ভূমিকে সৃষ্টিকর্তার দেওয়া পবিত্র উপাদান বলেই মানে আদিবাসীরা। এটি চিরায়ত জীবনের মৌলিক উপাদান, এটি রক্ষার দায়িত্ব মানুষের। আদিবাসীদের ভাবনায় ‘আমরা ভূমি থেকেই আসি এবং ভূমিতেই ফিরে যায়, ভূমি আছে বলেই বাতাস গতিময় আকাশ এত নীল, চন্দ্র-তারা সমুদ্র বালুকণা এত সুন্দর। গাছে ফুল হয়, পাখি- গান গায়। ভূমি আছে বলেই মানুষ স্বপ্ন দেখে জীবন হয় ছন্দময়। ভূমি আমাদের আমরাও ভূমির।’ এ হচ্ছে ভূমিকে নিয়ে আদিবাসীদের বিশ্বজনীন বিশ্বাস ও ভাবনা। আদিবাসীদের জীবনে ভূমিকে ঘিরেই সামগ্রিক জীবন চক্র আর্বতিত হয়। ভূমিই শেখর সংস্কৃতি, তাই ভূমি ভিত্তিক জীবনে রচিত হয়েছে নানা ইতিহাস, ঐতিহ্য, পৌরাণিক-গল্প, কিংবদন্তী রূপকথা, বিশ্বাস- মূল্যবোধ, লোকাচার, রীতি-রেওয়াজ, প্রথা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি। আদিবাসীরা ভূমিকে এবং প্রকৃতিকে নিয়ে শান্তির নীড় তুলে বাচাঁর স্বপ্নটুকুই দেখেছে প্রজন্মান্তরে। এখানেই আদিবাসী এবং অন্যান্য উন্নত জাতি সমাজের বিস্তর ব্যবধান লক্ষ করা যায়।
বিশ্বের ৭০টি দেশে প্রায় চল্লিশ কোটি আদিবাসীদের জীবন ধারণকে একটি বৈশিষ্টে সহজেই চেনা যায়। তা হল তারা ভূ-প্রকৃতির উপর বেশী নির্ভরশীল। এ জন্যে বিশ্বময় তাদেরকে প্রাকৃত সন্তান বলে জানে সবাই। অষ্ট্রেলিয়ার নর্দান টেরিটরি হয়ে ব্রাজিল, নেপাল, ভূটান, ভারত কিংবা বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল এবং ময়মনসিংহের গারো পাহাড় সবখানেই সব জায়গাতেই ভূ-প্রকৃতি, পাহাড় উপত্যকায় তাদের বসবাস বিশেষ ঐতিহ্য বহন করে। পৃথিবীর কোনো দেশেই ভূমিকে নিয়ে আন্তঃ সমাজে ঐতিহাসিক কোনো সংঘাত বা দ্বন্দ্ব-কলহ নেই। সকল আদিবাসীদের মধ্যেই একটি বিশ্বাস স্পষ্ট ভাবে প্রমাণ করে যে, ভূমিকে তারা বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে কখনও দেখেনি। এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভূমি দখলের চিন্তা তারা কখনও করেনি। তাদের সামাজিক প্রথা, নীতি, মূল্যবোধের চর্চার কারণেই কখনও ভূমি দখল ভাবতে পারে না তারা। ভূমি ভাগাভাগির সংস্কৃতি তাদের মধ্যে নেই। তাদের বিশ্বাস ভূমি থেকেই তারা এসেছে আবার ভূমিতেই চলে যাবে। এই মাটিকে এবং মাটির উপর গড়ে তোলা ঐশ্বর্য্যকে তারা কানাকড়িও সাথে নিয়ে যাবে না। ভূমি পৃথিবীর সাময়িক আশ্রয়স্থল মাত্র। তাই ভূমির উপর শান্তির সহবাস্থানের কথা ভেবেছে হাজার বছর ধরে। ভূমি কোনো ব্যক্তির একক উপাদান নয় বলেই মানে তারা। যা সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর সমুদয় মানব জাতিকে দিয়েছেন। সুতরাং আদিবাসীদের ভূমি ভাবনা ও বিশ্বাসে প্রকৃতিগত নিয়মেই ভূমির উপর সকল মানুষের অধিকার রয়েছে। আদিবাসী