নয়.
মুনলাইট সোনাটা বেজে উঠতেই আফ্রা চকিতে তাকাল ফোনের দিকে, ইফতি। চোখটা এমনিতেই ঘড়ির দিকে চলে গেল। রাত সাড়ে নটা।
অ্যাই, কী খবর রে?
হ্যালো…হ্যালো…আফ্রা?
ফোনে কেমন খড়খড় শব্দ হচ্ছে ওপাশ থেকে। এই বাড়িটায় এই এক সমস্যা। জায়গায় জায়গায় নেটওয়র্ক ঝামেলা করে।
হ্যাঁ, ইফতি, শুনছি তো। বল। তুই শুনতে পাচ্ছিস না? – একটু জোরেই বলে উঠলো আফ্রা এবার।
আপনি থেকে একেবারে তুইতে স্কিপ করে আসাটা অনেকদিন আগেই সেরে নিয়েছে ওরা। আফ্রার আবার আপনি বা তুমি বেশিক্ষণ পোষায় না। এই কমাসে ওদের মধ্যে একটা অদ্ভুত ধরণের সরল বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। কৃতিত্বটা অবশ্য ইফতিরই বেশি৷ মানুষের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবার এবং সেটাকে নিজে অনুধাবন করবার বিরল গুণটা আছে ওর। ফলে মনের কথা উজাড় করে দিতে আফ্রার কোনো সমস্যাই হয় না। এর মধ্যে তুবার সাথেও একদিন পরিচয় হয়ে গেছে।
হ্যাঁ…হ্যাঁ…এখন শুনতে পাছি। তুই কি খুব ব্যস্ত? কী করছিলি?
উম…কাল একটা কুইজ আছে। সেটায় ঘস্টাচ্ছি। কেন বল তো?
না মানে, বলছিলাম কি, একবার ছাদে আসবি নাকি?
ছাদে…! এখন…!! কেন? ছাদে কী করবো? আর তুইই বা ছাদে কী করছিস? তোর না পরশু ফেরার কথা? যাসনি?
ক্যান্সেল হয়ে গেছেরে। কপাল ভালো। তাই বাড়ি ফিরে একটা ঘুম দিলাম জম্পেশ। উঠে ছাদে এসেছি একটু আগে। আয় না একবার। মামা আজকে খুব মুডে আছে।
মামা মানে?
আরে, চাঁদা মামা। হেব্বি একটা লাইট জ্বালিয়েছে। মনটা একদম বিন্দাস মেরে যাচ্ছে। আসবি?
একমুহুর্ত ভাবে আফ্রা। ক্লাস টেস্ট না কি জোছনা? রাতে কখনই ছাদে ওঠেনি ইফতির সাথে। কেন যেন মনে হয়েছে, মা পছন্দ করবে না। আর ইফতিটারই বা হলো কী আজ? একদম চন্দ্রাহত।
কি রে? কী ভাবছিস? চলে আয়।
‘আচ্ছা। আসছি।’ – সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল আফ্রা।
কোঁকড়া চুলগুলো ঝোপ্পা হয়ে আছে। হলুদ হেয়ারব্যান্ডটা দিয়ে আটকে নিয়ে মার ঘরে উঁকি দিল একবার। ঘুমাচ্ছে। শরীরটা কদিন থেকে ভালো যাচ্ছে না। সন্ধ্যা হলেই ঘুমিয়ে যান। বাবাও এজন্য মার কাছ থেকে সহজে সরছে না। থাকুক দুজন। দরজাটা আস্তে করে ভেজিয়ে দিয়ে ছাদে উঠে এলো আফ্রা এবং মুগ্ধ হয়ে গেল।
কি রে? জম্পেশ লাগছে, বল?
