‘মুজিব বাইয়া যাও রে/ নির্যাতিত দেশের মাঝে জনগণের নাও রে—’। এটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাঙালি জাতির ইতিহাসের মহানায়ক ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে গাওয়া একটি কালজয়ী লোকগান। দরদমাখা এ গানের কথা ও সুর সে-সময় মুক্তিকামী মানুষকে দেশাত্ববোধের চেতনায় কতখানি উজ্জীবিত করেছিল- তা মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষকারী প্রত্যেকে জানেন। আজকের দিনে, অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও গানটির প্রাসঙ্গিকতা বিন্দুমাত্র কমেনি। একাত্তরের ওই উত্তাল সময়ে এমন আরও অনেক গান রচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। বিশেষ করে স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত অসংখ্য গান, কবিতা ও কথিকার বিষয়বস্তু ছিল বঙ্গবন্ধু। বলা বাহুল্য, স্বাধীনতা অর্জনের ৪৯ বছর পরও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সাহিত্য রচনার সেই ধারাটি জোরালোভাবে অব্যাহত। তাঁকে নিয়ে যত কবিতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, নাটক, গল্প-উপন্যাস ও গান রচনা হয়েছে এবং হচ্ছে- পৃথিবীর আর কোনো রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে ততটা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। একেকজন একেকভাবে উপস্থাপন করছেন বাঙালি জাতির এই অবিসংবাদিত নেতাকে। বিভিন্নধর্মী লেখায় তারা তুলে ধরছেন তাঁর অতুলনীয় দেশপ্রেম, ত্যাগের মহিমা এবং অসাধারণ নেতৃত্বের কথা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, লেখার বিষয়বস্তু স্বাধীনতা-চিন্তা হলেও ক্রমে তা বিবর্তিত হয়ে সঙ্গত কারণেই মুজিব বন্দনায় রূপ নিচ্ছে।
বাংলা লোকগানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে বাউলগান। বাউলরা সাধারণত আধ্মাত্মিক বিষয় নিয়ে মগ্ন থাকেন। জাগতিক বিষয়গুলোকে তারা কিছুটা ভিন্নভাবে অবলোকন করেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি রহস্য, ধর্ম-অধর্ম, ইহজগত-পরজগত, মানব জীবনের অর্থ-নিরর্থ প্রভৃতিই তাদের ভাবনার মূল বিষয়। কিন্তু এ-রকম ব্যতিক্রম ভাবনায় মগ্ন লোককবিদের নিজস্ব সাধনপদ্ধতি এবং আচারিক রীতির ওপরেও প্রভাব ফেলতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। অন্যদিকে আর দশজন সাধারণ বাঙালির মতো বাউলরাও তাঁকে ভেবে নিয়েছিলেন বাঙালি জাতির একমাত্র ‘মুক্তির দূত’ হিসেবে। ১৯০০ সালে জন্ম নেয়া বাউল ভবাপাগলার (১৯০০-১৯৮৪) একটি গানের অংশবিশেষ পড়লেই বিষয়টি খোলাসা হয়ে যাবে। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী বাংলার মানুষের দুঃখ-দুর্দশার বর্ণনা দিয়ে বিশ্বকাণ্ডারীর কাছে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারী শেখ মুজিবের জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করে ভবা লিখেছেন, ‘—ভবা পাগলার অভিমান/ আর কেন দেরি, শোনো হে কাণ্ডারী/ মুজিব রে হও অধিষ্ঠান/ সুসন্তান তোমার নিয়েছে এ ভার/ আজ ধরিতে বাংলার হাল \’ ভবাপাগলার মতো প্রাচীন বাউল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান লিখেছেন- এ এক বিরাট বিষ্ময়।
