সকাল থেকেই বিল্টুর জ্বর। গতকাল সন্ধ্যা থেকেই জ্বরের একটা ভাব ছিল। সেটা পরিণতি প্রায় আজ সকালে। কিছুক্ষণ আগে একজন ডাক্তার এসে দেখে গেছেন। বলে গেছেন ওর সামনে যেন কেউ কান্নাকাটি না করে। ওর মায়ের কান্নাকাটি দেখেই তিনি এ কথা বলেছেন কিনা জানা যায়নি। তবে ডাক্তার সাহেবের বিষন্ন চেহারা দেখে সকলেই বুঝতে পেরেছে ওর সামনে সবাইকে স্বাভাবিক থাকতে হবে। ডাক্তার সকাল বেলা এসে কয়েকটা টেস্ট করতে দিয়েছিলেন। ঐ রিপোর্টগুলো হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে তিনি কি বুঝলেন তিনিই জানেন। বললেন, ছেলেটাকে সবসময় আনন্দে রাখার চেষ্টা করবেন। ওষুধগুলো সময়মত খাওয়াবেন। তারপর থার্মোমিটার বের করে, রোগীর জ্বর মেপে, ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওকি কোনো কারণে ভয় পেয়েছিল? বাবা খানিক্ষন চুপ করে রইলেন। তার বাম পাশে দাড়ানো বিল্টুর মায়ের চোখের দিকে এক পলক তাকালেন। হয়তো চোখের ইশারায় কোনো একটা সমর্থন পেয়ে, ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন, গতকালের সেই ঘটনাটার পর থেকে…, তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না। ডাক্তার সাহেবও কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। তিনি উত্তরের বাকী অংশটা জানেন। আজ সকালে পত্রিকা খুলে প্রথম পাতায় লাল অক্ষরের শিরোনামটা তার চোখে পরেছে। “গণপিটুনিতে ছিনতাইকারীর মর্মান্তিক মৃত্যু।” তিনি খবরের মূল অংশটা আর মনে করতে চাইলেন না। যখনই সেকথা মনে হয় তার শরীর কেঁপে ওঠে। বিল্টুর মা ডাক্তারের মুখের দিকে খানিক্ষন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর পর তিনি কাঁদছেন। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলেছেন, পেঁয়াজের ঝাজে চোখে পানি এসেছে। একটু আগেই এমনিভাবে পেঁয়াজের ঝাজে তার চোখে পানি এসেছিল। তাই চোখ দুটো ফোলা দেখাচ্ছে। এতোদিন তিনি যথেষ্ট বুদ্ধিমতি আর সাহসি মহিলা হিসেবে পরিবারে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তার ছেলের বর্তমান অবস্থা দেখে বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছেন বলেই মনে হচ্ছে। অন্য মায়েরা এমন পরিস্থিতিতে কী করতেন কে জানে, তবে তিনি কেবল কাঁদছেন। কাল রাতের বিল্টু, আজ সকালের ও এখনকার বিল্টুর মধ্যে অনেক তফাত। বিল্টুর বাবা ওর মাকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছেন্। কিন্তু খুব একটা কাজ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। মধ্যবয়স্ক ডাক্তার ব্যাগ গুছিয়ে ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে বললেন, এটা সাধারণ জ্বর। তিন দিনেই সেরে যাবে। কিন্তু ওর মনে যে অসুখ ঘর বেধেছে। ওর মনুষ্যত্ববোধ খুবই তীব্র। ওকে একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর বাবা মা ছেলের মাথার দু’পাশে দুজন