উফ্! সত্যিই পাগল হয়ে যাব আরও কিছুক্ষণ থাকলে।
এরকম চাঁদমামাকে আগে দেখেছিস? আমি তো তখন থেকে মামাকে স্যালুট দিয়ে যাচ্ছি।
ভাগ্যিস তুই আজ যাসনি। নইলে আমাকে ডাকতি কিভাবে? অ্যাই, থ্যাংক য়্যু রে। থ্যাংক য়্যু সৌ মাচ, ইফতি।
দুজনেই এবার চুপ হয়ে যায় আচমকা। এখন লোডশেডিং চলছে। স্ট্রিট বালবগুলো জ্বলছে না বলেই চাঁদের রূপালী আলো ভাসিয়ে নিচ্ছে ছাদগুলো, পানির ট্যাংকটাকে, ঘুমিয়ে থাকা রাস্তাটা আর এক ঠেঙ্গে ল্যাম্পপোস্টদের।
আফ্রা ভাবছিল…আসলে কিছুই ভাবছিল না। বরং এই অদ্ভুত মায়াময় সমস্ত প্রকৃতিটাকে শুষে নিচ্ছিল যেন। বাতাসটাও যেন আজ প্ল্যান করেছে ওর চুলগুলোকে এলোমেলো করার। আবেশে চোখ মুদে আসছে ওর। তাই ঘাড়ের ওপর খুব আলতো স্পর্ষটা টের পেলও খুব আস্তে আস্তে। কানে একটা ফিসফিসে স্বর ওকে ডাকলো,
আফ্রা?
উম্?
একটা প্রশ্ন করবো। উত্তর দিবি।
বল না?
আমাকে ভালোবাসতে দিবি, তোকে?
চমকে আয়ত চোখ দুটো ফেরাতেই দেখলো, এক জোড়া ঠোঁট একদম কাছাকাছি চলে এসেছে। আফ্রা, আর যাই হোক মেয়েই তো, এই মুহূর্তে বুঝতে পারছে, ইফতি যে কথাটা বললো, সেটা ওর অনেক, অনেকদিনের আটকে রাখা একটা প্রশ্ন। কিন্তু সব প্রশ্নের কি চট করে উত্তর হয়?
আমি…আমি তো…ওভাবে…তুই আসলে, মানে…আমি…
এবার আফ্রার পালা। আচমকা অপ্রত্যাশিত কিন্তু অবশ্যম্ভাবী ঘটনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষ জানে না কী করতে বা বলতে হয়। ইফতি আবার বলে ওঠে,
নিজেকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, কথাটা কিভাবে বলবো। জিজ্ঞেস করেছি, বন্ধুকে কি ভালোবাসা উচিৎ? অনেক ভেবে দেখলাম, তুই আমার খুব ভালো বন্ধু বলেই তোকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি আমি। এটা কখন প্রেম হয়ে গিয়েছে, আমি জানি না। বন্ধুর সাথেই প্রেম করাটা সবচেয়ে সেইফ। কারণ আমরা একে অন্যকে বুঝতে পারি জলের মতো। আজ কথাটা না বললে নিজের কাছ থেকেই মুক্তি পাচ্ছিলাম না। তুই শুধু বল, আমি কী করব? তোর যেটা ইচ্ছা বল। আমি কিচ্ছু মনে করবো না। কিন্তু প্লিজ, চুপ করে থাকিস না। জাস্ট বল, আমি যে তোকে ভালোবা…
খেয়াল করলে ইফতি দেখতে পেত, আফ্রার ঠোঁটের কোণে প্রায় দেখাই যায় না এমন আবছা হাসি উঁকি দেব দেব করছে। ইফতির কথা শেষ করতে দেয় না আচমকা খুব নরম একটা স্পর্ষ। স্ট্রবেরির সুগন্ধ আর অনাস্বাদিত একটা স্বাদ আচমকাই ওর ঠোঁটজোড়ায় লেপ্টে গিয়েছে। গাঢ় নিঃশ্বাসের সাথে এবার আফ্রার ফিসফিস কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
সত্যিই ভালোবাসবি তো? সবসময়?
সবসময়। সবসময়। সারাজীবন।
তাহলে আমিও।
ইফতি দুহাতে জড়িয়ে ধরে আফ্রার পেলব গাল। সিগারেটের গন্ধ মাখা একটা আগ্রাসী পুরুষালি মুখ ঝুঁকে পড়ে। কোঁকড়া চুলগুলো উথালপাথাল হাওয়াতে দুজনকেই যেন আড়াল করে দিচ্ছে সব কিছু থেকে। আফ্রার হাঁটুতে কোনো জোর নেই। পুরো শরীরে যেন একটা বিদ্যুৎ এঁকেবেঁকে বয়ে যাচ্ছে মুহূর্তে মুহূর্তে। আফ্রা দুহাত দিয়ে হেলান দেয় রেলিং এ।
ঠিক সেই মুহূর্তেই খসে পড়লো রেলিং এর এক চাপড়া ইট-বালির স্তুপ। আর ইফতির হাত থেকে স্লো মোশানে ছুটে গেল আফ্রার গাল।
দশ.
