লেখক তিলক পুরকায়স্থ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম ডি, পেশায় চিকিৎসক। একটি বৃহৎ কেন্দ্ৰীয় সংস্থায় চিকিৎসা বিভাগের সর্বোচ্চ পদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। উৎকৃষ্ট সেবা পদক, লাইফ টাইম আচিভমেন্ট এওয়ার্ডসহ বিভিন্ন পুরস্কারে পুরস্কৃত। নেশায় লেখক, আছে ফটোগ্রাফির শখ। পশ্চিম বাংলার বহু গ্রামেগঞ্জে এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ক্ষেত্র সমীক্ষা করার জন্য ভ্রমণ করেছেন। বিদেশেও বহু জায়গায় গিয়েছেন। প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে আছে বিস্মৃতপ্রায় বঙ্গসংস্কৃতির প্রাঙ্গনে , আরণ্যক উড়িষ্যা ও মন্দিরময় কলিঙ্গের খোঁজে, ,মিশর দেশের সেকাল একাল, ভারতীয় সংস্কৃতির সন্ধানে ( ইন্দো -চীন পর্ব),কলিকাতা : সেকালের গল্প, একালের শহর ( পর্ব ১ এবং পর্ব ২) ইত্যাদি। তাঁর ভারতীয় সংস্কৃতির সন্ধানে ( ইন্দো -চীন পর্ব) বইটির পাঠ-পতিক্রিয়া চাতাল পাঠকের জন্য প্রকাশ করা হলো।
বইটি সাধারণ বাঙালি পাঠককে ট্যুরিস্ট থেকে ট্র্যাভেলারে উত্তরণে সাহায্য করবে।। ডাঃ আশীষ কুমার চট্টোপাধ্যায়।।
বিখ্যাত পরিব্রাজক ও লেখক (এবং পেশাগত জীবনে স্বনামধন্য চিকিৎসক) ডাঃ তিলক পুরকায়স্থ মশাইয়ের লেখা “ভারতীয় সংস্কৃতির সন্ধানে (ইন্দো-চীন পর্ব)” পড়লাম। প্রথমেই একটি কথা বলে রাখি, এই দেশগুলির ভ্রমণের একবার আমি ডাঃ পুরকায়স্থর সঙ্গি ছিলাম, এবং আমি আমার প্যারাডাইম দিয়ে এই দেশগুলি দেখেছি, তাই বইটির ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকা আমার পক্ষে একটু প্রবলেম্যাটিক। এই রিস্কটুকু নিয়েই এই অসাধারণ বইটি সম্বন্ধে কিছু লেখার চেষ্টা করছি।
প্রথমেই কয়েকটি বেসিক ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করা যাক। একটি বই কতটা তথ্য পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারে, এবং কতটা বোধগম্যভাবে, তা ভীষণ ইমপরট্যান্ট। লেখক যদি শুধুমাত্র তথ্যের পাহাড় চাপিয়ে দেন, তবে তো সাধারণ পাঠক বই ফেলে ছুটে পালাবে। বিদেশী খটোমটো নামে ভরা ইতিহাসের তথ্য এবং লৌকিক গল্প কত পারসেন্টেজে মেশালে সেটা সাধারণ পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, সেটা লেখকের মাথায় থাকতে হবে। । লেখক কতটা নিজের অভিজ্ঞতা লিখেছেন, আর কতটা নেট বা টেক্সট বই থেকে নিয়েছেন, তার উপরেও কিন্তু একটি বইয়ের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে। সাধারণ পাঠক কিন্তু লেখকের ব্যক্তিগত টাচটাই বেশি পছন্দ করেন। লেখকের মনে রাখতে হবে, বইটির টার্গেট অডিয়েন্স কারা? বইটি কি শুধুমাত্র জ্ঞানী ব্যক্তিদের জন্য লেখা, নাকি সাধারণ পাঠকদের জন্য?