বসলেন। মা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, এখন কেমন আছ বাবা? বিল্টু বললো, ভালো। ওর কথা বলতে ভালো লাগছে না। তবু মায়ের প্রশ্নের জবাব না দিলে পাপ হয় বিধায় জবাব দিয়েছে। ছটফটে, ফুরফুরে ছেলে বিল্টু কদিনেই কেমন নেতিয়ে পরেছে! ওর স্কুলের বন্ধুরা এসে দেখা করে গেছে। অয়ন বলেছে, বেশী বেশী আপেল কমলা খেয়ে তারাতারি সুস্থ্য হ বিল্টু। আগামী পরশু ‘এ’ দলের সাথে আমাদের খেলা। মনে থাকে যেন। সেকথা ওর ভালোভাবে মনে আছে। ক্রিকেট পাগল ছেলে বিল্টুর সেকথা ভুলে গেলে কি চলবে? সে যে দলের সেরা ব্যাটসম্যান। পুরোনো ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেনির ছাত্র বিল্টু। এবার সে ‘এ’ দলকে হারাবেই বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল। গত মাসে ওদের কাছে হেরে ‘বি’ গ্রুপের প্রেস্টিজ ধুলোয় লুটোপুটি খেতে দেখে ওর খুব কান্না পেয়েছিল। আগামি পরশু সেই প্রতিক্ষিত ক্রিকেট ম্যাচ। বন্ধুরা ওকে অনেকক্ষন সঙ্গ দিয়ে গেছে। সাহস দিয়ে গেছে। যদিও তারা জানেনা সাহসের ওর কোনো অভাব নেই। বিছানায় শুয়ে থাকতে ওর একদম ভালো লাগেনা। আবার বিছানা ছেড়ে উঠতেও কষ্ট হয়। বিল্টু বুঝতে পারছে সে অসুস্থ। বাবা-মা আর বুবলির বিমর্ষ চেহারা দেখে আরও বুঝতে পারে সে কঠিন অসুস্থ। তবুও শুয়ে থাকতে ওর ভালো লাগে না। অসুস্থ মানুষদের সবাই মায়া করে। করুনার দৃষ্টিতে তাকায়। কিন্ত সে নিজের জন্য করুনা চায়না। ওর চেয়ে দু’বছরের বড় বুবলি। পড়াশুনায় যথেষ্ট পরিমান অমনোযোগী। পড়ালেখায় খারাপ হলেও বিল্টু ওকে ভীষণ পছন্দ করে। ওর অনেক বুদ্ধি। ওদের ছোট পরিবারে বিল্টুর সবচেয়ে কাছের মানুষটি হচ্ছে বুবলি। বুবলি তার ভাইয়ের রোগমুক্তির জন্য আজ রোজা রেখেছে। সময় করে নামাজ পরেছে। কথাটা শুনে বোনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় বিল্টুর চোখে পানি এসে গেছে।
কপালে কোমল হাতের স্পর্শ পেয়ে বিল্টু জিজ্ঞেস করল, কটা বাজে, মা? মা ছেলের কপালে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ছয়টা। সে আবার জিজ্ঞেস করল, সন্ধ্যা নাকি সকাল? মা বললেন, সন্ধ্যা। সন্ধ্যাবেলায় স্বপ্ন দেখলে কি হয় মা। মা ছেলের কপালে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, জানি না, বাবা। স্বপ্নের কোনো মানে হয় না। উল্টা-পাল্টা চিন্তা করে আজে বাজে স্বপ্ন দেখিসনা। চুপচাপ শুয়ে থাক। আরাম করে কিছুক্ষন ঘুমা। ছেলের মাথাটা তার কোলে তুলে নিলেন। চুলে হাত বুলাতে বুলাতে অনেক বছর আগে তার নবজাতক ছেলের মুখটা মনে করার চেষ্টা করলেন। এইতো, ছেলের চিৎকার তার কানে ঝনঝন করে বাজছে। এই ছেলেটা খুব আবেগপ্রবন! মানুষের প্রতি তার মমতা ততটাই যতটা আর দশজন মানুষের মধ্যে নেই। এজন্য ছেলেকে তিনি শাষণ করেছেন অনেকবার। বলেছেন, বেশি মায়া ভালো না। একটু শক্ত হও। