সপ্তশিল্পের জননী বলা হয় নাচকে। কারণ বহুশিল্পের সম্মিলন এই নাচ। কোনো এককালে ময়মনমনসিংহ থেকে জগা স্যার আসতেন মগড়া নদীর বাড়ি। উদীচীর তখন একটি মাত্র ধারীর বেড়ার একচালা ছোট্ট ঘর, মাটির মেঝে। নাচ করানোর মত ঘর ছিল না। কখনো নারায়ণ কর্মকারদের বাসায়, কখনো রেডক্রিসেন্টের ঘরে তিনি ক্লাস করাতেন। ফি নিতেন দুইশত টাকা। সেই টাকায় উচ্চাঙ্গ, সাধারণ, লোক নাচ শিখাতেন। বছর দেড়েক পর জায়গা এবং ছাত্রের অভাব। ক্লাসটি বহাল রাখতে আমার মা আমাদের দুইবোনকেই পাঠায় কিন্তু চারশত টাকায় কি আর হয়! বলা যায় ছাত্রের অভাবেই ক্লাসটি বন্ধ হয়ে যায়।
লক্ষ্মী ছাড়া স্বরস্বতীর টিকে থাকা যেসব শিল্পে দায় তার অন্যতম হয়ে ওঠেছে নাচ। ভাবার কোনো কারণ নেই এমনিতে বলছি। কোনো এককালে আমিও নাচতাম। সে রূপকথার মত হলেও দীর্ঘসময় এই শিল্পের সাথে সখ্যতা ছিল আমার। আমি জানী, গুরুমুখী কাল সে অনেককাল আগে বিলীন হয়ে গেছে। সময়ের সাথে যে দিদি/দিদিমনি বা ম্যাডাম/স্যাররা আছেন তারাই ধরে রেখেছেন সকল প্রান্তে এই শিল্পকে। তাদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ। তবু সত্য এই সবকিছুর মত নাচটাও দিনদিন ধনীকের গোলায় উঠে গেছে। কেন বলছি?
একজন নৃত্যরত মেয়ের পোশাক পরিচ্ছদের যে বহর সেখানে একজন নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে যোগান দেয়া কঠিন! কারো কারো পক্ষে অসম্ভব। যাদের কাছে কঠিন তারা তবু শখে টিকে থাকে। কিন্তু যাদের কাছে অসম্ভব তারা ঝরে যায়। নাচের পাঠ চুকিয়েছি অনেকবছর। তবু ফোন আসে। দীর্ঘশ্বাস শুনি। পোশাক, সকলের সাথে মিলাতে গিয়ে বাধ্যহয়ে পার্লারে পাঠানো নানাকারণের কথা শুনতে পাই।। অথচ নাচের সাথে মেকাপ শেখানো দায়িত্ব শিক্ষকের। শিল্পী শিল্পের আধার। তিনি জানবেন, কীভাবে একটা উড়নাকেই নানা ঢঙ্গে উপস্থাপন করে নঁকশা বদলে দেয়া যায়। কীভাবে এক গহনার বহুবিধ ব্যবহার করা যায়।
কিন্তু দূভার্গ্য ক্রমেই স্টারজলসার মত নাচকে ঝলমল পোশাক, গয়নার বাড়াবাড়ি ও মেকাপের গন্ডি থেকে আর বের করা যাচ্ছে না। অথচ যার চোখের আর্ট, অঙ্গভঙ্গি ভালো তাকে সাদামাটা পোশাক ও সাজেও কত মনকাড়াই না লাগে। এখানে এসে আমরে আটকে গেছি। আধুনিক হতে পারছি না। । এর কুফল ভোগ করতে হয় দরিদ্রকেই।
যে মা সংসারের খরচ বাঁচিয়েও সন্তানকে নাচ শেখায়, যেখানে পূজা বা ঈদ ছাড়া সন্তানকে নতুন জামাই দিতে পারে না। তারপক্ষে যে বছরে একটি পোশাক বানিয়ে দেয়া কী কষ্টের! সিলেক্টেড পার্লারের খরচ বহন করা কী জুলুমের সে কথা তো একজন শিল্পীই অনুভব করবে। শিল্পীর কাছে তো এমনই প্রত্যাশা বীণাপানির।
