বেঙ্গালুরু শহরে সবচেয়ে যেটা চোখে পড়ার মতন, সেটা হল খানাখন্দে ভরা রাস্তাঘাট আর অফিস টাইমে যানজট| আগে থেকে সঠিক পরিকল্পনা ছাড়াই হঠাৎ করে যেন ভাগাড় আর পরিত্যক্ত পাথুরে জমিতে একগাদা কমপ্লেক্স গড়ে উঠেছে| মূল বেঙ্গালুরু শহরের বাইরের দিকটা, যেদিকটায় বেশিরভাগ তথ্যপ্রযুক্তি হাবগুলি গড়ে উঠেছে, সেখানে বেশিরভাগটাই জলে-জঙ্গলে ভরা| জন বসতি বিশেষ নেই, খাবার জলেরও বেশ অভাব| রোজ সকালে পিজি কিংবা হোমস্টে গুলোতে ট্যাঙ্কারে করে জল আসে| কাবেরীর জল এদিকটায় প্রায় আসেই না| পাহাড়ি রাস্তার ঢাল দেখে জায়গাটার রুক্ষতা সহজেই অনুমেয়|
অফিস শেষ করে “বন শংকরী”র ফুটপাথ বেয়ে হাঁটছিল সুমন, সামনের বাসস্টপটার দিকে| সন্ধ্যের অন্ধকারটা তখনও গাঢ় হয়নি| রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা| অফিস থেকে বাসস্টপ যাবার জন্য অটো করাই যেত, দূরত্বটা বেশ খানিকটা| তবে অটো ভাড়া এদিকে বেশ বেশি, শেয়ারের অটো পাওয়া যায় না বললেই চলে| এদিকে বর্ষাকালে যখন তখন বৃষ্টি আসে, বৃষ্টির ফোঁটাও বেশ বড় আর বৃষ্টির তোরও খুব| বৃষ্টির জল মাথায় লাগলে জ্বর অবধারিত| এতরকম অসুবিধার মধ্যেও সস্তার শিল্পায়ন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিবছর তার মতো হাজার হাজার তথ্যপ্রযুক্তি ইঞ্জিনিয়ারকে কর্ণাটকের রাজধানীতে ছুটিয়ে নিয়ে আসে| কারণটা প্রায় সকলেরই জানা| আনমনে হাঁটছিল সুমন| পিজিতে ফিরে বাড়িতে ফোন করতে হবে| এমনিতেই এর আগে কোনদিন বাড়ি ছেড়ে থাকেনি সে| এমনকি কলেজেও হোস্টেল লাইফের অভিজ্ঞতা নেই তার| এখানে নিজের কাজ সব নিজে করতে হয়| বাড়িতে তার মা অসুস্থ কিন্তু দিদি ছিল| তাই কোনদিন সে অর্থে কষ্ট করতে হয়নি|
হঠাৎ তার পায়ে কি যেন একটা ঠেকল| চমকে উঠে তাকিয়ে সুমন দেখল ফুটপাথের উপর একটা উইয়ের ঢিবির সামনে, সিঁদুর মাখানো লেবুর মালা গলায় দিয়ে কালো পুতুলের গায়ে পিন বিঁধিয়ে কে যেন ফেলে রেখে গেছে| পাশে একগোছা ধূপ জ্বলছে| আচমকা দেখলে মনে হবে নাগদেবীর আরাধনা করা হয়েছে| যেমনটা গ্রামবাংলায় হয়ে থাকে| সাউথ ইন্ডিয়ান সিনেমায় এমনটা অনেক দেখেছে সুমন| কিন্তু ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে অপকর্ম করা হয়েছে এখানে| ছুঁচে বেঁধা কালো পুতুল, তার মুখে গোল চোখ আর বিকশিত দন্তপাটি সবটাই হাতে আঁকা| যেন প্রচন্ড যন্ত্রণায় পুতুলগুলো কামড়াতে আসছে উন্মাদের মতো| এসব আগেও দেখেছে সুমন, ব্ল্যাকম্যাজিক সম্পর্কে জানার আগ্রহ হয়েছিল একবার| বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল, পায়ের জুতোটা শুকনো ডাঙায় ঘষে জায়গাটায় এক দুবার থুতু ফেলে জোরে হাঁটা লাগাল সে| মনটা কেমন কু গাইতে লাগল|
