বৈশাখের দুপুর ভেঙে অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। যতদূর চোখ যাচ্ছে কেবল ধোঁয়ার মতো উড়ে যাচ্ছে বৃষ্টি। চারপাশে জুড়ে সুনসান নিরবতা। কেউ কোথাও নেই। কারো কোনো কাজের তাগিদ নেই, কারো কোথাও যাবার নেই। সময় গড়াচ্ছে বৃষ্টির তোড়ে। কিন্তু পৃথিবীটা যেনো থমকে আছে শিমুলডাঙার পথে পথে। এই থমকে যাওয়া সময়েও কেউ কেউ দূর পথ পাড়ি দেন মনে মনে। চলে যান দূরে বহু দূরে।
এই এক সময় এসেছে- দুপুর নেই, রাত নেই, ভোর নেই, সকাল নেই কোনো সময় অসময় নেই হুটহাট চলে আসে বৃষ্টি। আকাশটাকে অন্ধকার করে দিয়ে নেমে আসা বৃষ্টি সব কিছু কেমন গতিহীন করে দেয়। কখনো তো শুকোতে দেয়া ধানগুলোও উঠানোর সময় দেয় না। কখনো ছাদের কাপড় আনার আগেই ভিজে শেষ। কতো কিছু ঘটিয়ে দেয় এই বৃষ্টি। বলে তো শেষ করা যাবে না। তবুও বৃষ্টি আসবে আসুক না।
গত দুদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে।ফসল তোলার উৎসবে বৃষ্টি এলে কি ঝামেলাই না পোহাতে হয়। রান্না-খাওয়া ছাড়া কোনো কাজ নেই আর রমা চক্রবর্তীর। দুপুরের খাওয়া শেষ হতেই আবার বৃষ্টি নেমেছে। পানের খিলিটা মুখে দিয়ে জানলার পাশে এসে শুয়ে পড়লেন। ঘরের মধ্যে সেদ্ধ করা ধানগুলো শুকোতে দিতে পারেন নি, কেমন একটা গন্ধ ছড়াচ্ছে ঘরজুড়ে। টিনের চালে অঝোরে ঝরে যাচ্ছে বৃষ্টি।চোখে কেমন তন্দ্রা নেমে এলো। বয়স হয়েছে, অল্পতেই কেমন ক্লান্ত হয়ে যান রমা। কেবল শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে তার।ঘুম ঘুম চোখে হঠাৎ একটা মুখ ভেসে উঠলো, সুনীলের মুখ।স্বপ্নের মধ্যে কি যেনো সে বলতে চাইছে রমাকে। আঁতকে ওঠে ঘুম ভেঙে গেলো রমার।সুনীল কেনো আসে আজকাল স্বপ্নে, কী বলতে চায় তাকে। উঠে বিছানায় বসে আবার জানলা দিয়ে তাকালেন রমা। না, বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই।বরং আরো বাড়ছে বৃষ্টির তোড়। তিনি বাইরের দিকে তাকিয়েই রইলেন, কতো কথা মনে আসছে, না চাইতেও আসছে। শিমুলডাঙার মাটির পথে পথে শরীর ভিজিয়ে রমা আঁকছেন তার শৈশব, কৈশোর, যৌবন আর ক্লান্তির ছবি। কেন যেন জীবন তাকে ভাবায় আজকাল। কী পেলেন এই ষাটোর্ধ্ব বয়সের জীবনে। জীবন তাকে কী দিয়েছে। কেবল নিজের জন্য কী সঞ্চয় তোলা আছে তার। নিজের বলতে কি সত্যিই কিছু আছে কি না তা বুঝতে পারেন না রমা। সব কি পেয়েছেন, নাকি এখনো অনেক অপূর্ণতা রয়ে গেছে তাও আজ ভাবায় তাকে।সন্ধ্যা হওয়ার খুব বেশি দেরি নেই। জানলাটা বন্ধ করতে চেয়েও করলেন না।ঠান্ডা বাতাসটা বেশ ভালো লাগছে। আজকাল অদ্ভূত রকমের ভালোলাগা ভর করে রমাকে।কেন করে জানেন না রমা।
শৈশব আজ তাকে ডাকছে। খুব মনে পড়ছে বাবা মায়ের কথা, ভাই-বোনদের কথা। এমন বৃষ্টির দিন এলে মা তাদের ভাই-বোনদের মুড়ির সাথে বড়া-ভাজি করে দিতেন। এমন কতো সন্ধ্যা বোনেরা কাঁথা গায়ে গল্প করে বা পুতুল খেলে কাটিয়েছেন।কোথায় গেলো সেসব দিন। কোথায় যেন হারিয়ে গেলো রমা চক্রবর্তীর নাম।আজ তিনি নুরজাহান বেগম রমা, ওসমান আলীর কাছেই ছিলেন শুধু রমা।
বৃষ্টির বেগ ক্রমে বাড়ছে। দূরে মাইকে ভেসে আসছে আজানের ধ্বনি।অন্ধকার নেমেছে শিমুলডাঙার বুক জুড়ে। বিকেল থেকে বিদ্যুতের দেখা নেই। রমার ঘরগুলোতে কেমন ভুতুড়ে অন্ধকার। এই অন্ধকারই আজকাল ভালো লাগে রমার। বিদ্যুৎ থাকলেও নিজের রুমের আলো নিভিয়ে রাখেন রমা। অন্ধকারকেই তার খুব আপন লাগে এখন। কাজের ছেলে রহিমের ডাকে রমার ঘোর কাটলো, রহিম বললো- চাচি আম্মা, সন্ধ্যা হয়ে গেছে; সোলারের লাইটগুলো কি জ্বালিয়ে দেবো।
রমা শুধু হু বললেন। বললেন- আমার রুমে লাইট জ্বালানোর দরকার নেই।
রহমত বললো- চা বসিয়েছি চাচি আম্মা, আপনি ওঠে হাতমুখ ধুয়ে নিন।
রমার উঠতে ইচ্ছে করছিলো না। বললেন- ঠান্ডা লাগছে, চা হলে এখানেই দিয়ে যাস।
রমার আজ পুরোনো দিনগুলোতে ডুবে যেতে ইচ্ছে করলো। এই বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যা শরীরকে জাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।কতো কথা মনে আসছে রমার। ওসমান আলী নেই দুই বছর চলছে। এতো বড় বাড়িতে রহিমকে নিয়ে একা থাকেন রমা। চারপাশের এই শূন্যতা রমাকে আজকাল খুব কষ্ট দেয়। মেয়ে ছিলো, তারও বিয়ে হয়ে গেছে প্রায় তিন বছর হলো। ওসমান আলীর আগের পক্ষের দুই ছেলে ছিলো, ওসমান আলী মারা যাবার পর থেকে তারাও শহরে থাকে। এক রহিম আছে ছোটোবেলা থেকে। নিজের বলতে আর কী আছে রমার, এতো বড় বাড়িটাকে আগলে পড়ে আছেন একা। কেউ নেই, সত্যি আজ কেউ নেই রমার। তিনি একা, ভীষণভাবে একা। বেঁচে থাকার কোনো কারণ খুঁজে পান না রমা। এক অপরাধবোধ আজো তাকে তাড়া করে। পালাতে চেয়েও পারেন না রমা। কোথাও যেন আটকে আসে পা। প্রথম সন্তানের মুখ, ভালোবাসা আর আদর।