খালাম্মা, কেমন আছেন?
এই আছি আর কি বাবা। তুমি কেমন আছ? তুবা? ও আর আসে না কেন?
এই ব্যস্ত থাকে। আফ্রা কোথায়?
আছে ওর রুমে মনে হয়। দেখ গিয়ে। তুবাকে বোলো তো আসতে। অনেকদিন দেখি না।
আচ্ছা।
কথাটা বলে রেশমা আক্তারের রুম থেকে বেরিয়ে এলো মিরাজ। তুবাকে নিয়ে কথা বলতে ওর ইচ্ছা করে না। জানে, ব্যাপারটা স্বাভাবিক না। কিন্তু সেই প্রথম থেকেই মিরাজের মাথা, মন একটা নামই আচ্ছন্ন করে রেখেছে – আফ্রা। অফিস থেকে ফিরে তাই মাঝে মাঝে চলে আসে এখানে। কখনও আফ্রাকে পায়। গল্প করে। আফ্রার অবশ্য কোনো সমস্যা নেই। বড় ভাইয়ের বন্ধুকে দেখছে অনেক বছর। এখন তো আবার প্রিয় বান্ধবীর বর। দেখা হলেই তুবাকে জড়িয়ে ঠাট্টা করবে। মিরাজের তখন মনে হয়, এর থেকে আফ্রা যদি একটা পেরেক ওর মাথার তালুতে বসিয়ে দিত, ওর বোধহয় এতটা কষ্ট হতো না। আফ্রার মুখে তুবার নামটা শুনতেও চায় না ও।
আজ আফ্রার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো, ও নেই। তার মানে ছাদে আছে নিশ্চয়ই। যাবে কি না, কয়েক সেকেন্ড ভাবলো। তুবা আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলেছিল। ওর নাকি একা সন্ধ্যাবেলায় ভয় লাগে। ধুত্তোর ভয়। আফ্রাকে কেন আর নিয়মিত দেখতে পারে না, এই নিয়ে মিরাজের আক্ষেপের শেষ নেই। আগে তুবা নিয়মিত যেত। সেই সাথে মিরাজও৷ গল্প হতো তিনজনে। তুবা আর আসতে চায় না। মিরাজ জানে কেন। মাঝে মাঝে বলেছেও তুবাকে, ‘যাও না কেন আফ্রার ওখানে?’ একটা শব্দও উচ্চারণ না করে তুবা শুধু তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। সেই দৃষ্টিতেই সব উত্তর। মিরাজ আর পাত্তা দেয় নি। এখনও বন্ধুর বাড়িতে ওর অবারিত দ্বার। তাই নিজেকে সামলাতে পারে না। কিন্তু ইদানিং মনে হচ্ছে, আফ্রা যেন ঠিক সহজ হতে পারে না ওর সামনে। অস্বস্তিতে ভোগে। মিরাজের সাথে বেশিক্ষন একা গল্প করতে চায় না। হয় মাকে ডাকে নয় তুবার কথা জিজ্ঞেস করে। কয়েকদিন তো তুবাকেও ফোন করে ডেকে এনেছিল।
মিরাজের একদম ভাল্লাগে না। যতদিন যাচ্ছে, আফ্রা ওর অবসেশন থেকে ম্যানিয়ায় পরিনয় হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে কেমন অবোধ পশুর মতো মনে হয় ইদানিং। আফ্রাকে না পেয়ে পেল তুবার মতো একজনকে। ইশ্! কেন যে বিয়েতে রাজি হয়েছিল? কেন যে তখন সাহস করে আফ্রাকে বলেনি?
