জীবন ও জীবনান্তর্গত সূক্ষ্ম ও জটিল গ্রন্থিসমূহ উন্মোচনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৮৬১-১৯৪১) ছিলেন সতত পরীক্ষাপ্রবণ। শিল্প-প্রমূর্তির প্রশ্নে তিনি ছিলেন তপস্যাশুদ্ধ, সপ্রতিভ ও সতর্ক। মেধাবী ও অন্তরঙ্গ পরিচর্যায় তিনি নাটকের জটিলতা উন্মোচন করেছেন এবং চরিত্রসমূহকে দিয়েছেন বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা। ‘রক্তকরবী’(১৯২৬) নাটকে তিনি অনুসূক্ষ্ম মেধায়-আবেগে-অনুভবে মানব প্রেমানুভূতির সূক্ষ্মতর দায়িত্ব ও স্বাধীন মুক্তচৈতন্যে সুস্থির হয়েই যে বিচ্ছিন্নতামুক্ত অস্তিত্বময় শুদ্ধসত্তায় উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব সে-ভাবনা শিল্পিত করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নানামাত্রায় বিবেচনাযোগ্য একটি নাটক; বহুমাত্রিক এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষন। আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় শোষণের যে বহুমাত্রিক রূপ এবং সেখানে মানবসভ্যতার যে বিপর্যয় ও বিপন্নতা তাকেই রবীন্দ্রনাথ এ-নাটকে মূল উপজীব্য করে তুলেছেন। ‘রক্তকরবী’ নাটক নির্মিত হয়েছে যক্ষপুরীর পটভূমিতে। মাটির তলদেশের এই পুরিতে সাধারণ মানুষের অনুপ্রবেশ সহজ নয়। এর মাটির নিচে আছে তাল তাল স্বর্ণপিণ্ড যা উত্তোলন করবে যক্ষপুরীর নামগোত্রহীন শ্রমিকেরা আর পৃথিবীর মানুষ তার খবর জানবে না। এ নগরীতে আছেন রাজা, তার সঙ্গে আছেন পারিষদবর্গ আর আছেন সর্দার, মোড়ল। নিপীড়িত শ্রমিকশ্রেণি এখানে খননকর্মে লিপ্ত যাদের সাধ্য কিংবা আকাঙ্ক্ষা নেই এখান থেকে বের হয়ে মুক্ত পৃথিবীতে বিচরণের। যক্ষপুরীর এই অভ্যস্ত জীবনে অকস্মাৎ সেখানে আবির্ভূত হয় এক নারী যার নাম নন্দিনী। যক্ষপুরীর গতানুগতিক, প্রচল জীবনধারায় নন্দিনী জীবনের জয়ধ্বনি তোলে। ফলে যক্ষপুরীর রাজার যে শাসন, সর্দারের যে নিপীড়ন-নির্যাতন তার আপাত অবসান হয়। একজন নন্দিনীর প্রভাবে রাজা-সর্দার-মোড়ল-খোদাইকর সব একাকার হয়ে যায়। যক্ষপুরীর পুঞ্জীভূত অনাচারের মধ্যে নেমে আসে স্বস্তিকর আবহ। এটুকুই ‘রক্তকরবী’র মূল নাট্যঘটনা।
সংক্ষিপ্ত এই নাট্যঘটনাকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় বিচ্ছিন্নতার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। যে বিচ্ছিন্নতার কারণে প্রথমত, সমাজকাঠামোয় শোষিত-নির্যাতিত খোদাইকরেরা সত্তাবিচ্ছিন্ন ও জীবনবিচ্ছিন্ন হয়ে ওঠে, নিজ অস্তিত্বের বিষয়ে হয়ে পড়ে নির্জ্ঞান-নিশ্চেতন। দ্বিতীয়ত, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় শুধু শ্রমিকশ্রেণি নয় সর্বময় ক্ষমতার অধীশ্বর রাজা তার শাসনতন্ত্র থেকে ছিটকে পড়ে হয়ে ওঠেন একাকী-নিঃসঙ্গ ‘ভয়ঙ্কর মানুষ’। তৃতীয়ত, প্রকৃতির সহজাত দানকে অস্বীকার করে মা-বসুন্ধরার হৃদয় বিদীর্ণ করে স্বর্ণসংগ্রহে মত্ত হয়ে ওঠে যক্ষপুরী। ফলে বিচ্ছেদ ঘটে মানুষ ও প্রকৃতির অবিচ্ছিন্ন প্রাণ-প্রবাহে। এই ত্রিবিধ বিচ্ছিন্নতা থেকে যক্ষপুরীকে মুক্ত করতে রবীন্দ্রনাথ পৌষের মিছিলের বার্তা প্রদান করেছেন নন্দিনীর মাধ্যমে। মূলত নন্দিনীর সংস্পর্শেই যক্ষপুরীতে নবপ্রাণের সঞ্চার ঘটে। রাজা-সর্দার-খোদাইকর প্রত্যেকেই বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্ত হয়ে অস্তিত্বময় শুদ্ধসত্তায় জাগ্রত হয়।
