৫_ এয়ারপোর্টে অভ্যর্থনা শেষে হোটেলের উদ্দেশ্যে যাত্রা
Nanjing Lukou International Airport- এ নেমে আমরা লাগেজ সংগ্রহ করে এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার মুখে আমাদের অভ্যর্থনাকারীদের দেখতে পেলাম। তাঁরা কাগজে লেখা স্টীকার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। আমরা তাদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করলাম। Dr. Shu Fei, Dr. Cai Mengsheng and Dr. Yu Fangmei আমাদেরকে স্বাগত জানাতে এসেছে। ওরা তিনজনই NRCR-এর গবেষক। পিএইচডি করছে। কিন্তু ওদের নামের সাথে ডক্টর লেখা দেখে আমরা জানতে চাইলাম তোমরা তো পিএইচডি করে ফেলেছো। ওরা বললো, না। ওরা NRCR-এ পিএইচডি করছে। ওদের দেশে এটাই নিয়ম। পিএইচডি করাকালীন নামের পার্শ্বে ডক্টর লাগিয়ে দেয়। আমাদের দেশে এরকম নিয়ম নেই ওদের আমরা জানালাম। চীনে পিএইচডি করতে আসা কোনো বিদেশী যদি চীনের বাইরে গিয়ে এটা করে তাহলে তাঁর মর্যাদা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে? যা হোক অভ্যর্থনা শেষে আমরা ওদের আনা গাড়িতে উঠলাম। আমরা এয়ারপোর্ট থেকে পঞ্চাশ মিনিটের ড্রাইভের পর পূর্বে বুক করা নানজিং-এর হুয়াডং হোটেলে উঠলাম। চার তারকা বিশিষ্ট হোটেল। চেক ইন করলাম। পরিবেশ ভালো। আশে পাশে বেশ খোলামেলা। রিসিপশন কাউনটারে যাঁরা আছে তাঁরা মোটামুটি ইংরেজি বোঝে। আমরা হোটেল রুমে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ পর সংবাদ পেলাম, ড. জামান সাহেব হোটেলে চলে এসেছেন। তাড়াতাড়ি নিচে গিয়ে তাঁর সাথে কথা বললাম। কী হয়েছিলো এবং কীভাবে সমাধান হলো? ড. জামান সাহেব বললেন, আসলে সমস্যা কিছুই না। মূলত কানেক্টিং ফ্লাইটে সিট বুকিং-এ একটু ভুল হয়েছিল। এ কারণে তিনি ঐ ফ্লাইটে আসতে পারেননি। পরবর্তী ফ্লাইটে সিট ম্যানেজ করে দিয়েছে। আমরা অনেকটা স্বস্তি বোধ করলাম। তিনি চেক ইন করে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হ্ওয়ার পর আমরা সবাই রুম থেকে নিচে নামলাম। ডিনার করার জন্য পূর্ব নির্ধারিত রেস্টুনেন্টে যেতে হবে। NRCR-এর Prof. Shaojun Chen ও এসেছেন। তিনি আমাদের সবার সাথে পরিচিত হলেন। চীনে আমাদের প্রোগ্রাম সম্পর্কে ব্রিফ করলেন। তারপর আমরা সবাই রেস্টুরেন্টে গেলাম ডিনার করতে।
রেস্টুরেন্টের সামনে নেমে তো আমরা অবাক। বাইরে থেকে দেখতে রেস্টুরেন্টটি অনেক আকর্ষণীয় ও চকমকি। ঢুকতেই দেখা গেল নিচে বিভিন্ন একুইরিয়ামে বিভিন্ন রকমের মাছ, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি। পরে জানলাম এগুলো দেখে ক্রেতারা খাবারের অর্ডার দেয় কোনটা খাবে। আমাদের ফ্যাসিলিটেটরকে খাবারের ব্যাপারে পরামর্শ দেয়া ছিল। বিফ বা পর্ক বাদে অন্য খাবারের অর্ডার দিতে বলা আছে। মাছ, মুরগী এবং সবজির মেন্যুকে প্রাধান্য দিতে বলা হয়েছে। আমরা খাবার টেবিলে বসলাম। গোলাকৃতি অনেক বড় টেবিল। টেবিলের চারপার্শ্বে আট দশ জন বসা একটি চেয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত থাকে। তাঁর পার্শ্বে ক্রমান্বয়ে জুনিয়রদের বসার নিয়ম। খাবার টেবিলেও এ রীতি মেনে চলা হয়। টেবিলের উপর একটি গোলাকার কাঁচ যা ঘোরানো যায়। প্রত্যেকের সামনে স্যুপের বাটির মতো বাটি, হাফ প্লেট, চপস্টিকস ও চামচ রয়েছে। ভাত খাবার মতো কোন প্লেট নেই। আমরা দেখে ভাবছি ভাত খাবো কিভাবে? এরপর আস্তে আস্তে খাবার মেন্যু আসতে থাকলো গরম গরম। প্রথম দিকে ফ্রাই জিনিসগুলো আসতে থাকে। একটা ডিস আসে আর সেটা সবার সামনে দিয়ে ঘুরিয়ে দেয়া হয়। যে যার মতো ঐ ছোট্ট বাটিতে নিয়ে নেয়। সেটা আবার চপস্টিকস দিয়ে খেতে হয়। কেউ চপস্টিকস ব্যবহার করতে পারছে, কেউ আবার কাটা টামচ ব্যবহার করছে। আমি প্রথমেই