শয়নে স্বপনে আফ্রাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে মিরাজ নিজেকে আর স্বাভাবিক রাখতে পারছে না। আফ্রাকে না পাওয়ার হতাশা আর ওকে নিয়ে ফ্যান্টাসি একসাথে মিশে গিয়ে আরও পাশবিককভাবে উগরে দেয় তুবার মধ্যে। আজ মিরাজ তাই ঘোরের মধ্যে চলে এসেছে। আফ্রার কাছে একটিবার ভিক্ষা চাইবে। ওর কাকুতিতে নিশ্চয়ই আফ্রা বুঝবে, ও কতটা অসহায়। তরতর করে ছাদে উঠে এলো ও। জানে আফ্রা কোথায় থাকতে পারে। ইদানিং ইফতি নামের একজনের কথা শুনছে আফ্রার কাছে। দেখাও হয়ছে একদিন। গা জ্বলে গেছে মিরাজের। আফ্রা মনে হয় একটু ঢলে পড়ছে। হারামজাদা! আর জায়গা পেল না থাকার। আজ আবার ব্যাটা থাকবে না তো? নাহ! সেটা ঠিক জেনেই এসেছে। গতকালই কথায় কথায় তুবার মাধ্যমে জেনেছে, ছেলেটা ঢাকার বাইরে।
ঠিক যেখানটায় ভেবেছিল সেখানেই আফ্রা বসে আছে। গুনগুন করে গান গাইছে। পায়ে পায়ে ওর পিছনে এসে দাঁড়ায় মিরাজ। মেয়েদের মনে হয় আলাদা একটা সেন্স থাকে। আফ্রাও পেল। চট করে ঘাড় ঘোরায় ও মিরাজের দিকে। উঠে দাঁড়ায়।
মিরাজ ভাই, কী ব্যাপার?
আফ্রা…। – মিরাজের গলাটা কেঁপে যায় হঠাৎ। আজ সব বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে ওর। এই স্বরেই আফ্রা বুঝে যায়, কোন একটা গন্ডগোল হচ্ছে।
কী হয়েছে মিরাজ ভাই? আপনি ঠিক আছেন তো? তুবা?
প্লিজ আফ্রা, ওই নামটা তুমি আমার সামনে উচ্চারণ কোরো না।
মানে? কী বলছেন?
আফ্রা, আমি…আমি…তোমাকে একবার চাই।
চাই মানে?
তুমি বোঝো না আমি কি চাই? বোঝো না? প্লিজ আফ্রা, আমি আর পারছি না। তোমাকে একবার আমি চাই, জাস্ট একবার। কেউ জানবে না, টেরও পাবে না।
ছিঃ। পাগলের মতো কী যা তা বলছেন?
অকৃত্রিম ঘেন্নার সাথে শব্দটা ছিটকে এলো আফ্রার কণ্ঠ থেকে। আর সেটাই যেন মিরাজের মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়। প্রাথমিক বাধা তো আগেই ভেঙ্গেছে। এবার মিরাজ আচমকা চেপে ধরে আফ্রার দু কাঁধ। জ্বরতপ্ত মানুষের মতো কাঁপছে ওর পুরো শরীর। মুখটা জোর করে গুঁজে দিতে যায় ওর গলার কাছে। আগুনের মতো গরম নিঃশ্বাসে আফ্রা পিছিয়ে যায় স্বাভাবিকভাবেই। আর মিরাজও ওকে আঁকড়ে ধরে টেনে আনে বুকের কাছে।
আফ্রার মাথা ঠিক মতো কাজ করছে না। ওর কী করা উচিৎ এই মুহূর্তে, মাথায়ও আসছে না। গায়ে, পায়ের সব জোর যেন ঘটনার আকস্মিকতায় উবে গেছে ওর। শুধু টের পাচ্ছে, মিরাজের হাতদুটো পাগলের মতো ওর সারা শরীরের যত্রতত্র স্পর্ষ করতে চেষ্টা করছে।
স্বাভাবিক রিফ্লেক্স কাজ করলো এইবার। মাথাটা ঝটকা মেরে সরিয়ে নেয়ার সময় একবার চোখে পড়লো তুবাদের বাড়িটার দিকে। জানালার ফ্রেমে তুবাকে দেখতে পেল ও এক পলক। এদিকেই তাকিয়ে আছে। জোরে ঠেলে দিল ও মিরাজকে। সরে যাচ্ছে মিরাজ, সরে যাচ্ছে ছাদ, সবকিছু। জোড়াতালি দেয়া রেলিংটা ওর ভেঙ্গে পড়া ইঁট বালির স্তুপের সাথে আফ্রাকেও যেন টেনে নিচ্ছে নিচের দিকে। যেন অনন্তকাল ধরে আফ্রা হাত বাড়িয়ে সিঁড়িটার ধাপ ধরতে চাইছে আর সেটা ক্রমেই দূরে দূরে সরে সরে যাচ্ছে। শুধু ‘তুবা’ ডাকটা প্রলম্বিত হতে থাকলো।
এগার.