কার্ল মার্কস(১৮১৮-১৮৮৩) বিচ্ছিন্নতাকে পুঁজিবাদী সমজের অভ্যন্তর সঙ্কট বলে মনে করেন। যক্ষপুরীর খোদাইকরদের মধ্যে এই বিচ্ছিন্নতার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। বিশু, ফাগুলাল, কিশোর, চন্দা সকলেই যাপন করে সত্তাবিচ্ছিন্ন জীবন। ফলে নির্যাতিত হলেও তারা তা উপলব্ধি করতে পারে না। উপরন্তু লোভ-লালসা, হীনম্মন্যতা, বিচ্ছিন্নতা ও নৈঃসঙ্গ্যের চাপে তারা নিক্ষিপ্ত হয় আত্মযন্ত্রণার জটিল গহ্বরে। নন্দিনীই তাদের মধ্যে সঞ্চার করে নবচৈতন্যপ্রবাহ। বিশুর কাছে নন্দিনী তাই ‘ঘুম ভাঙানিয়া’, ‘দুঃখজাগানিয়া’, ‘সমুদ্রের অগমপারের দূতী’:
তুমি আমার সমুদ্রের অগমপারের দূতী। যেদিন এলে যক্ষপুরীতে আমার হৃদয়ে লোনা জলের হাওয়া এসে ধাক্কা দিল।
নন্দিনীর আগমনে বিশু-কিশোর-ফাগুলালের মধ্যে ঘটেছে এক অভূতপূর্ব ভাবান্তর। নিজেদের অজান্তেই তারা হয়ে উঠেছে এক একজন বিপ্লবী। এদের মধ্যে অন্যতম কিশোর। সে সর্দারের অত্যাচার উপেক্ষা করে নন্দিনীর জন্য রক্তকরবী ফুল এনে দিয়েছে। বিশু বন্দি হয়ে অন্তর্জগতে মুক্তির অনন্ত আস্বাদ অনুভব করেছে আর ফাগুলাল বন্দিশালা ভেঙে বিশুকে মুক্ত করেছে।
মার্কস তাঁর Economic and Philosophic manuscripts of 1844 গ্রন্থে বলেছেন, প্রাথমিক অবস্থায় শ্রমিকরা থাকে বিচ্ছিন্ন, সেখানে তারা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র। এ-অবস্থাকে মার্কস বলেছেন class in itself পর্যায়। নন্দিনীর দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত খোদাইকরেরা ছিল এই পর্যায়ে। কিন্তু যখন নন্দিনী এলো অর্থাৎ নেতৃত্বের প্রেরণায় class in itself পর্যায়ের শ্রমিকদের মধ্যে সঙ্ঘচেতনা জাগ্রত হলো তখন তারা উপনীত হলো class for itself পর্যায়ে। শ্রমিকদের একতাবদ্ধতায় ব্যক্তির অভিজ্ঞতা, আশা-আনন্দ-প্রাপ্তির বেদনা তুচ্ছ হয়ে আসে। সমষ্টির প্রাপ্তিই সেখানে হয়ে ওঠে মুখ্য বিষয়। এভাবে সঙ্ঘশক্তির ঐকতানে বিচ্ছিন্ন খোদাইকরেরা প্রাত্যহিক বিমিশ্রসত্তা থেকে অস্তিত্বময় শুদ্ধসত্তায় উপনীত হয়।
পুঁজিবাদ বিকাশের প্রক্রিয়ায় বিচ্ছিন্নতাবোধ শ্রমিকশ্রেণি ছাড়াও অন্য সকল শ্রেণিতে ক্রমান্বয়ে ব্যাপ্ত হয়। বিচ্ছিন্নতার অভ্যন্তর নিয়মে প্রতিটি মানুষ নিয়ত হয় সম্ভাবনাহীন, মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে সে পরিণত হয় অজৈবসত্তায়। যক্ষপুরীর রাজা তার দৃষ্টান্ত। রাজাকে জালের আড়ালে রেখে শোষণের ‘নেটওয়ার্ক’ শক্তিশালী করেছে সেখানকার সর্দার-মোড়লরা। নন্দিনী যথার্থই অনুভব করেছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ভয় এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। তাই রাজাকে উদ্দেশ্য করে সে জানায়:
ভয় দেখানোর ব্যবসা এখানকার মানুষের। তোমাকে তাই তারা জাল দিয়ে ঘিরে অদ্ভুত সাজিয়ে রেখেছে। এই জুজুর পুতুল সেজে থাকতে তোমার লজ্জা করে না!
