প্রত্যেকের জীবনে কোনো না কোনো স্বপ্ন থাকে। কেউ নিজে স্বপ্ন দেখে আবার কেউ অন্যের প্রেরণায় স্বপ্ন দেখা শুরু করে। বাইসাইকেলে ৬৪ জেলায় ভ্রমণকারী লেখক রামকৃষ্ণ মন্ডল ক্লাস থ্রি-ফোর-এ পড়ার সময় রাতে আকাশের তারা দেখে স্বপ্ন দেখতেন তারার মতো আলো দিতে; বিকালে ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে স্বপ্ন দেখতেন ঘুড়ির মতো উপরে উঠতে।
উপরের স্বপ্নগুলো পূরণ না হলেও বাইসাইকেলে বাংলাদেশ দেখা’র যে স্বপ্ন পরবর্তীতে তিনি দেখেন তা পূরণ হয়। কোনো মানুষ যদি পাঁচতলা বাড়ি বানানোর স্বপ্ন দেখেন, একবারে কিন্তু সেটা সম্ভব হয় না। তারজন্য প্রথমে বাড়ির ভিত তৈরি করতে হয়, তারপর একতলা, দোতলা এভাবে একদিন পাঁচতলা বাড়িটি সম্পন্ন হয়।
লেখক বাইসাইকেলে বাংলাদেশ দেখা’র এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পেছনে তেমনি একটি গল্প রয়েছে। শুরুতেই কিন্তু তিনি বাংলাদেশ ভ্রমণে বের হননি। সেজন্য অল্প অল্প করে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে প্রথমে সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম কলাগাছি থেকে যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত’র বাড়ি ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। কলাগাছি থেকে মহাকবি মাইকেলের বাড়ির দূরত্ব প্রায় ৮০ কি.মি.। যাওয়া-আসা মিলিয়ে প্রায় ১৬০ কি.মি.। এই সময়ে তিনি তালার শালিখা কলেজ-এ উচ্চ মাধ্যমিকে পড়তেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর তিনি পিরোজপুর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ-এ ইতিহাস বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন। এই কলেজে পড়ালেখা করার সময় তিনি বাইসাইকেলে পিরোজপুর ও পাশের জেলা বাগেরহাট-এর প্রায় সকল প্রসিদ্ধ স্থান ও ঐতিহাসিক নিদর্শন প্রত্যক্ষ করেন। যখন তিনি ৪র্থ বর্ষের ছাত্র তখন কোনো এক সময় কয়েকজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে বাগেরহাট খানজাহান আলীর মাজার, দিঘী, মসজিদ প্রভৃতি ভ্রমণ করেন।
বাগেরহাট ভ্রমণে এসে তিনি মনে মনে অনেক খুশি হন। কারণ এরকম ছোট ছোট ভ্রমণের মাধ্যমে তিনি অনেক আত্মবিশ্বাস সঞ্চয় করতে থাকেন। আর এই পুঞ্জিভূত আত্মবিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই একদিন তিনি বিরাট এক সিদ্ধান্ত নিলেন বাইসাইকেলের পিঠে চড়ে সমগ্র বাংলাদেশ দেখবেন।
২০০৯ সালে ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা শেষ হলে তিনি ও তাঁর এক বন্ধু মিলে পিরোজপুর ডি.সি মহোদয়ের কাছ থেকে বাইসাইকেলে সমগ্র বাংলাদেশ ভ্রমণ করার অনুমতি গ্রহণ করেন। আগেই বলেছি, অনেক ছোটবেলা থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিলো অজানাকে জানার এবং অদেখাকে দেখার। আর সেজন্যই তিনি বাইসাইকেলে বাংলাদেশের ৬৪ জেলা ভ্রমণে বের হন। দু’জনের একসাথে ভ্রমণে বের হওয়ার কথা থাকলেও একেবারে শেষ মুহুর্তে ঠিক ভ্রমণের আগের দিন লেখক রামকৃষ্ণ মন্ডলের বন্ধু ভ্রমণে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