রমা চক্রবর্তী। শিমুলডাঙার পুরোহিত রামেন্দু চক্রবর্তীর মেয়ে। তিন ভাই তিন বোনের মধ্যে রমা ছিলেন সবার ছোটো। লম্বা আর উজ্জ্বল শ্যামলা রঙের রমার নাক মুখে প্রতিমার মুখের আদল ছিলো। বাবা তাই নাম রেখেছিলেন রমা। ছোটকাল থেকে রমা লক্ষ্মী মেয়েই ছিলো। সময় গড়াতে লাগলো। বড় হতে লাগলো রমা। খেলার সাথীদের সাথে খেলতে খেলতে রমা কখন যেন শৈশব পেরোতে লাগলো। শিমুলডাঙার বাতাসে বসন্ত লাগলো। বদলাতে লাগলো রমার ভেতর বাহির। কী এক স্রোত রমাকে ভাসাতে লাগলো। কোনো বাধা মানতে দিলো না। পথে যেতে যেতে যে ছেলেটা বারবার তাকে দেখে যায়, হাসি লুকিয়ে কিছু একটা বলতে চায় তার কথা কিছুতেই ভুলতে পারে না রমার ছোট্ট মন। কেমন একটা অনুভব হয় ভেতরে ভেতরে। বসন্ত যে ডাক দিয়েছে রমাকেও, সে খোঁজ তো কেউ রাখে না। বসন্তের পর আবার বসন্ত এলো। রমা কৈশোরে পা দিয়েছে। যুবক ছেলেটা এখনো রমাকে লুকিয়ে দেখে যায়। হয়তো কথার পিঠে কিছু কথাও হয়। কিন্তু কিছু একটা কথা হয় তাদের মনে মনে।রমা বুঝলো ওসমান আলী তাকে ভালোবাসে। সেও ভালোবাসে ওসমানকে।
ওমমান আলী শিমুলডাঙারই ছেলে। তার বাবা গ্রামের মেম্বার। প্রভূত সম্পত্তির মালিক। ওসমানের স্কুলের পথে রমাদের বাড়ি। সেই কবে থেকে রমাকে সে ভালোবেসে বসে আছে। রমাও তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। কিন্তু হিন্দুর মেয়ের সাথে প্রেম, তার কি পরিণতি পাবে কি না জানে না ওসমান। তবু সে মন থেকে ভালোবাসে রমাকে। রমাও আজকাল ওসমানের স্কুলের পথে সময় গুণে। কখনো সবার চোখ পালিয়ে ওসমান তাকে দিয়ে যায় ছোটো একটা চিঠি। কখনো লুকিয়ে রাতের বেলায় দেখা করে তারা। কোনো কোনো সন্ধ্যায় বেড়ানোর ছলে ওসমান আসে রমাদের বাড়ি। রমার বড়দাদার সাথে একসাথে পড়াশুনা করে সে। রমাদের বারান্দায় বসে গল্প করে। রমার হাত দিয়ে আসা এটাওটা খেয়ে রমাকে দেখে চলে যায়। এভাবেই দিন গড়ায়। বসন্তেও আসে পালাবদল। তুমুল বৃষ্টির দিনে ভিজে ভিজে ওসমান আসতো রমাদের বাড়ির পেছন দিকে। তাও রাতে। এমন নিভৃত গ্রামে মাঝরাতের এই দুই যুবক-যুবতীর প্রেম কাহিনির খোঁজ কে রাখতো। প্রেম যেন সব ভয় জয় করে, ওরাও তথৈবচ। তখনও এই নবীন যুগল জানতো না, কী হতে চলেছে তাদের জীবনে। তবু তারা ভালোবাসতো, ভীষণভাবে ভালোবাসতো পরস্পরকে।
রমা-ওসমানের এই অগোচর প্রেমলীলার দিনগুলোতে দেশজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতাও বাড়ছিল। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছিল সেসব খবর। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর থেকে আরো বাড়তে থাকে অস্থিরতা। হিন্দুরা নিজেদের নিরাপদ জীবনের খোঁজে দলে দলে পাড়ি জমাচ্ছে ভারতে। নানা বিছিন্ন ঘটনায় তারা পরিবার নিয়ে দেশ ছাড়ছে। দৃশ্যগুলো দ্রুত বদলে যেতে থাকে। এ দেশ যেন পাকিস্তানের, কেবলই মুসলিমদের। চাইলেও অনেকে সে মানসিকতা পরিবর্তন করতে পারলো না। শান্ত গ্রামের বাতাসও কেমন ভারি হতে লাগলো। সাম্প্রদায়িক বিষে শিমুলডাঙা এক অচেনা জনপদ হয়ে উঠলো।
রামেন্দু চক্রবর্তী ঠিক করলেন এবার ছোটো মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবেন। কর্তব্য ফেলে রাখবেন না আর। মেয়ে তার পনেরো বছরে পা দিয়েছে। পড়াশুনাও করেছে অল্পবিস্তর। ঘরে না রেখে এবার বিয়ে দিয়ে দেয়াই ভালো। পাত্রও দেখেছেন, এবার পাকা কথার পালা। মেয়ের বিয়ে নিয়ে এক কথার মানুষ রামেন্দুর কথাই যেন শেষ কথা। কিন্তু রমা যে ওসমানকে ভালোবেসে বসে আছে। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। কি করবে এখন রমা। কি করা উচিত তার জানে না সে। দুদিন পর ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে। বাইশ বছর বয়সী ওসমানকে খবর পাঠালেন রমা। ভালোবাসার রণভূমে হঠাৎই রমা যেনো অনেক বেশি পরিণত এখন। কোথায় তার বাকি সব উড়ে গেছে। ভালো মন্দের তফাত সে জানে না। হিন্দু-মুসলিমের দ্বিজাতিতত্ত্ব সে বুঝতে চায় না। সে শুধু জানে, ওসমানকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