“য়্যু ফিল আপ মাই সেন্সেস, লাইক আ নাইট ইন দ্য ফরেস্ট।
লাইক আ মাউন্টেইন ইন স্প্রিং টাইম,
লাইক আ ওয়ক ইন দ্য রেইন…”
আফ্রার কলার টিউনে জন ডেনভার গেয়ে চলেছেন চিরকালের সবচেয়ে সহজ প্রেমের অনুভূতিটা। তুবা এক মনে শুনছে, অনেকদিন পর। এককালে এই গানটা ওদের দুজনেরই অসম্ভব প্রিয় একটা গান ছিল। কট করে মাঝখানে কেটে গিয়ে ভেসে এলো সেই ঝলমলে কন্ঠ,
হ্যালো…তুবা। কি রে?
আফ্রা?
তোর গলা এরকম লাগছে কেন? কী হয়েছে রে?
কিছু না।
কিছু না মানে? আমার কাছ থেকে লুকাচ্ছিস তুই? কি হয়েছে, বল?
বললাম তো, কিচ্ছু না।
আবার কিছু না। নিশ্চয়ই মিরাজ ভাই। কী করেছে তোকে? কী নিয়ে ঝগড়া? অ্যাই তুবা, প্লিজ। চুপ করে থাকিস না।
বিশ্বাস কর, মিরাজের সাথে আমার ঝগড়া হয় নি। কখনও হয় না।
তাহলে কাঁদছিস কেন?
তোর জন্য।
আমার জন্য মানে?
আফ্রা, তুই…তুই…
আমি কী? বল।
আমার কিছু কথা বলার আছে আফ্রা। সামনাসামনি বলতে চাই।
বল না। এত রহস্য করছিস কেন? আমি আসবো?
উঁহু। আমিই আসবো।
কখন আসবি, বল। আমার সাড়ে সাতটা পর্যন্ত কাজ আছে একটা। ভার্সিটিতে থাকবো। নটায় আসবি?
আসবো। ঠিক সাড়ে নটায় আসবো। ছাদে থাকবি।
ঠিক আছে, থাকবো। চলে আয়। আর শোন।
কী?
যা-ই হোক, মনে রাখিস, আমি কিন্তু সবসময় আছি, তোর পাশে ।
জানি তো। – ছোট্ট করে উত্তর দেয় তুবা।
ভালো থাকিস। ছাড়ছি রে। বাই।
বাই।
কলটা কেটে যেতেও অনেকক্ষণ হাতে নিয়ে বসে রইলো তুবা। আফ্রাকে কী বলবে ও? কিভাবে বলবে? নিজের ভেতরের ঘুনপোকাটাকে আটকেই তো রেখেছিল ও। এখন সেটা কালকেউটের বাসা বানাতে চাইছে মিরাজ। ওকে আফ্রার মতো হতে বলে প্রতিদিন, ওইরকম পোষাক, কার্লি চুল। আহ্! প্রতিদিন একইভাবে মরে যাওয়াটা কী ভয়ংকর মিরাজকে ছেড়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই ওর। কে আছে দুনিয়ায়? পড়ালেখাটাও যদি শেষ করতে পারতো। মিরাজকে দোষী বানাতে অবচেতন মনই চাইছে না। আফ্রারও তো কোন ভূমিকা নেই এখানে। তুবা নিজেকে অভিশাপ দিতে শুরু করে এবার। ওর মনে হয়, ও আসলে আফ্রার তুলনায় কত সাধারণ, অনাকর্ষণীয়। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়, যদি আফ্রার সাথে পরিচয়টাই না হতো।
তুবার ফোনটা রাখার পর আফ্রা অনেকক্ষন ধরে ভাবল, তুবার কী হতে পারে। এইটুকু অন্তত বুঝতে পারাই যায় যে, সমস্যাটা ওদের দাম্পত্যজীবন নিয়ে। মিরাজ কি কোন কিছুতে জড়িয়েছে? অন্য কোন মেয়ে? নাকি তুবা কাউকে মন দিয়ে ফেলেছে? কিন্তু তাহলে তুবা ওর কথা বললো কেন? ভেবে ভেবে কোন কুলকিনারা পেল না আফ্রা।
সেদিন রাতেরবেলা দুই বান্ধবীর দেখা হলো অনেকদিন পর৷ পার্থক্য কেবল, সেই হাসিখুশি আড্ডার মেজাজটা নেই। একজনের মনে বিষন্নতার পাথর ভারী হয়ে আছে। আর আরেকজনের মন অসীম কৌতুহলে টগবগ করে ফুটছে।
