ইতিহাসের নানান উপকরণে সংস্কৃতির জনপদ কুষ্টিয়া জেলা গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধিকার আন্দোলনেও তার ব্যতিক্রম নয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথার ইতিহাস রয়েছে কুষ্টিয়া জেলায়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিলো, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সেই সূর্য উদিত হয়েছিলো এই জেলায়। প্রথমত, ৩১ মার্চ, ১৯৭১ প্রতিরোধযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম ভূখন্ড হিসেবে মুক্ত হয় বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা। দ্বিতীয়ত, ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের ভবেরপাড়ায় বৈদ্যনাথতলায় বাংলাদেশের প্রথম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ এর শপথ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় পযর্ন্ত স্বাধীনতা বিরোধীদের নির্যাতন কেন্দ্র, টর্চার সেল, বধ্যভূমি, গণহত্যা, ও গণকবর এবং ঘাটি স্থাপনের বহু ইতিহাস রয়েছে জেলায়। তারমধ্যে কুষ্টিয়া শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্স অন্যতম। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্স নির্মম ইতিহাসের স্বাক্ষী। অথচ এই কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্সকে নিয়ে সরকারি বেসরকারি কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ে স্বাধীনতার ৫০ বছরে কোন উল্লেখযোগ্য গবেষণা নির্ভর কাজ হয়নি। এমনকি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও না। খন্ডিত আকারে কিছু গ্রন্থ ও প্রকাশনায় কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্সে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান, যুদ্ধ, নির্যাতন কেন্দ্র, বধ্যভূমি ও কার্যক্রম নিয়ে উল্লেখ রয়েছে।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ কোষ দ্বিতীয় খন্ডে আলোকপাত করলে দেখতে পাই কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্সকে ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা ইতিহাসের তথ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে। ১০১ পৃষ্ঠায় কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্স নির্যাতন কেন্দ্র ও ২৮১ পৃষ্ঠায় পুলিশ লাইন্স বধ্যভূমির উপর সংক্ষেপে আলোকপাত করা হয়েছে। একাত্তর সালে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্স ছিলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও স্বাধীনতা বিরোধীদের নির্যাতন কেন্দ্র এবং বধ্যভূমি। এখানে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এই বন্দিদশা থেকেই ধরে নিয়ে হত্যা করা হয় অধ্যাপক দূর্গা দাশকে। কুষ্টিয়া শহরের গড়াই নদীর তীরবর্তী দক্ষিণ পাশেই এই পুলিশ লাইন্স অবস্থিত। এছাড়াও স্থানীয় ইতিহাস রাশেদুল ইসলাম বিপ্লবের কুষ্টিয়ার ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’, ইমাম মেহেদীর ‘মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়ার নারী’ গ্রন্থেও কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্স কুষ্টিয়ার সর্ববৃহৎ যুদ্ধক্ষেত্রের একটি হিসেবে উল্লেখ রয়েছে।
কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্স এর অবস্থান কুষ্টিয়া শহরের প্রাণকেন্দ্রে। উত্তরে ঐহিত্যবাহী গড়াই নদী, পূর্বপাশে কুষ্টিয়া পৌরসভা এবং মজমপুর বাসস্ট্যান্ড। দক্ষিণে রয়েছে কুষ্টিয়ার পুরাতন শহর মজমপুর এবং পশ্চিমে রয়েছে আলফামোড় ও মঙ্গলবাড়িয়া এলাকা। পুলিশ লাইন্সের দক্ষিণ পাশ দিয়ে গা ঘেষে রয়েছে কুষ্টিয়া ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়া মেহেরপুর এবং কুষ্টিয়া-ভেড়ামারা-পাবনা যাতায়াতের প্রধান সড়ক।
একাত্তর সালে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্স ছিলো মূলত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রধানতম একটি ক্যাম্প। ২৫ মার্চ সারাদেশে গণহত্যা শরু করে পাকিস্তানি শাসকচক্র। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন এবং গ্রেফতার হন হানাদার বাহিনীর হাতে। সারাদেশের ন্যায় ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে যশোর থেকে মেজর শোয়েবের নেতৃত্বে ২৭ বালচু রেজিমেন্টের প্রায় ২০০ শত পাকিস্তানি সৈন্য এসে ঘাটি স্থাপন করে কুষ্টিয়া জিলা স্কুল, পুলিশ লাইন্স ও আড়–য়াপড়ায় ওয়ারলের্স অফিসে। ২৬ মার্চ থেকে সারা শহরে কার্ফু ঘোষণা করে এবং টহল জোরদার করে। ২৭ তারিখে শহরের এনএস রোডে রনি রহমানকে গুলিকরে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। আতংক ছড়িয়ে পুরো শহর দখল করে।