সেদিন ছিলো আষাঢ়ের সন্ধ্যা। সারাদিন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিলো। সন্ধ্যার পর বৃষ্টি আরো বাড়লো। ওসমান সময় মতো রমাদের বাড়ির পেছন দিকটায় গেলো রমার সাথে দেখা করতে। রমা বৃষ্টি মাথায় করে এলো ওসমানের কাছে। সব কিছু খুলে বললো ওসমানকে। জোতদার পরিবারের ছেলে হয়েও প্রেমের জন্য অনায়াসে কতো কষ্ট সহ্য করছে। বৃষ্টিতে ভিজে রমার সাথে চলছে তার আলোচনা। কী করবে ওসমান বুঝতে পারছে না। রমা কাঁদছে, কাঁদছে আষাঢ়ের সন্ধ্যা। রামেন্দু বাবু কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলেন। ফেরার পথে বাড়ির পেছন দিকটায় হঠাৎ শুনলেন কারা যেনও কথা বলছে। একটু এগিয়ে গেলেন। হাতের টর্চ ধরলেন এদিক ওদিকে। দেখলেন তার মেয়ে রমা আর ওসমান আলী মুখোমুখি বৃষ্টিতে ভিজছে। রমাও দেখলো তার বাবাকে। কিছুই বুঝতে বাকি রইলো না রামেন্দু বাবুর। কেবল বললেন- রমা ঘরে চল। আর ভারি গলায় বললেন- ওসমান বৃষ্টিতে না ভিজে বাড়ি যাও। গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন মেম্বারের ছেলে ওসমান, তাকে বেশি কিছু বলতে সাহসও পেলেন না। রমা ঘরে গেলো ঠিকই, কিন্তু রামেন্দু বাবুর কাছ থেকে কথাগুলো তার পরিবারের কাছে যেতে সময় লাগলো না। রমার হেনস্তারও শেষ থাকলো না। অবশেষে ওসমানকে ছেড়ে রমা চক্রবর্তী শ্রাবণ মাসের এক শুভ লগ্নে সুনীল চক্রবর্তীর সিঁদুর মাথায় নিয়ে শিমুলডাঙা ছেড়ে পলাশপুরের পথে যাত্রা করলো। সাথে নিলো ওসমানের স্মৃতি, আর সেইসব আষাঢ়ের অবিরল ধারার মতো চোখের জল।
ওসমান আর রমার সম্পর্কের কথা গ্রামের অনেকে জেনেও না জানার ভান করতো। ওসমান রমার বিয়ে আটকাতে চেয়েছিলো, রমাও প্রেমিকের হাত ধরে পালাতে চেয়েছিলো। রামেন্দু বাবু শেষ পযর্ন্ত ওসমানের বাবা আজিত আলীর কানে খবরটা তুলে দেন। তিনি গ্রামের মেম্বার। সবদিক বিবেচনা করে তাকে চলতে হয়। ছেলেকে সামনে রেখে রামেন্দু বাবুকে কথা দিলেন বিয়েতে ওসমান কোনো সমস্যা করবে না। রামেন্দু বাবু আর আজিত আলীর প্রবল প্রতিরোধের মুখেও সেদিন কিন্তু ওসমান আর রমার চোখের জলে হিন্দু-মুসলিমের কোনো ভেদ ছিলো না। কেবল যন্ত্রণা লুকানো চোখগুলোই সত্যি ছিলো। বিয়ের পর দিন শিমুলডাঙা ছেড়ে যাবার সময় রমা খুব কেঁদেছিলো। তার সেই কান্নায় প্রতিবেশীরাও ওসমানের গন্ধ খুঁজে নিয়েছিলো। আপনজন আর প্রিয় গ্রাম ছেড়ে যাবার যন্ত্রণা নিয়ে রমাকে সেদিন যেতে হয়েছিলো, চোখের জলের উৎস তো বুকের খুব গভীরে জমা থাকে। রমারও ঠিক তা-ই ছিলো।
এভাবেই কাটছিলো দিন। মেয়ের বিয়ে দিয়ে রামেন্দু বাবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। ধর্ রক্ষা করেছেন তিনি। পূর্পুরুষদের নরকে যাবার হাত থেকে রক্ষা করেছেন।পুরোহিতের কাজ তিনি ক্রমে ছেড়ে দিলেন। তার দায়িত্ব পরলো বড় ছেলের হাতে। কিছুটা নিজেকে আড়ালেও রাখতে চাইলেন তিনি।কেমন কাটছিলো রমা ও সুনীলের সংসার সে খোঁজ রাখার দরকার মনে করেন নি তিনি। পারতে রমাকে আনতেও চাইতেন না শিমুলডাঙায়, পাছে সুনীল রমা আর ওসমানের কথা যেনে যায়।পলাশপুর রমার আপন হয়ে উঠতে পারেনি। রমার মন পড়ে থাকতো নিজের গ্রামে। কিন্তু এক সময় তো সব সয়ে যায়, রমারও গিয়েছিলো। সময়ের সাথে সাথে এক ছেলের মা হলেন রমা।জীবনটা যেনো আমূল পাল্টে গেলো।ওসমান পুরোনো স্মৃতির মতো পরে রইলো হৃদয়ের এক কোণে। মা হলে কি এমনি হয়, কি জানি হবে হয়তো। আর কোনো কিছু জানতে চান না রমা।সুনীলের সাথে তার সম্পর্ আর দশটা সম্পর্র মতোই কিন্তু কোথায় যেনো কি দিতে পারে না রমা। সুনীল ভালো মানুষ, শিক্ষিত মানুষ। রমাকে সে কখনো অযত্মে রাখেনি। নিজের সব টুকু দিয়ে চেষ্টা করেছে।টানাটানির সংসারে ছেলে চঞ্চল হবার পরে তো মা আর ছেলের জন্য সব টুকু দিয়ে চেষ্টা করেছে।ভালোও বেসেছে রমাকে।চেয়েছে সারাজীবন বুকে করে আগলে রাখতে।
চাচী আম্মা বলে রহিম বার কয়েক ডাকার পর রমার হুশ ফিরে। কি হইছে চাচি আম্মা? খাইবেন না রাইতে? বৃষ্টি বাড়তাছে, কমনের তো লক্ষণ দেহি না। চলুন খাইয়া লইবেন চলুন।কারেন্ট আওনেরও নাম নাই। মনে অয় না আইজ আর আইবো। আসুইন রুটি তরকারি সব ঠান্ডা অইয়া যাইতাছে।