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। লঞ্চ ডুবে মানুষ মরে, গাড়ীর ধাক্কায় মানুষ মরে, মানুষ মরে যুদ্ধে গিয়ে। পত্রিকায় এসব খবর পড়ে ওর মন খারাপ হয়ে যায়। মা তখন ছেলেকে শান্ত দেয়ার চেষ্টা করেন। বিল্টু ফ্যাল ফ্যাল করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর কিছু একটা চিন্তা করে। এমন একটা ভাব দেখায় যেন মায়ের কথায় সে শান্তনা পাচ্ছে। ছেলের এই নীরব চাহনি মায়ের বুকে আরো বেশি করে লাগে। রহিমা বুয়া এক বালতি পানি নিয়ে এসেছে। ওর মাথায় দেয়া হবে। ডাক্তার বলেছেন, দিনে অন্তত দুইবার মাথায় পানি ঢালার জন্য। বিল্টু তার নরম বিছানায় শুয়ে আছে। মাথাটা আগে যেখানে ছিল এখন তার বিপরীত দিকে। বিছানার কিছুটা বাইরে মা বসেছেন, বাম পাশে। বুবলি একটা ভেজা তোয়ালে দিয়ে ভাইয়ের পা দুটো ভিজিয়ে দিচ্ছে। বাবা গেছেন মাগরিবের নামাজ পরতে, মসজিদে। বিল্টুর কপালে ঠান্ডা জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে। ওর ভালো লাগছে। শরীরে শিরশির একটা অনুভুতি চলে এসেছে। চোখ দুটো আবার বুজে আসছে। ঘুমাতে ইচ্ছা করছে। চোখের পাতা ধীরে ধীরে বন্ধ হতেই স্বপ্নেরা এসে জায়গা করে নিলো সেখানে।
বিল্টু আর ওর মামাতো ভাইবোনেরা মিলে চার পাঁচজন প্লেট হাতে বসে আছে রান্নাঘরে। বড়মামী রুটি সেকছেন। মাটির উনানে দাউ-দাউ করে আগুন জ্বলছে। মাঝে মাঝে মামী উনানের ভেতর কাঠের গুড়ো ছিটিয়ে দিচ্ছেন। আর আগুন তাতে আরো ফুসে উঠছে। বিল্টু যখন স্কুলের ছুটিতে মামারবাড়ি আসে তখন মামী কিংবা নানীর পাশে বসে মাটির উনানে রান্না করার দেখে। দৃশ্যটা খুব চমৎকার। উনানের দিকে তাকিয়ে থাকতে ওর ভালো লাগে। মাটির উনানে আগুন কেমন যেন তেজী তেজী ভাব। সব সময় ফোঁস ফোঁস করে। এই চুপচাপ, হঠাৎ আবার গর্জে ওঠে। ঢাকার গ্যাসের চুলায় এরকম কখনও দেখেনি সে।
মামার বাড়িটা বিল্টুর কাছে খুব ভালো রাগে। বড় বড় ঘরের উপর টিনের চাল, মাটির মেঝে, বারান্দা আর উঠোন সবটাই মাটির। চারপাশে এতো ঘাস সে আর কোথাও দেখেনি। ওর কাছে মনে হয় পৃথিবীর কোথাও এতা গাছ নেই, এত সবুজ নেই, যতটা মামার বাড়িতে আছে। বাড়ির সামনেই বিশাল জঙ্গল। একবার মেঝ মামাকে জিজ্ঞেস করেছিল, জঙ্গল থেকে বাঘ এসে কাউকে খেয়ে ফেলেনা, মামা? মামা বিল্টুর প্রশ্নে একগাল হাসলেন। বললেন, এই জঙ্গলে বাঘ-ভাল্লুক নেইরে বেটা। থাকলে কি আর আমরা জঙ্গলের পাশে ঘর বাড়ি নিয়ে থাকতে পারতাম! তবে, বাঘ না থাকলেও… বাঘডাশ আছে।
বাঘডাশ! এটা আবার কেমন নাম? এই জন্তুর নাম সে আগে কখনও শোনেনি। তাই জিজ্ঞেস করল, বাগডাশ কী, মামা? মামা বললেন, বাঘের মতো ডোরাকাটা দাগওয়ালা একটা জন্তু। আকারে শেয়ালের মতো বড় হয়। বিল্টু শেয়াল চেনে। গতকালই একটা শেয়াল সে দেখেছে। কিন্তু বাগডাশ তার দেখা হয়নি। মামাকে বলল, আমাকে বাগডাশ দেখাবে, মামা? মামা ভাগ্নের আগ্রহ দেখে আরো উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। বললেন, সত্যিই দেখতে চাস? ভাগ্নে সত্যি সত্যি বাগডাশ দেখতে চায় শুনে মেঝ মামা আবার বললেন, ঠিক আছে, তোকে একদিন জঙ্গলে নিয়ে যবো। তিন মামার মধ্যে মেঝ মামার সাথেই ওর বেশি ভাব।