গবেষকগণ মনে করেন সভ্যতা বিকাশের সময় থেকে আদিবাসীরা যদি ভূমিকে ব্যক্তিগত মালিকানা সৃষ্টি করার চিন্তা করলে প্রতিজনে একেকটা রাজ্য সমান জায়গা নিতে পারত। কারণ সেই সব সময়ে পাহাড় উপতক্যায় আদিবাসী ছাড়া অন্য কোনো জনজাতির অস্থিত্ব ছিল না। বর্তমান বাস্তবতাই-ই তার প্রমাণ। বাংলাদেশে মোট ৪৫টি ছোট বড় আদিবাসী জন গোষ্ঠীর বাস স্মরনাতীতকাল থেকেই। বর্তমানে তাদের সংখ্যা প্রায় ৩০ লক্ষাধিক বলে জানা যায়। এদের মধ্যে গারো আদিবাসীদের সংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ। তাদেরও সামাজিকভাবে ভূমির উপর ব্যক্তি স্বত্ত¡ মালিকানার ইতিহাস নেই। ভূমি ব্যবহার এবং ব্যবস্থাপনায় সমঅধিকার এবং সুষম ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তাদের প্রথাগত ভূমি ব্যবস্থায় গ্রাম প্রধান (নক্মা) তা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এবং আখিং নক্মা গোষ্ঠীদের জন্যে অংশ ভাগ করে দেন এ অংশকে আজ (গোষ্ঠী ভিত্তিক সম্পদ) বলা হয়ে থাকে। পারিবারিক সম্পদ বা সম্পত্তির দায়িত্ব ক্ষমতা বলে গোষ্ঠীর পুরুষ প্রধানদের হাতে থাকে। এসব ব্যবস্থায় কোনো লোককে ভিটাহীন কিংবা সম্পদহীন থাকতে হয়নি। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি যদি অনত্র চলে যায় তবে তার সমুদয় সম্পত্তি ঐ গোষ্ঠীর হাতেই চলে যাবে। এবং কেউ যদি তার ব্যক্তিগত কোনো সম্পত্তি বিক্রি করে তো মুখের জবানেই সম্পন্ন হয়। কোনো কাগজি চুক্তি পত্রের প্রয়োজন হয় না। আদিবাসী সমাজে বিশ্বাসের এতটাই মূল্য বহন করে। আদিবাসী সমাজের সাথে বর্তমান উন্নত জাতিসমূহের এই বিশ্বাস ভঙ্গির মধ্যেই লক্ষ করা যায় বিস্তর ফারাক। এবং এই জায়গাতেই বর্তমানে সীমাহীন ক্ষতির শিকার হচ্ছে তারা (আদিবাসীরা)।
বাংলাদেশে সকল আদিবাসীদের সাথে অ-আদিবাসী এবং ভূমিচক্রের সাথে ভূমি বিরোধ দীর্ঘদিনের। রাষ্ট্রের আচরনও এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট নয়। রাষ্ট্রকে কখনও তাদের ভূমি বেহাত হওয়ার ক্ষেত্রে পৃষ্টপোষতা করতে দেখা গেছে। তবে আদিবাসীদের জন্যে জাতিসংঘ গত কয়েক দশকে আশার প্রদ্বীপ জ্বালিয়েছে। জাতিসংঘে এখন তাদের স্থায়ী দপ্তর রয়েছে। শুধু তাই নয় ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সাধারন পরিষদের ৬১তম অধিবেশনে ৪৬টি অনুচ্ছেদ সম্বলিত ‘‘আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’’ অনুমোদন করা হয়েছে।। এর ২৭নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র ‘‘সংশিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে যৌথভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আইন, ঐতিহ্য, প্রথা ও ভূমি মালিকানা ব্যবস্থাপনার যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান করে ঐতিহ্যগত ভাবে মালিকানাধীন কিংবা অন্যথায় দখলীয় বা ব্যবহার্য তাদের ভূমি, ভূ-খন্ড ও সম্পদের উপর গুরুত্ব প্রদান করে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার স্বীকৃতি দেওয়া ও নির্ণয় করার লক্ষ্যে একটি অবাধ, স্বাধীন, নিরপেক্ষ, উপযুক্ত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া প্রবর্তন ও বাস্তবায়ন করবে” বলা হয়েছে। ২৮নং অনুচ্ছেদের ১নং উপ অনুচ্ছেদে “তাদের হারিয়ে যাওয়া বা বেদখলকৃত জমি ফিরিয়ে দেওয়া এবং সাধিত ক্ষতির ক্ষতি পূরন দানে”র জন্যে রাষ্ট্রকে বলেছে। জাতি সংঘের ১০৭ (১৯৫৭) ও ১৬৯ (১৯৮৯) নং সাধারন অধিবেশনে আর্ন্তজাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) আদিবাসীদের জন্যে গুরুত্বপূর্ন সুপারিশ করেছে। এটাই বিশ্বের বঞ্চিত ৪০ কোটি আদিবাসীদের জন্যে অধিকারের বড় ভিত্তি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকার অংশের ২৭নং অনুচ্ছেদে ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী” বলা আছে। স¤প্রতি বাংলাদেশ সরকার আদিবাসীদের সংবিধানে স্বীকৃতি না দিলেও “ক্ষুদ্রজাতি গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০” নামে সংসদে আইন অনুমোদন করেছে। তবে সংবিধানের এই কথাগুলো আদিবাসীদের জীবনে প্রতিফলন লক্ষ করা যায়না। বাংলাদেশে তাদের সামাজিক প্রথাগত ব্যবস্থা, রীতি-নীতি, বিশ্বাস-মূল্যবোধকে রাষ্ট্রের সরকার কখনই সম্মানের চোখে দেখেনি। রাষ্ট্রে তাদের মূল্যায়ন করা হয়নি। বরঞ্চ ঐতিহাসিক ভাবে তারা বঞ্চনার শিকার হয়েছে। কাগজী জটিল প্রক্রিয়ায় ফেলে তাদের নীতি, প্রথা, বিশ্বাস এবং মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ঐতিহাসিক এবং স্থানীয়ভাবে তাদের ভূমি ভূ-খন্ড, পাহাড় পর্বতাঞ্চল হারানোর কথা বলতে গিয়েও লাভ হয়নি। আদিবাসীদের প্রকৃতিগত ভূমি অধিকারকে স্বীকার করা হয়নি। বরং স্মরনাতীতকাল ধরে তাদের বসবাসের ভূমিতে উডলট, রাবার বাগান, ইকোপার্ক, বিনোদন কেন্দ্র, চা বাগান ইত্যাদি নানা প্রকল্পের নামে উদচ্ছেদ অব্যাহত রেখেছে। এবং তাদের রের্কডীয় ভূমিকে শত্রুসম্পত্তি আইন করে রাষ্ট্র তাদের সাথে বৈষম্য আচরন করেছে। এছাড়াও সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিবেশী মানুষেরা নানান কূট-কৌশলে ও প্রভাব খাটিয়ে জবর দখল করে চলেছে। এ বিষয়ে আইনের কাছে ব্যবস্থা চেয়েও কোনো সুবিচার তারা পায়নি। কারণ এদেশের আইন সহজ সরল এবং অসহায়দের পক্ষে কাজ করে না।