আর একটি দরকারি কথা,সেটা হলো- ভ্রমণকারীর ক্যাটেগোরি নিয়ে। দু’ধরণের ভ্রমণকারী হয় – ট্যুরিস্ট, আর ট্র্যাভেলার। যেমন ধরেন- আপনি আঙ্করবাটের মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে টুক করে একটা সেলফি তুলে রাস্তার পাশের রেলিংয়ের বাসুকী নাগকে মিস করবেন, নাকি আঙ্করবাটের মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে তার ইতিহাসের কথা চিন্তা করে টাইম ট্র্যাভেলার হয়ে যাবেন, সেটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু প্রথমটা আপনাকে বানাবে একজন ট্যুরিস্ট, আর দ্বিতীয়টা একজন ট্র্যাভেলার। বান্তে শ্রেই মন্দিরে গিয়ে কী দেখবেন, সেটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু ট্র্যাভেলার হতে গেলে আপনাকে মন্দিরটির ইতিহাস ভূগোল জানতেই হবে।
কাম্বোডিয়ার কুখ্যাত “কিলিং ফিল্ড”-য়ে গিয়ে আপনি যদি সেই হতভাগ্য শিশুগুলির কান্না শুনতে না পান, তবে আপনি ট্যুরিস্ট, আর তাদের দেখতে পেলে বা তাদের মর্মান্তিক চিৎকার শুনতে পেলে আপনি ট্র্যাভেলার। ভিয়েতনামে গিয়ে ভিয়েৎকং গেরিলা সৈন্যদের মাটির তলায় বানানো এক্সটেনসিভ টানেল নেটওয়ার্ক দেখে আপনি যদি সেই অকূতোভয় যোদ্ধাদের দেখতে না পান, তবে আপনি ট্যুরিস্ট, আর তাঁদের দেখতে পেলে আপনি একজন ট্র্যাভেলার।
এতগুলো কথা বললাম শুধুমাত্র একটি আবহ তৈরি করার জন্য। এবার আসুন আসল প্রশ্নে। কাম্বোডিয়া-ভিয়েতনামের উপর লেখার অভাব নেই। নেট থেকে আপনি এক ক্লিকে যাবতীয় তথ্য ডাউনলোড করে নিতে পারেন। কিন্তু পুরকায়স্থর বইটিতে ভিন্নতা আছে, গতানুগতিক নয়। বইটিতে দুই পর্বে কাম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম নিয়ে অসংখ্য তথ্যের ভিড়। কিন্তু লেখকের মুন্সিয়ানার জন্য এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয় না কেউ ইতিহাসের ক্লাস নিচ্ছেন। খটোমটো বিদেশী নামে ভর্তি ইতিহাসের সঙ্গে লেখক যেভাবে লৌকিক কাহিনী গুলিকে মিশিয়ে পরিবেশন করেছেন, তা এককথায় অনবদ্য। লেখক নিজের অভিজ্ঞতাকে এমন সুন্দর জীবন্তভাবে পরিবেশন করেছেন যে, একবারের জন্যও মনে হয় না ঘটনাগুলি প্রক্ষিপ্ত। এবং তাঁর লেখার গুণে মনে হয় যেন বই পড়ছি না, সিনেমা দেখছি। যদিও বইটিতে প্রচুর ইতিহাস ও ভূগোলের তথ্য ও তত্ত্ব আছে, বইটি কিন্তু পণ্ডিত রিসার্চার এবং সাধারণ ভ্রমণপিপাসু পাঠক, দু’ ধরণের মানুষেরই জন্যই ভালো। তাছাড়া কাম্বোডিয়া-ভিয়েতনাম এখন ভ্রমণকারীদের কাছে যাকে বলে “ইন-থিং”। খুব একটা খরচ হয় না, এবং দু’টি দেশই ট্যুরিজমকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিয়েছে। ফলে, বহু মানুষ এখন ভিয়েতনাম-কাম্বোডিয়া বেড়াতে যাচ্ছেন। তাঁদের কাছে এই বইটি এককথায় যাকে বলে “গড গিফটেড বুন”, তা সে তাঁরা ট্যুরিস্ট হিসেবেই যান, বা ট্র্যাভেলার হিসেবে। বহু দেশ ঘুরে ঘুরে পোক্ত ট্র্যাভেলার আমার মনে হয়, সাধারণ বাঙালি পাঠককে ট্যুরিস্ট থেকে ট্র্যাভেলারে উত্তরণে সাহায্য করতে এই বইটির জুড়ি নেই।
বইটির প্রকাশক- অমর ভারতী, টেমার লেন, কলেজ স্ট্রিট, কলিকাতা, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত। মুদ্রিত মূল্য ২৭৫ টাকা।