পিজিতে ফিরে ক্যান্টিনে রাতের খাবারটা বলে দিল সুমন| এখানে একটি চমৎকার বাঙালি কুক আছে| মেদিনীপুরের চাউলপুরা গ্রামের ছেলে, বাংলা আর ওড়িয়া মিশিয়ে বলে| পুরো বেঙ্গালুরুতে এরকম প্রচুর মেদিনীপুরের ছেলে কাজ করে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ও পিজিতে| এই পিজির অ্যাটেনডেন্টরাও বাঙালি| শুয়ে যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়ালই নেই সুমনের| মাঝরাতে হঠাৎ অদ্ভুত একটা আওয়াজে ঘুম ভাঙল তার| এই পিজিতে ছাদের ওপর ঘর পেয়েছে সুমন| পুরো বেঙ্গালুরুতে আইটি হাবের কাছাকাছি পিজিগুলোতে জায়গা পাওয়াই দুষ্কর| একটা মাঝারি ঘরকে প্লাইউডের পার্টিশান দিয়ে 2BHK বলে চালায় এরা| সুমনের ঘরটার মাথায় আবার অ্যাসবেস্টাসের চাল| সেই চাল বেয়ে কি একটা যেন গড়িয়ে নীচের দিকে নেমে গেল, কিন্তু মাটিতে পড়ল না| চমকে উঠল সুমন, চারপাশে এক অপার নৈঃশব্দ| দূরে আউটার রিং রোডের উপরের ফ্লাইওভার দিয়ে সশব্দে রাতের বুক চিরে ছুটে চলেছে ব্যস্ত নগরীর বাহনেরা| ব্রিজ পেরোনো ভারী যানের কম্পনে তাদের পিজির বিল্ডিংটাও কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝে যেমনটা রোজ হয়ে থাকে| পাথুরে রুক্ষ এই টিলাভূমির জায়গাটা এমনিতেই কেমন যেন একটা দুর্ঘটনাপ্রবণ| কদিন আগে সুমনের পিজির পেছনে একটি নির্মীয়মান ফ্ল্যাট বিল্ডিং ভেঙে পড়েছিল| সেদিনটা ছিল শনিবার| এমনিতেও অচেনা জায়গায় খুব বেশি ঘোরাঘুরির অভ্যাস নেই সুমনের| ছোট থেকেই সে একটু ঘরকুনো প্রকৃতির, একটু ভাবুক, একটু আধটু কবিতাও লেখে| দুপুরে খাবার পর বিছানায় শুয়ে ল্যাপটপে গান শুনছিল সুমন| হঠাৎই ধুড়মুড় করে একটা ভীষণ শব্দ শুনতে পেলো সে, যেন খুব ভারী কিছু ভেঙে পড়ছে, অনেকটা পাহাড়ে ধ্বস নামলে যেমন হয় সেরকম, সাথে অনেক লোকের চিৎকার চেঁচামেচি আর কান্নার শব্দ| সঙ্গে সঙ্গে দুম করে হয়ে গেল লোডশেডিং| বেঙ্গালুরুর আবহাওয়া এমনি বেশ ঠান্ডা| কিন্তু আসা ইস্তক সুমন দেখছে ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের খুবই সমস্যা এখানে| সারা দিনে কতবার যে লোডশেডিং হয় তার ইয়ত্তা নেই| তাই বেঙ্গালুরুতে পিজি দেখতে হলে দেখে নিতে হয় ইলেকট্রিক ব্যাকআপ আছে কিনা আর কাবেরীর জল আসে কিনা| যদিও বেঙ্গালুরু শহরে সবকিছুই চলে ঈষৎ রুঢ়ভাষী ব্যাবসা সর্বস্ব মানসিকতার তেলুগু সম্প্রদায়ের রিয়েল এস্টেট এজেন্ট “রেড্ডি”-দের অঙ্গুলি হেলনে| এই যে শহর জুড়ে এত পিজি বা