দেশভাগের হাহাকার ও রান্নার রসনায় গ্রামীণ কিশোরির বলিষ্ঠ চরিত্র হয়ে উঠার গল্প
কল্লোল লাহিড়ীর ইন্দুবালা ভাতের হোটেল বইটা নিয়ে এত বেশি প্রশংসা শুনেছি যে, পড়ার জন্য কৌতুহল ছিল তো অনেকই, সেই সাথে একটা সন্দিগ্ধ মনও ছিল, ভালো লাগবে তো আমারো? হতাশ হবো না তো?
নাহ, ইন্দুবালা দিদিমা আমাকে তার রসনার জগতে টেনে আনতে পেরেছেন। বই পড়তে পড়তে এই বৃদ্ধা আমার চোখে অবয়ব লাভ করেছেন, সাদা থান আর সোনালি ফ্রেমের চশমা পরা রক্ত মাংসের এক মানুষ,বয়স যাকে আটকাতে পারেনি, মুখের বলিরেখাও যাকে বৃদ্ধ করতে পারেনি।
বই পড়তে পড়তে খুলনার কলাপোতা গ্রাম, ছেনু মিত্তির লেনের সাবেকি এক বাড়ি, রান্নাঘর, থালা বাসন এমনকি ধনঞ্জয়ের বকাবকি সব জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সেই যে কিশোরী এক বন্ধু, প্রেমিক হয়েও না হওয়া মনিরুল,বোসদের পুকুর, ছোট আদুরে ভাই, বাবা মা ঠাম্মা,মাঠ ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছের রাজ্য থেকে গিয়ে পড়লেন স্বাধীনতার গন্ধ নিয়ে ধুঁকতে থাকা এক কলকাতা শহরে, তার ব্যথা, তার কথা, তার অনুভূতির সাথে মিলেমিশে গেছি যেমন করে কচুবাটার সাথে মিশেছে খাঁটি সরষের তেল আর কাঁচালঙ্কা৷ চোখ যে ছলছল করে উঠেছে তার কারণ লছমির আঁচলে বাঁধা চুইঝাল,সরষের ঝাঁঝ না কয়লর উঁনুনের আঁচ তা বলতে পারি নে। রসে ভেজা মালপোয়া আর চন্দ্রপুলির জন্য যেমন জীহ্বা অনাদৃত আহত অঙ্গের ন্যায় অভিমান করতে চেয়েছে তেমনি ঐ যে এক ইন্দুবালা, চুলোর আঁচে একে একে অমৃত নামাচ্ছেন তার স্মৃতিতে ডুবসাঁতার দিতে দিতে দীর্ঘশ্বাস পড়েছে দাদুর জন্য, দেশভঙ্গের ব্যথা যার বুকে টনটনে ছিল মৃত্যুর দিন পর্যন্ত,মনিরুল আর ছোট ভাইটার জন্য, দেশের জন্য তারা পুড়ে মরেছে,গুলি খেয়েছে, অলক,কৃষ্ণা আর প্যাঁচাদের দলের জন্য যারা একটা শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখতে গিয়ে বুকের তাজা রক্তে ভিজিয়েছে মাটি, ওরা কখনো আর ভাত খেতে আসেনি। আচ্ছা লছমির ছেলেমেয়েগুলো কেমন করে বড় হয়েছিল মা হারা হয়ে? লছমির জন্য মনটা কেমন করে, কেমন করে ও সেই কমলা গাঁ,কমলা নদীর জন্য।
ইন্দুবালা নিজেই এক ইতিহাস। দেশভাগ থেকে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে দাঙ্গা, এপার বাংলা ওপার বাংলা, আমাদের ইতিহাস, রান্নাঘরের রসনা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, মানুষের পূরণ না হওয়া লালিত অজস্র স্বপ্ন, সব কিছু এক হয়ে গেছে ঐ মূর্তিময়ী ইন্দুবালাতে। অতীতকে সযত্নে আগলে রাখলেও ইন্দুবালা কিন্তু বর্তমানের খোলা বাতাসকেও গ্রহণ করেছেন প্রাণ খুলে, ছোট ছোট করে চুলছাটা হোস্টেলে মেয়েটা তার কাছে সিগারেটের ধোঁয়া উড়ানোর জন্য দিদিমা সুলভ খোঁচা পায় বটে, কিন্তু ছোট চুলের জন্য বকা সে খায় না, বরং পায় প্রশংসা, ভিনদেশি প্রেমিকের প্রতারণায় আহত বড় নাতনিকে অনায়াসে গ্রহণ করেন তিনি, ছুতমার্গের ধার ধারেন না।
আর রান্নার গল্প কী আর বলি?
বাঙালির হেঁসেল ঘরের এইসব ঐতিহ্য নিয়ে আরো বেশি প্রচার আর পরিচর্যার প্রয়োজন৷ জীবনের তাগিদে আমরা ব্যস্ত হয়ে উঠেছি, আমাদের রান্না হয়ে উঠেছে শর্টকাট, তারপরও এই শিল্প বাঁচিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব, দরকার সংরক্ষণের, না হলে আমরা হারিয়ে ফেলব আমাদের শিকড়ের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করার মতই বই ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। শুধু ইলিশ মাছ খাবার সময় অসাবধানে একটা কাঁটা গলায় বিঁধে যেমন গলা খুশখুশ করতে থাকে একটা তথ্য সেরকম অস্বস্তি দিচ্ছে। বইয়ে এক জায়গায় আছে ইন্দুবালার ভাই ও মা মারা যান মুক্তিযুদ্ধের সময়, স্বাধীনতা বিদ্বেষীদের দেয়া আগুনে পুড়ে, তাহলে সেই ভাইই আবার ভাষা শহীদ হন কীভাবে? ভাষা সংগ্রামী; অতঃপর মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, এমনটা হলে সহজবোধ্য হত ব্যাপরটা। তথ্যের এই গড়মিল বা অমিলটুকু লেখক যদি সযত্নে পরিহার করেন, তবে বইটার আরো জীবন্ত ও পাঠক প্রিয় হবে বলে আমার বিশ্বাস।
বইটি প্রকাশ করেছে সুপ্রকাশ প্রকাশনী। মূল্য-২৩০ টাকা।