কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃজনশীলতার আলো ছড়িয়ে ছিলেন সাহিত্যের সকল শাখায়। তাঁর গান বাঙালি মননে চিন্তায় প্রতিনিয়ত জড়িয়ে আছে। জড়িয়ে আছে উৎসবে প্রেমে দুঃখে দুর্দিনে। তাঁর দেশাত্মবোক গান বাংলাকে ভালোবাসতে শেখায়, সাম্প্রদায়িক আর ধর্মান্ধতার গণ্ডি ভেঙে। অখন্ড ভারতের পরাধীনতা, দেশভাগ, মহান ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তানে তাঁর গান নিষিদ্ধ করা, অতপর বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। যার প্রতিটি স্তরে কবিগুরুর দেশপ্রেমের গান অতোপ্রতোভাবে আমাদের প্রেরণা দিয়েছে, মুক্তির পথ দেখিয়েছে। ‘চাতাল’ এর পক্ষে রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধক গানের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে তরুণ রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী ঝুম্পা রায়ের এ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন শিশির রাজন।
রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধক গানের কথা ও সুর কেন আপনাকে আলোড়িত করে?
রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধক গানের কথা এবং সুর আমাকে আলোড়িত করে এজন্যই যে, রবীন্দ্রনাথ যে গানগুলো দেশের জন্য লিখেছিলেন সেই গানের কথা মাটির কথা মায়ের কথা দেশমাতৃকার কথা আর যে সুর সেটি মাতৃসম সুর। একজন মা যেমন শিশুকে যে সুরে ডাকে বাবা আয়, বাবা খেয়ে নে, বাবা দুধ খা। এইযে একটা সজীবতা এই যে একটা মাতৃসম স্নেহের সুর , সেই সুর গুলো রবীন্দ্রনাথের কথা বা গানের ভেতর পেয়ে থাকি। ‘ও আমার দেশের মাটি’ আমরা যদি এই গানটিকে বিশ্লেষণ করি- ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।’ এই গানের ভেতরে একটা ভক্তি আছে। আমাদের মা কিন্তু দুটো। একটা হলো জগৎজননী মা আর একটা হলো জন্মদাত্রী মা। আর আমাদের বাংলা মা এটা আমাদের সেই জগৎদায়িনী মা। যার বুকে আমাদের জন্ম। আমরা মায়ের পেটে বড় হয়েছি, মায়ের পেট থেকে ভুমিষ্ট হয়েছি কিন্তু আমাদের বেড়ে ওঠা এই দেশমাতৃকার কোলে। এটিই আমাদের দ্বিতীয় মা। এইখানে রবীন্দ্রনাথের যে কথা সেটি আসলেই হৃদয়স্পর্শী। এবং সেটি আমাদের যে জন্মভূমি মা সেই জন্মভূমির মায়ের মাতৃকোলে আমাদের ভুমিষ্ট হওয়ার পরের থেকে বেড়ে ওঠা সেটিকেই প্রতিফলিত করে। এবং যে সুর সেটি সত্যি এই গানের কথার সাথে মিলে যায়। সেটি আমাদের হৃদয়কে আন্দোলিত করে অনুরনিত করে। এমন অনুভবের টান থেকেই রবীন্দ্রনাথের দেশের গান আত্মমগ্ন হই বা অোমাকে আলোড়িত করে।
তাঁর দেশাত্মবোধক গানে অবিভক্ত বাংলার কোন বিষয়টি খুববেশি প্রভাব বিস্তার করেছে বলে আপনি মনে করেন?
স্বাধীনতা, দেশপ্রেম, প্রকৃতিবাদ ও আধ্যাত্মিক জীবন দর্শণ এই বিষয় গুলি প্রতিভাত হয়।
তাঁর দেশপ্রেমের গান গণমানুষের সাথে আদৌ কোনো সেতু তৈরি করেছে কি? যদি করে থাকে তাহলে কেন?
হ্যাঁ। অবশ্যই সেতু তৈরি করেছে। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত যেটা ‘ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।. ‘ এখানে বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করা হয়েছে। এই গানের যে কথা এটি আসলে এমন একটা ব্যাপার যে আল্লাদে এটাকে বলে হ্লাদিনি শক্তি তার গানের ভেতরে একটা হ্লাদিনি শক্তি ছিল অর্থাৎ আল্লাদের একটা ব্যাপার। আমি আদর করে আল্লাদ করে বলি,-আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। যেমন আমি আমার মাকে ভালবাসি। ওমা তোমাকে আমি খুব ভালবাসি। ঠিক এমন একটা অনুভুতি নিয়ে, ও আমার বাংলা আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। তুমি আমার মা তুমি যদি কাঁদো তোমার কান্না দেখে তোমার কষ্ট দেখে আমার গন্ড বেয়ে অশ্রু ঝরে। তুমি যদি ভালো থাকো তোমার সুখ দেখে আমার হাসি পায়। তোমার সুখ দেখে আমি শান্তি পাই। সেরকমই একটা গান আমাদের জাতীয় সঙ্গীত।‘… মা তোর বদন খানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি..’ এটাই সেরা কথা। জাতীয় দুর্বিপাকে জাতীয় দুর্যোগে যখন মায়ের মন কেঁদে ওঠে আমাদের দেশমাতৃকা যখন কম্পিত হয় তখন ঐ মায়ের কষ্ট দেখে আমারও কষ্ট লাগে। মা যখন হাসে আমিও তখন হাসি। মা যখন কাঁদে আমিও তখন কাঁদি। এই অনুভুতিটাই মনে হয় রবীন্দ্রনাথের গানে ব্যক্ত হয়েছে। এবং রবীন্দ্রনাথ এখানেই সফল বলে আমি মনে করি।
উপমহাদেশের রাজনীতিতে বিশেষকরে বিভক্তবাংলায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর দেশাত্মবোধক গানকে কীভাবে বিশ্লেষণ করেন?