মাঝখান থেকে বেঁচে যাচ্ছে সংগঠনগুলো। সরকারি প্রতিষ্ঠান বিশেষত শিল্পকলা, শিশু একাডেমির অনুষ্ঠান বাজেটে কিন্তু পোশাকের একটা পার্ট থাকে। সেটা অভিভাবকরা জানে না। সামর্থবানদের জানার প্রয়োজনও পড়ে না। কেউ খোঁজ নেয় না। প্রশ্ন করে না। শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠানের সাথে ভেসে যায় ফলে ঐ টাকা উধাও হয়ে যায়। অথচ এইটাকায় পোশাক কিনে সংরক্ষণ করলে অনেককেই পোশাকের জন্যে ঝরে যেতে হয় না। বাকী রইলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তাদের এমন সামর্থ থাকে না। বিশেষত, আমি যে সংগঠনের আদর্শ ধারণ করি তাদের তাদেরতো থাকেই না। তাই এধরণের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর নীতি ও আর্দশের পাঠটা সকল শিক্ষক এবং কর্মীর থাকাটা বড়বেশী জরুরী। শিক্ষক যে ঘরানা থেকেই আসুক তাকে সংগঠনের নীতিমালাকে আত্মস্থ করে নিতে হয়। এক্ষেত্রে সকলের সামর্থকে বিবেচনায় রাখা তাদের জন্যে ফরজ। এখন আমরা কতটা করতে পারছি, বা আদৌ আর্দশিক জায়গাগুলোকে নিজে ধারণ লালন এবং পালন করছি কিনা সেটা অন্য আলোচনা।
শিখন প্রক্রিয়ার এইসকল ত্রুটি ও ধনীক অভিভাবকের ঝলকানির ছটায় ছাপোষাদের ত্রাহিত্রাহি অবয়বের গল্প শেষ আর হয় না। দিনদিন বরং উর্দ্ধমুখী।
যোগ হয়েছে রেস্টৃরেন্ট কালচার। সেতো আর এক সংস্কৃতি। গণসংগঠনগুলোও কিঞ্চিত সংকোচ বোধ করে না সেসব ফটোগ্রাফ সোস্যাল মিডিয়ায় দিতে। যেখানে একটা হালকা টিফিন জোগানোর ফান্ড কালেক্ট কষ্ট সেখানে চাঁদা করেই হোক আর ধনীকজনের উপহারেই হোক এইটাযে কোনো এক পক্ষকে বিব্রত করে সেইবোধও যেন আমাদের লোপ পেয়েছে। সাধনার চেয়ে প্রতিযোগিতার দিকে ঝুঁকে যাওয়ার প্রবণতা! বিশেষত মাতৃকূলের প্রতিযোগিতা। সেই দ্বন্দ্বে না চাইলেও শিশুরা জড়িয়ে পড়ে। ওদের উষ্ণ সম্পর্ক নিরুত্তাপ হয়ে যায়। কোনোদিন সময় ও সুযোগ মিললে সেসব নিয়ে বলা যাবে।
একটা অভিজ্ঞতা বলি, আজকাল অনেক ছানাদের অভিভাবকরা বলে, অর্ন্তজালে তাদের সন্তানের নাচের প্রতিযোগিতা চলছে। আমি সেখানে যাই, লাইক কমেন্টও দেই। কিন্তু ওদের বয়সানুযায়ী নাচের যে গান এবং ওদের যে ভাব তা রীতিমত উদ্বেগের।
