(এক)
কালিবাড়ী বাজারে এসে একটু জিরিয়ে নেয় সনজু। পানদোকানের বালতিতে থাকা একমগ পানি মুখে দিয়ে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করে। সারাদিন বেশ খাটুনি গেছে তার শরীরের উপর দিয়ে। গরুটা শেষ নাগাদ বিক্রি হল না। সারাদিন না খেয়ে গরুটা যেমন নুইয়ে পড়েছে ঠিক তেমনি সনজুও। আজ শনিবার, হাটের দিন। এই দিনে গরুটা বিক্রি করতে না পারাটা হতাশার। পানদোকানী তহিদুল এই বিষয়টা জানে। দু-টুকরো শুকনো সুপারী পানের ভাজে পুরে চুনের বটাটা গুজে দিতে দিতে নীরবতা ভাঙলো।
– সনজু ঘুরেফিরে লাভ নেইরে ভাই। বাড়ি চলি যা। বিক্রি করতে পারবে না।
সনজু হাত বাড়িয়ে পানটা এগিয়ে নেয়। মুখে গুজে দিয়ে একটু সটান হয়। সনজুও জানে, আজ বাজারে হাজারো কথা শুনে এসেছে। তার যত রাগ অভিযোগ তার গায়ের নেতাদের উপর। তার তিরিশ বছেরর জীবনে এমনটা আগে কখনো দেখেনি। সনজু ঘুরে বসে তহিদুলকে সায় দেয়।
– হ, বাজারে কত কথাই শোনা অইছে। গওহর চাচা বললে রাজনীতির কথা। গরু বেচাও রাজনীতির মইধ্যে চলে গেছে। দহগ্রাম আর আঙ্গুরপোতাবাসীকে সপ্তায় দুইদিন গরু পারাপারের অনুমতি দিল ঠিকই বিএসএফ। গরু বিক্রির সিরিয়াল দেয় চেয়ারম্যানে।
তহিদুল তার কথায় সায় দিয়ে চায়ের কাপে চামচ ঘুরাতে থাকে। সামনের রাস্তায় ছুঁ মেরে চলে যায় শফিকুলের ভ্যানগাড়ি। গরুর হাটের সে আরেক দালাল। গরুর খড়বিচালী বিক্রি করলেও সে বিক্রি করে গরুর টোকেন। চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য মিলে বিজিবি সদস্যদের ম্যানেজ করে অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে এসব গরুকে বৈধতা দিয়ে সিরিয়াল দেয়। ভারতীয় গরু প্রবেশের কারণে দহগ্রাম-আঙ্গুরপোতাবাসী নিজের পালিত গরু বিক্রি করতে পারে না।
তহিদুল দ্রুত চলে যাওয়া শফিকুলের ভ্যানের দিকে তাকিয়ে সনজুর মনোযাগ আকর্ষণ করে।
– তর গরু বিক্রিতো কোনকালেও হবি না। শফিকুলরে দুইচারপাশশো টেকা দিয়া দে। দেখিস বুধবারে গরু বিক্রি হয়ে যাবেন।
সনজু গরুর খাটো রশিটা টেনে ধরে উঠে বসে। চায়ের দামটা চুকিয়ে বাড়ির পথ ধরে। সরু রাস্তাটা পেরোলে একটা ছোট খাল। খালের পানি শুকিয়ে এখন খা-খা করেছে। শুকনো হলেও মানুষজন সাঁকো পেরিয়েই রাস্তা পেরোয়। গরুটাকে ছেড়ে দিয়ে একটু দম নেয় সনজু। দিনহাটা মন্দিরের পাশে সবুজ লতাগুল্ম বেশ বড় হয়ে উঠেছে, পূব পাশটায় গজিয়ে উঠেছে নরোম দূর্বা ঘাস। মানুষের পদচারণা বেশি নেই বলেই ঘাস ও গাছেরা স্বাধীন ডালপালা বিস্তার করেছে। এই সুযোগে লতাপাতায় মুখ লাগায় গরুটা। চিন্তাটা আবারো মাথাচড়া দিয়ে উঠল সনজুর। গরুটা বিক্রি হলো না। তার বাবার অসুখটা বাড়ছে।
(দুই)
বাড়ির পাশের মসজিদে মাগরিবের আযান শোনা গেল। কবুতরগুলো তখনো কুপে ঢুকেনি। হাঁসদলের কয়েকটা তখনো লেব্তুলায় হাটছে। সনজু বাড়ি ফিরল। ছোট খুপরী ঘরটায় তার বাবা ব্যথায় কুকরাচ্ছে। গায়ে জামা নেই। পরনের লুঙ্গিটা বেশ খানিক উপরে উঠে গেছে। কুপির আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে তার বাবার মুখ। এই যন্ত্রণাকাতর মুখের আলো-অবয়ব সনজু অনেক আগ থেকেই দেখে এসেছে। এই গোটা দিন দশেক ধরে ব্যথাটা বেড়েছে।
