উনিশ শতকের নবজাগরণের মধ্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটে। এই নবজাগরণের প্রধান চরিত্র বিদ্যাসাগর। বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী বিদ্যাসাগরের প্রধান পরিচয় তিনি রেনেসাঁস পুরুষ। ইহজাগতিকতা, যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতা, নতুন গদ্যরীতি, সমাজসংস্কার, নারী শিক্ষার প্রসার, পাঠ্যসূচি থেকে অলৌকিকতার বিলুপ্তি, চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং মানবমুখিনতার মতো বৈশিষ্ট্য যা ইউরোপীয় রেনেসাঁসকে তুলে ধরেছিল বিদ্যাসাগর তার জীবন্ত প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
অনুজ শম্ভুচন্দ্রকে প্রেরিত একটি চিঠিতে বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, ‘আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি।’ দেশাচারের নামে প্রচলিত অনাচার ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর ইহজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গির কল্যাণে। যে জগৎ জীবন ও মৃত্যুর সীমায় আবদ্ধ এবং যে জগৎ ইন্দ্রিয়গোচর ও যুক্তিগ্রাহ্য সেই জগৎকেন্দ্রিক মানবজীবনের সাধনাই ইহজাগতিকতা। পরকাল, আত্মা বা অতিপ্রাকৃত, অলৌকিক কোনো চিন্তা-ভাবনা ইহজাগতিকতার কাছে মূল্যহীন। মনুষ্যকেন্দ্রিক চিন্তা ভাবনা ও ধ্যানধারণাই ইহজাগতিকতার প্রধান লক্ষণ। এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্জিত হয়েছিল ইতালীয় রেনেসাঁসের আবির্ভাবের কারণে।
রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরকে অভিহিত করেছিলেন যথার্থ মানুষ হিসেবে। এই ‘মানুষ’ শব্দটির অর্থ নতুন এক ধরণের মানুষ যার তাৎপর্য বোঝা গিয়েছিল পঞ্চদশ শতাব্দীর রেনেসাঁসের সময়ে। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির ভাষায়- “প্রকৃতি জগত এবং বাস্তব জগতের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি জগতের নিয়ম দিয়ে, বিজ্ঞান দিয়ে বুঝতে হবে এই ‘মানুষ’কে । ফুটিয়ে তুলতে হবে, ‘মানুষ’-এই বাস্তবটিকে -ফুলের মতো করে তার সমস্ত দিক পরিব্যাপ্ত করে।” রেনেসাঁসের এটিই প্রথম প্রকাশ যার মূল প্রত্যয় ছিল মানুষকে ‘মানুষ’ করে তোলা। সভ্যতার অগ্রযাত্রায় ইতিহাসের একটি বিশেষ স্তরে পৌঁছে নতুন যুগের আদর্শ হিসেবে রেনেসাঁসের উদ্ভব ঘটে যা অলৌকিক ও দৈবের হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করে তাকে ‘মানুষ’ করে তুলেছিল।
রবীন্দ্রনাথের মতে বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। বাংলা গদ্যের জনক বিদ্যাসাগর সম্পর্কে সুকুমার সেনের মন্তব্য যথার্থ-‘তিনি প্রচলিত ফোর্ট-উইলিয়মি পাঠ্যপুস্তকের বিভাষা, রামমোহন রায়ের পণ্ডিতি ভাষা এবং সমসাময়িক সংবাদপত্রের অপভাষা কোনটিকেই একান্তভাবে অবলম্বন না করিয়া তাহা হইতে যথাযোগ্য গ্রহণবর্জন করিয়া সাহিত্যযোগ্য লালিত্যময় সুডৌল যে গদ্যরীতি চালাইয়া দিলেন তাহা সাহিত্যের ও সংসারকার্যের সব রকম প্রয়োজন মিটাইতে সমর্থ হইল।’ পরবর্তীকালে বাংলা গদ্যের যে সুরম্য অট্টালিকা তৈরি হয়েছে এর ভিত্তি স্থাপন করেছেন বিদ্যাসাগরই। প্রবন্ধ, অনুবাদ, মৌলিক রচনার লেখক হিসেবে অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী বিদ্যাসাগরের অন্যতম অবদান অসাধারণ শিশুপাঠ্য গ্রন্থ প্রণয়ন। তাঁর ‘বর্ণপরিচয়’, ‘বোধোদয়’ ও বিভিন্ন বিজ্ঞানী মনীষীর জীবনীগ্রন্থ শিশুদের মনে নীতিবোধ ও বিজ্ঞানমনস্কতার বীজ রোপণ করেছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও প্রাচ্যশিক্ষার মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন তিনি। তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণেই ইংরেজি ভাষা আয়ত্তের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পথ সুগম হয়।
