৬_হোহাই ইউনিভার্সিটিতে আমাদের প্রোগ্রাম
০২ আগস্ট ২০১১সকালে আমরা রেডি হয়ে নিচে নামলাম। হোটেলেই নাস্তা খেলাম। আমাদের জন্য রাখা গাড়িতে হোটেল থেকে হোহাই ইউনিভার্সিটিতে গেলাম। যাওয়ার পথে শহরটাকে দেখলাম। খুবই Neat and Clean. পথে দেখলাম, রাস্তার ধূলো পরিষ্কার করে নিচ্ছে মেশিনযুক্ত গাড়ি দ্বারা। গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছে আর ধূলো টেনে নিচ্ছে ও জল দ্বারা ধূয়ে দিচ্ছে। দেখে ভাবলাম, এই না হলে শহর কি করে ধূলিমুক্ত হয়? ঢাকায় কবে এভাবে রাস্তা পরিষ্কার করা শুরু হবে? রাস্তার মিডয়ানে দেখলাম, অসংখ্য ফুলে ভরা। কি অপরূপ সৌন্দর্য। পনেরো মিনিটের মধ্যে হোহাই ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছলাম। রাস্তায় কোনো ট্রাফিক জ্যাম নেই। সিগন্যাল বাতিতে পাড়ি ও মানুষ থামে ও চলে। ট্যাফিক পুলিশের তেমন উপস্থিতি নেই। বিশ্ববিদ্যালয় গেটের আগেই আমাদের গাড়ি থামলো। গাড়ি থেকে নেমে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। ভেতরে কোনো যন্ত্রচালিত যানবাহনের প্রবেশাধিকার নেই। অধিকাংশই হেঁটে যাচ্ছে। কেউ কেউ বাইসাইকেলে করে যাচ্ছে। ছাত্ররা এমনকি অধ্যাপকরাও সাইকেল ব্যবহার করছে। দারুণ ভালো লাগলো দেখে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রয়েছে শুনসান নিরবতা। গাছপালায় ঘেরা। রয়েছে ফুলের সমারোহ। অনেক বড় বড় গাছও রয়েছে। প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে আমরা হোহাই ইআউনিভার্সিটির National Research Centre for Resettlement (NRCR) ভবনে পৌঁছলাম। লোকজনের উপস্থিতি খুবই কম।
NRCR –এর পরিচালক Dr. Go Quing Shi এবং Prof. Shaojun Chen আমাদের স্বাগত জানালেন। আমাদের কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন। হোটেলে আমাদের ঘুম ঠিকমতো হয়েছে কি না, খাবার ঠিক আছে কি না ইত্যাদি। আমরা এ ট্যুরে ছিলাম ড. জামানসহ সাত জন। NRCR-এর আরো দু একজন উপস্থিত ছিলেন। প্রোগ্রামের শুরুতে সবাই সবার সংগে পরিচিত হলাম। Dr. Go Quing Shi আমাদেরকে NRCR সম্পর্কে ব্রিফ করলেন। তারপর Prof. Shaojun Chen NRCR-এর Resettlement Program নিয়ে Power Point Presentation দিলেন। আমরা জানতে পারলাম চীনের বড় বড় প্রকল্পসমূহে লক্ষ লক্ষ মানুষকে স্থানান্তর করা হয়। তাদের পুনর্বাসন করা হয়। সারা দেশে রয়েছে পুনর্বাসন কর্মসূচী বাস্তবায়নের জনবল ও অফিস। রাজধানী, জেলা শহর থেকে শুরু করে কাউন্টি পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে এর কার্যক্রম। তারপর আমরা পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের পক্ষ থেকে আমাতের পুনর্বাসন কর্মসূচী সম্পর্কে আমি Presentation দিলাম। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন ও অন্যান্য সকল সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও জাইকার সামাজিক ও পরিবেশগত নীতিমালার আলোকে প্রনীত পরিকল্পনা সম্পর্কে আমি সংক্ষেপে ধারণা দিলাম। আমরা পদ্মা সেতুর জমি অধিগ্রহনের ফলে ঘরবাড়ি হারানো মানুষদের জন্য পুনর্বাসন সাইট করছি। তাদের সেখানে নামমাত্র মূল্যে প্লট বরাদ্দ দিচ্ছি। রয়েছে শিক্ষা ও চিকিৎসা সহায়তার প্রাতি ষ্ঠানিক ব্যবস্থ।
NRCR একটি গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান। এখানে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, সেমিনার, কর্মশালা ইত্যাদি আয়োজন করা হয়। এ প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডি ডিগ্রিও দেয়া হয়। সরকারের বড় বড় প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারও আয়োজন করে। বিশ্বব্যাংকও তাদেরকে সহায়তা দেয়। সরকারের পুনর্বাসন সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সহায়তা প্রদান করে থাকে। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চীনে উন্নয়ন প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পুনর্বাসন কর্মসূচী এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা বিশ্বব্যাংকের নীতিমালার থেকেও এগিয়ে রয়েছে। Dr. Go Quing Shi এবং Prof. Shaojun Chen বাংলাদেশেও ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন। হোটেল সোনারগাঁও-এ এ ধরণের একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে Prof. Shaojun Chen-এর সংগে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ড. মোহাম্মদ জামান। তিনি ওনাদের সংগে আন্তর্জাতিক ফোরামে কাজ করেন। তাই Prof. Shaojun Chen-এর সংগে পুনঃ দেখা হওয়ায় উভয়ই আনন্দিত হলাম। আমাদের প্রোগ্রামের প্রথম পর্ব এভাবে শেষ হলো। প্রোগ্রাম শেষে চা নাস্তা খেলাম।