রমা একটা দীঘর্শ্বাস ফেলে বলে- তুই যা, আসছি জানলাটা বন্ধ করে। এই রহিমই আজ তার অবিভাবক।কেউ তো নেই আজ রমার, যাকে আপন বলে মনে করতে পারেন। নিজের ছেলে মেয়ে থেকেও কেউ নেই আজ। একা, নিজেকে আজকাল বড় একা লাগে তার।
রাতের খাবারের পর ঔষধ খেয়ে ঘুমোতে যায় রমা। আজকাল ঘুমোতে পারে না সে। বৃষ্টি হলে তো আরো কেমন ভয় হয় তার।অন্ধকার ভালো লাগলেও অঝোরে বৃষ্টি এলে লাইট জ্বেলে রাখে। ঘুমোতে না পারার কষ্ট তাকে পিছু ছাড়ছে না। একা একা বড় ভয় পায় ঘুমোতে রমা ।ভাবে যদি আর ঘুম না ভাঙে। টিনের চালে আচড়ে পড়ছে বৃষ্টি। কোথাও আর কোনো শব্দ নেই। না আসে না, ঘুম আসে না রমার। কতো কথা ভেসে আসছে মনে। সুনীলের কথা মনে পড়ে। যার প্রতি দায়িত্ব পালন করেছে সে আড়াই বছর, ভালোবাসতে পারে নি। সেই সুনীল একদিন কোথায় হারিয়ে গেলো।
রমার কতো কথা যে মনে পড়ছে। কথারা যেনো আজ বইয়ের পৃষ্ঠার মতো খুলে গেছে। রমা আজ সব পড়তে চাইছে, তার শূন্য জীবনকে নিয়ে একা হাঁটতে কষ্ট হয় তার, স্মৃতি গুলোই বাঁচিয়ে রাখছে তাকে। কোনো কিছুই এখন ফেলে দিতে ইচ্ছে করে না।বেঁচে থাকুক, তার দিন গুলো বেঁচে থাকুক।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পাল্টে দিয়েছিলো দেশের বহু মানুষের জীবন। রমাও তাদের একজন। এই যুদ্ধে রমাও হারিয়েছে অনেক কিছু। দেশের অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপের দিকে যাচ্ছিলো।চারদিকে যুদ্ধের আবহ।মানুষ আতঙ্ক নিয়ে দিন পার করছে। বঙ্গবন্ধুর ৭মার্র ভাষণের পর দেশ আরো গরম হতে থাকে। গ্রামে গ্রামেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে উত্তেজনা।কি করবে কি করা উচিত অনেকেই বুঝতে পারে না।হিন্দুরা আতঙ্ক নিয়ে দিন পার করে। যারা পেরেছে দেশ ছেড়েছে।
রমাকে নিয়ে সুনীল বেড়াতে এসেছিলো শিমুলডাঙায়।এখানে ওখানে শুধু যুদ্ধের খবর। ততদিনে শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।বাতাসে ছড়াতে থাকে সে খবর।মুক্তির গান গাইতে থাকে শিমুলডাঙার পাখি। দিন দিন খারাপ হতে থাকে গ্রামের অবস্থা। ক্রমেই রাজাকার মাথা চারা দিয়ে উঠছে গ্রামে। চুরি যাচ্ছে হিন্দুদের বাড়িতে। কখনো প্রকাশ্যে নিয়ে যাচ্ছে গরু ছাগল।চেনা মানুষেরা কেমন অচেনা হয়ে উঠছে।রামেন্দু বাবু কি করবেন বুঝতে পারেন না।সুনীলকেও বাড়ি যেতে দিচ্ছেন না। বড় দুই ছেলে তাদের সংসার নিয়ে দেশ ছেড়ে বোনেদের কাছে চলে গেছে আরো আগেই।ছোটো ছেলে পড়াশুনা করছিলো শহরে। বন্ধুদের সাথে সে চলে গেছে যুদ্ধে। যাবার আগে বাবাকে চিঠি লিখে দিয়ে গেছে। এখন আছে কেবল রমা।
গত আড়াই বছরে রমা আর ওসমানের কথা গ্রামের মানুষ প্রায় ভুলেই গেছে। কোথাও যেনো কিছু হয়নি। ওসমান ও এতোদিনে সংসারী মানুষ। পুরোনো ক্ষত তার সেড়েছে কি না সে খোঁজ রাখেনি কেউ। ওসমান অবস্থা সম্পন্ন বাবার ছেলে। বিয়ে করেছে, সন্তানের বাবা হয়েছে, আর কি চাই জীবনে। এই তো মনে হয় সুখী হওয়া, সুখে থাকা । গ্রামের পথে তখন ঘোর বর্ষা।আষাঢ়ের বৃষ্টিতে ভাসছে শিমুলডাঙা। সারাদিন বৃষ্টিতে ঘরবন্দি মানুষ। শিমুলডাঙায় এলেই মন কেমন করে রমার। কি যেনো নেই, কোথায় যেনো বিশাল এক শূন্যতা তার। ওসমানের সাথে দেখা নেই বিয়ের পর থেকে। রমার আসার খবরে ওসমান এ পথ দিয়ে আসাই বন্ধ করে দিতো।পাছে অসুখী হয় রমা।
মাটির পথ ধরে এক সন্ধ্যায় হাঁটতে হাঁটতে ওসমানের সাথে দেখা হয়ে যায় রমার। কেমন অসস্থি হয় দুজনেরই। তবু ভালোমন্দ কথা হয়। সব কথা ছাপিয়ে এখন বড় কথা দেশের মুক্তিযুদ্ধ। ওসমানের চেনা চোখের যন্ত্রণা নিয়ে সেই সন্ধ্যায় রমা বাড়ি ফিরে আসে।সে রাতে খুব কষ্ট হয় রমার। এই কষ্ট কেমন অচেনা লাগে তার। তার প্রিয় মানুষ আজ অন্য কারো।সহজে কেনো যেনো মানতে পারে না সে। কষ্ট হয়, খুব কষ্ট হয় রমার।কেনো হয় জানে না সে।
সেদিন সুনীল গ্রামের বসিরের চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলো।রেডিওতে খবর শুনছিলো।সারা গ্রামের মানুষ বসিরের চায়ের দোকানে জড়ো হয় যুদ্ধের খবর শোনার জন্য। মানুষ মরছে, দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে মানুষ। পাকিস্তানিদের অত্যাচারের কাহিনী শুনে কাঁটা দেয় খবর শোনা মানুষদের। চারদিকে ঘর বাড়ি পুড়ে ছাই হচ্ছে।শান্ত থাকেনা আর শিমুলডাঙার বাতাস।মেয়ে বৌদের নিরাপত্তা নেই, পালাচ্ছে, গ্রাম খালি করে পালাচ্ছে সব।বসিরের চায়ের দোকানে আব্দুলের সাথে পরিচয় হয় সুনীলের।আব্দুল রাজাকারের দলে নাম লিখিয়েছে।ঘুরে ঘুরে গ্রামের গোপন তথ্য যোগার করে সে। সুনীলকে বলে-জামাই, আর কয়দিন থাকবাইন শ্বশুরবাড়িত, আপনের ছোটো শ্যালাডা কই আছে, গ্রামে আইতো না।নাকি মুক্তিবাহিনীত নাম লেখাইছে।