চপস্টিকস ব্যবহার শুরু করলাম। দেখি পারা যাচ্ছে। প্রথমে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, ফিস ফ্রাই, এরপর অর্ধ সিদ্ধ শাক, আস্ত মাছের কারি, নুডুলস, চিকেন কারি, হাঁসের কারি ইত্যাদি একটার পর একটা আসতেই থাকে। কিন্তু যেটা আসে না সেটা হল ভাত। এ খাবারে আমাদের অনেকেই অভ্যস্ত নয়। আমি কিন্তু ভালোই উপভোগ করছি। আমেরিকাতে ও আমার খাবারে কোন অসুবিধা হয়নি যে স্টেটেই যাইনা কেন। মাংসের তরকারিগুলো একটা বড় ডিসে অনেক ঝোলের মধ্যে। সিদ্ধ ভালোই কিন্তু আমাদের দেশের মতো স্বাদের নয়। আবার স্বাদ একেবারে খারাপও নয়।
এভাবে পনেরো বিশ আইটেম খাবার আসার পর একটা ছোট্ট ডিসে স্টিকি রাইস এলো। দেখলাম চাইনিজরা ছোট্ট বাটিতে করে কিছু খালি ভাত নিয়ে চপস্টিকস দিয়ে খাচ্ছে। আমাদের অনেকেই অবাক হচ্ছে এ খাবার দেখে। এরপর কিছু কেক, পেস্ট্রি ও সুইট এলো। আমাদের খাওয়া হলো। আমি ভালোই খেলাম। কোন সমস্যা হলো না। হোটেলে এসে জানলাম আমাদের গ্রুপের বেশ কয়েকজন খুব একটা খেতে পারেনি। খাবারে একটা কিরকম গন্ধ পেয়েছে। যাহোক চীনে আমাদেরকে এরকম খাবার খেয়েই এক সপ্তাহ কাটাতে হবে। Prof. Shaojun জিজ্ঞাসা করলেন, খাবার কেমন হয়েছে? আমি বললাম ভালোই। আমার কোন সমস্যা হয়নি, বেশ এনজয় করেছি। এরকম হলে কোন সমস্যা নেই। তিনি বললেন, ধন্যবাদ। চীনের খাবার পছন্দ হওয়ার জন্য। আসলে আমরা আমাদের দেশে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে যে খাবার খাই সেটা আসলে মূল চাইনিজ খাবারের ধারে কাছেও নেই। আমাদের দেশের চাইনিজ খাবার বলা যায় বাংনিজ খাবার অর্থাৎ বাংলা ও চাইনিজ- এর সংমিশ্রণ হয়ে বাঙ্গালিয়ানাই বেশি প্রকাশ পেয়েছে। যাহোক, চীনদেশে এসে চীনের খাবারের স্বাদ পেলাম। যদিও চীনাদের নিজস্ব খাবার আমরা খেতে পারবো না। তাঁরা তো শামুক, ঝিনুক এমন কি সাপও খায়। আরো কত কী? রেস্টুরেন্টের নীচে একুইরিয়ামের দিকে তাকালেও গা ঘিন ঘিন করে।
Prof. Shaojun আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন আগামীদিনের প্রোগ্রামের বিষয়ে কিছুটা ব্রিফ করে। হোটেলে ফিরে রাত্রে কিছুটা পায়চারী করলাম। নানজিং এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল পর্যন্ত আসা ও হোটেল থেকে রেস্টুরেন্টে যাওয়া এসময় রাস্তায় তেমন কোনো ট্রাফিক জ্যাম চোখে পড়েনি। রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কোথাও ময়লা আবর্জনা নেই। রাস্তায় কোন ডাস্ট বিনও চোখে পড়েনি। হাঁটাহাঁটি করেত করতে প্রায় রাত বারোটা বেজে গেছে। হোটেলের পেছনের বড় রাস্তায় চোখ পড়লো। দেখি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের কাভার্ড এসেছে ময়লার কন্টেইনার সংগ্রহ করতে। রাস্তার পার্শ্বে বড় বড় ড্রামে ময়লা ভর্তি করা আছে। সেই ড্রামগুলো ময়লার কন্টেইনারে ঢাকা অবস্থায় সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছে। কোনো ময়লা বাইরে পড়ে যাওয়ার বা দুর্গন্ধ ছড়ানোর সৃযোগ নেই। এগুলো আবার নিয়ে যাবে রি-সাইক্লিং সেন্টারে। এরই নাম আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। শহরের মানুষের জীবনে শান্তি ও স্বস্তি এনে দিতে পারে এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। এই বর্জ্য থেকে উৎপাদিত হবে সার, বিদ্যুৎসহ পুনঃব্যবহারযোগ্য জিনিস। এভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে বর্জ্য দায় না হয়ে সম্পদে পরিণত হয়। কবে আমাদের দেশে এই পদ্ধতিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা হবে? আমরা কি এরকম পরিচ্ছন্ন শহরে বসবাস করতে পারবো? আমাদের ঢাকা কি এরকম পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারে না?