মামাতো ভাই বোনেরা বিল্টুর চেয়ে অনেক দ্রুত খায়। এই মুহূর্তে সবাই প্রতিযোগিতা করে নাস্তা করছে। কেউ কেউ তিনটি রুটি খেয়ে ফেলেছে। আর সে এখনও প্রথমটাতেই আছে। সকাল বেলা খেতে ওর ইচ্ছা করে না। শুধু মায়ের বকুনির ভয়ে খেতে হয়। সে এটাও বুঝতে পারে না খাওয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা করার কি আছে। সবাই বেশ আনন্দে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। বড় মামী তাকে যখন আরেকটা রুটি দিতে চাইলেন তখন সে প্লেট সরিয়ে নিয়েছে।
হঠাৎ কি যেন একটা হলো। লোকজন দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে লাগলো। মামাতো ভাই বোনদের সাথে বিল্টুও খাওয়া ছেড়ে এক দৌড়ে ছুটে এলো বাড়ির সামনে। একেবারে জঙ্গলের পাশে। বৃদ্ধ থেকে শুরু করে মধ্যবয়স্ক, যুবক আর ছোট ছোট ছেলে মেয়েরাও ছুটছে জঙ্গলের দিকে। কারো হাতে লাঠি। কারো হাতে বাঁশ, বল্লম, দাঁ। যে যা পাচ্ছে তাই নিয়ে ছুটছে জঙ্গলের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় বিল্টুর চোখ একেবারে ছানাবড়া হয়ে গেল। ওর বুক ধড়ফড় করতে লাগল। না জানি আজ কী খুনোখুনিটাই না হয়! ও শুনেছে জমি দখল নিয়ে যখন মারামারি হয় তখন অনেক মানুষ আহত হয়, অনেকেই আবার মরেও যায়। মারামারি বিষয়টিকে এরা বলে হাজাহাজি। হাজাহাজি জিনিশটা নাকি খুবই ভয়াবহ। কিন্তু কী আশ্চর্য! ওর সঙ্গীরা সবাই জঙ্গলের দিকে যেতে চাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে কানাকানি করছে। বড় মামার ভয়ে যেতে পারছে না কেউ। বড় মামা যদি শুনতে পায় কেউ জঙ্গলে গিয়েছিল তবে সবার হাড্ডি মট ভেঙ্গে দেবে। বাড়ির ভেতর থেকে মহিলারাও ছুটে আসছে। বিল্টুর দুই মামী আর ওর মা সেই দলের মধ্যে আছে। সে এক দৌড়ে ছুটে গেল মায়ের কাছে। মায়ের পাশে দাড়িয়ে মাকে জিজ্ঞেস করল, কেন সবাই লাঠি সোটা নিয়ে জঙ্গলের দিকে ছুটছে? মা ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, পাশের বাড়ির তোমার রমজান মামার মুরগীর খোয়ার থেকে মুরগী নিয়ে গেছে, বাগডাশ। সবাই ছুটছে তার পেছনে। বিল্টুর চোখ মুহূর্তেই চকচক করে উঠলো। হাত-পা নিশপিশ করতে লাগল। কিছুক্ষন আগে যে ঘটনায় সে ভয় পাচ্ছিল, এই মুহূর্তে সেখানে এ্যাডভেঞ্চার সুবাস ছড়াচ্ছে। এই জন্তুটার নাম সে মামার কাছে শুনেছে। জন্তুটা মুরগী চুরি করে তা জানা গেল এইমাত্র। কোনো জন্তু ধরতে গেলে মানুষ এতো আনন্দ করে তা সে কখনও ভাবেনি। তবে জিওগ্রাফী চ্যানেলে সে বাঘকে দেখেছে হরিন শিকার করতে। দেখতে দারুন লাগে। কিন্তু বাস্তবে কেমন লাগে? উৎসব উৎসব একটা ভাব চলে এসেছে সবার মাঝে। বিল্টুরও ইচ্ছা করছে বাগডাশ শিকার উৎসবে যোগ দিতে। কিন্তু বড়মামা…
