মানুষ উচ্চশিক্ষিত, দেশী বা বিদেশী বড় ডিগ্রিধারী হলেই মননে ও চিন্তায় আধুনিক হয় না। অপবিশ্বাস ও অন্ধকারের অচলায়তন ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারবে ব্যাপারটা অতো সরলীকরণ করা যায় না। মানুষের চিন্তা চেতনার অগ্রসরতা ও উদারতার পেছনে একটা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমির বিরাট প্রভাব থেকেই যায়। এর একটি উজ্জ্বল উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথ ও মহাত্মা গান্ধীর একটি ব্যক্তিগত মনোমালিন্যে। প্রকাশ্যে শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের আবরণে ঢেকে রাখলেও নানা সময় প্রকাশ পেয়েছে বিশ শতকে ভারতবর্ষের দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির জীবনদর্শন ও রাজনৈতিক মতদ্বৈততা। রবীন্দ্র্রনাথ ১৮৭৮ সালে পিতা মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইচ্ছায় উচ্চশিক্ষার জন্য সতেরো বছর বয়সে বিলেতের পথে পা বাড়ান। ভর্তিও হলেন ১৮৭৯-৮০ শিক্ষাবর্ষে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে। স্কুলকে যেমন কারাগার মনে হতো বিলেতে কলেজকেও তাই মনে হলো। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পদ্ধতিকে কখনোই ভালো লাগেনি রবীন্দ্র্রনাথের। স্কুল পালানো বালক হিসেবেই পরিচিত হলেন (কিন্তু স্কুল পালালেই কী রবীন্দ্র্রনাথ হওয়া যায় না?) এজন্যই বোধহয় সচেতনভাবে ‘শিক্ষার বাহন’প্রবন্ধে লিখছেন, “মুখস্থ করিয়া পাশ করাই তো চৌর্যবৃত্তি! যে ছেলে পরীক্ষাশালায় গোপনে বই লইয়া যায় তাঁকে খেদাইয়া দেওয়া হয়; আর যে ছেলে তার চেয়েও লুকাইয়া লয়, অর্থাৎ চাদরের মধ্যে না লইয়া মগজের মধ্যে লইয়া যায়, সেই-বা কম কী করিল?”
আমরা রবীন্দ্র্রনাথের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে এভাবে সহসা দেখি না। সেটা অবশ্য সম্ভবও নয়। চাদর বা পোশাকের ফাঁক ফোঁকরে অসৎ উদ্দেশ্যে আর সৎ উদ্দেশ্যে মগজের মধ্যে মুখস্থ করে রাখার মধ্যে যে ফারাক নেই এ তো রবীন্দ্র্রনাথ আমাদের অভ্যস্থ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। নামে মাত্র শিক্ষা পদ্ধতি কিছুটা সৃজনশীল করলেও গাইড আর নোট মুখস্থ করতে এখনও শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত। আমাদের শিক্ষাবিজ্ঞানীরা (Pedagogist) এখনও এ নিয়ে ভাবতে প্রস্তুত না। সুতরাং স্কুল পলায়ন করা বালকের মতো সেবারও কবির দশা হলো তাই। রবীন্দ্র্রনাথের আইসিএস কিংবা ব্যারিস্টার হওয়া হলো না। শুধু ভালো লেগেছিল ইংরেজির অধ্যাপক হেনরি মর্লির সাহিত্যের পাঠ। একই সঙ্গে আইসিএস হওয়ার বাসনা নিয়ে একই কলেজে ভর্তি হওয়া লোকেন পালিতের ইচ্ছে পূরণ হলেও রবীন্দ্র্রনাথ ১৮৮০ সালেই পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ (প্রথম ভারতীয় আইসিএস) ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে অক্সাস জাহাজে করে দেশে ফিরলেন। প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আর সার্টিফিকেটের প্রতি কবি বরাবরই বিমুখ ছিলেন। এজন্যই আমৃত্যু তাঁর জ্ঞানতৃষ্ণা জাগ্রত ছিল। চিন্তা ও চেতনায় অলৌকিক বিশ্বাসের চেয়ে বেশি প্রগতি, যুক্তি ও বিজ্ঞানমনস্কতায় আস্থা রাখতেন। কর্মে, ধ্যানে, সৃষ্টিশীলতায় ছিলেন ভারতবর্ষের সবচেয়ে অগ্রসর মানুষ। সৃজনশীলতার বিবেচনায় সারাবিশ্বেও তাই। শিক্ষাবিদ ও ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রবীন্দ্র্রনাথ কেন জরুরী নামক একটি প্রবন্ধে তিনি বলছেন,
… রবীন্দ্র্রনাথ নিজেই একটি বিশ্ববিদ্যালয়। যে বহুমুখিনতাকে আধুনিক ইউরোপ তার জন্মকালে অত্যন্ত প্রশংসা করত, রবীন্দ্র্রনাথের মধ্যে সেই গুণ ছিল, তার আগে অন্য কোনো বাঙালির মধ্যে এটা দেখা যায়নি, পরেও দেখা যাবে বলে আশা করা যায় না। কেননা, ইতিমধ্যে যুগ এসে গেছে বিশেষজ্ঞ হওয়ার।
