এক.
শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব এর বয়স যখন তিন তখন তার বিয়ে হয় শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে। শেখ মুজিবুর রহমান এর বয়স তখন এগারো। শৈশবে শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব (রেনু) মা বাবা হারান। সেই শৈশব থেকে শাশুড়ির নিকট মানুষ হয়।
বেগম মুজিবের ধৈয ছিল, আন্তরিকতা ছিল, ভালোবাসা ছিল। স্বামী লেখাপড়া ও রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকার জন্য সংসারে সময় দিতে পারতেন না। ১৯৪৭সালে তাদের বড় মেয়ে শেখ হাসিনার জন্ম হয়। তখন শেখ মুজিবের বয়স ২৭ বছর। বেগম মুজিবের বয়স ১৮ বছর। শেখ মুজিব রাজনীতি করতে গিয়ে বারবার কারাবরণ করেছেন। তাই সংসারটা বেগম মুজিবকেই সামলাতে হয়েছে। মায়ের কাছ থেকেই ছেলেমেয়েরা শিক্ষাদীক্ষা পেয়েছে।
পড়াশুনার প্রতি রেনুর খুব ঝোঁক ছিল। শাশুড়ি মা বাড়িতে শিক্ষক রেখে বাংলা, ইংরেজি, আরবি শিক্ষা দিয়েছেন। শাশুড়ি রেনুকে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। ছেলেবেলা থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি গল্পের বই পড়ার অভ্যাস ছিল। মূলতঃ রেনু শাশুড়ির কাছে মানুষ হয়েছেন। স্বামী কলকাতায় লেখাপড়া করতেন আর রাজনীতি করতেন। মাঝেমধ্যে শেখ মুজিব বাড়ি আসতেন। বেগম মুজিবের ধৈর্য ও সাহস ছিল বলে ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে ঠিক সংসার করে গেছেন। তিনি একাধারে গৃহবধূ অন্যদিকে রাজনৈতিক সামাজিক একজন মানুষ।
১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হয়। পূর্ব বাংলায় আইয়ুব খান এর বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন চলছিল। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পথে, ঘাটে, মাঠে সে কি আন্দোলন। রাজধানী ঢাকাসহ সারা বাংলায় শ্লোগান- জেলের তালা ভাংবো, শেখ মুজিব কে আনবো। জেগেছে জেগেছে বীর বাঙালি জেগেছে। ঢাকা না পিন্ডি, ঢাকা ঢাকা। তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা। আইয়ুব খান দিশেহারা। তিনি গোল টেবিল বৈঠক ডাকলেন। শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে লাহোরে নিয়ে যাবেন। সেদিন বেগম মুজিব বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি মেয়ে শেখ হাসিনা ও জামাতা ওয়াজেদ মিয়াকে শেখ মুজিব এর নিকট পাঠিয়েছিলেন যাতে শেখ মুজিব প্যারোলে মুক্তি না নেয়। কারণ সারা বাংলার জনগন তার সাথে। সুতরাং শেখ মুজিবকে আইয়ুব খান মুক্তি দিতে বাধ্য হবে। সত্যিই তাই হয়েছিল।
দুই.
১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে রেনুর জন্ম হয়। পিতা শেখ জহুরুল হক। তিনি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান এর সম্পর্কে চাচা।
বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে বলেছেন,”আমার বয়স বারো-তেরো। রেণুর বাবা মারা যাবার পর ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, আমার সাথে তার এক নাতির বিয়ে দিতে হবে। কারণ তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাবেন। রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরুব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি তখন কিছুই বুঝতাম না। রেণুর বয়স তিন বছর হবে। রেণুর বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তার মা হোসনে আরা বেগম মারা যান। তারপর থেকেই রেণু আমার মায়ের কাছে চলে আসে। রেণুদের ঘর আমার ঘরের পাশাপাশি ছিল।”
শেখ মুজিব এর মা বেগম সায়রা খাতুন পাঁচ বছর বয়সেই মাতৃহীন রেণুকে ঘরে তুলে নেন। শৈশব থেকেই রেণু শেখ মুজিবসহ পরিবারের সকল সদস্যদেরকে আপন করে নিতে সচেষ্ট ছিলেন।
প্রাথমিক জীবনে নিজের লেখাপড়া বেশি দূর না এগুলেও স্বামীর শিক্ষা নিয়ে তিনি সবসময় চিন্তা করতেন। শেখ মুজিব যখন কলকাতায় যেতেন তখন বাবা শেখ লুৎফর রহমান বলতেন, আমি চাই তুমি বিয়ে পাশ করো। বাবা তো খরচের টাকা দিতেন। এদিকে রেণুর কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলে সে স্বামীর হাতে বেশকিছু টাকা দিয়ে দিতেন। কারণ রেণু জানতো তার স্বামী লেখাপড়া করার পাশাপাশি রাজনীতি করে। তার অতিরিক্ত টাকা দরকার। রেণু নিজের জমির ধান বিক্রি করে রেখে দিত। স্বামীর জন্য তার চিন্তার অন্ত ছিল না। যাবার সময় রেণু স্বামীকে বলতো, একবার কলকাতা গেলে আসতে চাও না। এবার ছুটি হলে চলে এসো।
তিন.
শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের সুখ-দু:খের সঙ্গী হয়েছেন। বহুমাত্রিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এই নারী মানুষের ভালোবাসা অর্জন করে হয়ে ওঠেন বঙ্গমাতা।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের থাকার জন্য শেরে বাংলা নগরে একটি বাড়ী বরাদ্দ দিয়েছিলেন। একবার সেই যুদ্ধাহত ক’জন মুক্তিযোদ্ধা সকালবেলা বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নাম্বার সড়কের বাড়িতে গেলেন। সেই সময় বঙ্গবন্ধু মেঝে মাদুরে বসে পান্তা ভাত খাচ্ছেন লবন, পিঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ দিয়ে। ওদের দেখেই বঙ্গবন্ধু বললেন, তোরা বসে পড়। আয় পান্তা খাই। বেগম মুজিব যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পান্তা ভাত খাওয়ালেন। আতিথিয়তায় কোন অংশে কম ছিলেন না। সেদিনকার সেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ছিলেন খুলনার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ জিয়াউর রহমান। যিনি পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদান করেছিলেন। তিনি এই ঘটনা বলেছিলেন এবং প্রচন্ডভাবে কেঁদেছিলেন। সেদিন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আমাদের বলেছিলেন এই হলো আমাদের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহধর্মিণী মহিয়র্সী রমনী বেগম মুজিব।
বঙ্গবন্ধু যখন জেলে ছিলেন তখন ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার সামলানোর, আবার কখনো কখনো কারাগারে গিয়ে স্বামীর সাথে সাক্ষাৎ করা, আইনজীবীদের চেম্বারে যাওয়া, মামলার খোঁজ-খবর নেয়া এমন কি নিজের গয়না বিক্রি করে মামলার খরচও করতে হয়েছে।
এই মমতাময়ী মহিলা সারাজীবন স্বামীর পাশে থেকেছেন। কখনো অনুযোগ, অভিযোগ করেন নি। তার জীবনে তেমন কোন চাহিদা ছিল না। শুধু চেয়েছেন তার স্বামী দেশের মানুষের সেবা করুক।
১৯৭১ সালে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেবেন। তিনি অত্যন্ত বিচলিত। বেগম মুজিব দেখলেন স্বামী তার খুবই অস্থির। বেগম মুজিব স্বামীকে বললেন, তুমি এতো অস্থির হয়ো না। তুমি সারা জীবন বাংলার জন্য, বাংলার মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছো, তাদের পাশে থেকেছো। তোমার যা মন চায় তাই বলবা।” সত্যি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ এর ভাষণ লিখিত ছিল না। বঙ্গবন্ধু সেদিন মুক্ত মনে প্রাণে খোলে বক্তব্য দিয়েছিলেন। এইভাবে বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে সহযোগিতা করেছেন।
চার.
বঙ্গবন্ধু তার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা জেল খানায় বসে লিখেছেন। মহিয়সী নারী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব তার স্বামীকে খাতা ও কলম যোগান দিয়েছেন। তাগিদ দিয়েছেন কিছু লেখার। বঙ্গবন্ধু বলতেন, আমি তো লিখতে জানি না। তাছাড়া আমি এমন কোন কাজ করি নাই যে, আমি লিখবো। তবু রেণু তাগিদ দিতেন লিখার জন্য। বলতেন তুমি যা করেছো তাই লিখো। বেগম মুজিব স্বামীকে সবসময় অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। জীবনে কোনদিন স্বামীর সাথে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়নি।
এমন মহয়সী নারী সমাজের বিরল। আগামী প্রজন্মকে জানতে হবে। একজন গৃহবধূ কি করে এতো মেধাবী হয়। বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর সাথে হত্যা করে। সেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বেগম মুজিব এর বড় ছেলে শেখ কামাল, মেঝ ছেলে শেখ জামাল ও ছোট ছেলে শেখ রাসেলকে ও ঘাতকরা হত্যা করেছিল। শুধু বেঁচে গিয়েছিলেন দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তারা দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন।
বাঙালির এমনি ভাগ্য যে ডালিমকে পুত্রের মতো ভালোবাসতেন সেই হত্যাকারীদের দলে ছিল। নিষ্ঠুর এ পৃথিবী, নিষ্ঠুর এ সমাজ। নিষ্ঠুর বাঙালির বিশ্বাসঘাতক।
বঙ্গমাতা তুমি যেখানেই থাকো ভালো থেকো। হে বঙ্গমাতা তুমি যুগযুগ জিও।
হামিদুল আলম সখা-সম্পাদক, মহুয়া এবং সদস্য, বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপ-কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।