আমি ওয়াশ রুমে গেলাম। চীনা ভাষায় লেখা। কিছু বোঝা যায় না। একটা বাথরুমের দরোজা খোলা পাই। খুলে দেখি ভেতরে লোক একজন বসে আছেন শৌচকর্মরত। দরোজা খোলা হলেও তার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। পরে দেখি দরোজায় ভেতর থেকে কোন ছিটকানি নেই। এ কি রকম ব্যবস্থা! দেখে তো অবাক। আমি একটা বাথরুম থেকে বের হলাম সংক্ষিপ্তটা সেরে। বের হয়ে ফিরে আসার সময় দেখি অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে দুজন মহিলা বসে আছেন। তারা একটু মুচকি হাসছেন। বুঝালো আমি যেটাতে গিয়েছি ওটা মহিলাদের বাথরুম। যাক, বাবা। চীনে ভাষাগত বিভ্রাট শুরু হল। আরো সামনে অপেক্ষা করছে কে জানে?
এরপর ক্যাম্পাসটা একটু ঘুরে দেখার জন্য বের হলাম। ক্যাম্পাসের রাস্তাগুলো এত নিরব, নিভৃত যে একটা ভাবগাম্ভীর্য ভাব চলে আসে। রাস্তার দু পার্শ্বে বড় গাছ, ছোট গাছ, ফুল বাগান যেন একটা সৌন্দর্য পুরী। অনেক বড় গাছের সারি দেখলাম। বেশ পুরনো মনে হলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়লো শত শত সাইকেলের সারি। পার্কিং করা। এত সাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ভেবে অবাক হলাম। পরে জানলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী সবাই সাইকেলে করে আসা যাওয়া করে। তাই এই বিশাল সাইকেল পার্কিং এলাকা। এতে সবার শরীর ও ভালো থাকে আবার তা পরিবেশ বান্ধব যানবাহনও বটে। পরিবেশের জন্যও অনেক উপকারী। পরিবেশ দূষণ হয় না। শহরের বায়ুমান ভাল থাকে। এ রকম মানসিকতা যদি আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের থাকতো। স্কুল কলেজের ছাত্ররাই তো সাইকেল ব্যবহার করে না। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের তো কথাই নেই। ওখানে সাইকেল ব্যবহারের পরিবেশও আছে। রাস্তায় রয়েছে সাইকেল মটর সাইকেলের জন্য আলাদা লেন। নিরাপদে সাইকেল আরোহীরা চলতে পারে। রাস্তায়ও তেমন যানযট নেই। এরকম পরিবেশতো আমাতের দেশে নেই। সাইকেলে চলে ছেলেমেয়েরা যে স্কুল কলেজে যাবে তাদের জীবন কি তাতে নিরাপদ। অভিভাবকরা কি তাদের সন্তানদেরকে এভাবে সাইকেলে চড়ে স্কুলে পাঠাতে রাজী হবেন? মনে হয় না। আগে আমাদের রাস্তার পরিবেশ নিরাপদ ও উন্নত করতে হবে। মানসিকতাও পরিবর্তন করতে হবে। তাহলেই এ রকম পরিবেশবান্ধব যানবাহন আমাদের ছেলেমেয়েরাও ব্যবহার করে স্কুল, কলেজ এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেও উৎসাহিত হবে। আমাদের সেই দিনের প্রতীক্ষায় থাকতে হবে।
কৃষ্ণ কান্ত বিশ্বাস– জন্ম মাদরীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার শশিকরে এক মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারে। পিতা হরিবর বিশ্বাস ও মাতা মনতারা বিশ্বাস। শশিকর থেকে এসএসসি ও এইচএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক সম্মানসহ স্নাতকোত্তর এবং বিএড ও এমএড, এসইউবি থেকে এনভায়রনমেন্টাল সাইন্সে মাস্টার্স এবং এনএপিডি থেকে পিজিডি অন প্লানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট কোর্স করেন। মাঠ প্রশাসনে ম্যাজিস্ট্রেসি, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছাড়াও পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে উপ-পরিচালক (পুনর্বাসন) ও সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে যুগ্মসচিব পদে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে মেট্রোরেল প্রকল্পে অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি আমেরিকা, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, সিংগাপুর, জাপান, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম ভ্রমণ করেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ-ভ্রমণকাহিনী পার্ল হারবার থেকে মানালি ।