“দ্যাখ তেরে সনসার কি হালত,
ক্যয়া হোগেই ভগবান
কিতনা বদল গ্যায়া ইনসান
সরুজ না বদলায়, চাঁদ না বদলায়,
না বদলায়রে আসমান
কিতনা বদল গ্যায়া ইনসান”।
কথাগুলোর বাংলা তর্জমা করলে এর অর্থ দাঁড়ায়, “হে ভগবান, তোমার দুনিয়া দেখ, মানুষ কেমন বদলে গেছে, সূর্য, চাঁদ, আসমান কিছুই বদলায়নি। অথচ মানুষ বদলে গেছে”। ১৯৫৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বিখ্যাত সিনেমা “নাস্তিক”-এর গানের অর্থগুলো বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না। মানুষ হিংসা, নিন্দা, লোভ, লালসার জালে বন্দি হয়ে হিংস্র পশুতে পরিনত হয়ে গেছে। বিশ্ব আজ বস্তুবাদের দ্বারা এমনভাবে প্রভাবিত হয়েছে যে, সবকিছুকে অর্থের মানদণ্ডের বিচার করতে শুরু করেছে। মানুষে মানুষের সম্পর্ককে যখন ভালোবাসার মানদণ্ডে বিচার না করে অর্থের মানদণ্ডে বিচার করা হয় তখনই শুরু হয় ফ্যাসাদ। মানুষ স্বার্থের নেশায় মাতাল হয়ে তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। ভুলে গেছে জীবনের উদ্দেশ্য কী? শূন্যদৃষ্টি বা স্বার্থশূন্য দৃষ্টি নিয়ে কোনো কিছুকে দেখার ভঙ্গিকে বলা হয় দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি। এই ভঙ্গিতে বিচার করলে আণবিক অস্ত্র দ্বারা যুদ্ধ নামক কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকে না। মানুষ যখনই তার বিবেকের আলোকে হারিয়ে ফেলে তখনই জড়িয়ে পড়ে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির সঙ্গে। এই স্বার্থ হাসিলের জন্য শুরু করে প্রযুক্তির অপব্যবহার।
দর্শনশাস্ত্রের মহান মনীষা মহাত্মা প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবে নিযুক্ত/নির্বাচন করেছেন দার্শনিক রাজা। একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি মুহূর্তের মধ্যে গোটা ভবিষ্যতকে দেখতে পারেন। মানুষ যখন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিকে অবজ্ঞা করে অন্ধ ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসায় তখনই প্রদীপের আলো নিবে যায়। শুরু হয় অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, যতসব গণ্ডগোল। বলা চলে অন্ধের হাতে মশাল যত না আলো দেয় তার ছেয়ে ঘর পোঁড়ায় বেশি। যুদিষ্ঠির হাতে মশাল থাকলেই পৃথিবী আলোয় উদ্ভাসিত হবে।
রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে যে সংঘর্ষ চলছে তার আসল কারণ জানতে হলে আমাদের সোভিয়েত আমলের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মধ্যদিয়ে বামপন্থি সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শীরা দ্বিতীয় জার নিকোলাসকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে এক বলশেভিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ১৯২১ সালে লেনিন রেড আর্মি নিধনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। ১৯২২ সালের এক চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান ভ্লাদিমির লেলিন সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন করেন। ১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি চুক্তি সম্পন্ন হয়। রাশিয়া, বেলারোশ, ইউক্রেন, কাকেশাসীয় অঞ্চলের ইউনিট বর্তমান জার্জিয়া, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান মিলে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ১৯৪০ সাল নাগাদ সোভিয়েত ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা ১৫-এর কোটায় গিয়ে পৌঁছায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের মূলনীতির একনীতি হল, মার্ক্সবাদ একটি বাউন্ডারি বিহীন দেশ গঠনের স্বপ্নে বিভোর ছিল। বিশ্ব শ্রমিকের অধিকার সম্মিলনে ছিল সদা ব্যাপক। পরবর্তীসময়ে ১৯৯১ সালে আগস্টে তিন দিন দুনিয়া কাঁপানো এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গরভাচেব-এর ক্ষমতাকে ইয়ালতাসির চ্যালেঞ্জ করে বসে। গরভাচেব ক্ষমতায় ছিলেন ঠিকই কিন্তু আগের সেই প্রতাপ ছিল না। ১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বর গরভচেব ক্ষমতা থেকে পদ ত্যাগ করেন। ১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর গঠিত হওয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন সাত দশকের বেশি সময়ের পর ১৯৯১ সালের ৩১ ডিসেম্বর তার অবসান ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার মধ্যদিয়ে ১৯৯১ সালে ইউক্রেন আবার একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিনত হয়।
