রাইফেল, রোটি, আওরাত– এ কি কোন উর্দু বইয়ের নাম? নাহ! বাংলাই। আরো বিস্তারিত করে বললে এই বই বাংলামায়ের উদ্দেশ্যে আমাদের দুখিনী বাংলাভাষা দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়েছেন লেখক আনোয়ার পাশা। সেই যে ৫২তে রক্ত ঝরেছিল ভাষার দাবীতে, সেই ভাষায় যে বই লিখেছেন শহিদ বুদ্ধিজীবী লেখক আনোয়ার পাশা, তা পড়তে গিয়ে রক্তবিন্দু অশ্রুকণা হয়ে গড়িয়ে পড়বে চোখ দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত উপন্যাস রাইফেল, রোটি, আওরাত। উপন্যাসের মোড়কে লেখক নির্ভয় সত্যের ইতিহাস রচনা করে গেছেন। কিন্তু হায়! তিনি জানতেন না, ২৫মার্চের কালোরাত পেরিয়ে তার সেই দুঃসহ স্মৃতির ভার তিনি ঢেলে দিলেন এপ্রিল থেকে জুন মাসে রচিত তার উপন্যাসের বর্ণনায়, ১৪ ডিসেম্বর মাতৃভূমির কিছু কুসন্তান তাকে তুলে দেবে ঘাতকদের হাতে, তিনি তার উপন্যাসের মতই ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবেন। বিজয়ের পর এই মহান শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও লেখকের দেহাবশেষ পড়ে থাকতে দেখা যাবে মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের কাছে৷
বইটি পড়তে গিয়ে, ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয় যেমন মানুষ, তেমনি সেই কালোরাত্রির বর্ণনায় আমি বারবার চমকে উঠেছি। নিজেকে কখনো সুদীপ্ত শাহীন, কখনো ফিরোজ, কখনো আমেনা কখনো বুলার জায়গাতে গিয়ে সেই মানুষগুলির তৎকালীন মানসিক পীড়নকে বোঝার চেষ্টা করেছি। উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র সুদীপ্ত শাহীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক। সুদীপ্ত শাহীনের আড়ালে আমরা যেন আনোয়ার পাশাকেই দেখতে পাই। লেখক কি নিজের অনুভূতিই প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন তার উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে? বাংলা নামের জন্য যাকে বারবার মুছিবতে পড়তে হয় তৎকালীন পাকওয়াতানে। অথচ ভাষার ধর্ম হয় না, ভাষা ও কৃষ্টির সৃষ্টি হয় ভৌগলিক অবস্থানের ভিত্তিতে। যিনি পরমকরুণাময়, তিনি ভাষাভেদে মানুষকে ভিন্ন চোখে দেখেন না। যে বোবা, যে বধির, তার করুণ আর্তি কি তবে স্রষ্টার কাছে পৌঁছায় না? পৌঁছায় তো! সকলকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে, অন্নবস্ত্র সংগ্রহের তাগিদে লেখক সুদীপ্ত শাহীন বেছে নেন চলনসই নাম। কিন্তু তার ভেতরে প্রদীপ্ত থাকে যে ব্যক্তিমানুষ, তার নাম সুদীপ্ত শাহীনই। তিনি কোন ধরাবাধা সংস্কারে বাঁধা পড়তে চান না,প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক৷ তবে কি তিনি খুব দুঃসাহসী? না। তিনি আর দশটা সাধারণ বাঙালি গৃহস্থের মত একজন। ছাত্রদের আন্দোলনে প্রচ্ছন্ন মমতা বোধ করেন কিন্তু খালেক বা মালেক সাহেবের কথার বিপরীতে ঠোঁটকাটা উত্তর দিতে পারেন না। তার মতের বিরুদ্ধে গেলে তিনি চুপ করে যান। তারও মন চায় হানাদারদের এই নৃশংস অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটা মেশিনগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে, পরমুহূর্তে মনে পড়ে স্ত্রী সন্তানের মুখ, তাদের একটি নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার বাসনা৷
ঔপন্যাসিক আনোয়ার পাশা আমাদের জানাননি সুদীপ্ত শাহীন ও তার পরিবার, তার বন্ধু ফিরোজ তাদের কি পরিণতি হয়, তারা মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ যোগদান করেছিলেন কি না, কারণ উপন্যাসের দিনকালের স্থায়িত্ব সবে দুই-তিন দিন। ফ্লাশব্যাক টেকনিক অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সাথে ব্যবহার করে আনোয়ার পাশা পূর্বের ঘটনাবলি উত্থাপন করেছেন। কখনো ভবিষ্যতের গল্প বলেছেন। পাঠক তাই একমুহূর্তও অমনোযোগী হবার সুযোগ পাবে না৷
