এক.
ওদিকে সূর্যের আলোর তাপে বাঘের ঘুম চলে গেছে। বাঘ মাটির বিছানায় শুয়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠে শাকেরের বাড়ির দিকে খেয়াল করছে, কোনো মোরগ পাওয়া যায় কি না।
একটি বিশাল সাইজের মোরগ শাকেরের থাকার ঘরের পেছন দিয়ে কক্ কক্ করে ডাকতে ডাকতে যাচ্ছিল। বাঘ অমনি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাকে ধরার শব্দে শাকেরের বউ ছুটে এলো। ততক্ষণে বাঘ মোরগের নরম ঠ্যাং মুখের মধ্যে পুরে নিয়েছে।
শাকেরের বউ বাঘের মোরগ খাওয়া দেখে বলল, হায় হায়, আমার এত বড় পোষা মোরগ বাঘ খেয়ে নিল। সে বাঘের সাথে ঝগড়া শুরু করে দিল।
বাঘ বলল, আপনি তো জানেন প্রতিদিন সকালে আমি একটি দেশি মোরগ দিয়ে নাশতা করি।
শাকেরের বউ বলল, আমি মোরগ-মুরগি পুষি আমাদের খাওয়ার জন্য। আপনার মোরগ খেতে ইচ্ছে হলে বাজার থেকে কিনে খাবেন।
বাঘ বলল, আমি বাজারে গেলে পশু-পাখি, মানুষ সবাই ভয় পায়। এ জন্য যেতে পারি না।
শাকেরের বউ বলল, যা-ই হোক, কাল থেকে আপনি আর আমাদের বাড়ির মোরগ খেতে পারবেন না।
শাকেরের বউয়ের কথা শুনে বাঘ ক্ষেপে গিয়ে গর্জন করে শাকেরের সাথে দেখা না করেই চলে গেল। শাকেরও বাড়ির ভেতর থেকে কিছু বুঝতে পারল না।
কিছুক্ষণ পর শাকের কয়েক প্রকার মাছ ধরার জাল নিয়ে জেলে বন্ধু তাকে ডাকার আগেই নদীতে পৌঁছে গেল। নদীতীরে বালুর ওপর মাছ ধরার জাল, মাছ রাখার ঝুড়ি রেখে বারবার নদীর গভীরে তাকিয়ে পানির বেগ বোঝার চেষ্টা করছিল। তখন আকাশে হালকা মেঘের সাথে চারদিকে ঝড়ের বেগে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। তীরের সবুজ ভূমিতে নতুন গজে ওঠা ফসলের মাথাগুলো দুলছে। শাকের দূরে খেয়াল করে দেখছে নৌকা কিংবা মাঝি বন্ধুকে দেখা যায় কি না। কিন্তু কোনো কিছুই চোখে পড়ছে না।
সে আবার আকাশ দেখে বোঝার চেষ্টা করছে বেলা কত। তাও মেঘের কারণে বোঝা যাচ্ছে না। ভাবছে, সময় নদীর স্রোতের মতো চলে দুপুর এসে পরবে। নদীতীরে একাকী অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর সহকর্মী বন্ধু মাঝিকে উঁচু গলায় ডাকা শুরু করল।
অনেকক্ষণ ধরে উচ্চ শব্দে ডেকে বলছিল, বন্ধু তুমি নদীর কোন প্রান্তে আছ? এদিকে আসো। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
অনেক ডাকাডাকির পর কেউ এলো না শাকেরকে নিতে। শাকেরের বউ আকাশে মেঘ দেখে ভাবছে, মেঘ যে কালো রূপ ধারণ করেছে তাতে কোনো বিপদ হয় কি না কে জানে।
দুই.
শাকের আকাশের কালো মেঘের গর্জনে আতঙ্কিত হয়ে বাড়ি ফেরার কথা ভুলে গেছে। নদীতীরে এখনো নৌকার জন্য অপেক্ষা করছে। শাকেরের বউ ঝড়ের মধ্যে ছোট ছেলেমেয়ে রেখে শাকেরকে নিতে আসতে পারছে না। ইতিমধ্যে চারপাশে ঝড়ের বেগ কয়েক গুণ বেড়েছে। শাকের উদ্ভ্রান্ত হয়ে সকাল থেকে নদীর দিকে চেয়ে আছে। এখনো অপেক্ষা করছে তার বন্ধু মাঝির জন্য।
ঝোড়ো বাতাসের ভেতর নদীর ওপরের আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল এক দরবেশ।
শাকেরের অতি সন্নিকটে ভয়ানক বিপদ দেখে আকাশ থেকে শাকেরের পাশে নেমে বলল, সমস্ত আকাশে ভয়াবহ কালো মেঘের ঘনঘটা, তুমুল ঝড়ের মধ্যে নদীতীরে একা একা কী করছেন?