সকল বয়সের একটা নিজস্ব সৌন্দর্যতা রয়েছে। সেই বয়স পেরিয়ে চাইলেও তাকে ধরা যায় না। আমি এখন চাইলেই আমার বিশবছর আগের করা পারফরমেন্সে ফিরত যেতে পারবো না। সম্ভব নয়। তাই সেইসব নাচ দেখে দুঃখহয় এজন্য যে অনেক নাচ ওরা চাইলেও আর নাচতে পারবে না। দোষ কি তবে শিশুদের? মোটেও নয়। আমাদের। মানে আমরা সেসব হাইজাক করে নিচ্ছি ওদের কাছ থেকে। শৈশবের স্বাদ না দিয়ে পূর্ণবয়স্কের স্বাদ দিয়ে দিচ্ছি। তাল লয় ভাব মুদ্রা না বুঝিয়ে সরাসরি গান। আর সেই গানের অর্থ শিশুসুলভ তো নয়ই। ওরা বনের পরী আমার সনে খেলতে আসে কুঞ্জবনে, মোরা ঝঞ্জার মত উদ্যাম, মোরা ঝরণার মত চঞ্চল গানের সাথে নাচার পরিবর্তে ফাগুনে পূর্ণিমা রাতে চল পালাইয়ে যাই বা এইধরণের অন্যকোনো গানের সাথেই পারফর্ম করা শিখে যায়। সব যেনো কেমন জগাখিচুরি অবস্থা।
সব নাচের ফর্ম আছে। যেমন লোক নাচ আমাদের পল্লী সমাজকে রিপ্রেজেন্ট করে। সাধারণ করে নাগরিকতাকে, উচ্চাঙ্গ, কথক, মনিপুরী, কুচিপুরীসহ নানা নাচের পোশাক, মুদ্রা, গল্প ভিন্ন। নাচ সবগুলো শিক্ষকরা জানবে তা নয়। কিন্তু বেসিক ব্যাকরণটা জানা থাকলে শিশুদের শিখনটা পোক্ত হয়। তা না হলে পল্লী নাচে শাড়ি পরার যে একটা ধরণ আছে, সাজের একটা ধরণ আছে। কথক আর পল্লী নাচের মুদ্রা যে এক হবে না। এইটা তারা শিখবে কোথা থেকে? কিছুর সাথে যেন আর কিছু মিল রাখতে হয় না এইটাকে আধুনিকতা বলে ধরে নিয়েছি!! সিনেমায় যেমন দেখি ঘুমাচ্ছে জমকালো সাজ দিয়ে। বাড়িতে খেতে বসেছে বেড়াতে যাওয়ার মত ঝকমকে পোশাক পরে। অনেকটা এমনই বোধহয় মাঝেমাঝে।
মফস্বলে চিরকালই সোনা ফলে। আমাদের অনেক সম্পদ আছে। কিন্তু অনেক সুবিধাই ওখানে পৌঁছায় না বলে আমরা আর এগুলো জানতে পারি না। অনেকদিকে উন্নতও হয়েছি আমরা আজকাল। কিন্তু আমাদের শিশুরা কথক, মনিপুরী, ভরতনাট্যম শিখতেই পারে না। এর একটি কারণ হলো আমরা নিজেরাও এতদূর শিখেনি।
তবে শিখতে পারিনি এইটার চেয়ে দৈন্যতা হলো আমাদের যে সীমাবদ্ধতা আছে সেটা আমরা বুঝতেও চাই না, মানতেও চাই না। বরং নতুন কিছু শিখতে অন্য শিক্ষকের কাছে গেলে মুখ বেজার হয়। আমরা এইভাবে ভাবি না যে, না জানায় লজ্জা নেই। এক্ষেত্রে হয় নিজে শিখে নেই নতুবা যিনি পারেন তার কাছে যেতে পরামর্শ দেই। বা তাকেই আমন্ত্রণ জানায় এতে করে শিল্পী খাটো হয়ে যায় না। কাজের কাজ না করে আমরা ভুলপথে হাঁটি। নিজের বীরত্ব দেখাতে গেয়ে অন্যজনদের কোনঠাসা করাই কখনো কখনো মূল সাধনা হয়ে যায়। ফলে শিল্পের সাধনায় সময়ের ঘাটতি পরে।
