গ্রামের নাম উজালপুর। ছোট্ট একটি গ্রাম। বড় বড় গাছপালা ও ঝোপঝাড়ে আবৃত শান্ত সুনিবিড় গ্রামটি। মাঝে মাঝে ঘন বাঁশঝাড়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ, দু’ধারে তার ঘন সবুজ ঘাস। অবশ্য চৈত্র-বৈশাখ মাসে ঘাসের রং আর সবুজ থাকে না, ধুলিময় মাটির পথের কারণে ধুলার আস্তরণে ঘাসের বর্ণও পরিবর্তিত হয়ে সাদা হয়ে যায়। পুকুরের ঘোলা পানিকে আরও ঘোলা করতে ব্যাস্ত থাকে পাতি হাঁসের দল। দোয়েল, শালিক, ফিঙে, হাঁড়িচাচা, বুলবুলি, ঘুঘু, চুড়ুই পাখি ছাড়াও অসংখ্য নাম না জানা পাখির কলরবে মুখরিত থাকে সবসময়।
এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষক। তেমনি একজন কৃষকের নাম ‘জছি’। আসলে তার প্রকৃত নাম জসিম উদ্দিন, গ্রামের লোক জছি বলে ডাকে। সাধারণত গ্রামের লোক যেকোনো নামকে সংক্ষেপ এবং অনেক ক্ষেত্রে কিছুটা বিকৃত করে ডাকতে ভালোবাসে। দেখা গেছে গরীব মানুষ অনেকে নিজের ভালো নাম বা প্রকৃত নাম বলতে এবং শুনতেও লজ্জা পায়। ছিপছিপে গড়ন, হাতে গোণা সামান্য চুল বিশিষ্ঠ্য মাথা, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। তার একটি মাত্র মেয়ে, নাম তার জোসনা। সবে মাত্র দশ বছরে পা দিয়েছে সে। স্ত্রী কন্যা নিয়ে অভাবের সংসার হলেও সুখের অভাব নেই। পরিবারের এ তিনজন সদস্য ছাড়াও আরও তিনজন সদস্য আছে। একটি গরু, একটি কুকুর ও একটি টিয়া পাখি। তিনজনই বেশ পোষা। টিয়া পাখিটি পোষা হলেও কথা বলতে পারে না। তবে জোসনার খুব ভালো খেলার সঙ্গী সে। মানুষ না হলেও এরা পরিবারের সদস্যের চেয়ে কোনো অংশে কম আদরের নয়।
নিজের জমি নেই, পরের জমিতে কাজ করে জছি। সকালে উঠে কিছু পান্তা গামলায় সাজিয়ে নিয়ে গামছা দিয়ে বেঁধে লাঠির সাথে ঝুলিয়ে নেয় সে। অন্য হাতে থাকে গরুর দড়ি। যে মাঠেই সে কাজ করতে যায় সে মাঠেই গরুটিকে নিয়ে গিয়ে ঘাস যুক্ত স্থানে বেঁধে রাখে। সারাদিন পর বাড়ি ফিরবার সময় আবার তাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে। আর কুকুরটির কথা তো বলাই বাহুল্য। সেই ছোট্ট ছানাটিকে যখন পথের ধারে পেয়ে নিয়ে এসেছিলো, সেই থেকে আজঅব্দি কুকুরটি যেনো তার মনিবকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। প্রভুভক্ত কুকুরটি মাঝে মাঝে তার মনিবের সঙ্গে মাঠে চলে যায়, আইলে বসে বসে ঝিমায় আর সবার কাজ করা দেখে। বেজায় সাহসী ও ক্ষিপ্র দৃষ্টি তার চোখে মুখে। শেয়াল বেজি তো দূরের কথা অন্য কুকুর বা বেড়ালও তার ভয়ে কৃষকের বাড়ির সীমানায় আসতে ভয় পায়।
প্রাচীর ঘেরা ছোট্ট বাড়ি। ঘরে মাটির দেয়াল, তবে সম্প্রতি খড়ের পরিবর্তে টিনের চাল লাগিয়েছে সে। বাড়ির সামনে কিছুটা পরিত্যাক্ত ফাঁকা জায়গা, তার পরেই ঢালু হয়ে মাঠের শুরু। ঢালুর উপরে একটি আমগাছ। গাছটি বেশ পুরোনো এবং উঁচু।
এখন বৈশাখ মাস। অনেক গাছের মতো এই গাছটিতেও আম ধরেছে অনেক। কিন্তু আমগুলো কাঁচা অবস্থায় এতো টক যে দুষ্টু ছেলেরাও সেগুলো খাবার সাহস করে না। তবে ভালোভাবে পাকলে সেগুলো খেতে মন্দ নয়। ছোট ছোট চেহারার আমগুলো বেচতে গেলেও ভালো দাম মেলে না। সবকিছু দেখে শুনে কৃষক আম গাছটি বেচে দেবার কথা ভাবছিলো।
একদিন দুপুরে খুব গরম পড়েছে। জোসনা ও তার বাবা আম গাছটির নিচে বসে বাতাস খাচ্ছে। এমন সময় জোসনা বলে উঠলো-
আব্বা, আপনে নাকি গাছটা কাইট্টা ফালাইবেন?
