ছাতাই হাট। হাটটি প্রাচীনত্বের দাবি রাখে। হাট বসে সপ্তাহে একদিন বৃহস্পতিবার। একদা এই হাটের হাকডাক ছিল। এখন উঠতে উঠতে উঠে যায়নি। ওসমান আহমেদ এই হাটে বহুদিন আগে একটি চায়ের স্টল করেছিল। হাটে ঢোকার মুখে রাস্তার উপরে। এ পর্যন্ত তার চা স্টলে কতলোকের পদধুলি পড়েছে তার ইয়াত্তা নেই। ওসমান আঁচ ধরিয়ে কেটলি বসিয়েছে উনুনে।
একজন লোক এসে বাতার নড়বড়ে বেঞ্চে বসল। একটা লিকার চা দাও তো চাচা।
ওসমান লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছে। লোকটি কি আগে কখনো তার চা স্টলে এসেছে…! ঠাওর করতে পারছে না।
আজ হাট বেলায় বিকালে অনেকদিন পর দেখা হয়ে গেল মুখোমুখি। অনেকদিন পর অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা হবে জানত না তারা। ওসমান লোকটির মুখের দিকে চেয়ে জিগ্যেস করল-আপনি? আপনাকে চেনা চেনা লাগছে। চিনতে পারনি চাচা? লোকটির ঘাড়ে শান্তিনিকেতনি ব্যাগ এবং মুখের রেখা মুছতে মুছতে মুছে যায়নি। লোকটি নেহাত মন্দ নয়। হাত তুলে সেলাম জানাল।
লোকটির হাওয়াই চপ্পল, ছেড়া পাঞ্জাবি-পায়জামা থেকে আজ নিত্যনতুন ধোপদুরস্ত পোশাক উঠেছে গায়ে। সবই গরীবদের ভাঙিয়ে হয়েছে। একদিন বলেছিল সমাজের অন্ধকার দূর করতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। করেও ছিল। পার্থক্য এখনো কোনো মুক্তির স্বাদ পায়নি ওসমানের মতো অনেকেই। কিন্তু লোকটি ঠিকই জীবন যাপন বদলে নিয়েছে। বিড়ি থেকে এখন ঠোঁটে সিগারেট উঠেছে। ওসমান লোকটির সাদা পোশাকের দিকে লক্ষ্য করছে। হায় আফসোস…!
কে এই লোক। শরীর জুড়ে সুখের ঢেউ বইছে। সে সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা ইস্কুল মাস্টার। দশ বছর আগে লোকটি তাদের ফেলে গেল এখানে। ওসমানদের একটুও পরিবর্তন হয়নি। লোকটি তাদের ভোট নিয়ে বিধায়ক হলেন। পরে শহুরে জীবন যাপন করছে। সরকারি হিস্যা পেয়ে ভালোই আছে। ওসমানদের জীবনের উপর দিয়ে কত ঝড় ঝাপটা বয়ে গেল।
লোকটি কেমন যেন অপরাধীর মতো ওসমানের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ওসমান মনে মনে আউড়াতে লাগলো। লোকটি সরকারি হিস্যায় শহরে বাড়ি-গাড়ি আর একটা বেশ ভুড়ি এবং মসৃণ শরীর হাঁকিয়েছে। সবাই মুখোশধারী আমাদের নিয়ে খেলা করে।
সন্ধ্যা নেমে আসছে। চায়ের স্টল বন্ধ করতে হবে। লোকটি ওসমানের দিকে তাকিয়ে দেখল। ওরা আজও যে তিমিরের সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। এই জটিল ভাবনা পেয়ে বসলো। লোকটি আসলে আর কেউ-ই না। মুখোশধারী।