনোনিবেশ করে। ভারতীয় কংগ্রেসের জন্মলাভের ইতিহাসের মধ্যে কথার নির্গলিতার্থ নিহিত রয়েছে। এরপরে তারা জাতির আভ্যন্তরীণ সংঘাতকে কাজে লাগিয়ে শাসনব্যবস্থা পাকাপোক্ত করতে সচেষ্ট হয়। যেকোন জাতির মুক্তি সংগ্রামের মূল শক্তি আসে সংস্কৃতি থেকে। সাম্রাজ্যবাদ সেই সংস্কৃতির মূল তুলে ফেলে শাসন কায়েম করতে সচেষ্ট হয়। হালের বিশ্বায়ন ধারনার মাধ্যমেই দেশে দেশে জাতীয় সংস্কৃতি ধ্বংস করে ছদ্মসাম্রাজ্যবাদ বাস্তবায়িত হয়ে আসছে।
আদমবোমা বইতে সলিমুল্লাহ খানের মোট ১৮ টি প্রবন্ধ যথাক্রমে পূর্বাভাস, আদমবোমা, যুদ্ধ ও সাম্রাজ্য, সাম্রাজ্য ও সংস্কৃতি এবং সত্যের প্রয়োগ এই পাঁচটি গুচ্ছে বিভক্ত হয়ে সন্নিবেশিত হয়েছে।এছাড়াও সংবর্ধনা অংশে মূল গ্রন্থের বিষয়বস্তুর সাথে প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখকের কিছু লেখা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তালাল আসাদ, এডোয়ার্ড সায়িদ, হেগেল, ফ্রানতস ফানোঁ, থুকুদিদিস সহ আর অনেক তত্ত্বজ্ঞানীর বিশ্লেষণ থেকে সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃত চালচিত্র তুলে ধরেছেন সলিমুল্লাহ খান। বিশ্বের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে বাংলায় রচিত এরকম একটি গ্রন্থ অনুসন্ধিৎসু পাঠকের মনযোগ ও আগ্রহের চাহিদাকে পূরণ করবে নিঃসন্দেহে। ইতিহাস কারখানা বৃক্ষের আদমবোমা কান্ড তাই আমাদের বাংলা সাহিত্যে এক উজ্জ্বল সম্পদ হিসেবে টিকে থাকবে।
নাহিদুল ইসলাম– শিক্ষক। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।