হোমস্টে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গা ঘেঁষা ঘেঁষি করে, তার সবই প্রায় তেলুগু সম্প্রদায়ের মালিকানাধীন| পিজি খোঁজার সময় এদের মিথ্যে ভাষণ বুঝতেই দেবে না পরবর্তীতে কি কি ভোগান্তি আছে কপালে ! সুমনের পিজিতে ইনভার্টার ব্যাকআপ আছে যদিও, কিন্তু তাও অপর্যাপ্ত হয়ে পরে মাঝে মাঝে| বেশ কিছুক্ষন খাটেই শুয়ে রইল সুমন| মনটা কেমন একটা আনচান করছিল| বাইরে কি হয়েছে দেখার জন্য একটা অদ্ভুত অস্বস্তি থেকে গায়ে জামাটা গলিয়ে ট্র্যাকস্যুট পরেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল সুমন| ছাদে বেরিয়ে রেলিং ধরে ঝুঁকে পিজির পিছনের দিকটা দেখার চেষ্টা করল একবার| কিন্তু পাশের ফাঁকা জমিতে নারকেল গাছের সারি আর পরপর ফ্ল্যাট বাড়ি দূরের দৃশ্যমান্যতাকে খর্ব করেছে| শুধু চারপাশের জোরালো পরিস্থিতি আর আতঙ্কের পরিবেশ দেখে অনুমান করতে পারল সাংঘাতিক একটা কিছু ঘটে গেছে| নিচে পিজির অ্যাডমিন অফিসে গিয়ে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করায় তেলেগু ম্যানেজার আধা হিন্দি, ইংরেজির সাথে তেলেগু মিশিয়ে বলল “বিল্ডিং গির গ্যায়া, building collapsed, রাত্রিপুটা বিদ্যুৎ কোটা এক্কুভাভুতুনডি”| তার হাবে ভাবে বোঝা গেলো রাতের মধ্যে কারেন্ট আর আসবে না|
পিজি থেকে বেরিয়ে কয়েক পা ভিড়ের দিকে এগোতেই সুমনের চোখে পড়ল দৃশ্যটা| এই জায়গায় আসা ইস্তক অফিস যাতায়াতের পথে যেখানটায় দেখা যেত একটা বিল্ডিং উঠছে, জায়গাটা হঠাৎ কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে| ঠিক সন্ধ্যে নামার আগে চারদিকে ধুলোর কুন্ডলী পাকানো ধোঁয়া উঠছে| চারদিকে মানুষ তখন পাগলের মতো দৌড়াচ্ছে এদিক ওদিক| বিল্ডিংটার তলায় শ্রমিকেরা থাকত তাদের পরিবার নিয়ে, প্রায় সবাই চাপা পড়েছে| কর্ণাটক রাজ্য সরকারের পুলিশ, দমকল, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী জায়গাটাকে ঘিরে রেখেছে কর্ডন করে| জায়গাটার কাছে কাউকে যেতে দিচ্ছে না তারা| সামনের ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে সুমন দেখল একটি শিশুর থ্যাতলানো রক্তমাখা ড্যালাপাকানো দেহটা বেলচা দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে বার করা হচ্ছে| এমনিতেই এখানকার বিল্ডিংগুলোর কনস্ট্রাকশন দেখলে বোঝাই যায় মিউনিসিপাল রুলকে দেদার ফাঁকি দিয়ে ঘুষের কালো হাতে কাজ হয়| সূর্যের আলোটুকু গলবার সুযোগ না দিয়ে গায়ে গায়ে বিল্ডিংগুলো যেন মূর্তিমান বিভীষিকার মতো গিলতে আসে সুমনকে| দৃশ্যটা দেখতে না পেরে চোখ বন্ধ করে সেখান থেকে চলে এসেছিল সুমন| শুধু একটি আতঙ্ক তার মনকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো, যদি কোনোদিন তাদের পিজিটাও এইভাবে কোলাপ্স করে, সেদিন কি হবে? ওতো দূর থেকে এসে তার বাবা হয়তো তার দেহাবশেষ ও পাবেন না| ঐরকম তালগোল পাকানো মাংস পিন্ড হয়ে রাস্তার ধুলোয় মিশে যাবে তার দেহ| ঠিক যেমনটা রাস্তায় কুকুর গাড়ি চাপা পড়লে হয়| বেঙ্গালুরুর মতো একটা আপাত ঝা চকচকে অথচ মূল্যবোধহীন শহরে, তার মতো পেটের দায়ে ভিন রাজ্যে পরিযায়ী, মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের ছেলের ব্যক্তি স্বাধীনতা কিংবা জীবনধারণের প্রশ্নে, মানুষ আর পশুতে খুব একটা ফারাক আছে কি? একটা তীব্র দেহতাত্বিক অনুকম্পায় মন টা তার ভরে গেলো| মা- দিদি র সাথে শেষবারের মতো দেখাটাও বুঝি আর হলোনা তার| কত কষ্ট করে তার এই শরীরটা ওঁরা তৈরী করেছেন, তার দেহাবশেষ এর ওপর তো ওদেরই অধিকার সব থেকে বেশি| অথচ ওরাই… হা ভগবান তুমি কি এতটাই নিষ্ঠুর? বুক ফাঁটা কান্নায় গলার কাছ টা দলা পাকিয়ে এলো সুমনের| এইসব আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে সেই রাতে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিল সুমন, দেখেছিল সেই ছোট ছেলেটি রক্তমাখা অবস্থায় সেই স্তূপ থেকে বেরিয়ে আসছে আর সে নিজে হাতে তার দলাপাকানো শরীরটাকে একটা বেলচা দিয়ে কাঁচিয়ে জড়ো করছে একপাশে| আস্তে আস্তে সেই কাঁচা রক্ত মাংসের স্তুপে সে আবার চাপা পড়ে যাচ্ছে| দৃশ্যটির অভিঘাতিক তীব্রতায় স্বপ্নেও ছেলেটির চোখের দিকে তাকাতে পারেনি সুমন| সে চোখের অদ্ভুত দৃষ্টিতে কোনো যন্ত্রণা নেই| অথচ আছে এক অপার্থিব বিস্ময় ও জীবনের প্রায় সূচনালগ্নেই প্রতাড়িত হবার পর এক তীব্র বিদ্বেষ| মনুষ্যসৃষ্ট এই কাঁচের স্বর্গের বাইরের গোলার্ধে জন্ম হয়েছিল তার| সেই দুপুরে মায়ের কোলে নিশ্চিন্তে শুধু সে ঘুমাতে চেয়েছিলো| এই ছোট্ট বয়সেই জাগতিক মায়া থেকে মুক্ত হয়ে অর্থলোলুপদের দুনিয়াদারী আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে চোখেমুখে তার কোনো ক্ষোভ নেই, আছে শুধু এক নিষ্কলুষ জিজ্ঞাসা| হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেছিল সুমনের| সে রাতে আর ঘুম আসেনি তার|
কিন্তু আজকের রাতের ঘটনা স্বপ্ন নয় কোনোমতেই| দিব্য বুঝতে পারছে, সে জেগে আছে| সিলিং এর পাখাটা বন্ধ হয়ে গেছে, লোডশেডিং হয়ে গেছে নির্ঘাত| ইনভার্টার এর ব্যাক আপ কি শেষ? এতো তাড়াতাড়ি? কখন কারেন্ট গেছে? তলায় কি কেউ নেই জেনারেটারটা অন করার মতো? মাথায় এইসব প্রশ্ন নিয়েই বেশ কিছুক্ষন বিছানায় কান পেতে শুয়ে রইলো সুমন| চেতন