তৎকালীন পশ্চাৎপদ সমাজের অন্ধকারকে ভেদ করে তিনি নারীশিক্ষার প্রসারে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। একই বছরে মেয়েদের জন্য ৩৫টি বিদ্যালয় খুলেছেন। বহুবছর আগেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন নারীকে অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত রেখে সমাজ অগ্রসর হতে পারবে না। তাঁর পূর্বসূরী রামমোহন রায় ‘সতীদাহ প্রথা’ রদ করে নারীর জীবন রক্ষা করেছিলেন। বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রবর্তন করে নারীকে জীবন্মৃত অবস্থা থেকে রক্ষা করেছিলেন। বহুবিবাহ বন্ধের আন্দোলন করেছিলেন। বিধবাবিবাহকে তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ বলে মনে করতেন। কাজটি মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিলনা।
বিধবাবিবাহকে আইনসঙ্গত করার জন্য ১৮৫৫ সালে যে আবেদনপত্র দাখিল করা হয়েছিল তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন ৯৮৭ জন ব্যক্তি। সর্বশেষ স্বাক্ষরটি ছিল স্বয়ং বিদ্যাসাগরের। আর এই আবেদনের বিরোধিতাকারী পাল্টা আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন প্রায় ৩৬,০০০ ব্যক্তি। বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে এই অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাধাকান্ত দেব। দুই আবেদনের সমর্থকদের সংখ্যার বিশাল তারতম্য দেখে সেই সময়ের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ চিত্র পাওয়া যায়। বোঝা যায় কী প্রতিকূল পরিস্থিতিকে ডিঙ্গিয়ে বিদ্যাসাগরকে অগ্রসর হতে হয়েছিল। শুধু বিধবাবিবাহ নয়, জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে বিদ্যাসাগরকে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়। সংখ্যায় কম হলেও কিছু সহযোগীও তিনি পেয়েছিলেন।
উনিশ শতকীয় নবজাগরণের অন্যতম স্তম্ভ ইয়ংবেঙ্গল। ধূমকেতুর মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী শিক্ষক ডিরোজি একদল যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনষ্ক ছাত্র তৈরি করেছিলেন যারা প্রচলিত বিশ্বাস ও সংস্কারকে টলিয়ে দেওয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। ‘ইয়ংবেঙ্গল’ নামে পরিচিত এই যুবকরা ছিলেন বিদ্যাসাগরের অন্যতম ভরসাস্থল। দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ সিকদার, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, হরচন্দ্র ঘোষ, শিবচন্দ্র দেব, রামতনু লাহিড়ীর মত ইয়ংবেঙ্গলরা বিধবাবিবাহ আন্দোলন ও নারীশিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগরকে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন। উগ্র পাশ্চাত্য আধুনিকতার কারণে সমাজ তাঁদেরকে গ্রহণ করতে চায়নি। ধনী সমাজপতিদের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া প্রাচীন পণ্ডিত সমাজের মোকাবিলা করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। বিদ্যাসাগরের মতো বটবৃক্ষ তুল্য ব্যক্তিত্বের আশ্রয়ে ইয়ংবেঙ্গল জ¦লে উঠেছিল। রাজা জমিদারদের কাছে, সরকারি প্রশাসনের কাছে বিদ্যাসাগর ছিলেন সমীহ জাগানিয়া ব্যক্তিত্ব। অকাট্য যুক্তি ও শাস্ত্রীয় পাণ্ডিত্য দিয়ে তিনি নির্বাক করে দিয়েছিলেন গোঁড়া ও যুক্তিবিমুখ পণ্ডিতদেরকে। ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রথম বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। এই বিয়ে আয়োজনে ইয়ংবেঙ্গলরা মুখ্যভূমিকা পালন করেছিলেন।
কোনো প্রতিকূলতাই বিদ্যাসাগরকে তাঁর সংকল্প থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। যুক্তিকে অবলম্বন করে তিনি কুসংস্কার ও দেশাচারের দুর্গে আঘাত করেছেন। নিজে ব্রাহ্মণ ছিলেন, কিন্তু গোঁড়া ব্রাহ্মণদেরকে পরাস্ত করে ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সকলের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করেছিলেন। সংস্কৃতে অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল তাঁর, কিন্তু ইংরেজিকে শিক্ষা গ্রহণের বাহনে পরিণত করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের চরিত্র সম্পর্কে মাইকেলের মূল্যায়ন অবিস্মরণীয়-‘প্রাচীন ঋষিদের মতো প্রতিভা ও জ্ঞান, ইংরেজদের মতো প্রাণশক্তি আর বাঙালি মায়ের হৃদয়।’ মাইকেলই তাকে প্রথম বলেছিলেন ‘করুণাসাগর’ আর বলেছিলেন ÔFirst man among us.’