অগত্যা কী আর করার! কবিগুরুর অন্যতম বিখ্যাত গান “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে” স্মরণ করে তিনি একাই বীরদর্পে বাইসাইকেলে ৬৪ জেলা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। ২০০৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর রবিবার পিরোজপুরের শ্রী শ্রী হরিগুরু বিপিন চাঁদ সেবা আশ্রম থেকে তাঁর ভ্রমণযাত্রা শুরু হয়। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ লেখকের সেই বন্ধুর কথা মনে করে ভ্রমণ সম্পন্ন না করেই ফিরে আসার মনস্থির করেছিলেন। সেই বন্ধু ভ্রমণে না আসার কারণ হিসেবে যা বলেছিলেন তা হলো, ‘রাতে থাকব কোথায়, খাব কী? শীতকাল, ঘুমাব কোথায়?’ ঠিক পরক্ষণেই আবার মেসে থাকার সময় সবাইকে বাইসাইকেলে ৬৪ জেলা ভ্রমণের যে কথা দিয়েছিলেন সেকথা মনে করে সবকিছু মন থেকে ঝেড়ে ফেলে আবার সাইকেলের প্যাডেল সামনের দিকে ঘুরাতে শুরু করেন। এবার কিছুদূর যাওয়ার পর শংকর পাশা নামক স্থানে পৌঁছালে কবি আহসান হাবিব-এর বাড়ি চোখে পড়ে। মুহুর্তে যেন তাঁর সঙ্গীহীন পরিব্রাজক জীবনে খুশির বন্যা বয়ে যায়। কবির স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি দেখে তিনি এতটাই উৎফুল্ল ও অভিভূত হয়ে পড়েন যে, তাঁর পথচলার উৎসাহ বহুগুণ বেড়ে যায়। এরপর আর কখনও তিনি নিজেকে একা মনে করে ফিরে আসার কথা ভাবেননি। শুধুই সামনের দিকে এগিয়ে চলেন। ফলশ্রুতিতে তিনি একটার পর একটা জেলা বা সে জেলার কোনো উপজেলা ভ্রমণ করেন আর প্রমাণ স্বরূপ সেসব জেলার ডিসি, ক্ষেত্র বিশেষে উপজেলার ইউএনও মহোদয়ের কাছ থেকে নিজের কাছে থাকা ডায়েরিতে তাঁদের স্বাক্ষরসহ কিছু মন্তব্য লিখিয়ে নেন। ২০১০ সালের ৬ মে মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে এসে তাঁর ৬৪ জেলা ভ্রমণের স্বপ্ন সম্পন্ন হয়।
দীর্ঘ প্রায় সাড়ে পাঁচ মাসব্যাপী এ ভ্রমণ চলাকালে তিনি স্বচক্ষে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা ও প্রত্নতাত্মিক নিদর্শন প্রত্যক্ষ করার পাশাপাশি অনেক বিষয়ে বিপুল অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এদীর্ঘ ভ্রমণপথে তিনি যে সর্বদাই আনন্দ উপভোগ করেছেন তা কিন্তু নয়, চট্টগ্রামের তৎকালীন ডিসি মহোদয় তাকে তো জঙ্গী হিসেবেই সন্দেহ করেন। আবার রাঙ্গামাটির আসাম বস্তিতে পৌঁছার পূর্বে তিনজন সন্ত্রাসী তার কাছে থাকা ব্যাগ, সাইকেলসহ সর্বস্ব কেড়ে নেয়। এক পর্যায়ে তারা তাঁকে সাংবাদিক, গুপ্তচর মনে করে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সেসময় মাথা ঠাণ্ডা রেখে সুমিষ্টভাষায় অনেক চেষ্টার পর নিজেকে ছাত্র প্রমাণ করতে সক্ষম হন এবং তিনি যে পিরোজপুর ডিসি মহোদয়ের অনুমতি নিয়ে বাইসাইকেলে দেশ ভ্রমণে বের হয়েছেন তার প্রমাণ স্বরূপ ব্যাগে থাকা কাগজপত্র দেখালে সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে ছাড়া পান।
তিনি কয়েকটা লক্ষ্য স্থির করে বাইসাইকেলে ৬৪ জেলা ভ্রমণে বের হন। যেমন:
১. পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য পরিবেশবান্ধব বাইসাইকেল চালানো;