আর অবচেতনের মাঝামাঝি এক অদ্ভুত অবস্থায় পরে সে ঘামতে লাগলো| অথচ সারা ঘর জুড়ে এক মৃদু আলো| সে আলোর উৎসের খোঁজ না করেও দিব্য এক হাত দূরের জিনিস দেখা যায়| ঘরের বাতাস অদ্ভুত রকম ভারী হয়ে উঠেছে| নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে একটা অদ্ভুত চাপ অনুভব করছে সুমন| বন্ধ জানালাটা খুলে দিলে ভালো হয়, কিন্তু বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতা নেই তার| ঘরের ছাদটা কি ক্রমশ কাছে নেমে আসছে? নাকি তার বিছানাটা শূণ্যে ভাসছে? একটা প্রচন্ড বল যেন খাটের পাশের বন্ধ জানলাটাও খুলে ফেলতে চাইছে| হঠাৎই চোখের নিমেষে খুব দ্রুত ছাদটা যেন সুমনের দিকে ধেয়ে এলো| ভয়ে চোখ বন্ধ করে বালিশের পাশে নিজের ফোনটা হাতড়াতে লাগল সুমন, কিন্তু পেল না| আবার সেই শব্দ, এবার একসাথে অনেক| হঠাৎই সমস্ত চাল জুড়ে সেগুলো যেন ছোটাছুটি লাগিয়ে দিয়েছে| সারারাত জুড়ে চলল একই তাণ্ডব|
সকাল হতেই সুমন ছুটল কমপ্লেন করতে| তেলুগু ম্যানেজার সুমনের কথায় বিশেষ আমল না দেওয়ায় সুমন গিয়ে ধরলো সেই আধা ওড়িয়া আধা বাঙালি কুক টিকে| সেই এখানকার হত্তাকত্তা, আধাবাংলায় সে বলল “কিছু চিন্তা করবেননি দাদা, ও ইঁদুর আছি”| পরপর দু রাত চলল এই উপদ্রব| ঘরের ছাদে সেই দৈত্য সম আগন্তুকের অশরীরী স্পন্দন সাথে সেই একই ভাবে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে যাওয়া, সেই মাঝরাতে লোডশেডিংয়ের মতো সিলিং পাখা বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও এক অজানা আলোয় ঘর ভরে যাওয়া, আশ্চর্য্যজনকভাবে ছাদের, নিচে নেমে আসা, সেই একইভাবে কাঁচের জানলায় বলপ্রয়োগ কোন অদৃশ্য শক্তির, সমস্ত ঘটনা সমান লয়ে ঘটতে থাকলো| শুধু ইঁদুর? তাহলে বাকি অনুভূতিগুলো? সেগুলো কি শুধুই ভীত, বিপর্যস্ত সুমনের ভ্রান্ত মনের কষ্টকল্পনা? মনটা খচ্ খচ্ করতে লাগল সুমনের| সুমন এই পিজিতে এসেছে প্রায় তিন মাস হল, কই আগে তো কোনদিন এমন অভিজ্ঞতা হয়নি তার| হঠাৎই যেন গত দুদিন ধরে কেউ তাকে জানান দিতে চাইছে নিজের বিদেহী উপস্থিতি| ঘটনার তীব্রতা সীমা ছাড়ালো তৃতীয় দিনে, মাঝরাতে চাল থেকে নামতে নামতে হঠাৎ ঘরের দরজায় ভীষণ জোরে একটা আঘাত করল ওরা| দরজাটা যেন ছিটকে খুলে যাবে সেই অভিঘাতে| রাতটা আর বিছানা ছেড়ে ওঠেনি সুমন|