মায়ের সাড়া পেয়ে সনজু এগিয়ে যায় পেয়ারাতলার রান্নাঘরের দিকে। কুন্ডুলী পাকানো ধোয়া বেরুচ্ছে চুলা থেকে। ঘর্মাক্ত মুখটা আচলে মুছে নিয়ে তাকায় সনজুর দিকে ।
– আইজ বিচতি পাললনি না গরুটা। তর বুড়া বাপটা গরুর মত চিল¬াছে ষারাদিন।
– না, এই গরু বিক্রি করা যাবনা। বাবারে চিকিৎসা করতেহলে টেকা সুদে নেও মা।
– তরে কে টেকা সুদে দিব হারামজাদা।
ছেলেকে শাসানোর এই গালি মায়ের মুখে আজ নতুন নয়। স্বামী প্যারালাইজড হবার পর পুরো সংসারের ভার তার ঘারে। খেয়ে না খেয়ে স্বামী-সন্তানের মুখে ভাত জুটানোই যেন বড় শান্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ সন্ধ্যায় এই পেয়ারাতলায় দাঁড়িয়ে যে জীবনের খতিয়ানের হিসেব তা সনজুর ঘাড়েই বর্তালো। বুড়া বাপ তার যে তিলেতলে ধুকে মরছে। কেউ কিছুই করতে পারছে না। তিন তিনটে মানুষ তার পরিবারে। একটা মানুষ পুরো অচল। সেই সকাল থেকে শুরু হয় জীবনযুদ্ধ। ভাত রানতে গিয়ে চাল আছে তো তরকারী নাই। লাউশাক, কচুশাক, এটা সেটা কুড়াতে কুড়াতে আধবেলা। ঘুটে কুড়ানী মা তার হাফ ছেড়ে বাঁচে রান্নাটা শেষ হলে।
(তিন)
সনজুদের বাড়ি যে পাড়ায় সেখানে প্রায় একশো ঘরের বসবাস। পূবপাড়া পেরোলে ছোট ডোবা, তারপর চিকন আলের মতো সড়ক। সেটা আদৌ সড়ক মনে হয়না সনজুর কাছে। ও পাড়ায় – পশ্চিমপাড়ায় দশঘর হিন্দু পরিবার। এর মধ্যে গোটাতিনেক পরিবার এতোটা প্রান্তিক না, যতটা না সনজুদের পরিবার। এ পাড়ায় সুরেশরা নাড়ু বেচত, এখন তারা গরু কেনাবেচার সাথে যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া জগদীশ, ইন্দ্রজীত, সুকুমারদের বাড়িও এখানে। গেরস্থি নেই, কাজ নেই, নিজেদের ঘরভিটের লাগোয়া জমি চাষবাস করে যা আয় হয় তা দিয়ে চলে তাদের সংসার।
দেবযানীদের বাড়ি এ পাড়াতেই। এরা সবাই এ ছিটমহলের বাসিন্দা। তাদের সবার ধর্মের পরিচয় আছে কিন্তু দেশের পরিচয় নেই। দেবযানী আর সনজুরা তবু পড়াশোনাটা চালিয়ে গিয়েছে পাশের গায়ের স্কুলে। সনজুর ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। বাবার হাত ধরে যখন স্কুলে গিয়েছিল। মা তার প্যান্ট ধুইয়ে দিয়েছিল, শুকোয়নি। শেষে ভেজা প্যান্ট পড়েই ইস্কুলে যেতে হয়েছিল। জুতো নেই খালি পা, তবু কত উত্তেজনা। কিন্তু বিপত্তি সাধলো হেডমাস্টার। তাদের কিছুতেই স্কুলে ভর্তি করবেনা। কারণ তাদের সুনির্দিষ্ট নাগরিকত্ব নেই। হেডমাস্টার সনজুর বাবাকে বললেন।
– তোমাদের পাড়ায় একটা ইসকুল খুলে নিলেই পারো।
এ কথা বলার পরও সনজুকে ভর্তি করেছিল এই স্কুলে। তাদের গ্রাম থেকে ফুলবাড়ির চন্দ্রখানা প্রাথমিক বিদ্যালয় বেশ দূরে। ও গ্রামের অনেকেই ভর্তি হয়েছে বাবা-মা’র বিশেষ আইডি কার্ড দিয়ে! দাশিয়ার ছড়া গ্রামের দেবযানীও এই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল একই দিনে। দুজন বাবার অনুরোধে। এ পাড়ায় এখন শখানেক ছেলেমেয়ে ছিল স্কুলছাড়া। ওদের টিকা নেই, স্কুল নেই, যত্মআত্তি নেই। তাদের যেভাবে জন্ম হলো, জন্মের পর মানবেতর বেঁচে থাকা। স্নেহ আছে, মায়া আছে কিন্ত অনেকেরই যতটা মিলে না। সারাদিন দলবেঁধে এটা সেটা খেলা। জামাইবৌ খেলা, চড়ুইভাতি খেলা, ধুলোবালি খেলা, চেলচেলি খেলা।