যক্ষপুরীর শাসনতন্ত্রকে ভয় করেছে সবাই, কেবল ভয় করেনি নন্দিনী। তাই ‘জুজুর পুতুল’রূপী রাজাকে কটাক্ষ করতেও সে দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি।
রাজা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও একাকী নিঃসঙ্গ মানুষ। তার দ্বিবিধ বিচ্ছিন্নতা: এক-আমলাতন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্নতা, দুই- শ্রমিকশ্রেণি থকে বিচ্ছিন্নতা। রাজার এই বিচ্ছিন্নতার প্রমাণ আমলাতন্ত্রের সঙ্গে তার কোন যোগ দেখা যায় না; পক্ষান্তরে অভ্যন্তর সামাজিক নিয়মেই শ্রমিকশ্রেণির সঙ্গেও তার দূরত্ব বিস্তর। এই বিচ্ছিন্নতার কারণে যক্ষপুরী ‘মকররাজতন্ত্র’ না হয়ে ‘সর্দার-মহারাজতন্ত্র’ হয়ে ওঠে। এই বিচ্ছিন্নতার ফলে অবুঝ কিশোরের জীবন বুদ্বুদের মতো মিলিয়ে যায়; নন্দিনীর প্রেমাস্পদ রঞ্জনের রক্তে রঞ্জিত হয় যক্ষপুরী। বিচ্ছিন্নতা মুক্তির জন্য তাই নিজের বিরুদ্ধে নিজেই লড়াইয়ে নামেন রাজা। এপর্যায়ে নন্দিনীর উদ্দেশ্যে রাজার উক্তি লক্ষণীয়:
এই আমার ধ্বজা, আমি ভেঙে ফেলি এর দণ্ড, তুমি ছিঁড়ে ফেল ওর কেতন। আমারই হাতের মধ্যে তোমার হাত এসে আমাকে মারুক, মারুক সম্পূর্ণ মারুক – তাতেই আমার মুক্তি।
নন্দিনীর প্রভাবে রাজার মধ্যকার মানবাত্মা যখন জাগ্রত হলো সদর্থক চেতনায়, সমগ্র দৃষ্টি দিয়ে তিনি যখন উপলব্ধি করলেন জগৎ ও জীবনকে, তখনই তিনি ‘একলা আমি’র বন্ধন ছিঁড়ে বেরিয়ে এলেন ‘বহু আমি’র প্রঙ্গণে। নঞর্থক অস্তিত্বসত্তা অতিক্রম করে তিনি উত্তীর্ণ হলেন বিশ্বায়ত মানব-অস্তিত্ব চেতনায়।
যক্ষপুরীর খোদাইকরেরা ছিল নিস্তরঙ্গ-নগরবিচ্ছিন্ন গ্রামজীবনে অভ্যস্ত। কিন্তু ঘটনাচক্রে তারা যক্ষপুরীর যন্ত্রনিগড়ে বন্দি। ক্ষণে ক্ষণে তাদের চিন্তা ও কর্মে তাই প্রকৃতি-বিচ্ছিন্নতার মর্মপীড়া পরিলক্ষিত হয়। আবার যক্ষপুরীর কর্মযজ্ঞও প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন। নন্দিনীর ভাষ্যে ধরা পড়ে এই অসঙ্গতি:
পৃথিবী আপনার জিনিস আপনি খুশি হয়ে দেয়। কিন্তু যখন তার বুক চিরে মরা হাড়গুলো ঐশ্বর্য বলে ছিনিয়ে নিয়ে আস তখন অন্ধকার থেকে একটা কানা রাক্ষসের অভিসম্পাত নিয়ে আস।
রবীন্দ্রনাথ ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’(১৮৮২) নাটকেও এ কথাই বলেছেন যে, প্রকৃতির ওপর জোর খাটে না। জোর করে কিছু নিতে চাইলে প্রকৃতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়। এ নাটকে যক্ষপুরীর যে বিপর্যয়, রাজার বিপন্নতা এক অর্থে প্রকৃতিরই প্রতিশোধ। রবীন্দ্রনাথ জানেন মানুষ প্রকৃতির অবিচ্ছিন্ন অংশ তাই রাজা-সর্দার-মোড়ল খোদাইকরদেরকে তিনি শেষ পর্যন্ত পৌষের মিছিলে সামিল করেছেন। প্রকৃতি বিচ্ছিন্নতা থেকে প্রকৃতি পুনর্মিলনের পথে রবীন্দ্রনাথের এ আহ্বান শাশ্বত ও চিরন্তন।
বিচ্ছিন্ন মানুষ সর্বদায় সন্ধান করে নতুন সংযোগ-সূত্র। ধনতন্ত্রের অভিশাপে ব্যক্তিমন বিচ্ছিন্নতায় সংক্রমিত হলেও তা থেকে মুক্তির জন্য ব্যক্তিমানুষের মধ্যে রয়েছে দুর্মর আকাঙ্ক্ষা। এ আকাঙ্ক্ষাই শেষ পর্যন্ত ‘রক্তকরবী’র পরিণামী রস নিষ্পত্তিতে সহায়ক হয়েছে।
জোবায়ের জুয়েল- কলেজ শিক্ষক ও লেখক।