পরের দিন সকালে বাড়িতে ফোন করে বাবাকে সব জানায় সুমন| সে তখন প্রায় নিশ্চিত এ অতিলৌকিক ঘটনা ছাড়া কিছু নয়| জীবনে এরকম অভিজ্ঞতা এর আগেও এক দুবার তার হয়েছে| পর পর তিন রাত না ঘুমানোয় শারীরিক ও মানসিকভাবে অসম্পূর্ণ বিপর্যস্ত সে| এমনকি গত তিনদিন অফিসও যেতে পারেনি সুমন| সিক লিভ নিয়ে ঘরেই বসে থাকতে হচ্ছে তাকে| এই তিনদিনে সে বেশ বুঝতে পারছে তার স্বাভাবিক চেতন ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে| এমনকি স্নান বা খাওয়ার ইচ্ছেও চলে গেছে সম্পূর্ণ ভাবে| এই তিন দিন রুম সার্ভিসকেও দরজা খোলেনি সে| সেটা যে শুধু ভয় থেকে তা নয়, অপরিষ্কার শরীরে, অপরিচ্ছন্ন ভাবেই থাকতে তার ভালো লাগছে| মাঝে মাঝে শরীরে একটা প্রচন্ড জ্বালা সে অনুভব করছে| ইচ্ছে করছে হাতের কাছে ধারালো কিছু পেলে তা দিয়ে নিজের শরীরটা চিরতে| একবার দুবার পেপার কাটিং নাইফ দিয়ে সে চেষ্টা করেও ছিল সুমন কিন্তু পরক্ষনেই বোধহয় পরমেশ্বরের অশেষ দয়ায় সে সম্বিৎ ফিরে পেয়েছে| তার স্বাভাবিক চৈতন্যে ফিরে সে বুঝতে পেরেছে এই ধ্বংস্বাত্মক আমিটা তার আসল আমি না| মাত্র ১২ বছর বয়সে তন্ত্র মতে তার দীক্ষা হয়েছে| একটা বয়স থেকেই আধিভৌতিক ঘটনা কে উপলব্ধি করতে পারে সে| বুঝতে পারে আর পাঁচ জন যে জিনিস উপলব্ধি করতে পারেনা, তা তাকে ষষ্ঠেন্দ্রিয়ে কেউ বুঝিয়ে দিয়ে যায়| এ তার এক আশ্চর্য্য ক্ষমতা বলা চলে| কিন্তু এবারে বাড়ি থেকে দূরে এসে একা এই পরিস্থিতিতে বড় অসহায় লাগছে তার| পরদিন দুপুরে ফোন করে তার বাবা পিজির কুকটিকে চেপে ধরতে একথা ওকথায় আসল কথা স্বীকার করে সে, “ওই ঘরটায় প্রবলেম আছি, মোর বাবা-মাও এসেছিল গ্রাম থেকে, ওই ঘরে থাকতে পারে নাই, কয়েকবছর আগে ওই ঘরটাতে একটা সুইসাইড কেস ঘটছিলো, দাদার মতই একটা আইটি এর ছেলে ছাদ থেকে ঝুলে পরছিলো”| আর একদিনও পিজিতে থাকেনি সুমন, পিছনের পিজিতে শিফট করেছিল একদিনের নোটিশে| এখানে পিজি বদলানো তেমন শক্ত কিছু নয়| শুধু শেষ দিনটা বাবার কথামতো ক্যান্টিন থেকে একটা ছোট লোহার রড মাথার বালিশের তলায় দিয়ে শুয়েছিল সুমন| তার বাবাও ফোন করে সুমনের গুরুদেব কে সব খুলে বলেন। গুরুদেব আশ্বস্ত করেন তাঁকে| এই পিজি তে শেষ রাতে খুব ভালো ঘুম হয়েছিল সুমনের, এসব অভিজ্ঞতা আর হয়নি তার| মনে হয়েছিল এক দীর্ঘ মানসিক উচাটনের শেষে, স্থির সাম্য বিরাজ করছে তার চারিদিকে|
আজ দীর্ঘ লকডাউনের পর অফিসে ফিরছে সুমন| এতদিন ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলার পর সদ্য আজ বিকেলের ফ্লাইটে বেঙ্গালুরুতে নেমেছে সে| নাগরিক ব্যস্ততার বিপরীতগামিতায় হেঁটে এই কদিনে মায়ানগরীর বাহ্যিকতায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে| একটা ক্যাব নিয়ে পিজিতে ফিরতে ফিরতে পুরোনো বিল্ডিংটার দিকে একবার চাইল সুমন| পিজিটা বন্ধ হয়ে গেছে| ছাদের ঘরে আদৌ আর কেউ থাকতে পেরেছিল কি?