(চার)
দেবযানী যেদিন প্রথম স্কুলে গিয়েছিল – বেগুনি বলপ্রিন্টের ফ্রক পড়া ছোট্ট একটি মেয়ে। গালগুলো ফেটে গেছে শীতে। এই সময়টার কথা খুব মনে পড়ে সনজুর। শীতের দিনে শুকনো বাঁশের সাঁকোয় ঝুলে থাকার স্মৃতি তাকে সম্মোহনী করে তুলে।
দেবযানী বলতো-কাকু বকবে, বাড়ি চল সনু
সনজু ভ্রক্ষেপ করতো না দেবযানীর কথা। দুপুর গড়িয়ে বেলা পশ্চিমে না গেলে সময়ই হতোনা সনজুর। বাড়ি ফেরার পথে নদীর পার ধরে এগাতো দুজন। কোনদিন খেসারি কলাইয়ের ক্ষেতে বসে কলাই খাওয়া হতো ধূম। এ বাড়ির পাকা বেল কুড়ানো, কিংবা শীতের দুপুরে বাতাসে ভেসে যাওয়া শিমুল তুলো ধরার খেলা। আবার কোনদিন দেবযানীর সাথে চড়ুইভাতি খেলা। সনু জামাই আর দেবী বৌ। এই অসাধারণ ভালোলাগার সময়ে সনজু বলে উঠতো- আচ্ছা দেবী, বড় হলেও কী তুই আমার বৌ থাকবি?
দেবাযানী উত্তর দিতনা, নিশ্চুপ থেকে তারপরউত্তর মিলতো- কী জানি বাপু।
সনজু- আচ্ছা দেবী তুমি কী ট্রেনে ছরছ? তুমি যদি আমার বৌ হও সত্যি সত্যি ট্রেনে ছড়াম।
দেবযানী আবারো চুপ। তার জামার পকেটথেকে দুটো লাড্ডু বের করে। ‘নে খাই, খেতে খেতে বাড়ি যাই।’
সনজু লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ির পথ ধরে। পেছনে পরে থাকে দেবযানী। চিৎকার করে বলে- ‘একটু খাড়া সনজু। আমারে নিয়া যা।’
দেবযানীর দাদামশাই ও তার পিসিরা আজ থেকে বেশ কয়েক যুগ আগে ভারতে চলে গিয়েছে। এখানে আর জীবন চলছিল না। হাড়ভাঙা খাটুনির পর জীবনের বেঁচে থাকার স্বপ্ন যেখানে ক্ষীণ সেখানে থেকে লাভ কী!সেখানে তারা কী মানুষ- নাকি না-মানুষ। নাগরিকত্ব হীনতায়-অধিকারহীনতায়-বঞ্চনায় আর অনিশ্চয়তায় ঘেরা জীবনে কী সংসার, আর কী মোহমায়া। দেবাযানীর বাবা পড়ে রইলো মোহমায়ায়, তার মায়ের টানে। শুধু একটা কথা বলেছিল- থাকি যাও, জীবনতো একটাই। এই এক জীবনে মনের মানুষ হারায়ে লাভ আছে কও। তোমার খারাপ লাগপেনা।
দেবযানীর পিসিরা যে বছর ভারতে চলে গেল। সে বছর এ দেশে যুদ্ধ। রাস্তাঘাট নাই, খবরের কাগজ নাই, রেডিও নাই। মানুষের মুখে মুখে শুনে হাঙামার কথা। শেখ মুজিব যুদ্ধ ঘোষণা করেছে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানীরা অধিকার দেয় নাই। শেখ মুজিব বাণী দিয়েছে ঢাকায়। ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। তখন মার্চ মাস। দেবযানীর দাদা দিনরাত চিন্তা করেছে। সীমান্তের মানুষ না খেয়ে মরছে। মরছে কলেরায়। হিন্দুস্তানে গিয়ে একটা উপায় বের করতে হবে। এই মাটিতে আর মন টিকলো না।
ঠিক বছর তিনেকের মাথায় মুজিব-ইন্দিরা মিলে তখন চুক্তি-টুক্তি হচ্ছে। তারাতো আর এই চুক্তি জানেনা। দেশ বিভাগের আগে স্যার র্যাডক্লিফের নেতৃত্বে যে স্থলসীমান্ত কমিশন গঠন করেছিল, তাদের নির্ধারিত সীমানা নিয়ে শুরু হয় নতুন বিতর্ক। ভারত ও পাকিস্তানে এই নিয়ে বেশ শোরগোল। আর তখন এই ছিটমহলগুলো নিয়েই বড় সমস্যা দেখা দেয়। সমস্যার সমাধান হয়ে উঠেনা সহজে। আরেকটা চুক্তি সই হলো। চুক্তির সইয়ে আর ভাগ্যবদল হয়না ভাগ্যবিড়ম্বত মানুষদের।
