নাম তার ছিল জন হেনরী
ছিল যেন জীবন্ত ইঞ্জিন
হাতুড়ির তালে তালে গান গেয়ে শিল্পী
খুশিমনে কাজ করে রাত দিন
হেমাঙ্গ বিশ্বাস অনূদিত এই গণসঙ্গীত যেন মে দিবসের আখ্যান। মে দিবসের অনুষ্ঠান গাইতাম এককালে। ১লা মের সকালে একটি সাজানো ট্রাক এসে দাঁড়াতো উদীচী অফিসের সামনে। পুরো শহরের যানশ্রমিকরা সেদিন চাকা ঘুরাবেনা, তাই পথঘাট শুনশান। ট্রাকে উঠার জন্য একটি চেয়ার রাখা হতো। আমরা চেয়ারে উঠে দাঁড়ালে অগ্রজরা আমাদের হাত ধরে সেই ট্রাকে উঠিয়ে দিত। সকলে জায়গা নিয়ে বসতাম। ট্রাকটি ধীরে ধীরে নেত্রকোনাজুড়ে ঘুরে বেড়াতো।
ট্রাকের পিছনে মাথায় লাল ফিতা বাঁধা শ্রমিকদের ঢল ছুটতো। আমরা একের পর এক গাইতাম ১৮৮৬’র পহেলা মে শিকাগোর হে মার্কেটে, শ্রমিকের তাজা খুনে ভেসে গেল খোলা রাজপথ, প্রথম শহীদ হলো মজুর।/হেই সামালো ধানহো, কাস্তেটা দাও শানহো….আর দেবো না, আর দেবো না রক্তে বুনা ধান মোদের প্রাণ হো/ নাম তার ছিল জন হেনরী আরো/ মারো জোয়ান হেঁইয়ো, মারো কষে টান আরো কত গান। মাথার উপর মে’র সূর্যটা রেখে তিরতির করে ট্রাকটা প্রদক্ষিণ করতো শহর। দুপুরের বাসস্ট্যাশনে বিকেলের আয়োজন। আমি গানের শিল্পী নই কিন্তু গণসঙ্গীত আমরা গাইতেই পারতাম। গণসঙ্গীত তো শুধু গান নয়, গণসঙ্গীত প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিবাদের আগুন। একটু আগে গানগুলো আপনমনে গাইতে গাইতে মনে হলো, কেন পহেলা মে নিয়ে দুকথা কইবো না!
পহেলা মে সরকারি ছুটি। ছুটি পেয়ে তাকধিনাধিন মনে বাড়ি ফিরি। কিন্তু সময়ের ভয়ালস্রোতে আজকাল অনেকেই জানে না এর ইতিহাস। বিকেলে গিয়েছিলাম রবীন্দ্র সরোবরে, রিক্সাটি টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন এক বৃদ্ধ বাবা। বয়স কম করে হলেও আশি। তাকে দিবসের কথা জিজ্ঞাসা করলে সে কেবল জমার টাকা না হওয়ার কষ্টেই দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল। মালাই চা নিয়ে যে ছেলেটি ছুটে এসেছিল তার বয়স উনিশ কি বিশ। ফুল বিক্রি করা বোনটি কোলের শিশুকে মাই দিতে দিতে ক্রেতার অপেক্ষায় ছিল- এঁরা জানে আজ শ্রমিক দিবস কিন্তু তাদের খেতে হবে তাই দিবস তাদের চমকিত করে না। বরং মানুষ না বেরুলে মহাবিপদ। কিছুটা দূরে তিনজন নবীন বসে গিটারে গান গাইছিল। কাছে গিয়ে বললাম কি সুন্দর গাও। তোমরা কি মে দিবসের একটা গান শুনাবে। মেয়েটি মে ডে’র এর একটা ইংলিশ গান বলে জানতে চাইলো এটি কিনা। ছেলেটি বিষয়বস্তু বুঝতে পেরে বললো, দিবসের গান তো জানীনা একটা শায়নের গান গাই। আমি শুনলাম বসে। আসার আগে দুটো গানের কয়েকলাইন গেয়ে বলে আসলাম গুগলে সার্চ দিলেই পাওয়া যাবে। তোমরা শিখে নিও। ওরা আনন্দই প্রকাশ করলো। মনে মনে বকলো কিনা জানীনা।
যেকথা বলছিলাম, ট্রাকের সেই নগর ভ্রমণের সময়ে আমার এই দিনের ইতিহাস নিয়ে এত আগ্রহ ছিলনা। কেবল ‘জন হেনরী কচিফুল মেয়েটি, পাথরের বুকে যেন ঝর্না, মার কোল থেকে সে পথ চেয়ে আছে, বাবা তার আসবেনা, আসবেনা—হো হো হো” এই কথাগুলোতে বুক গুড়িয়ে যেত। বড় হলাম ধীরে ধীরে ১লা মে’র ছুটি, আটঘন্টা কাজের অধিকারে লড়িয়েদের লুটিয়ে পড়ার ইতিহাস জানলাম।
সামান্য মজুরির বিনিময়ে ১২-১৪ ঘন্টা শ্রম, সাদা সর্দারের অকথ্য নির্যাতনের বিরুদ্ধে ১৮৬০ সালে আমেরিকার শ্রমিকরা দাবী তুলে। তাদের স্লোগান ছিল ৮ঘন্টা কাজ, ৮ ঘন্টা বিশ্রাম, ৮ ঘন্টার অবসর বিনোদন। সুতরাং মজুরি ঠিক রেখে কর্মঘন্টা ৮ করার জন্য এই দাবীর কন্ঠস্বর মিলিত ভাবে সংগঠন তৈরি করে। পরবর্তীকালে আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার নামে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে স্বোচ্চার হয়। পর্যায়ক্রমে ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের ৮ ঘন্টা কাজের দাবীতে আওয়াজ তুলে একদল শ্রমিক। দাবী বাস্তবায়নে সময়সীমা বেঁধে দেয় ১৮৮৬’র পহেলা মে।