২. সকল মানুষের মধ্যে স্বাক্ষরতা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা;
৩. ধূমপান করা থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ প্রদান করা এবং
সর্বশেষ লক্ষ্য তাঁর প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশকে স্ব-চোখে দেখা ও জানা এবং তার ওপর একটি বই রচনা করা।
উপরোক্ত তিনটি বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তিনি কিছু প্লাকার্ড ব্যবহার করেন এবং চলার পথে বিভিন্ন জেলা/উপজেলার বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সেসব বিষয়ে বক্তৃতা প্রদান করেন।
এক পর্যায়ে তাঁর চতুর্থ লক্ষ্যও পূরণ হয়। তিনি তাঁর প্রতিদিনের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিজের কাছে থাকা কয়েকটি ডায়েরিতে লিখে রাখেন। পরবর্তীতে সেসব ডায়েরি হতে উল্লেখযোগ্য অংশসমূহের সমন্বয়ে এই চমৎকার বইটি রচনা করেন। বইটি পাঠের মাধ্যমে ৬৪ জেলা ভ্রমণ করার জন্য পথের সুন্দর দিক নির্দেশনা পাওয়া যায়। এজাতীয় ভ্রমণ বিষয়ক বই পাঠের মাধ্যমে পাঠক যে বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি আশা করেন তাহলো বইয়ে যেসব স্থানের উল্লেখ করা হবে সেসব স্থানের ভৌগলিক, রাজনৈতিক পরিবেশ, সেখানকার মানুষের আর্থ- সামাজিক অবস্থা, খাদ্যাভ্যাস, জীবন-যাপন পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে জানা। পূর্বোক্ত বিষয়সমূহ সম্পর্কে সামান্য কয়েকটি জেলার ক্ষেত্রে বর্ণনা করা হলেও অধিকাংশ জেলার ক্ষেত্রে তেমন একটা ধারণা পাওয়া যায় না। পৃথিবীর অন্যান্য ভ্রমণ কাহিনি থেকে এই ভ্রমণ কাহিনির মধ্যে তাই যথেষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
কিন্তু আলোচ্য ভ্রমণকাহিনি বিষয়ক বইটি পাঠ করার মাধ্যমে আমরা সামান্য কয়েকটি জেলা বাদ দিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পথের বর্ণনার পাশাপাশি আর যেটা পাই সেটা হলো তিনি কোন জেলা বা উপজেলায় কবে ভ্রমণ করেছেন, কার কার সাথে দেখা হয়েছে, কোথায় থেকেছেন এবং তিনি যে সেই জেলা/উপজেলায় বাইসাইকেলে পৌঁছেছেন তার স্বীকৃতি আদায় করতে ডায়েরিতে তাঁদের মন্তব্যসহ স্বাক্ষর ইত্যাদি। বিশেষ করে ভ্রমণের স্মৃতি স্বরূপ ৬৪টি জেলার জেলা প্রসাশক ও বিভিন্ন উপজেলার উপজেলা নিবাহী অফিসারদের লিখিত বিবৃতি। যা বইটিতে সংযুক্ত করা হয়েছে।
তাই আশা করি, বইটির আগামী সংস্করণে লেখক তথা ভ্রমণকারী এই বইয়ে পাঠকের যেটুকু অতৃপ্তি থেকে গেল তা পূরণ করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। প্রয়োজনে খণ্ড খণ্ড আকারে তাঁর বাইসাইকেলে সমগ্র বাংলাদেশ দেখার সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করবেন। সেটা করতে পারলে আগামী প্রজন্মের কাছে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
২০১৯ সালে বিজয় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ১১০ পৃষ্ঠার এই বইটি প্রকাশ হয়েছে। মূল্য ২২০ টাকা। বইটির দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকেছেন বদরুল আলম পরশ।
শুকদেব হালদার