তার এই বিবরণীতে এসেছে ২৫ মার্চের আগে মানুষের চাপা উদ্বেগের কথা, বিহারী সুবিধাবাদী দোকানী, মালেক ও খালেক সাহেবের মত সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি ও ফিরোজের চাচার মত মুখোশধারী ব্যক্তির কথা। কতখানি অমানুষ হলে ভাইয়ের মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে, নিজের ভাতিজিদের অসম্মান বিস্মৃত হয়ে শাসকগোষ্ঠীর পদলেহন করা যায়? কতখানি ভেকধারী ধার্মিক হলে ধর্মের দোহাই দিয়ে অমানবিক নৃশংস কাজের অযৌক্তিক কুযুক্তির দোহাই দেয়া যায়? কতখানি অমানবিক ও পাষণ্ড হলে নিজের ঘরে আশ্রিত শরনার্থীদের হানাদারদের হাতে তুলে দেয়া যায়? এই বইয়ে আমরা হয়ত কেবল দু চারটি ঘটনা জানি, কিন্তু প্রকৃত সত্য এই যে, শ’য়ে শ’য়ে এসব কল্পনার অতীত ঘটনা ঘটে গিয়েছিল আমাদের দেশে।
এসব পড়তে পড়তে যখন হতাশ হয়ে পড়ি তখন দেখা পাই, হাসিম শেখের। রাজারবাগে সামান্য অস্ত্র নিয়ে ইপিআর পুলিশ প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন সেই নারকীয় রাতে, এই উপন্যাসে হাসিম শেখ তাদের প্রতিনিধি। স্বল্পশিক্ষিত মানুষগুলি হৃদয় দিয়ে বুঝেছিলেন বাংলামায়ের কষ্ট, রক্তশপথ নিয়েছিলেন, এই অপমানের প্রতিশোধ তারা নেবেনই। বুকের ভেতর কাঁপন ধরে, রক্তে নেশা লাগে পাড়ার সামান্য ছেলেটি যখন বলে ওঠে, মরার আগে অন্তত পাঁচটা মেরে তবে মরব৷ ফিরোজ, জামাল কোরাইশী, বুলাদি- তাদের তৎপরতায় আশা জাগে। ভালো লাগে যখন ভিন্ন মতাদর্শের মানুষ বুলাদি ও কোরাইশী একযোগে কাজ শুরু করেন দেশের স্বার্থে৷ অথচ আজ দেশে দেখি নোংরা দলাদলির নির্লজ্জ প্রদর্শন! ব্যক্তিস্বার্থের কাছে ধুলিসাৎ হয় দেশের অগ্রগতি,হেরে যায় যাবতীয় মানবিক গুণাবলি৷
বইটি যখন লেখা হয় তখনো বিজয় আসেনি৷ ফিরোজ, জামাল, বুলাদি এরকম আরো স্বপ্নবিলাসী মানুষ- এদের হাত ধরে তো বাংলা স্বপ্ন দেখেছিল স্বাধীন হবার। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন লেখক আনোয়ার পাশা কি বুঝতে পেরেছিলেন বিজয় আসছে? তাই কি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন বাংলা বিজয়ের তার শেষ উপন্যাসে? তিনি কি জানতেন তাদের রক্তে স্নাত হয়েই আসবে বাংলার স্বাধীনতা? বেঁচে থাকলে আজকের বাংলা দেখে তিনি কী বলতেন? হতাশ হতেন? নাকি ছাইয়ের গাঁদা থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ খুঁজতেন? আমাদের জানা হয় নি। সে সুযোগ আসতে দেয়নি পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরা৷ ১৪ ডিসেম্বর আমাদের সূর্যসন্তানদের ধ্বংস করেছে, আজ তারা অর্ধেকও যদি বেঁচে থাকতেন বাংলার ইতিহাস হয়ত ভিন্নভাবে লেখা হত। ড. জি সি দেব, মনীরুজ্জামান, মুনীর চৌধুরী, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, শহীদুল্লাহ্ কায়সার -কত জনের নাম করব?
স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও রাইফেল, রোটি, আওরাত বইটার কিছু বর্ণনা এখনো প্রাসঙ্গিক মনে হয়৷ মনে হয় আরে, এই নোংরা কাদার মতো চিন্তাধারা তো অনেক মানুষেরই মন থেকে সাফ হয় নি। বইটিতে অনেক কঠিন কিছু কথা লেখক রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, কখনো ব্যঙ্গ করেছেন। সত্য কঠিনের মতই বজ্রকঠোর কিন্তু তাকে অস্বীকার করা যায় না।কবির মত তাই বলতে হয়,”কঠিনেরে ভালোবাসিলাম”। তাই বলতে হয়এই কঠিনসত্যকে বুক পেতে নিলাম৷
বাঙালি জাতির অকৃতজ্ঞ বলে একটা বদনাম আছে। নয়তো যে বইটা বা তার লেখককে মহান মর্যাদায় ভূষিত করার কথা ছিল তাকে কেন আমরা বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দিচ্ছি?সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ, সকলের প্রতি অনুরোধ, যদি বইটা পড়ে থাকেন, তবে তার মর্মার্থ হৃদয়াঙ্গম করুন৷ আর যদি না পড়ে থাকেন তবে মস্তিষ্ক টেবিলে খুলে না রেখে যথাস্থানে বসিয়ে বইটা পড়ুন, হৃদয় দিয়ে পড়ুন। যে রক্তস্নাত বাংলামায়ের বুকের উপর দাঁড়িয়ে শ্বাস নিচ্ছি তার কাছে আমাদের কিছু তো অন্তত দায় আছে, আসুন আমাদের বিবেক জাগ্রত করি, চিরদুঃখী বাংলা মায়ের দুঃখ দূর করতে একটু হলেও ব্রতী হই৷