সুনীল এটা ওটা বলে পাশ কাটায়। তারপর আব্দুল বলে- জামাই, রমার কথাডা কি জানতাইন না হি? ওসমানের লগে যে ওর…এ কথাডা কিন্তু গ্রামের বেহেই জানে। কি যে ভিমরতি অইছিলো ছেড়িডার। বিয়াডাই তো বইতে চায়ছিন না। অনেক জোর হইরা তবে বিয়া দিলো।
আর দোকানে বসে না সুনীল। কানের পাশ দিয়ে মনে হলো কিছু একটা বয়ে গেলো। শরীরটা কেমন করে উঠলো তার।বুকের ভিতরটায় মোচড় দিয়ে ওঠলো ভারি কোনো কিছু একটা। রমা, রমা এভাবে ঠকিয়েছে তাকে।এই শোক সে কোথায় রাখবে। বলতে পারতো,আমায় তো বলতে তা পারতো রমা। কেনো লুকোতে গেলো। এই এতো গুলো দিনেও কি আমাকে চিনতে পারেনি ও। সে রাতে বাড়ি ফিরে সুনীল কেমন নিরব হয়ে রইলো। রমার সাথে কোনো কথা বললো না। ছেলেটাকে ঘুম পাড়িয়ে রমা জানতে চাইলো কি হয়েছে সুনীলের। তাও কোনো কথা বলে না সুনীল।রমার কথার পিঠে কেবল বলে-কাল পলাশপুর চলে যাবো রমা। অনেকদিন তো হলো। আর কতো।তুমি থাকো এখানে। রমা বলে-বাড়িতে একা গিয়ে কি করবে। মা ও তো আর বেঁচে নেই। ওখানে কে আর আছে।সুনীল হঠাৎ করে বলে-কেনো ঠকালে আমায় রমা।ওসমানকে তুমি পছন্দ করতে,তার সাথে তোমার সম্পর্ক ছিলো সে কথা কেনো আমার কাছে গোপন করে গেলে। কেনো ঠকালে আমায় রমা? রমা আর কোনো উত্তর দিতে পারে না। কে যেনো তার গলা টিপে ধরে। কথা হারিয়ে ফেলে রমা।
পরদিন সকালে সুনীলকে আর বাড়িতে দেখা যায় না। কেবল সুনীলের একটি চিঠি পাওয়া যায়।সে লিখে গেছে-আমি যুদ্ধে চলে যাচ্ছি রমা। এভাবে ঘরের কোণে বসে না থেকে দেশের কাজে যাচ্ছি।জীবনটাকে কাজে লাগাই।যদি বেঁচে ফিরি আবার দেখা হবে। চঞ্চলকে দেখো। সাবধানে থেকো রমা।
তখন অঘ্রাণের ফসল ঘরে তোলার সময়। কেমন একা হয়ে পড়লেন রামেন্দু বাবু। লোক নেই, ফাঁকা গ্রাম কেমন খাঁ-খাঁ করছে।পালাচ্ছে, সবাই পালাচ্ছে। তিনিও কি চলে যাবেন।সহায় সম্বল সব শেষ হতে চলেছে। কি করবেন কোথায় যাবেন তিনি পরিবার নিয়ে।কিছু ধান কেটেছিলেন নিজেই,আরো অনেক বাকি। হঠাৎ এক মাঝরাতে বাড়ির উঠোনে কাদের যেনো পায়ের শব্দ পেলেন।কারা যেনো ডাকলো-কাকা, ও রামেন্দু কাকা,উঠুন, কথা আছে।তার হুশ ফিরলো। বুঝলেন বিপদ এবার ঘাড়ে এসে পড়েছে। আর বোধহয় শেষ রক্ষা হবে না। কি করবেন তিনি।কি করে বাঁচাবেন রমাকে।রমা জেগেই ছিলো, নানা চিন্তায় তার ঘুম আসছিলো না। ততক্ষণে সব বুঝতে পেরে নিজের সঞ্চয় টুকু নিয়ে ছেলেকে মায়ের কোলে দিয়ে বাবার কাছে এসে চুপিচুপি বলে- বাবা, দরজা খুললে আর রক্ষা নেই। চলো, পেছনের দরজা দিয়ে চলো পালাই। আব্দুলের গলা শুনছি। আর রক্ষা নেই বাবা।চলো তাড়াতাড়ি।এদিকে একটানা ডাকার শব্দ, সাথে দরজা ধাক্কানো। রামেন্দু বাবু বুদ্ধি করে বলেছিলেন-দাঁড়াও, নাতিটা ঘুমাচ্ছে, উঠে পরবে দাঁড়াও খুলছি।
পেছনের দরজা দিয়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বড় রাস্তা পার হয়ে রমা তার পরিবার নিয়ে এসে দাঁড়ায় ওসমানদের বাড়ির সামনে।বলে বাবা-চলো রাত টুকু এখানেই আশ্রয় নেই। বাকিটা পরে দেখা যাবে। রামেন্দুবাবু আর অমত করলেন না। বাঁচতে হবে তাদের।বাড়ির ভেতর ঢুকে রমা ওসমানদের দরজায় শব্দ করে। কিছুক্ষণ পর ওসমান বের হয়ে আসে দরজা খুলে।কিছুটা অবাক হলেও তার বোঝতে বাকি থাকে না কিছুই। এ বাড়িতে আসার সাহস নেই কারো। রমাদের চারদিন ওসমানের বাড়িতেই থাকতে হয়। ওসমানই তাদের দেশ ছাড়ার ব্যবস্থা করে দেয়।বলে কাকা-চলে যান ভারত, আমি আরো লোক দিয়ে দিচ্ছি। ধান বন যা আছে আমি কাটিয়ে তোলে রাখবো।সব ঠিক হলে আবার চলে আসবেন।রমাকে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারে না ওসমান। কি বলবে আর, দিন গুলো যে আগের মতো নেই।রাতে গ্রাম ছাড়ার সময় ওসমান রমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে দেয়। রমা নিতে চায় না, বলে রাখো, দরকার হবে। সাবধানে থেকো রমা।সব ঠিক হলে চলে এসো।