শাকের বলল, আমি মাছ ধরতে বের হয়েছি সকালে। ভোরবেলায় আমার বন্ধু গেছে গভীর নদীতে মাছ ধরতে। তার সাথে কথা ছিল বেলা বাড়লে আমাকেও মাছ ধরতে নিয়ে যাবে। কিন্তু নদীতে এসে তার কোনো দেখা পাচ্ছি না।
দরবেশ বলল, আকাশ কালো হয়ে যে ভয়ানক ঝড় শুরু হয়েছে তাতে আপনার বন্ধু দূরের নদী থেকে ফিরতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। আপনাকে অনুরোধ করছি, এখনই বাড়ি ফিরে যান। আপনার বউ আপনার জন্য দুশ্চিন্তা করছে।
শাকের বলল, না, আমার বন্ধুকে না নিয়ে কীভাবে যাব? ঝড়ে পড়ে নৌকা ডুবে যদি ও মারা যায়! ও আমার ছোটবেলার বন্ধু।
দরবেশ বলল, ঠিকই বলছেন, ও আপনার জীবনবন্ধু, কিন্তু প্রকৃতির এমন ভয়াল তান্ডবের সময় আপনি ওকে কীভাবে খুঁজে পাবেন? এখনই নদীর জল কয়েক শ ফুট উঁচু হয়ে প্রবাহিত হবে। নদীর তীর, পাশের রাস্তা, মাঠের ফসল, উঁচু গাছপালা জলের তলে চলে যাবে। আমাকে মহামায়া পাঠিয়েছে নদীর তীরবর্তী এলাকায় এই খবর পৌঁছনোর জন্য। আমি এ পথেই যাচ্ছিলাম। আপনাকে এই নদীতীরে একা দেখে আকাশ থেকে নেমেছি। এ জন্য আপনাকে এখনই বাড়িতে ফিরে যাওয়া উচিত। জলোচ্ছ্বাস আসতে বেশি দেরি নেই।
শাকের বলল, আমার বন্ধুকে না নিয়ে আমি কীভাবে স্বার্থপরের মত বাড়িতে ফিরি ? তাকে আমি কত ভালোবাসি। তার সাথে কত স্মৃতি। একসঙ্গে কতদিন মাছ ধরেছি এই নদীতে।
দরবেশ বলল, আপনার গ্রাম, ঘর-বাড়ি সব প্লাবিত হবে। অনেক মানুষ, পশু-পাখি মারা যাবে, গাছপালা উপড়ে পড়বে। দয়া করে আপনি ঘরে ফিরে যান।
শাকের বলল, প্রয়োজনে আমি ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করব তবু আমার বন্ধুকে বাঁচাতে হবে।
শাকেরের কথা শুনে দরবেশ বলল, আপনি এটা কী বলেন? ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করবেন? এই ভয়ানক কালো মেঘময় ঝড়ের যে শক্তি, আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। আপনার কথা যদি ঝড়ের কানে যায়, তার গতি আরো বাড়িয়ে দেবে। এই লোকালয় শেষ করে ফেলবে। দয়া করে আপনি এ কথা বাতাসের মধ্যে আর বলবেন না।
তিন.
শাকের এবং দরবেশের কথার মধ্যে বাতাসের শ-শ-শ আওয়াজ বাড়ছে, ঘন বৃষ্টির অঝোর ফোঁটায় খুব কাছের কিছুকেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না।
শাকের বলল, আমি এখন নদীতে বন্ধুকে খুঁজতে যাব। ততক্ষণে নদীর জল কয়েক ফুট উঁচু হয়ে উঠেছে। তুমুল ঢেউয়ে জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দে মুখরিত হয়ে উঠছে প্রকৃতি।
শাকের জলে নামার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
দরবেশ বলল, আপনাকে অনুরোধ, আপনি পানিতে নামবেন না। এই অসময়ে নদীতে নামলে হারিয়ে যাবেন। নদী থেকে আর ফিরতে পারবেন না।
শাকের জীবনের মায়া না করে, দরবেশের অনুরোধ না রেখে নেমে পড়ল উত্তাল নদীতে।
এক ডুবে মাঝনদীতে পৌঁছে একবার শুশুকের মতো ভুস করে মাথা জাগিয়ে হাত নেড়ে দরবেশকে বলল, আমি যেকোনোভাবে খুঁজে বের করব আমার বন্ধুকে। আমার বন্ধু কোনো অপরাধ করেনি। তাহলে জল আর ঝড় তাকে কেন মেরে ফেলবে?
শাকেরের কথা বাতাসের তীব্র শব্দের কারণে দরবেশ বুঝতে না পেরে ডাকছে―শাকের, শাকের, আপনি ফিরে আসেন।
ওদিকে শাকেরের বউ একা একা ছেলেমেয়ে নিয়ে অপেক্ষা করছে বাড়িতে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর শাকেরকে ফিরতে না দেখে ছেলেমেয়েকে ঘরবন্দি করে নদীতীরের দিকে ছুটেছে সে। তার বুক ফেটে দুচোখ দিয়ে জল ঝরছে। বৃষ্টির মধ্যে কাঁদছে বলে চোখের জল দেখা যাচ্ছে না। সে দৌড়াচ্ছে নদীর দিকে। তীরের কাছে পৌঁছে দেখল দরবেশ বাবা দাঁড়িয়ে নদীর দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে আছে।
শাকেরের বউ বলল, আমার শাকের কই?
দরবেশ বলছে, শাকের নদীতে নেমেছে ওর মাছ শিকারি বন্ধুকে খুঁজতে।
দরবেশের কথা শুনে শাকেরের বউ বলল, আপনি ওকে ভয়ানক তুফানের মধ্যে কেন নামতে দিলেন? কেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওর বন্ধুকে খুঁজতে নামল?
দরবেশ বলল, আমি ওকে অনেক অনুরোধ করেছি। আমার কথা শুনল না। নদীর তলদেশে একবারে মাটির শরীর ঘেঁষে তার বন্ধু মাঝিকে খুঁজছে। আমি সব কিছু প্রত্যক্ষ করছি। তুমি ভয় কোরো না। আমি তো আছি।
শাকেরের বউ বলল, আপনি ওকে বাঁচান, মহামায়াকে বলে ঝড় থামিয়ে দেন।
দরবেশ বলল, আর কিছুক্ষণ দেখি, শাকের ওর বন্ধুকে খুঁজে না পেলে ঝড় থামিয়ে শাকেরের জীবন বাঁচাব।
আব্দুল আলিম-কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ।
প্রকাশিত বই- আমি আমাকে ও অন্যান্য গল্প, শাকেরের কৃষি পা।