বাংলাদেশের গারো পাহাড় খ্যাত শেরপুর জেলা ভারতের মেঘালয় রাজ্যঘেষে অবস্থিত। ১৯৮৪ সালে পৃথক জেলা হিসাবে স্বীকৃতি পায়। এ জেলায় প্রায় ত্রিশ হাজার আদিবাসী জনগোষ্ঠীরবাস। জেলার শ্রীবরদী উপজেলাতে প্রায় ১২ হাজার আদিবাসী জনসংখ্যা রয়েছে। এখানেও ভূমি নিয়ে সমস্যা ও জটিলতা সীমাহীন। বনবিভাগের নেতিবাচক মানসিকতার প্রভাবও অহরহ চোখে পরে। বর্তমানে তারা নিজ ভিটাবাড়ীর গাছও বিক্রি করতে পারছে না। ভূমি দখল ও মামলায় নিঃস্ব হয়েছেন অনেকেই। তার মাঝে বাবেলাকোনা গ্রামের মিসেস মেরিনা সাংমা একজন ভূক্তভোগী। তিনি নিম্ন আদালদের রায় প্রাপ্তির একযুগ পরেও ২৬ একর রের্কডীয় জমি ফিরে পাননি। বর্তমানে সুপ্রীম র্কোডের আপিল বিভাগে মামলাটি চলমান রয়েছে। দীর্ঘদিন মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি প্রচুর আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। একই গ্রামের বৈদ্যনাথ কোচের প্রায় ৭ একর রের্কডের জমি প্রভাব খাটিয়ে বেদখল করে ভোগ করছে স্থানীয় অ-আদিবাসীরা। ১৯৬৪ সালে দেশে অবস্থানকালীন সময়েই অনেকের রের্কডীয় জমি শত্রæ সম্পতি করেছে সরকার। বর্তমানে অর্পিত সম্পত্তি প্রর্ত্যপন আইন হলেও অনেকেই ফিরে পাননি তাদের জলাজমি। তাছাড়া রয়েছে বনবিভাগের সমস্যা। তাই বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের আদিবাসীরা নিজেদের জায়গাজমি হারিয়ে হয়েছে নিঃস্ব, দিনমজুর বা কেউ জীবন বাঁচার তাগিদে হয়েছেন দেশান্তরী। শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার একসময়ের উল্লেখযোগ্য গ্রাম মারাকপাড়া, জিগাদকোনা, জাসান নক্খাপ, জুঁকহবাহা, নাকলার মত জনবহুল প্রায় ৩০টি গ্রাম হয়েছে জনশূন্য। বেসরকারী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান কালচারাল এন্ড ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি-সিডিএস এর ২০০৫ সালের অনুসন্ধানী মূলক শিক্ষাসফরের তথ্য মতে, প্রতি ৮/১০ বছরের মধ্যে একটি করে গ্রাম হারিয়ে গেছে। বাকী যে কয়টি গ্রাম জীবিত আছে সেগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। বিশিষ্ট আদিবাসী লেখক ও গবেষক বাঁধন আরেং এর মতে, আদিবাসী জনগোষ্ঠীরা পৃথিবী এবং মানবসভ্যতার জন্যে ক্ষতিকর কোনো কাজ করেনি। ঐতিহ্যমন্ডিত এসব জনগোষ্ঠীর লোকেরা ধরীত্রী বাঁচাবার জন্যে আরও সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে অথচ তারা আজ অন্যায্যতার শিকার হচ্ছে, অসহায় হয়ে পরেছে। এটা দুঃখ জনক। তাদের ভূমি ভাবনা ও বিশ্বাসকে সম্মান করা দরকার। তাতে রাষ্ট্র এবং বিশ্ব পরিমন্ডলেরই লাভ হবে। সাংবিধানিক ভাবে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান, পৃথক ভূমিকমিশন গঠন করে দখলকৃত ভূমি ফিরে পেতে চাই আদিবাসীরা। বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে তাদের এ দাবির ভিত্তি অযৌত্তিক নয় নিশ্চয়।