তত্ত্বসূত্রে জানা যায়, ১৯৯৪ সালে উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোটেও (ন্যাটো) যোগদান করে ইউক্রেন। ২০১৩ সালে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে চুক্তি মুলতবি করে রাশিয়ার সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিলে দেশটিতে ইউরোময়দান নামক মিছিল-বিদ্রোহ শুরু হয়। এর জের ধরে মর্যাদারক্ষার বিপ্লব নামক একটি বিপ্লবের মাধ্যমে ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতাচ্যুত করে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে রাশিয়া ক্রিমিয়া উপদ্বীপটিকে নিয়ন্ত্রনে নিয়েনেয়। ফলশ্রুতিতে ২০১৪ সালের এপ্রিল মাস থেকে রুশ সমর্থিত বিচিন্নতাবাদীরা ইউক্রেনের পূর্বভাগে দোনবাসের যুদ্ধ শুরু করে। ফলে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে।
রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে যে সংঘর্ষ চলছে তাকে কেন্দ্র করে সমগ্র বিশ্বে আজ আতঙ্ক বিরাজ করছে। কি জানি কি হয়! রাশিয়া তার মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছে মূলত ইউক্রেন যেন ন্যাটোতে যোগদান না করে। পুঁজিবাদী বিশ্ব চায় তার একচ্ছত্র নেতৃত্ব। পুঁজিবাদী দলগুলো চায় পুঁজিবাদের ধারায় সমগ্র বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে কিন্তু একদিকে রাশিয়া এবং অপর দিকে চীন। এই দুই দেশ এখন তাদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়াকে হাতে নিতে পারলেই কেল্লাফতে। চীন একা কিছুই করতে পারবে না। কার্ল মার্কস এবং ফেডরিক এঙ্গেলস-এর যৌথ রচিত গ্রন্থ “কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো”-এর প্রথম বচন “ইউরোপ ভ‚ত দেখেছে- কমিউনিজমের ভ‚ত। এ ভ‚ত ঝেড়ে ফেলার জন্য পবিত্র জোটের মধ্যে এসে ঢুকেছে সাবেকী ইউরোপের সকল শক্তি”। একদিকে রাশিয়া তার ঐতিহ্যকে ধরে রাখাতে বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করছে। অপর দিকে বিরোধী শক্তি মারার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কে জানে কোথাকার জল কোন দিকে গড়ায়।
যাই হোক না কেন হত্যাযজ্ঞ, সংঘর্ষ, বিশৃঙ্খলা এইসবের কোনো কিছুই পৃথিবীর স্থায়ীত্বকে দীর্ঘায়িত করতে পারবে না। বরং এই সব অমানবিক কাজ পৃথিবীর স্থায়ীত্বকে কমিয়ে আনবে। মানুষের বসবাসের জন্যই এই পৃথিবী। এই পৃথিবীকে সুন্দর রাখার দায়িত্বও মানুষের। কিন্তু মানুষ যখন তার দায়িত্ব জ্ঞানের কথা ভুলে যায় তখনই স্বার্থের জালে বন্দি হয়। ব্যক্তিগত স্বার্থ, পারিবারিক স্বার্থ, সামাজিক স্বার্থ, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ এই সকল স্বার্থ মানুষের বিবেকের আলোকে নিবিয়ে দেয়। বিবেকের আলো নিবে গেলেই মানুষ অধপতিত হয়। অধপতিত হলেই এ কথা সে ভুলে যায় মানুষ মানুষের জন্য।
মহামতি সক্রেটিসের অমর বাণী, “নিজেকে জানো”। বস্তুবাদের প্রভাবে সক্রেটিসের নিজেকে জানার শিক্ষা আজ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত প্রায়। আঙ্গুলে গুণা যে কয়জন এই শিক্ষার চর্চা এবং প্রচার করছেন তাঁরা সকলেই আজ অবহেলিত, লাঞ্জিত, অপমানিত। বর্তমান বিশ্বে শিক্ষার পরিমাণগত দিক অনেক বেড়েছে। আধুনিকায়নের ফলে বিজ্ঞানের নতুন নতুন প্রযুক্তি পৃথিবীকে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মানবিক দিক দিয়ে মানুষ নুয়ে পড়ছে। সক্রেটিসের মতে শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে “নিজেকে জানা”-এই মৌলিক শিক্ষার ব্রত গ্রহন করে তা চর্চা করলেই উপলব্ধি করা যায় স্থান-কাল পাত্রভেদে সকল মানুষই এক।