সময় যেতে থাকে। সময়ের ক্ষত কে ভুলাতে পারে আর। দেশ স্বাধীন হয়। একে একে সবাই ফিরে আসে।কতো প্রিয়জন হারানোর ব্যথা সয়ে ফিরে আসে অনেকে। রমারাও ফিরে আসে। একে একে ঘরে ফিরে আসে রমার ভাইরা।গ্রাম আবার পূর্ হতে থাকে।আবার বসন্ত ফিরে আসে শিমুলডাঙার পথে পথে।কেবল রমাকে শূন্য করে দিয়ে ফিরে আসে না সুনীল।দিন যায়, চঞ্চলও বড় হতে থাকে, কিন্তু সুনীল আর ফেরে না। তার কোনো খোঁজ কেউ দিতে পারে না। রমার অপেক্ষার আর শেষ হয় না। এভাবেই বারো বছর অপেক্ষা করে রমা। এতো গুলো দিন একা কাটানো কি যে যন্ত্রণার তা রমা বুঝতে পারে। তার কেমন এক অপরাধবোধ কাজ করে।তার জন্যই যেনো সুনীল ফিরে এলো না। বারো বছর অপেক্ষার পর সুনীলের শ্রাদ্ধ করে বৈধব্য বরণ করে সে।নিজেকে বড়ো একা লাগে রমার। ফিরবে না, সুনীল আর ফিরবে না তার কাছে।
রামেন্দু বাবু রমার দুঃখ নিয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।রমা আছে, সেই আগের মতো শিমুলডাঙাতেই।এদিকে ওসমান তখন গ্রামের মেম্বার, দুই ছেলের বাবাও। বাবার একমাত্র ছেলে ছিলো ওসমান। বাবার মৃত্যুর পর নিজেই সবকিছু সামলে নিয়েছে।রমার জন্য তার দুঃখ হতো। এমন কেনো হলো রমার।না হলেও তো পারতো। সে খোঁজ রাখতো নিয়মিত রমার। না এখন আর কেউ কিছু বলেনা তাকে। সেই তো সেদিন রমাদের বাঁচিয়েছিলো।হঠাৎ এক সকালে শিমুলডাঙার বাতাসে ভেসে এলো ওসমানের বৌয়ের মৃত্যু সংবাদ। কয়েকদিনের অসুস্থতায় মারা গেছে ওসমানের বৌ।সে খবরে রমাও কষ্ট হলো। দুটো ছেলে মা হারা হলো। সময় আবার পালা বদল করে। বসন্ত কানে কানে কি যেনো বলে যায় রমার আর ওসমানের।সেই আগের দিন গুলোকে কি ফিরে পাওয়া সম্ভব।অনেক তো কষ্ট সইলেন আর কতো।
সেদিন আজকের মতো এমনি বর্ ছিলো। অঝোরে ঝরছিলো শিমুলডাঙার বুকে। সেই বিকেলে ওসমান আলী এলেন রমাদের বাড়ি। বলেছিলেন-রমা এতো বছরেও তোমাকে ভুলতে পারলাম না। সময়, দায়িত্ব, সংসার সব তো হলো তোমার আমার। সব কিছু করেও দেখলাম ভালোবাসি আজো তোমাকেই।জানি তুমিও আমাকেই ভালোবাসো মনে মনে।রমা যাবে আমার সাথে,পুরোনো স্বপ্নটাকে চলো সত্যি করি । নতুন করে শুরু করি আবার। লোকে কি বলবে বলুক, নিজেদের জন্য বাঁচি রমা। আমি আসবো রাতে, যদি যেতে চাও তবে এসো বাইরে। তোমাকে নিয়ে শহরে চলে যাবো ফুফাতো বোনের বাড়ি। তারপর বিয়ের পর ওখানে কিছুদিন থেকে আবার ফিরে আসবো গ্রামে। চলো রমা, একসাথে সংসারের স্বপ্নটাকে সত্যি করি এবার।
রমা সেদিন নিজের কথাই ভেবেছিলো। সুনীল তার বাবা কারো কথা তার মনে পড়ে নি। কেবল ছেলের মুখটা ভেসে উঠলো। ছেলে তার কৈশোরে পা দিয়েছে। পারবেন তো রমা। তার মন যেনো বলে গেলো-এতো বছর তো ছেলেকে দিলি এবার নিজের দিকে তাকা রমা। ওসমান এখনো তোর আছে। চলে যা রমা ওর সাথে। বহু দূরে চলে যা।রমাও তার মনের কথাই শুনেছিলো। সেই রাতে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তারা গ্রাম ছেড়েছিলো।বহুদিনের অপেক্ষার পর এক হলো রমা আর ওসমান আলী।ছেলেকে ঘুমে রেখে আদর করে বলে এলো-ক্ষমা করিস চঞ্চল। ভালো থাকিস বাবা।
তারপর থেকে রমা হয়ে গেলেন নুরজাহান বেগম রমা। কৈশোরের প্রেম তার পূণর্তা পেয়েছে। সুখে আছেন। ওসমান তাকে সুখের মধ্যেই রেখেছেন। কি নেই তার সব আছে। রমারা গ্রামে ফিরে ছিলেন মাস তিনেক পর।ধর্ ত্যাগ করে রমা এই বয়সে আবার বিয়ে করেছেন তা মানতে পারেনি অনেকে। কিন্তু কারো তো কিছু করার নেই। কেবল চঞ্চল কেমন হয়ে গেলো লজ্জায়।মায়ের বিয়ে সে মানতে পারলো না। সমাজের কাছে তাকে ছোটো হতে হলো। এই লজ্জা নিয়ে সে আর মায়ের মুখ দেখতে চাইলো না।সে কলকাতায় চলে গেলো তার মাসির কাছে। বড়মামাই তাকে সব ব্যবস্থা করে দিয়ে এলো।রমার আদরের ছেলেকে রমা আর দেখতে পেলো না।
শিমুলডাঙায় ফিরে সব কেমন অচেনা লাগে রমার।এ যেনো তার চেনা গ্রাম নয়।সবাই কেমন আড় চোখে তাকায়। চারটা বাঁকা কথা শুনিয়ে যায়। মানুষ গুলোকে অচেনা ঠেকে তার। নিজের কাছের মানুষ গুলো আর তার কেউ হয় না। সে এখন অন্য ধর্র অন্য জীবনের পথে।সময়ের সাথে সাথে সব কিছু বদলে যায়। নতুন কোনো বিনোদনের সন্ধ্যান পেলে পুরোনো বিনোদন ভুলে যায় মানুষ। এই যেনো জগতের নিয়ম।রমার নতুন করে বিয়ে করার কথা ক্রমে ক্রমে সহজ হয়ে গেলো সবার কাছে।সবাই মেনে নিলো রমা এখন প্রভাবশালী মেম্বার ওসমার আলীর স্ত্রী।গ্রামের লোকেরা এখন সহজ ভাবেই যায় তার কাছে,গল্প করে ।রমা কখনো পানের বাটাটা এগিয়ে দেয় তাদের দিকে।খুব চেনাদের কাছে বাবার বাড়ির খোঁজ নেয়, ছেলের কোনো খবর কেউ রাখে কি না সেই খোঁজের জন্য উথাল-পাতাল করে সে।