বিশাল এক জঙ্গলের ভেতর ত্রিশ থেকে চল্লিশজন লোক নানা প্রকার গ্রামীণ অস্ত্র নিয়ে একটা জন্তর পেছনে ছুটছে। দলটা মাঝে মাঝে চার পাঁচটা উপদলে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। আবার একত্র হচ্ছে। উত্তর দিক থেকে একদল হৈ হৈ করলে অন্যদল দক্ষিন দিক থেকে রৈ রৈ শব্দ তুলে সাড়া দিচ্ছে। সকলের চোখে মুখে অদ্ভুত এক উত্তেজনা। কারোর হাসি। শিকারের নেশা যেন পেয়ে বসেছে সবাইকে। বিল্টুর মেঝ মামাও সেই দলের একজন। বিল্টু এই শিকার দলের ছোট একটা উপদলের সঙ্গী হয়েছে অনেকক্ষন। দলের ভিতর যে তার মত ছোট একটা ছেলে আছে তা লক্ষ্য করেনি কেউই। সকলেই ব্যস্ত শিকার নিয়ে। বিল্টুর কাছে পুরো ব্যাপারটাই ঘোরের মতো লাগছে। মামাতা ভাই বোনেরা কেউই জঙ্গলের ভেতর ঢুকতে সাহস করেনি। সে মায়ের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে কখন যে জঙ্গলের ভেতর ঢুকেছে নিজেও বুঝতে পারেনি। এই মুহূর্তে শিকার দলটা মোট পাঁচটা উপদলে ভাগ হয়ে আছে। বিল্টু আছে মেঝ মামার দলের সঙ্গেই। বাগডাশ নামক জন্তুটা দীর্ঘক্ষণ সবাইকে দাপাদাপি করিয়ে এখন কিছুক্ষন যাবৎ ঘাপটি মেরে কোথাও বসে আছে। সে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে তার পেছনে ত্রিশ-চল্লিশ জন সশস্ত্র মানুষের তৎপর পদক্ষেপ। যে করেই হোক প্রাণ বাঁচাতে হবে তার। তাই সে ছুটছে দিগ্বিদিক। যে দিকেই চোখ যায় সে দিকেই ছুটছে সে। লাফ-ধাপ-ঝাপ এবং পুর্বপূরুষ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যে কৌশল সে শিখেছিল সব ব্যবহার করছে। শিক্ষার সর্বোচ্চ ব্যবহার আজ যদি করতে পারা না যায় তবে বিপন্ন হবে প্রানধন। পূর্বদিক থেকে হৈ হৈ রব শুনা গেল। বেরিয়েছে-বেরিয়েছে, মার-মার…। পশ্চিম থেকে আবার সাড়া এলো, ধর…ধর। বিল্টু পেছন ঘুরে তাকালো। বাঘের মতো ডোরাকাটা, শেয়ালের মতো আকার, বেড়ালের মতো চকচকে চোখজোড়া। চোখাচোখি হলো পলকের জন্য। প্রাণীটা উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে প্রাণপন। বিল্টুর কচি চোখজোড়া চকচক করছে উত্তেজনায়। সারা শরীর জুড়ে বয়ে যাচ্ছে অদ্ভুত এক শিহরণ। জিওগ্রাফী চ্যানেলে দেখা বাঘের হরিন শিকারের কথা মনে পড়ে গেলো তার। ওর কাছে মনে হলো জন্তুটা ঠিক শেয়ালের মতো নয়। প্রায় অনেকটা বেড়ালের কাছাকাছি। সে দেখতে পেল সবাই ছুটছে একটা বাগডাশের পেছনে। বিল্টুও ছুটছে সবার পেছনে। পেছনে থাকলেও ওর মনটা ছুটছে সবার আগে। নিজেকে এখন বাঘ বলে মনে হচ্ছে। আবার আওয়াজ উঠলো, মার-মার-মার। এই ডাইনে, এই বায়ে, এমন অনেক চেষ্টার পর পাজি নচ্ছার বাগডাশ ধরা পড়লো। মেঝ মামার বন্ধু মজনু মামা সগৌরবে বললেন, শালা বাগডাশের বাচ্চা। অনেকক্ষন দৌড়াইলি, খামোখা ভুগাইলি, মরবিতো জানস, হুদাই দৌড়াইলি ক্যান? সবাই বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়লো।