ভবার মতো আরেক বড় সাধকের নাম মহিন শাহ (১৯০৩-১৯৯৬)। লালন-দুদ্দু শাহ ঘরানার এ বাউলসাধকও স্বাধীনতার নেপথ্য ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে টেনে এনেছেন দেশবিভাগ, ভাষা আন্দোলন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন ও শোষণের মর্মন্তুদ ইতিহাস এবং এসব বলার পর শেষ স্তবকে অনিবার্যভাবে উপস্থাপন করেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে। মহিন শাহ লিখেছেন, ‘…একাত্তরে মুজিবের নৌকার হলো জয়/ রুটিখোরেরা দেখল ভারি বিপর্যয়-মরি হায় রে হায়/ দিল ইয়াহিয়া সৈন্য পাঠাইয়া গো/ মার বাঙালি কেউরে ছাড়বে না \/ রাজাকার আর আলবদরের দল/ হলো তারা দল ছেড়ে বেদল-মরি হায় রে হায়/ সাজিয়া পাকিস্তানের পোষা কুত্তা গো/ দেশবাসীকে দিল কতই-না যাতনা \’
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঐতিহাসিক ছয়দফা, এগারো দফা, সত্তরের নির্বাচন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান, স্বাধীনতা-সংগ্রাম এমন নানা প্রেক্ষাপট নিয়ে সহজ-সরল ভাষায় লেখা বাউলদের গানগুলো পড়লে বা শুনলে বর্তমান প্রজন্মের যে কারও কাছে মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেইসব দিনের ইতিহাস। বলাবাহুল্য, স্বশিক্ষিত বাউলরা এসব গান শুধু দর্শক-শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে রচনা করেননি, গানের মধ্য দিয়ে তারা প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামকে যেমন সমর্থন জুগিয়েছেন- অন্যদিকে সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রেও পালন করেছেন অগ্রণী ভূমিকা। সচেতন করেছেন স্বাধিকার সম্পর্কে। ছয়দফা ও এগারো দফা নিয়ে আবদুল মজিদ তালুকদারের (১৮৯৮-১৯৮৮) একটি গান: ‘রঙ্গিন কাষ্ঠের রঙ্গিন নাও/ রঙ্গিন নায়ে ছইয়া/ বঙ্গবন্ধু হাল ধইর্যাছে/ নায়ের পাছায় বইয়া রে \/ ছয় দফারই নৌকাখানি/ এগারো দফা বইঠা/ গরিব-দুঃখী লইয়া নাও/ শূন্যে মারছে উড়া রে \/ ভয় করি না আসুক যত/ তুফান কিংবা ঝড়/ নায়ের পাছায় বইসা আছে/ নেতা শেখ মুজিবুর রে \’
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু যখন স্বপ্নের সোনাবাংলা গড়ার কাজে মনোনিবেশ করেন তখন সে বিষয়টি নিয়েও গান লিখেছেন একাধিক বাউল। দুর্বিন শাহর (১৯২০-১৯৭৭) এমনই একটি গান: ‘বাংলা হলো হলো রে স্বাধীন পুরল মনোসাধ/ বিশে^ এলো নতুন বাণী নতুন মুজিববাদ \/ রক্ত দিলাম স্বাধীন পাইলাম দায়িত্ব রয় সম্মুখে/ সোনার বাংলা গড়ব মোরা বাসনা রাখি বুকেতে/ দুদিন পরে দেখব চউখে হইয়াছি আজাদ \’
এটি আজ হয়তো অনেকে জানেন, জনপ্রিয় বাউল শাহ আব্দুল করিম (১৯১৬-২০০৯) একনিষ্ঠ মুজিবভক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর একান্ত সান্নিধ্যও পেয়েছিলেন একুশে পদকে ভ‚ষিত এ বাউলসাধক। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি গান বেঁধেছেন এটিও এখন অনেকের জানা বিষয়। তার এমন একটি গান: ‘শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু সবাই কয়/ বন্ধু ছিলেন সত্য বটে/ আসলে শত্রæ নয় \/ —-/ শুনি জ্ঞানী-গুণীর কথা/ শ্রেষ্ঠ হয় মানবতা/ শেখ মুজিব জাতির পিতা/ করিম বলে নাই সংশয় \’ খুব প্রাঞ্জল শব্দে লেখা গানটির শেষ দুই চরণ অনেক অর্থবহ ও ক্ষুরধার। বঙ্গবন্ধুকে যারা ‘জাতির পিতা’ মানতে নারাজÑ সেই পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে দিয়েছেনÑ ‘শেখ মুজিব জাতির পিতা/ করিম বলে নাই সংশয় \’