এই শিমুলডাঙা তাকে কতো পরিচয় দিলো। সে এখন ওসমানের দুই ছেলের ছোটো আম্মা।কারো চাচি আম্মা। কিন্তু নিজের ছেলেকে সে একটু সময়ের জন্যও ভুলে থাকতে পারে না। সুনীলের কথা মনে পড়ে। কেমন অপরাধ বোধ কাজ করে রমার।ওসমানের কাছে এখনো সে রমা।ওসমানের মা, আত্মীয়রা যখন রমাকে অপমান করে তখন সে রমার ঢাল হয়ে দাঁড়ায়।তাকে আগলে রাখে, মনের শক্তি বাড়ায়।সবকিছুর পরও ওসমান কিন্তু এতোটা উদারতা দেখাতে পারে নি। রমা চেয়েছিলো নিজের ধমর্টাকে নিজের মতো করে পালন করতে । কিন্তু ওসমান ও তার পরিবারের আপত্তিতে তাকে পুরোপুরি মুসলিম বনে যেতে হলো।এক ধর্ ছেড়ে অন্য ধর্ পালন করছে সে। পুরোহিত বাবার সংস্কার ভুলে যেতে পারে না রমা ।ছোটো থেকে যে ধর্ম নিয়ে বড় হয়েছে সে তা ত্যাগ করতে হয়েছে।অন্য ধর্ম পালন করলেও মন থেকে মানতে পারে না সে। বুকের ভেতরটায় মাঝে মাঝে মোচড় দিয়ে ওঠে। ভাবে যা করলাম ঠিক করলাম তো। রমার যে একটা জীবন ছিলো তা ওসমান মুছে দিতে চাইলো।ধর্মীয় বেড়াজাল থেকে বের হতে পারলো না ওসমান। সময়ের সাথে সাথে রমাও নিজেকে ভুলে যেতে থাকলো।ওসমানের সাথে সুখী হলেও নিজের ভেতরটাকে রমা খুব যত্ন করে তুলে রাখলো। সেখানে ওসমানেরও প্রবেশের অধিকার নেই। রমা বুঝে গিয়েছিলো তার প্রেমিক ওসমান আর স্বামী ওসমানে অনেক ফারাক। একদিন ধর্ তাদের পথের বাঁধা না হলেও রমা তার ধার ধারেনি।সংসার করতে এসে সে দেখলো ওসমানও স্ংস্কারের বাইরে না।
দিন যায়, আবার পুষ্ট হতে থাকে রমার শরীর। প্রথমবার মা হবার কথা মনে পড়ে রমার। তার প্রথম সুখ। ছেলের একটা খবরের জন্য ছটফট করে রমা।ছেলেটা কিভাবে আছে, সে খোঁজ আনতে বাবার বাড়িতে রহিমকে পাঠায় রমা। ছেলে যে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার থেকে, রমা তা জানে, যেনেও কেমন ছটফট করে।মনটা কারণে অকারণে খারাপ হয়ে যায় রমার।এই শরীরে মায়ের কাছে যেতে মন চায়। কেউ নেই তার। মা ও তাকে দূরে সড়িয়ে দিয়েছে। একদিন ভোররাতে শিমুলডাঙার বাতাস খবর পেলো রমার কোল আলো করে এক মেয়ে জন্ম নিয়েছে। রমার মন খারাপের পথে সুখ খুঁজে পেলো। এই মেয়ে তার নিজের, তার একমাত্র অবলম্বন।রমা তাকে আঁকড়ে বাঁচতে চাইলো।
এক গ্রামে বাস করার ফলে রমার ভাইদের সাথে তার সম্পর্ক ধীরে ধীরে সহজ হতে থাকলো তার মেয়ের জন্য। রমা মাঝে মাঝে মায়ের কাছে যেতো।ততদিনে রমার ভালো মন্দের কথা ভুলে গেছে গ্রামের মানুষ।রমার এখন পরিপূর্ণ সংসার। কেউ বিপদে পরে তার কাছে এলে তাদের খালি হাতে ফেরায় না সে।কিন্তু মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ে ভাবতে বসে সে। সুনীলের সংসারে সম্মান ছিলো, অঢেল প্রেম ছিলো। এখন ভুল আর দোষের হিসেব আছে, সম্মান নামের শব্দটার তো দেখাই নেই।ওসমানের মা রমাকে বউ হিসেবে মেনে নিতে পারে নি। তার কারণ ছিলো রমা হিন্দুর বিধবা ও এক সন্তানের জননী।কোথায় যেনো রমাকে বউ হিসেবে মানতে আটকাতো ওসমানের মায়ের।
ওসমানের দুই ছেলে তাকে কখনোই পছন্দ করতো না। কেবল বাবার সম্পত্তির জন্য কিছু বলতে পারতো না। সময়ের সাথে সাথে পরিবতর্ন হয়ে গেলো অনেক কিছু।রমার মেয়ে বড় হতে থাকলো।বাবার বাড়ির সাথে মুসলিম রমার আর কোনো সমস্যা থাকলো না। ভাইয়েরা আসতো যেতো। রমাও মেয়েকে নিয়ে যেতো আবার চলে আসতো। ওসমান কখনো কখনো যেতো। শিমুলডাঙার পথ আবার রমাকে কাছে টেনে নিলো।সহজ হলো তার পথ চলা। রমা ভুলে গেলো বাকি সব। জীবনটাকে মেনে নিলো সে। এ ছাড়া তার অন্য কোনো পথ নেই সে জানে।মেয়ে কোহিনূর তার সব। তাকে ঘিরেই আবার নিজেকে স্বপ্নে দেখে রমা। মেয়েটার চোখ মুখ সে মনে মনে চঞ্চলের সাথে মেলাতো। দেখতে রমার মতোই হয়েছিলো সে। চঞ্চল তার প্রথম আদর । মাকে ভুলে থাকতে চাওয়া চঞ্চল।থাক, ভুলেই থাক। কেমন অভিমানও হয় রমার।
ওসমান আলীর বয়স বাড়ছিলো।ছেলেদের বিয়ে করিয়ে সংসারী করে দিলো।কোহিনূরকে পড়াশুনা করাচ্ছে। ছেলেদের তেমন পড়াশুনা হয়নি । বিশেষ কিছু করেও না তারা।সে চায় মেয়ে যতোদূর পড়তে চায় পড়ুক।তারপর তার বিয়ে দেবে।রমা বাড়ির সবকিছু দেখা শোনা করে । ধান সেদ্ধ করার সময় এলে রমার চোখে ঘুম থাকে ন। কাজের লোকদের সাথে জেগে থাকতে হয়।রহিম তার খুব অনুগত।বাবা মা ছাড়া রহিম সব সময় চাচি আম্মা বলে রমার কাছাকাছি থাকে। তার দুই ছেলেও এখন তাকে মেনে নিয়েছে।ছোটো আম্মা বলে ডাকতে গিয়ে আম্মা শব্দটা আগের মতো মিলিয়ে যায় না।বউ দুটোও তাকে সম্মান করে। রমা নিজেকে সুখী ভাবতে ভালোবাসে। সুখে আছে সে।