হ মা, গাছটাতো তেমন কাজে লাগে না। তাছাড়া এই সময় আমার হাতের অবস্থাও ভালা না। তাই ভাবলাম…
কিন্তু আব্বা গাছ না থাকলে এই এতো সুন্দর বাতাসডা কই পাইবেন।
হ মা, এই গাছডার লাইগ্যা বৈশাখ মাসের ভর দুপুরেও বাতাসে শরীরডা জিরান যায়। তয় দেখি কী করণ যায়। অহন তুই আমার লাইগ্যা একটা পান সাজাইয়া লইয়া আয়তো মা।
জোসনা দৌড়ে চলে যায় বাড়ির ভেতর। জছি আনমনে কী যেন ভাবতে থাকে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকতে শুরু করেছে। শুনশান নীরবতা। জোনাক পোকাগুলো মিটমিট করে আলো দিতে দিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক-সেদিক। কৃষকের কুকুরটিও তার ডিউটি দিতে শুরু করেছে। সন্ধ্যার পর তার ডিউটি খুব বেশি কিছু না। বাড়ির পারপাশে একবার করে প্রদক্ষিণ করা, তারপর বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করে বারান্দার এক কোণে চুপটি করে বসে ঝিমানো।
রাত্রি তখন আট অথবা তার কিছু বেশি হবে। কৃষক পত্নী রান্না বসিয়েছে, চলছে মাছ ভাজা পর্ব। রাত হলেও প্রচন্ড গরম যেন কমছেই না। আর এর মধ্যে মাছ ভাজার গন্ধে চরদিকে যেন ম-ম করছে। গন্ধটি এতো দূর ছড়িয়েছে যে পাশের বাড়ির হুলো বিড়ালের কাছে পৌঁছতেও বাঁকি রাখেনি। গন্ধ অনুসন্ধান করে বিড়ালটি পৌঁছে গেলো কৃষকের বাড়ির দরজায়। অমনি কুকুরটি উচ্চস্বরে ঘেউঘেউ করে তাড়া করলো তাকে। প্রাণ ভয়ে বিড়াল আর যাবে কোথায়? কষে এক দৌড়ে উঠলো গিয়ে আম গাছে। তারপর যা হবার তাই হলো, কুকুরটি আর ধরতে না পেরে গাছের নিচে কিছুক্ষণ ঘেউঘেউ করে শেষে ফিরে এসে চুপটি করে বারান্দায় বসে পড়লো।
কৃষক(জছি) কুকুরের চিৎকার শুনে বাহিরে বের হতে লাগলো।
‘কুত্তা চিল্যায় ক্যা, দেইখ্যা আসি চোর ডাকাত নয়তো?’