জন্তুটা প্রাণপন ছুটতে ছুটতে একসময় একটা আমগাছে গিয়ে উঠলো। লুকানোর চেষ্টা করল পাতার আড়ালে, ডালের আড়ালে। কিন্তু বিধিবাম! তার সহায় হলোনা কেউই। ভূমি থেকে নিক্ষিপ্ত ইট আর ছোট ছোট পাথরের বৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে একসময় মহামূল্যবান প্রানধন বাঁচাতে পাশের কাঁঠাল গাছের একটা সুবিন্যস্ত ডাল নাগাল পেতে জন্তুটা দিল লাফ। কাঙ্খিত লক্ষ্যবস্তুর নাগাল পেতে সমর্থ হলেও সে বুঝতে পারেনি ডালটা তার ওজন বহনের তুলনায় যথেষ্ট নরম। তার দেহের ওজন ডালটা রাখতে পারেনি। দেহটা ভেসে উঠলো শূন্যে। মজনু মামা তার হাতের বল্লমটা উঁচু করে ধরলো। ধারালো অংশটা আকাশের দিকে তাক করে। যেন সে আকাশটা ফুঁটো করে দেবে। জন্তুটা উপর থেকে একেবারে মজনু মামার বল্লমের আগায় এসে পড়ল। আর তৎক্ষনাৎ এফোঁড়-ওফোঁড়। বল্লমের মাথায় ঝুলিয়ে মৃত জন্তুটাকে এভাবেই জঙ্গলের বাইরে লোকালয়ে নিয়ে আসা হল। সবাই জয়ের আনন্দে নাচানাচি করতে লাগল। হাজাহাজির পর বিজয়ী দল নাকি এভাবেই উল্লাশ করে। পুরো ঘটনাটাই ঘটেছে বিল্টুর চোখের সামনে। শেষ মুহূর্তে ওর খুব মায়া হয়েছিল জন্তুটার বাঁচার আকুতি দেখে। সে মনেমনে প্রার্থনা করেছে জন্তুটা বেঁচে যাক। জন্তুটা যখন মজনু মামার বল্লমের সংস্পর্শে এলো তখন নিজের অজান্তেই বিল্টুর মুখ দিয়ে অস্পষ্ট একটা শব্দ বেরুলো। ইশ…।
বিল্টুর মনে হচ্ছে ওর মাথাটা কেউ যেন ঝাকাচ্ছে। ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ যুগলে ধীরে ধীরে আলো প্রবেশ করল। মা ওর মাথা তোয়ালে দিয়ে মুছে দিচ্ছেন। সে বুঝতে পারছে ঘুম আর জাগরনের মধ্যবর্তী একটা অবস্থানে ছিল সে। তিন বছর আগে সে তখন ষষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্র ছিল। তাই মামারবাড়ির বাগডাশ শিকারের ঘটনাটা তার মস্তিস্কে এখনও সমুজ্জল হয়ে আছে। গতকাল দুপুরে শহরের বাগডাশ শিকারের বীভৎস দৃশ্যটা নিজের চোখে দেখার পর বিল্টু এই স্বপ্নটা এই নিয়ে দুবার দেখেছে। গতকালের ঘটনাটা সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না।
কী একটা কারনে যেন গতকাল স্কুল ছিল বন্ধ। বিল্টু আর বুবলি টিভি দেখছিল। হঠাৎ রাস্তা থেকে শোরগোল শুনে জানলা দিয়ে উকি দিল। ভলো করে দেখা যাচ্ছে না। তাই ছাদে গেল দৌড়ে। এরকম শোরগোল প্রায়ই শোনা যায়। রিকশাওয়ালারা এভাবিই ঝগড়া করে। দেখতে বেশ ভালোই লাগে । ওদের ঝগড়াগুলো বেশ মজার হয়। বেশিরভাগ সময়েই কারনগুলা থাকে অতি তুচ্ছ।
একটা পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ির সবার উপরের তলায় বিল্টুদের ঘর। বাড়িটা রাস্তার একেবারে পাশে হওয়ায় ছাদ থেকে রাস্তাটা পরিস্কার দেখা যায়। অনেকগুলো লোক মিলে একটা মানুষকে মারছে। লাথি, ঘুষি, চড়। যে যেভাবে পারছে, মারছে। এই দৃশ্য দেখে বিল্টু চমকে উঠলো। তার বুক কেঁপে উঠলো। সে বুঝতে পারলো না এতোগুলো লোক মিলে একটা মানুষকে মারছে কেন! পাশের