এবার বল, কী হয়েছে। কিচ্ছু লুকাবি না কিন্তু তুবা।
তুবা যেন এই কথাটারই অপেক্ষায় ছিল। একে একে বলে যায় মিরাজের সাথে ওর সংসার জীবনের কথা। স্বামী স্ত্রীর ওই খুব বিশেষ ব্যাপারটায় মিরাজের অস্বাভাবিক আচরণের কথা, যেটা কিনা বিয়ের পর থেকেই তুবাকে সহ্য করে যেতে হচ্ছে।
সবশেষে আফ্রাকে নিয়ে মিরাজের বলা ফ্যান্টাসিগুলো আর সেটাকে কিভাবে প্রতি রাতে তুবাকে বাধ্য করে শুনতে, সেভাবে আচরণ করতে, সেটা বলতে গিয়ে লজ্জায়, ঘৃণায় তুবা হেঁচকি তুলতে শুরু করে। ঝরঝর করে পানি ঝরে পড়ছে দুচোখ দিয়ে। আফ্রা পাথরের মুর্তির মতো বসে৷ কী শুনছে ও এইসব? কী বলবে ও তুবাকে? একটা মেয়েকে এই অবস্থায় কী বলা যায়? আফ্রার মাথাতেই আসছে না, কিভাবে দিনের পর দিন তুবা এইসব সহ্য করে যাচ্ছে।
আফ্রা দুহাতে জড়িয়ে ধরতে গেল তুবাকে, সেই ছোট্টবেলার মতো। যেন স্পর্ষ দিয়ে মুছে নেবে বন্ধুর সবটুকু কষ্ট। মিরাজের নামটা মনে হতেই ওর মাথায় আগুন ধরে যাচ্ছে। এরকম বিকৃত একটা মানুষের সাথে এই ফুলের মতো নরমসরম মেয়েটা এতোদিন নরক যন্ত্রনায় জ্বলছে, আফ্রা সহ্য করতে পারছে না আর।
তুবা দাঁড়িয়ে ছিল দেয়ালে ঠেস দিয়ে। ওভাবেই চুপ করে গিয়েছে কথাগুলো বলে। আফ্রা পরম মমতায় ওকে জড়িয়ে ধরতে যেতেই তুবা ছটফটিয়ে উঠল। যেন গায়ে কেউ গরম তেল ঢেলে দিয়েছে ওর। দু হাতে ঠেলে সরিয়ে দিল আফ্রাকে, ‘আমাকে ছেড়ে দে তুই। আমার আর কিচ্ছু নেই, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।’ তুবা এগিয়ে যেতে চায় ছাদের কিনারার দিকে। এই নামহীন নরকের জীবন রেখে কী লাভ?
অন্যসময় হলে আফ্রা তুবাকে ছাড়তো না কিছুতেই। কিন্তু মনের ক্লেদের স্লুইস গেটটা খুলে যেতেই সেই ধাক্কাটা হয়ে গিয়েছিল মাত্রাছাড়া। পুরোনো রেলিংটা ভেঙ্গে একটা আর্তচিৎকারের সাথে আফ্রা যখন নিচে পড়ে যাচ্ছিল, তখন ওর দেখা শেষ দৃশ্যটা তুবার দু চোখ – তাতে প্রচন্ড কষ্ট আর সব হারানোর হতাশার সাথে কোথায় যেন খুব আবছা করে উঁকি মারছিল অন্য একটা অনুভূতি।
বার. পরিশিষ্ট
সব গল্পের পরিশিষ্ট থাকতেই হবে, তেমনটা নয়। সবকিছু প্রতিদিনকার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যাপারগুলোর মতো ব্যাখ্যা করা যাবে, তা-ও নয়। অনেকগুলো ‘যদি’, ‘হয়তো’ আর ‘কিন্তু’ লুকিয়ে থাকে বন্ধ জানালাটার ওই পাশটাতে।
তুবা, ইফতি, মিরাজ – প্রত্যেকেই নিজের জানালাটার ওপাশে বন্দী হয়ে আছে। হতে পারে সেটা কোন মেন্টাল অ্যাসাইলাম। হতে পারে সেটা কোন সলিটারি সেল। আবার হতেও পারে একা অথবা অন্য কারও সাথে ভাগ করে নেয়া কোন বেডরুম। তিনজন মানুষ আর তিনটা জানালা নিয়ে কতগুলো ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার কম্বিনেশন বানানো যায়? গনিতের হিসেবে হয়তো অল্প কটা কিন্তু জীবনের হিসেব? অগুনিত।