আসলে আমার মনে হয়কি রবীন্দ্রনাথ রাজনীতি করতেন না। তাঁর একটাই নীতি ছিল চিরন্তনতা বাদ। আমরা যখন বিভক্ত বাংলার কথা বলি বাংলাদেশ তো পাকিস্তানের একটা প্রদেশ হয়ে যায়। আর ভারতবর্ষ আলাদা একটা রাষ্ট্র হয়ে যায়। কিন্তু ভারতবর্ষের মধ্যে যে পশ্চিম বাংলা এবং আমাদের পূর্ব বাংলা এই দুইয়ের মধ্যে কিন্তু একটা মেল বন্ধন ছিল। এবং সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ অনেক কিছুই লিখেছিলেন। আমি একটা গানের কথা স্মরণ করতে চাই ‘..আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে ঘরের হয়ে পরের মতন ভাই ছেড়ে ভাই কদিন থাকে..’। এখানেও কিন্তু মায়ের কথা বলা হয়েছে। ‘…আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে নইলে মোদের রাজার সনে মিলবো কি সত্তে ..’এটি দারুন একটি কথা। আমাদের সবার এই গানটা খুবই পরিচিত। আসলে এই “রাজা” দিয়ে তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন। আমরা সেই রাজার সঙ্গে মিলে যাবো এক সত্তে। এটি আসলে একটা ইউনিভার্সল একটা ফিলিংস থেকে না আসলে এই গানের কথাটা আসতো না বা সৃষ্টি হতো না। তিনি আসলে দ্বিজাতি তত্ব বা দ্বিধাবিভক্ততায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি ছিলেন মানবতাবাদী। তিনি ছিলেন নান্দিক একজন মানুষ। তিনি চেয়েছিলেন সব মানুষকে এককাতারে আনতে। এবং তার রাজনৈতিক যে দর্শন যেটা আমার মনে হয় তিনি ছিলেন সাম্যবাদী। যিনি তার সাম্যের লেখনির মাধ্যমে সব বাংলার মানুষকে এক করতে চেয়েছিলেন বলে আমার মনে হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান অনেক সাহস এবং শক্তি যুগিয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা…’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। পশ্চিমবাংলায় অনেক খ্যাতিমান শিল্পীরা গানটিকে ভিন্ন সুরে গেয়েছেন। একজন তরুণ শিল্পী হিসেবে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
আসলে গান তো গানই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ একটা ব্রান্ড। নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথ এই দুজনার গান আছে। আমরা একটা কথা বলি রবীন্দ্র সঙ্গীত এবং নজরুলগীতি। What is the difference between these two terms? সঙ্গীত এবং গীতি। নজরুলের গান কিন্তু অনেক লোকে সুর করে নিজের ঢঙে গেয়েছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তার অধিকাংশ গানে স্বরলিপি সুর নিজেই রচনা করেছেন। তিনি একজন নোবেল বিজয়ী কবি। বিশ্বকবি হিসাবে যার খ্যাতি। তাঁর গানকে বিকৃত করার অধিকার আছে বলে আমার মনে হয় না। যতই সত্ত্ব আমরা পেয়ে থাকি না কেন, যতই ওয়েস্ট্রান ইনুস্ট্রুমেন্ট আমরা ব্যবহার করি না কেন। রবীন্দ্রনাথের গান ঐ স্বরলিপিটা রেখে আমরা মিউজিকালি কিছু চেন্জ করতে পারি। কিন্তু তার সুর বা স্বরলিপিকে চেন্জ করার ধৃষ্টতা বোধয় আমাদের নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন অত্যাধুনিক মানুষ। সে যুগে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি কিন্তু আমাদের থেকেও অনেক আধুনিক। তিনি প্রত্যেকটা গানের সুরারোপ করে গেছেন। তাঁর এই সুরটাকে আমাদের ঠিক রাখা উচিত বলে আমার মনে হয়। আমাদের তাঁর স্বরলিপিটাকে ডাইভার্ট করা উচিত হবে না। আর কোনো দেশের জাতীয় সংগীতের ক্ষেত্রে তো সেটা আরো অনুচিত। কারণ তার আবেগ জড়িয়ে থাকে সমগ্র জাতিসত্তা তথা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সংঙ্গে।
ঝুম্পা রায়- রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী। জন্ম-খুলনায়। শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত প্রতিযোগিতায় রবীন্দ্র সংগীতে বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম এবং জাতীয় পর্যায়ে রানার আপ। বিশ্ব ভারতীর শিক্ষার্থী।