ফ্ল্যাটের কলেজ পড়ুয়া মামুন ভাই বললো, লোকটা নাকি ছিনতাইকারী। মহল্লার একজনের গলা থেকে নাকি সোনার চেন ছিনতাই করে পালাচ্ছিল। শুনে বিল্টু অবাক হয়ে নীচের দিকে তাকালো আবার। তাই বলে একটা মানুষকে নির্মমভাবে পেটাতে হবে? চল্লিশ থেকে পঞ্চাশজন লোকের ঠিক মাঝখানে ছিনতাইকারী নামের লোকটা মার খাচ্ছে, বেদম। কয়েকজন লোক এর মধ্যেই রড আর লাঠি নিয়ে এসেছে। সেগুলো সদ্ব্যবহার চলছে। কিছু অতি উৎসাহী লোক এদিক সেদিক থেকে ছুটে ছুটে আসছে। আর তাদের নাগরিক অধিকার আদায় করে সটকে পরছে। ছাদ থেকে বিল্টু লক্ষ্য করল একজন পুলিশ অফিসার লোকগুলোর ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে ছিনতাইকারী লোকটা মার খাচ্ছে। চতুর্দিক দিয়েই হামলা হচ্ছে। চুরির শাস্তি দেয়া হচ্ছে তাকে। পুলিশ অফিসারকে দেখে অস্থির হয়ে উঠলো বিল্টু। লোকটাকে সে বাঁচাচ্ছেনা কেন? এতোগুলো লোক মিলে যেভাবে একটা মানুষকে মারছে তাতে সেতো মরে যাবে। একে থানায় নিয়ে গেলেইতো হয়। খাঁচায় বন্দী পাখির মত তার মনটা কেবল ছটফট করতে লাগলো। এই মুহুর্তে ছিনতাইকারী লোকটার জন্য বিল্টুর মায়া হচ্ছে। ভীষণ মায়া। লোকটা ছিনতাইকারী হলেও মানুষতো! বিল্টু লক্ষ্য করলো সে অনেক উচু থেকেও মারের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। সে শব্দ একটা মানুষের করুন আর্তনাদকেউ ছাপিয়ে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে পুলিশ অফিসার কার সাথে যেন ওয়াকিটকিতে কথা বলছেন। আর উত্তেজিত মানুষগুলোকে হাতে কী যেন একটা ইশারা করছেন। সে ইশারায় লোকগুলো আরো উৎসাহিত হয়ে উঠলো। উত্তেজিত হয়ে উঠলো। বুঝা গেলো আগুনে ঘি ঢালা হয়েছে। বিল্টু আবার উত্তেজিত মানুষের কন্ঠ শুনতে পেল। মার-মার-মার…। হঠাৎ কার হাতে যেন একটা পাথর উঠে আসলো। এ…ত্তো বড় একটা পাথর। লোকগুলো বলছে মার-মার-মার। পুলিশ অফিসার আবার ইশারা করছেন। লোকগুলো আবার বলছে মার-মার-মার। বিল্টু লক্ষ্য করল হঠাৎ করেই সে চোখে ঝাপসা দেখছে। মাথাটা একটু যেন ঘুরে এলো। ছাদের রেলিং ধরে সে বসে পরল নীচে। সে বুছতে পারছে তার গাল বেয়ে উষ্ণ জলের ধারা বয়ে চলেছে। স্পষ্ট শুনতে পেল, তার পাশে দাঁড়িয়ে বুবলি, মামুন ভাই ও আরো সকলেই ছিনতাইকারীর করুন পরিণতি নিয়ে আফসোস করছে। পক্ষে বিপক্ষে তর্কাতর্কিও হচ্ছে। বিল্টু নিজেকে সামলে নিয়ে দাড়ালো। চোখ মুছে তাকালো নীচে। দেখলো, একটা বাগডাশ মরে পড়ে আছে। ছিন্ন ভিন্ন মাথা। থেতলে যাওযা শরীর থেকে লাল টকটকে রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে চতুর্দিকে। বিজয়ীরা উল্লাশ করছে। বিল্টু ভাবছে, মানুষের জীবন এতো তুচ্ছ? তার মনে হচ্ছে সে নিজেই যেনো মানুষটার জায়গায় মরে পড়ে আছে। নিজেকে দুমড়ানো মুচড়ানো একটা মাংসপিন্ড বলে মনে হচ্ছে। সে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো, এ রক্ত বাগডাশের নাকি মানুষের?