আমি তুমি আমরা অনেকেই শিখতে পারিনি অনেককিছু। জগা স্যার প্রতিষ্ঠানের বারোয়ারী ক্লাসেই ২০০ টাকা প্রাতিষ্ঠানিক চার্জে উচ্চাঙ্গ শিখিয়েছিলেন দুইটা। এখন সেই নাচ শিখতে হলে শিক্ষককে উচ্চমূল্য দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে শিখতে হয় । যা দরিদ্রের সার্মথ্যে কুলোয়নাতো। তাহলে দরিদ্র মেয়ে কোথা থেকে শিখবে বলুন? তার একসময় ঝরে যাওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায়ই এই শিল্প আর রাখছে না। ফলে যা খরচ!-বলে মা বাবা অনেকসময় নাচ শিখাতেই আসে না।
নিজেদের অজানামুক্ত করতে নাচের অসংখ্য বই আছে। সেগুলোরও পাঠ নেয়া যেতে পারে। শিল্পিদের এত সমিতি টমিতির কী প্রয়োজন একটু ভেবে বলেনতো! শিল্পীরা শিল্পচর্চা করবে। শিল্পদিয়েই পলিটিক্স করবে। রাজনৈতিক আদর্শবোধ তার নাচের গান, ছন্দ, লয় তার বোলে এমনিতেই প্রতীয়মান হবে। মিছে এসবে জড়িয়েও আমাদের সময় কমে যায়। মাথার উপর লেখাপড়া, সংসারের আলু পটল চিন্তাও তো কম নয়। ফলে আনুষ্ঠানিকতা আর সেল্ফি এতে জীবনের মহামূল্যবান সময় চলে যায়। এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ধারণা। কারো ভিন্নমতের উপরও আমার শ্রদ্ধা রইল।
দিনশেষে গণমানুষের সংগঠনটাই আমি মনপ্রাণ দিয়ে করেছি। সময় না দিতে পারলেও এখনো করি। মানি। তাই মাঝে মাঝে নিজের জানাবোঝাগুলোও আওরাই।
করোনাকালে ঘরে বসে অফিস করার সুবাদে শুক্রবার ছাড়া সকাল দিন রাত আমার বিলিন হয়ে গেছে। তারমধ্যে আছে ভয়। এরমধ্যে লেখাই আমার এখন সাধনা। কালেভদ্রেই তা করতে পারি। নৃত্যদিবসে কাল অনেকেই আমার নাম করেছেন তখন মনে হয়েছে। তোমরা মনে কর আমি সত্যি ভীষন খুশি হই। আজ আমি মৃত হলেও একদা কোনোকালে আমিও নাচতাম এইটা মনে করি। তোমাদের ভালোবাসা একঝাঁক পাখী ডানা ঝাপটে ওঠে।
তাই, নৃত্যদিবসে চাওয়া পোশাকের বহর কমুক। প্রতিটি নৃত্যশিল্পী তাদের নিজের মেকাপ নিজে করুক। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা প্রাইভেটের চেয়ে প্রতিষ্ঠানে বেশি দিক প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানও তাদের সম্মানী বাড়িয়ে দিক। সভাসমিতি আর কমিটিতে যে সময় সেটা সাধনায় দিক। সকল নৃত্যশিল্পীদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আর, শুধু ধনীকজন নয় গরিবের গোলায় সোনার ফসল উঠুক।
নেত্রকোনা সাহিত্য সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বাঁকেবাঁকে একসময় ছিলেন তিনি। নাচ, আবৃত্তি, নাটক, উপস্থাপনা যখন যাই করেছে প্রশংসা কুড়িয়েছে। সর্বোপরি একজন সংগঠক হিসেবে প্রিয়মুখ। পারিবারিক সূত্রেই শৈশব থেকে উদীচীর সাথে সম্পৃক্ততা।