সময় গড়ায়। মালিকপক্ষ সাড়া দেয় না। ঐসময় আন্দোলনের পক্ষে একাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় যা আন্দোলনকে বেগবান করে। ১৮৮৬’র পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ শ্রমিক কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে আসে । শ্রমিক বিদ্রোহ তুঙ্গে উঠে। ৩ মে পুলিশের আক্রমনে কয়েকজন শ্রমিক আহত ও নিহত হয়। এর প্রতিবাদে ৪ মে তারিখে শিকাগোর হে মার্কেটে মিছিলের জন্য জড়ো হয় সবাই। শ্রমিকনেতা অগাস্ট স্পীজ সকলের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখার সময় একটি বোমা বিস্ফোরিত হয় যেখানে একজন পুলিশ ঘটনাস্থলে মারা যায় ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। পুলিশ হিংস্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিদ্রোহীদের উপর। পুলিশের গুলিতে ১১ জন শ্রমিক মারা যায়, এই সংখ্যাকে বিশ্বাস করার কিছু নেই। কারণ, প্রকৃত মৃত শ্রমিকের সংখ্যা অপ্রকাশিত রয়ে গেছে বলে ধরে নেয়া হয়।
বোমাহামলার মিথ্যা মামলায় অগাস্ট স্পিজসহ আটজনকে আটক করা হয়। আটজনের মধ্যে মাইকেল সোয়াবকে যাবজ্জীবন ও অস্কার নেবেকে পনের বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বাকী ছয়জনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে স্যামুয়েল ফিল্ডেনের আবেদনের ভিত্তিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পায়। কারারুদ্ধ অবস্থায় লুইস লিং আত্মহত্যা করেন। বাকী চারজনকে ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়। এতসব আত্মত্যাগের পর আজ আমাদের কর্মঘন্টা ৮। এই আন্দোলনকে সম্মান জানাতেই মে’র এক তারিখ অন্যান্য অনেক দেশের মত বাংলাদেশে ছুটি।
কিন্তু এই ছুটি কিসের ছুটি? মে দিবস কেন? কি? কেবল মাত্র ছুটি, এর কৃত্তিত্ব কাদের সেই উত্তর কেউ নবযাত্রীদের কাছে রয়েছে কিনা? আবার প্রান্তজনের মে দিবসটিই বা কেমন? সময়ের সাথে সাথে শ্রমিকদের অধিকার পূরণের বিষয়সমূহকি বিস্তৃতি পায়নি? প্রান্তিকের মে দিবস, উচ্চ, মধ্য ও প্রান্তের শ্রমিকদের মে দিবস কি একই না ভিন্ন?
অফিস আদালতের বাইরে লক্ষ কোটি মানুষ শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। তাদের তো আটঘন্টা কাজ করলেই ভাত ডাল-মিলছে না। ছুটিতে তাদের পেট ভরে না। যারা অফিস আদালত, কল কারখানায় কাজে আছে তার মজুরী কি মিলে ঠিকঠাক? খাতাপত্রে আটঘন্টা কি বাস্তবের সাথে মিলে সবসময়? আজ কি সব শ্রমিকরা ছুটি পেল? আর, বাজারে আগুন জ্বলে দাউদাউ করে। এতকিছুর ভীড়ে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম সফল হলো?
অগাস্ট স্পিজের শেষ সেই উক্তি, The day will come when our silence more powerful than the voices you are throttling today. – কতদূর?
জয়শ্রী সরকার-নেত্রকোনা সাহিত্য সমাজসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠনেও তিনি সম্পৃক্তত। বহুবছর ধরে যুক্ত আছেন উদীচীর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে।
প্রকাশিত গ্রন্থ :
কাব্যগ্রন্থ : শূন্যাতা (২০০৬), ছোট গল্পগ্রন্থ: ফিরে আয় মাটির পুতুল (২০১৬ ), উদ্বাস্তুদের মিছিল গবেষণাগ্রন্থ: প্রান্তবাসী হরিজনদের কথা (২০১২), বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্রে সহকারী নারী অভিনয় শিল্পীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার তুলনামূলক চিত্র, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছর, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, তথ্য মন্ত্রণালয়।
উপন্যাস: অম্বা আখ্যান (২০১৫)।