মেজর আবু ওসমান চৌধুরী (পরবর্তীতে আট নম্বর সেক্টর কমান্ডার) নেতৃত্বে সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনছার সেনবাহিনী, ইপিআর, জনপ্রতিনিধি ও স্বাধীনতাকামী সাধারণ নারী, পুরুষ এবং কিশোরদের অংশগ্রহণে প্রতিরোধ যুদ্ধে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্স থেকে ৩১ মার্চ রাতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি বাহিনী। ১ এপ্রিল থেকে ১৬ এপ্রিল বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা সম্পূর্ণ মুক্ত এলাকা ছিলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে। ১৬ এপ্রিল পড়ন্ত বিকেলে পাবনা হয়ে প্রবেশ করে পর্যায়ক্রমে পুনরায় দখল করে। কুষ্টিয়া জিলা স্কুল ও কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্স যুদ্ধ এবং হানাদার বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রধান আবু ওসমান চৌধুরী ভাষ্য-
‘সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানি কুষ্টিয়ার পুলিশ লাইনসের দিক দিয়ে আক্রমণ করবে, ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীর কোম্পানি শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে, অর্থাৎ সার্কিট হাউসের দিক দিয়ে আক্রমণ করবে এবং একটা প্লাটুন ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কিছুসংখ্যক লোক পূর্ব দিক থেকে মোহিনী মিল ও ওয়্যারলেস স্টেশনের ওপর আক্রমণ চালাবে। আক্রমণ হবে সংযুক্তভাবে একই সময়ে তিনদিক থেকে’। (তথ্যসূত্র : আবু ওসমান চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে কুষ্টিয়ায় প্রতিরোধযুদ্ধ, প্রথম আলো, ০২ ডিসেম্বর, ২০২০)।
কুষ্টিয়া শহরের বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল আলম টুকুর ভাষ্য
‘কুষ্টিয়া প্রতিরোধ যুদ্ধে আমার ডিউটি পড়েছিলো হাসপাতালের পাশে পোস্ট অফিসের দোতলায়। ১ এপ্রিল থেকে পুরো শহর মুক্ত হলো। আমরা তখন পুলিশ লাইন্স এবং জিলা স্কুল থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অস্ত্র সংগ্রহ করলাম। আমি নিজেও একটা নিলাম। পরবর্তীতে পুনরায় পাকিস্তানি বাহিনী কুষ্টিয়া দখল করে জিলা স্কুল, পুলিশ লাইন্স, ওয়ারলেস আড়–য়াপাড়া এবং কুষ্টিয়া সদর থানায় অবস্থান করে ঘাটি স্থাপন করে। (তথ্যসূত্র : ইমাম মেহেদী, একাত্তরের জনযুদ্ধের ভাষ্য, অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি)।
আবু ওসমান চৌধুরীর বিবরণ অনুযায়ী,
পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০ মার্চ ভোর চারটায় আকস্মিকভাবে তিন দিক থেকে কুষ্টিয়া আক্রমণ করি। আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে অনুসরণকারী জনগণের গগনবিদারী জয়ধ্বনিতে বোধ হয় শত্রুপক্ষের মনোবল ভেঙে যায়। ঘণ্টাখানেক তুমুল যুদ্ধের পর আমাদের সেনারা পুলিশ লাইনস ও ওয়্যারলেস কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে পড়ে শত্রু হনন করতে থাকে। উপায়ান্ত না দেখে সামান্যসংখ্যক শত্রুসৈন্য তাদের অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দিয়ে দ্রæতগতিতে তাদের সদর দপ্তরের দিকে পালিয়ে যায়’। (তথ্যসূত্র: সম্মুখযুদ্ধ ১৯৭১, মুক্তিযোদ্ধাদের কলমে, প্রথমা প্রকাশন ২০২০, পৃষ্ঠা ৪৭-৫৬)।
পুলিশ লাইন্স যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আশকর আলীর ভাষ্য,
আমরা মারফত আলীর নেতৃত্বে মঙ্গলবাড়িয়ার পাশ দিয়ে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করি এবং পুলিশ লাইন্স হানাদার মুক্ত করি। (সাক্ষাৎকার: ০২ অক্টোবর, ২০২০, নিজবাসা, আমলা, মিরপুর, কুষ্টিয়া)।
কুষ্টিয়া জিলা স্কুল ও পুলিশ লাইন্স থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বা স্বাধীনতা বিরোধীরা সারা জেলায় খুন, ধর্ষণ, হত্যা, নির্যাতন ও গণহত্যার নীল নকশা পরিচালনা করতো। অন্যদিকে তার বিপরীতেও রয়েছে ইতিহাস। একাত্তর সালে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্সকে শত্রæ মুক্ত করতে গিয়ে সেই সময় কুষ্টিয়ার অনেক বীর সন্তানই শহীদ হয় এবং আহত হয়। পরে ১১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া মুক্ত হলে পুলিশ লাইন্স বধ্যভ‚মি ও নির্যাতন কেন্দ্র থেকে বহু মানুষের কঙ্কাল উদ্ধারের ইতিহাসও রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কুষ্টিয়া থেকে বাংলাদেশ পুলিশের ৩৩ জন শহীদ হওয়ার তথ্যও রয়েছে। (তথ্যসূত্র : শেখ জাহাঙ্গীর আলম, নয় মাসরে রণাঙ্গনে শহীদ হন ৭৫১ পুলশি সদস্য, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৬)।
মুক্তিযুদ্ধের সূর্যোদয়ের ইতিহাস খ্যাত কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্স একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালিদের উপর চালানো নির্মম ইতিহাস বহন করে। এ বিষয়ে আরো বিস্তর গবেষণা ও অনুসন্ধানের সুযোগ রয়েছে।
ইমাম মেহেদী
গণমাধ্যমকর্মী ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।