শিসুলডাঙার বয়স বাড়ে রমার মতোই। নতুন চকচকে রাস্তা, বিদ্যুতের আলো, ঘরে ঘরে টেলিভিশন,কি নেই এখন। রমার চুলে সাদা রেখা ,ওসমান ক্লান্ত।ঔষধের বাক্স ঘিরে তার বেঁচে থাকা।রমা তাকে সেই আগের মতোই যত্ন করে। ওসমানের প্রতি তার কোনো অভিমান নেই। সারাজীবন ওসমান তাকে অনেক কিছু দিয়েছে।কেবল নিজেকে রমার নিজের কাছে অচেনা করে দিয়েছে। সময় সেই অভিমানও ভুলিয়ে দিয়েছে।একমাত্র মেয়ের বিয়ে ওসমান ধুমধাম করেই দেয়। কোনো কিছুর অভাব নেই তার। শেষ কতর্ব্য সে ভালো ভাবেই শেষ করে। কোহিনূরের বর বিদেশে থাকে। কোহিনূরও ওখানেই চলে যাবে। রমার ইচ্ছে ছিলো না মেয়েকে বিদেশে বিয়ে দেওয়ার। মেয়েরও না। মাকে ছেড়ে থাকতে পারতো না কোহিনূর। কিন্তু ওসমান আর তার দুই ছেলের কাছে রমার ইচ্ছে কোনো গুরুত্ব পায় না। রমার শেষ আশ্রয়ও দেশ ছাড়া হয়। রমা আবার একা। শিমুলডাঙা রমা দুঃখে চোখের জল ঢেলে দিলো।
ওসমান মারা গেছে দুবছর হলো। মারা যাবার আগে সমস্ত সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়ে গেছে। রমার অংশও আলাদা।রহিমের নামেও অংশ আছে। ওসমানের ইচ্ছে ছিলো রহিমকে বিয়ে করিয়ে যাবে। সময় তাকে সে সুযোগ দেয়নি। রমা এখন একেবারে একা। ভূতের মতো আগলে রাখছে বাড়ি। তার এতো বছরের সংসার, মায়া মমতা। আজকাল একা থাকায় খুব ভয় হয় রমার।শিমুলডাঙাও কেমন শূন্য হয়ে গেছে। পুরোনো মানুষ কেউ বেঁচে নেই। অনেকে শহরমুখী।গ্রাম এখন রমার মতোই ফাঁকা খাঁ-খাঁ। ওসমান মারা যাবার পর কোহিনূর দেশে এসেছিলো। চেয়েছিলো রমাকে সাথে করে নিয়ে যাবে। রমা রাজি হয়নি। বাকি জীবন এখানেই কাটাবে সে। কোনো ভাবেই তাকে রাজি করতে পারেনি কোহিনূর। দুইছেলে তাদের ভাগের অংশ বিক্রি করে সংসার সন্তান নিয়ে শহরবাসী। রহিম ছাড়া আর কেউ নেই রমার।
রমা ঘুমোতে পারে না। বৃষ্টির শব্দ টিনের চালে নেচে যাচ্ছে। বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে রমার।শ্বাসকষ্ট নিতে কষ্ট হচ্ছে।ভোর হতে চললো, রমা কি করবে বুঝে ওঠতে পারে না। রহিম কে ডাকতে চেয়েও ডাকে না। এতো বৃষ্টি সে কোথায় তুলে রাখবে। চঞ্চলের মুখটা ভেসে ওঠে। তার সেই ছোটোকালের মুখ। বড় হয়ে কেমন হয়েছে জানে না রমা। একবার যদি ছেলেটাকে দেখে যেতে পারতো। সুনীল বারবার কেনো আসে তার স্বপ্নে। কি বলতে চায় তাকে। এই অপরাধবোধ সারাজীবন পিছু ছাড়লো না রমার।মনে মনে কতোবার যে সুনীলের কাছে ক্ষমা চেয়েছে সে।
আযানের পর শিমুলডাঙার পাখিরা ডাকতে শুরু করেছে। ভোর হচ্ছে, এমন বহু ভোর রমাকে দেখে, রমা ভোরকে দেখে।খুব কষ্ট হয় রমার। বুকের ভেতরটাতে কিছু একটা ভেঙে যেতে থাকে। নেই কিছুই নেই তার।সে সম্পূর্ণ শূন্য। কি পেলো সে জীবনে, নিজের নাম মুছে দিয়ে, ধর্ম মুছে দিয়ে সারাটা জীবন দিয়ে দেখলো, সংসার তাকে দুহাত উপচে জলই দিলো।
রমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো একদিন সেজে গুজে ঢাক ঢোল পিটিয়ে নতুন করে ঘরের বউ হয়ে এসেছিলো সে। দেখলো নিজের আত্মসম্মান ক্রমেই হারিয়ে গেলো। শত সহস্র ভুল আর দোষের ভাগ ছাড়া কোনো কিছুই সঞ্চয় হলো না জীবনে। নিজেকে ভুলতে বসতো সে। ফেলে আসা জীবন পিছুডাকতো। সে জীবনটাকে ভুলে না গিয়ে মনে রাখাটাই তার ন্যাকামি মনে হতো। নেই কিছু নেই তার,কেউ নেই। সংসার কেনো এতো কঠোর হয়। যাকে আপন ভেবে আঁকড়ে ধরেছে রমা তারাই ছেড়ে চলে গেছে। তার ছেলে তার মেয়ে কিছুই তো আর তার নেই। রহিম আছে, তার কাছে কোনো চাওয়া নেই রমার। কেবল মায়া ছাড়া। বৃষ্টি থামে না বরং থেমে থেমে বেড়ে যায় কখনো। রমার খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বৃষ্টির শব্দে মিশে যেতে থাকে তার শ্বাসের শব্দ।শিমুলগ্রাম ডাকছে, ডাকছে শৈশব। রমার মনে পড়ে দুর্গা মায়ের পায়ে অঞ্জলির শ্লোক। বাবার কাছে লিখতে শেখা, বাবার গুনগুণিয়ে গাওয়া রামায়ণ মহাভারতের সুর।ওসমানের শেখানো আরবি অক্ষর, নামাজের কায়দা কানুন। রমার মনে পড়ে, কেবল মনে পড়ে।শ্বাসকষ্টের টান বাড়ছে, সকাল দেখতে ইচ্ছে করছে তার।
ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে রমা ভাবে, ধেত আমার কি কোনো জীবন আছে নাকি। না ছিলো কোনো কালে। বৃষ্টি বাড়ছে, অনন্তকাল চলবে এই বৃষ্টি…
অথই নীড়-কবি। প্রকাশিত বই-নিঃসঙ্গ রাতের ঝিনুক।