‘দয়ার সাগর’, ‘করুণার সাগর’ বিদ্যাসাগর তাঁর জীবনের সিংহভাগ ব্যয় করেছেন শিক্ষাবিস্তারে। নিজগ্রাম বীরসিংহে ১৮৫৩ সালে অবৈতনিক ও আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপন থেকে শুরু করে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত ৩৭ বছর ধরে তিনি একটি নর্মাল স্কুলসহ ২০টি মডেল বিদ্যালয়, ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় ও ১টি কলেজ স্থাপন করেছিলেন। আজকের শিক্ষাব্যবসায়ীরা হয়তো জানেননা বিদ্যাসাগরের এই প্রচেষ্টা ছিল শিক্ষাবিস্তারের লক্ষ্যে, বিত্ত অর্জনের জন্য নয়। ইতালীয় রেনেসাঁসের সাথে প্রায়ই বাংলার নবজাগরণের তুলনা করা হয়। ইতালীয় রেনেসাঁসের নায়কদেরকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে বিদ্যাসাগরের কীর্তি। তিনি ছিলেন পরাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। প্রখর আত্মমর্যাদা ও অসামান্য তেজস্বিতায়, বিপন্ন মানুষের দুর্দশা মোচনে, শিক্ষা বিস্তারে, নারী অধিকার রক্ষায় খাঁটি হিউম্যানিস্ট বিদ্যাসাগর ছিলেন অতুলনীয়। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছিলেন, ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব।’ সমাজসংস্কারে আধুনিকতার জাজ্জ্বল্যমান প্রতীক বিদ্যাসাগর ধর্মীয় অনাচার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ইহজাগতিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে। উপমহাদেশে ও বিশ্বের নানা স্থানে যখন সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তখন বিদ্যাসাগরের মানবকেন্দ্রিক ইহজাগতিকতাকে স্মরণ করা একান্ত জরুরি। শাস্ত্রের অন্ধবিরোধিতা নয়, শাস্ত্রের ভেতর থেকে যুক্তি আহরণ করে শাস্ত্র দিয়ে শাস্ত্র মোকাবেলা করার অব্যর্থ উপায় বিদ্যাসাগর আমাদেরকে দেখিয়েছেন।
রেনেসাঁসের যুগকে অভ্যর্থনা জানিয়ে এঙ্গেলস লিখেছিলেন, ‘আজ পর্যন্ত মানুষ যা দেখেছে তার মধ্যে এইটে সবচেয়ে প্রগতিশীল বিপ্লব, এ যুগের প্রয়োজন ছিল অসাধারণ মানুষের এবং তার সৃষ্টিও হয়েছিল যারা ছিলেন চিন্তাশক্তি, নিষ্ঠা, চরিত্র, সর্বজনীনতা এবং বিদ্যায় অসাধারণ।রেনেসাঁসে ব্যক্তি প্রতিভার বিস্ফোরণ দেখা দেয়। রেনেসাঁসে দেখা যায় ‘অনন্য মানুষ’বিদ্যাসাগর রেনেসাঁসের সেই ‘অনন্য মানুষ’। প্রকৃত অর্থেই তিনি নবজাগরণের অগ্রদূত। দ্বিশতজন্মবার্ষিকীতে বিদ্যাসাগরকে অন্তহীন শ্রদ্ধা
।
রাজীব সরকার-বিতার্কিক ও প্রাবন্ধিক।