প্রায় আট মাস কেটে গিয়েছে ওই ঘটনাটার পর। সময়ের ফ্রেমে আটকে থাকা জুম্মান কোচওয়ান লেন বদলে গিয়েছে অসম্ভব রকমের৷ সরাফ সাহেব বিক্রি করে দিয়েছেন বাড়িটা। চলে গিয়েছেন এলাকা ছেড়ে নিজের গ্রামে। পুরোনো ভাড়াটেদের মধ্যেও প্রায় কেউই নেই। গলিটায় আসলে প্রাণটাই আর নেই আফ্রা চলে যাওয়ার পর। নেই তুবা, মিরাজ বা ইফতিও।
অনেকদিন পর তুবাদের ছেড়ে যাওয়া বাসাটায় একটা তরুণ দম্পতি উঠেছিল। মেয়েটা একদম অল্প বয়সী, নাম শাহানা। ওর স্বামীটাও চব্বিশের বেশি হবে না। মেয়েটা এক রাতে রান্না করছিল এক মনে। ডালটা অনেকটা ফুটে উঠতে তাড়াতাড়ি কাঠের হাতাটা নেওয়ার জন্য জানানার পাশে রাখা স্ট্যান্ডে হাত বাড়ায় এবং সেখানেই জমে যায়। জানালার আবছা অন্ধকারের ফ্রেমে একটা অবয়ব ঝুলে আছে, কোঁকড়া চুলের একটা মেয়ে, যার মাথায় হলদে একটা হেয়ারব্যান্ড আলগা করে লাগানো। মায়াময় মুখটা কিছু যেন বলতে চাইছে। কিন্তু গাঢ় তরলে ভেসে যাওয়া ঠোঁটদুটো কেবল নড়ছে, আওয়াজ হচ্ছে না কোন।
শাহানা একটা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। এরপর হুলুস্থুল কান্ড। সবাই এক সময় ধরে নেয়, কি দেখতে কি দেখেছে। শাহানা যেহেতু অন্তঃস্বত্তা, তাই ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয় খুব। আফ্রার কাহিনী তো এই লেনের সবাইই জানে। মেয়েদের এই অবস্থায় মনের মধ্যে অনেক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। শাহানার স্বামী জানালাটা বন্ধ করে দেয় এরপর। এরও এক মাস পর ওরা চলে যায় বাড়িটা ছেড়ে। কারণ শাহানার সবসময়ই মনে হতো, জানালার ওপাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। খুব করে কিছু একটা যেন বলতে চায়। কিন্তু বন্ধ জানালায় তার অতৃপ্ত নিঃশ্বাস ধাক্কা খেয়ে ফিরে যায় শুধু।
জানালাটা তাই আর খোলা হয় না। চেষ্টাও করেনি এরপর কেউ আর কখনও। জানালা কখনও আকাশ দেখায়, কখনও হু হু হাওয়া চুল ওড়াতে আসে, আবার কখনও খুব প্রিয় কারও ফেলে যাওয়া শব্দরা ফিস ফিস করে উড়ে উড়ে আসে – আমি তো ছিলাম। আমিও তো থাকতে পারতাম।
সেই তিনজন মানুষ এখন তিনটি আলাদা আলাদা জানালায় তাকিয়ে থাকে সারাক্ষণ। আর ভাবে, সেই ময়ুরকন্ঠী রাতটায় যদি…। তিনটা ভিন্ন ভিন্ন টাইমলাইনে তিনটা ভিন্ন স্লাইড শো ওদের চোখের সামনে ছায়াছবির মত চলতে শুরু করে এরপর। কোনটা যে সত্যি, সেটা তিনজনের কেউই কি জানে? শুধু ঝিম ধরা মধ্য দুপুরে কখনও কখনও কোন বাড়ির ছিটকিনি খোলা জানালার কবাট শব্দ তোলে নিরুদ্দেশ বাতাসে।
কোনো কোনো ময়ুরকণ্ঠী রাতে এমন কিছু জানালা খুলে যায়, আবার বন্ধও হয়ে যায়। তার খবর কেউ রাখে না। শুধু জানালাগুলোই লুকিয়ে রাখে তাদের গল্পগুলো।
(শেষ)