‘গরীবের বাড়ি চোর ডাকাত আইসা কী করবো? থাউক যাওনের দরকার নাই। সন্ধ্যার পরে বাইরে অনেক কিছু ঘোরাফেরা করে। আমরা সেগুলারে দেখতে পাই না কুত্তা বিলি দেখতে পায়।’ কৃষকের বউ উত্তর দেয়।
আরে কীযে কও এগুলা! এই বলে কৃষক কথাটি উড়িয়ে দিলেও মনে মনে বিষয়টি ভাবতে ভাবতে বাইরে চলে যায়।
এদিকে কুকুরের ভয়ে বিড়ালটি সেই যে আমগাছে উঠেছে আর কিছুতেই নামতে পারছে না। আবার কুকুরের ভয়ে ম্যাও.. ম্যাও.. করে ডাকতেও পারছে না। তবে কাছাকাছি যে মোটা ডাল রয়েছে সেখানে এসে নামার জন্য সুযোগ খুঁজছে।
কৃষকটি বাইরে এদিক সেদিক দেখলো কিন্তু কাউকেই খুঁজে পেলো না। অবশেষে প্রচন্ড গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ভাবলো, আম গাছের নিচে কিছুক্ষণ বসে গা টা একটু জুড়িয়ে নিই। বসলো গিয়ে গাছের নিচে। এদিকে বিড়ালটি খুঁজছিলো সুযোগ, কখন নামতে পারবে। এমন সময় সে কৃষকের স্বল্পকেশী মাথাকে তার নিকটবর্তী অবলম্বন মনে করে বসিয়ে দিলো ঝাঁপ। কৃষকটি আচমকা এই ঘটনায় হকচকিয়ে উঠে ‘ওরে বাবারে…’ বলে দে দৌড়। সে এতাটা আতঙ্কিত হয়ে পরে যে অন্ধকারে সেটা কী ছিলো তা দেখার মতো সাহস করে উঠতে পারেনি তখন।
এক দৌড়ে সে বাড়ির মধ্যে এসে বারান্দায় পড়ে যায়, সংজ্ঞা হারানোর মতো অবস্থা। তার বউ ‘কী হইছে’ বলে ছুটে আসে, দেখে কৃষক হাঁপাচ্ছে। ঘরের ভেতর থেকে জোসনা ছুটে আসে। কৃষকের বউ জোসনাকে বলে, ‘মা’রে একটু পানি আন জলদি, তোর আব্বার কীযেন হইছে’। কৃষকের বউ আবার জিজ্ঞেস করে,‘কী হইছে আপনের? আমারে কন’। কৃষক শুধু বলে,‘আমি ঠিকমতো কইতে পারুম না। ওই আম গাছে বড় কোনো কিছু আছে। ভারী তার হাত। বড় বড় নোখ। গাছের উপর থাইক্যা আমার মাথায় থাবা মারছে। আর কিছু কইতে পারি না।’ জছি হাঁপাতে থাকে। এই কথা শুনে কৃষকের বউ বলে,‘খুব বাঁচা বাইচ্যা গেছো। তোমারে আগেই কইছিলাম সন্ধ্যার পর বাইরে অনেক কিছু ঘোরাফেরা করে। ওইডা নিশ্চিত গেছো পেত্নী আছিলো। আম গাছে শেষ রাতে আমিও একদিন দেখছিলাম। লাল-লাল চোখ। ওই গাছেই ও থাকে। এতোদিন আপনারে কিছু কয় নাই কিন্তু আজ মাছ ভাজতেছিলাম তাই আপনারে খামছা মারছে। মাছ ভাজার গন্ধে ওদের আবার মাথা ঠিক থাকে না।’ মাথার উপর বিড়ালের আঁচড় দেখে কৃষকের বউ বলে, ‘এইতো দেখতাছি নোকের আঁচড়ের দাগ। কেমন রক্ত বার হইতাছে। ইশিরে! পেত্নীর আঁচড় দ্যাখলেই চেনা যায়।’ ইত্যাদি।
পরদিন এই খবরটি সমস্ত গ্রাম রটে যায়। সেই থেকে সন্ধ্যার পর আর কেউ আম গাছটির নিচে যায় না। শুধু তাই নয় এখন পর্যন্ত গাছটি কৃষক আর বিক্রয় করেনি বা কেউ কাটেনি।