ফ্রাঞ্জ ফাঁনোর দোহাই দিয়ে বলা যায়, আমার সামনে যে মানুষটি দাঁড়িয়ে আছে তাকে কি আমি মানুষ হিসেবে চিনতে পেরেছি? যদি তাকে আমি মানুষ হিসেবে চিনতে পারি তাহলে আমি উপলব্ধি করতে পারব জগতের সকলেই আমার ভাই। যখনই আমার সামনের মানুষটিকে অন্য প্রজাতির মনে করব তখনই আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে। আমার এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ফলে চিন্তার আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। এই পরিবর্তনের ফলে “নিজেকে জানো” এই কথার বদলে “নিজের স্বার্থকে আগে দেখো” এই বচন সামনে এসে দাঁড়ায়। স্বার্থ থেকেই শুরু হয় দ্বন্ধ। দ্বন্ধ থেকে হত্যাযজ্ঞ আরও নানান কিছু ঘটে যায় পৃথিবীতে। এই সকল অঘটন ঘটে আমাদের অন্তর্দৃষ্টি না থাকার কারণে।
এই পর্যায়ে ইতালির বুদ্ধিজীবী আন্তেনিও গ্রামসির কথা বললে বোধ হয় বেশি বলা হবে না। গ্রমসি বলছেন, সকলেই হয়তো দার্শনিক নয় কিন্তু কোনো মানুষ দার্শনিক নয় এ কথা বলা যাবে না। এই কথার মর্মার্থ বুঝা খুবই সহজ আবার খুবই কঠিন। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই দার্শনিক হওয়ার গুন তথা অন্তর্দৃষ্টি বিদ্যমান রয়েছে কেবলমাত্র দৃষ্টির আলো ফিরিয়ে আনায় হচ্ছে দর্শন চর্চা। অন্তর্দৃষ্টির আলোতে যখন সবকিছুকে দেখতে পারা যায় তখনই আপনার বাহিরে কোন কিছুকে মনে হয় না। হিংসা, কাম, ক্রোধ, লোভ, লালসা, মদ, মাৎসর্য এগুলো আমাদের অন্তর্দৃষ্টির আলোকে ঢেকে রাখে। মেঘ যেমন সূর্যকে ঢেকে রাখে।
ষোড়শ শতকে কোপার্নিকাস মহাবিশ্বে মানুষের ভূ-কেন্দ্রক অবস্থান সম্পর্কিত মানুষের আত্মম্ভরি ধারণার অবসান ঘটালেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে চার্লস ডারউইন পৃথিবীর মানবজাতির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ প্রসঙ্গে মানুষের স্বর্গীয়-সৃজন এই কুপমুণ্ডকতা উড়িয়ে দিয়ে প্রজ্ঞার আলো জ্বালিয়ে সত্যকে আমাদের সামনে উদ্ভাসিত করেছেন। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা বিচার করলেই আর বিরোধ সৃষ্টি হয় না। খালি চোখে যাকে সমস্যা মনে হয় স্পিনোজার মতো অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তাকে দেখলে তার সমাধান অতি সহজেই করা যায়।
রাশিয়া এবং ইউক্রেন যুদ্ধে কার লাভ কার ক্ষতি এর হিসাব করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার কথা হচ্ছে মানব হত্যা মোটেও ভালো কাজ নয়। আধুনিক যুগে সবকিছুই উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মানবীয় গুণের অবক্ষয়ের ফলে মানুষ দিন দিন যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। তাই তো যাযাবর বলেছিলেন, “বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ”। মানুষ মানবীয় অনুভ‚তি উপলব্ধি করতে পারেনা বিধায় যখন তখন বিশ্বযুদ্ধের ঘোষণা দেওয়ার হুমকি দেয়। বস্তুবাদের দিকে ঝুকে পড়ার কারণে এই সকল অমানবিক কাজ আমাদের জীবনকে ধ্বংসের সম্মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বিজ্ঞানের কল্যাণে পৃথিবী অনেক দূর এগিয়ে গেছে এ কথা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু এই বিজ্ঞানকে মানুষের অকল্যাণে ব্যবহার করার কোন দার্শদিক যুক্তিও নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হিরোশিমায় এবং নাগাসাকি শহরে পরমাণু বোমা ফেলেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এখনও জাপানের সেই শহরগুলোর আশপাশে বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম গ্রহন করছে। এর থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় পরমাণু বোমার তেজস্ক্রিয়তা এখনও পৃথিবী থেকে শেষ হয়নি। আবার যদি বড় ধরনের কোন কিছু ঘটে তাহলে পৃথিবী মানব বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাবে। দীর্ঘদিন দর্শন থেকে বিজ্ঞানকে আলাদা করে রাখার ফলে যে নৈতিক সংকট এবং দর্শনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা আজ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বিশ্বের সকল চিন্তকদের এক হয়ে দর্শন চর্চায় মনোনিবেশ করা এবং জগৎ ও জীবরে মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে সকলকে অবহিত করা দরকার।