পঁচাত্তরের ঘৃণ্য-জঘন্য হত্যাকারীরা না বুঝলেও অজপাড়াগাঁয়ের বাউলকবিরা সেদিন ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, জাতির পিতার নাম এ দেশের ইতিহাস থেকে কখনও মুছবার নয়। গানের ভাষায়ই তারা নির্মম সে হত্যাকাÐের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। করেছেন রোদন। সহজিয়া গান ও সুরের অটুট বন্ধনে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন ‘জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব আরও অনেক বেশি শক্তিশালী।’ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাউল আবেদ আলীর (১৯২১-১৯৯৯) লেখা একটি গানের অংশবিশেষ: ‘কে বলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু গিয়াছে মরে/ জিন্দা আছে শেখ মুজিবুর জনগণের হৃদয় জুড়ে \/ শেখ মুজিবুর জাতির পিতা/ এনে দিল স্বাধীনতা/ পাইয়াছে কত ব্যথা, স্মরণ হইলে নয়ন ঝরে \/ আয় তোরা কে কে যাবি/ নিজের চোখে দেখতে পাবি/ জাতির পিতার উজ্জ্বল ছবি/ বাংলাদেশের ঘরে ঘরে \’
এ তো গেল প্রাচীন বাউলদের কথা। বর্তমানকালের বাউলরাও ধরে রেখেছেন পূর্বসূরিদের সেই ধারাবাহিকতা। তাদের গানেও আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শন পাই। তাদের একতারা বা বেহালার তারেও অবিরাম বেজে চলে বঙ্গবন্ধুর জয়গান। বিভিন্ন সময়ের নির্লজ্জ ইতিহাস বিকৃতি, শত বাধা-বিপত্তি এবং উপেক্ষার পরও এ প্রজন্মের বাউলরা ঠিকই মূল্যায়ন করছেন বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের মহিমাকেÑ এটি আজ আমাদের আশা জাগায়। তরুণ বাউল-গীতিকার আবুল বাসার তালুকদারের(১৯৭২) লেখা গানের অংশ: ‘কে বলেছে/ বঙ্গবন্ধু নাই/ বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে/ তারে দেখিতে পাই \/ লাল সবুজের পতাকাতে/ শেখ মুজিবুর আছে তাতে/ দেখি আমি দিনে রাতে/ সদায় সর্বদায় \’ মুক্তিযুদ্ধ এবং পঁচাত্তরের পরবর্তী প্রেক্ষপট নিয়ে এমন আরও অনেক গান লেখা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে।
বলা দরকার, একাত্তরে এদেশেরই কিছু কুলাঙ্গার নানা কারণে বা প্রলোভনে মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতা করে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, ওই নিমকহারামদের দলে একজনও বাউলকবি নেই। বাউলরা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গান লিখেছেন এবং গেয়েছেন। গান গাইতে গাইতে সঙ্গত কারণেই করেছেন মুজিববন্দনা। এ-সবের মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত করেছেন মানুষকে। তাদের এই সচেতন রাজনীতি-জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ সত্যি আমাদের অবাক করে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, গ্রামীণ পরিমন্ডলে এসব গানের ব্যাপক আবেদন থাকলেও যথাযথ প্রচার-প্রচারণার অভাবে বোদ্ধা সারস্বত সমাজে বাউলদের গানগুলো তেমন পরিচিতি পায়নি। আবার সংগ্রহ বা সংরক্ষণের অভাবে অনেক গান এবং গানের সুর আজ হারিয়েও গেছে। এ ব্যর্থতা আমাদেরই। আমরা বাউলকবিদের এ গানগুলো সংগঠিতভাবে নতুন প্রজন্মের সামনে খুব একটা তুলে ধরতে পারছি না। কাজেই ইতিহাস-আশ্রিত সুর-বাণীর এই বিশাল ভান্ডারটিকে সেচে আনা আজ অতি জরুরী। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনগুলো এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারে। বিশেষ করে মুজিবর্ষকে সামনে রেখে বাংলা একাডেমি বা শিল্পকলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আমরা এ দায়িত্ব অর্পণ করতেই পারি। এটি যে কত বড় একটি কাজ হবে তা কাজটিতে হাত দিলেই অনুমান করা যাবে। এছাড়া হালের স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও এগিয়ে আসতে পারে। তারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে লেখা গানগুলো পরিবেশনে উৎসাহিত করতে পারে নতুন শিল্পীদের।