জগদীশ চন্দ্র বসু ও আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীদের সান্নিধ্য কবি উপভোগ করতেন। বিক্রমপুর নিবাসী জগদীশ চন্দ্র বসু রবীন্দ্র্রনাথের ঘনিষ্ট বন্ধুও ছিলেন। রবীন্দ্র্রনাথ ইউরোপ, আমেরিকা, আরব, পূর্ব এশিয়া থেকে প্রাচীন ভারতবর্ষের জ্ঞানসমুদ্রে ছিলেন এক বিনিদ্র নিঃসঙ্গ ডুবুরি। মননে ও চিন্তায় অগ্রসর ছিলেন ভারতবর্ষে সে সময় রাজনৈতিকভাবে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারকারী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সভাপতি ব্যারিস্টার মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর চেয়েও। এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ টানলেই পরিষ্কার হবে। এ লেখার উদ্দেশ্যও তাই। ঘটনাটি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘রবীন্দ্র্রনাথ পূর্বোক্ত’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত।
সেবার ১৯৩৪ সালের বিহারে ভয়ঙ্কর এক ভূমিকম্প ঘটে। সে ঘটনার সময় গান্ধীর এক প্রতিক্রিয়ায় রবীন্দ্র্রনাথের সঙ্গে মতবিরোধ স্পষ্ট রূপ লাভ করে। গান্ধী ওই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে বলেছিলেন, ‘এ হচ্ছে অস্পৃশ্যতার পাপের জন্য বিধাতা প্রেরিত শাস্তি।’ রবীন্দ্র্রনাথ গান্ধীজীর এমন কথার প্রতিবাদ করেন। সমালোচনা করে রবীন্দ্র্রনাথ বলেছিলেন যে, ‘গান্ধী যে শুধু ঈশ্বরকে টেনে আনছেন তা নয়, তিনি এমন এক ঈশ্বরের ধারণা প্রচার করেছেন যিনি পাপীকে শাস্তি দিতে গিয়ে নিষ্পাপকেও সাজা দিয়ে ফেলেন। তার চেয়েও বড় কথা, গান্ধী সেই অন্ধত্বকেই শক্তিশালী করেছেন যা মানুষের দুর্ভোগের কারণ খোঁজে ঐশ্বরিক জগতে।
বলা বাহুল্য, গান্ধী এর উপযুক্ত জবাব দিতে পারেননি। পারার কথাও নয় এবং বেশ মনঃক্ষুণ হন। গান্ধীজীও ব্যারিস্টারি পড়তে ভারত ছেড়ে ছিলেন রবীন্দ্র্রনাথের প্রথম বিলেত যাত্রার আট বছর পরে অর্থাৎ ১৮৮৮ সালে। কঠোর রক্ষণশীল পরিবারে বড় হওয়া গান্ধী বিলেত যাত্রার সময় মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন বিলেতে জাত বা ধর্ম যায় অর্থাৎ ধর্মসংস্কার ও শাস্ত্র বিরোধী কোনো কাজ করবেন না, নিষিদ্ধ পানীয় বা মাংস স্পর্শ করবেন না। ধর্ম ও শাস্ত্রবিরুদ্ধ কিছু করবেন না। বিলেতে ভারতীয় সমাজের সম্পূর্ণ প্রতিকূল বাস্তবতায় গান্ধীজী মাকে দেওয়া কথা কতোটা রেখেছিলেন কে জানে। তবে নিষ্ঠাবান ছিলেন বলে তাঁর আত্মজীবনী ‘The Story of My Experiments with Truth’ পড়ে জানা যায়। কঠোরভাবে নিরামিষভোজী ছিলেন এবং আমৃত্যু। ব্যারিস্টারিও সফলভাবে পাশ করেছিলেন। নিজ দেশে ফিরে এসে সুবিধা না করতে পেরে চলে গেলেন আফ্রিকায়।
মহাত্মা গান্ধীর (মহাত্মা – রবীন্দ্র্রনাথের দেয়া উপাধি) প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান অটুট রেখে, তাঁর অসাম্প্রদায়িক বোধের কথা স্মরণে রেখেও এ কথা বলা বোধহয় অত্যুক্তি হবে না কালাপানি পাড়ি দিয়ে গান্ধীজী বিলেতে পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষিত হয়ে পৃথিবী ঘুরে দেখেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ক‚পমণ্ডূক ভারতবাসীর মতো মননে কখনোই সংস্কারমুক্ত হতে পারেননি। ব্রাহ্ম ধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারী হয়ে, স্কুল পালানো বালক, আনুষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা বঞ্চিত রবীন্দ্র্রনাথ যতোটা পেরেছিলেন। এই সময়ের বাস্তবতায় এরচেয়ে বেশি অসম্ভব ছিল। বিলেতি ব্যারিস্টারের চেয়েও জ্ঞানে, চিন্তায়, মননে অগ্রসর ছিলেন ডিগ্রিহীন এক কবি। কিছু ব্যতিক্রম বাদে ব্যারিস্টার, উকিল, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানীদের নিজ কাজের ক্ষেত্র ছাড়া তেমন পড়াশোনার অভ্যাস থাকে না। কিন্তু ডিগ্রিগুলোর বিজ্ঞাপনে ঠিকই আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তাঁদের প্রথাগত পড়াশোনা ও ডিগ্রিগুলো তো কৌশল, দক্ষতা আর জ্ঞানের একটা ক্ষুদ্র শাখা। অনেকেই এই দক্ষতাকে ব্যবহার করে জ্ঞানের মহাসমুদ্রে নিজের সংযোগ ঘটাতে পারেন নি। উল্টো টাকা উৎপাদনের, ক্ষমতা চর্চার কেন্দ্র বানিয়েছেন। ভোগবাদী সমাজের লক্ষ্যও তাই। সৃষ্টিশীল মানুষেরা তো রফিক আজাদে কবিতার সেই বালকের মতো- যে বালক মূল বই পড়ার কথা ভুলে- সমাজের চোখে যেটা ভুল বই- তাই পড়ে চিরকাল।
বালক ভুল করে পড়েছ ভুল বই,
পড়েনি ব্যাকরণ, পড়েনি মূল বই!
আলমগীর শাহরিয়ার-কবি ও গবেষক।