আটান্নো সালের দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নূনের মধ্যে চুক্তি সই হলো। সেটি কার্যকর হতে পারেনি দুই দেশের সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে। চুক্তিতে ভারতের মধ্যে থাকা বেরুবাড়ি ছিটমহল পাকিস্তানের অংশ হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়। কিন্তু ভারতের ভূখÐবেষ্টিত দুটি ছিটমহল দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতার ভাগ্য অমীমাংসিত থেকে যায়। চুয়াত্তোর সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে বেরুবাড়ি ভারতের হাতে প্রত্যর্পণ করা হয় এবং দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাকে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ করার জন্য ওই দুটি ছিটমহলকে সংযুক্ত করতে কুচলিবাড়ির তিনবিঘা জমি ভারতের কাছ থেকে স্থায়ী লিজের ব্যবস্থা রাখা হয়।
মানুষের জনজীবন কঠিন রাজনীতির সুঁতোয় বাঁধা পড়ে ঠিকই। সবই এগোয়- এগোয় না জীবন। তেমনি এগোয়না দেবযানীর দাদার পরিবার।
(পাঁচ)
দাশিয়ার ছড়া। কবিতার ছন্দের মতো একটা গ্রাম। শোনা যাচ্ছে এই গ্রাম চার ভাগ হয়ে চারটি ইউনিয়নের সাথে মিশে যাবে। পাশের সব ছিটমহলগুলোতে বেশ গুঞ্জন। যারা ভারতে চলে যেতে চায় তারা যেতে পারবে। যার ইচ্ছে থেকে যেতে পারবে এই মাটিতে।
গ্রামের মানুষ দুইভাগ হয়ে গেছে। কেউ কেউ নেতাদের পেছনে ছুটছে। কেউ কেউ পাশের দেশ ভারতে চলে যাবে। বাজার আজ বেশ সরগরম। একচলি¬শ বছর পর আবারো চুক্তি হলো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে। গেজেট এসেছে নেতাদের কাছে। সীমান্তের পুলিশের কাছে। তারা বলেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ও ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল আছে, শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির সীমান্ত চুক্তি অনুস্বাক্ষরের কপি বিনিময়ের পর এর হস্তান্তর-প্রক্রিয়া শুরু হবে। সব মিলিয়ে লোকসংখ্যা ৫১ হাজারেরও বেশি। এসব ছিটমহল অন্য রাষ্ট্রের ভূখÐ দ্বারা বেষ্টিত থাকায় এর বাসিন্দারা যে দেশের নাগরিক হিসেবে আইনত স্বীকৃত, সেই দেশ থেকে ছিল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধাসহ সব ধরনের মৌলিক অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত ছিল।
গরু-ছাগলের দাম পড়েছে। কেউ কিনছে না। নেতারা তালিকা তৈরি করেছে। সরকার সুযোগ দিয়েছে। যে যে দেশ থাকতে চায়, থাকতে পারবে। একটা হুলস্থূল অবস্থা ছিটমহল জুড়ে। হৈ চৈ। দিনদুপুরে মিছিল। ব্যানারে ব্যানারে ছেয়ে গেছে বাজার। হাসিনা-মোদির গলায় মালা ঝুলছে। ইন্দিরা আর মুজিবের ছবিও চোখে পড়ে কিছু ব্যানারে। মানুষের মনে একটা অস্থিরতা। কবে শুরু হবে নতুন জীবন।
(ছয়)
পঞ্চায়েতের পুরনো চাপড়া ঘরের পাশে আজ সকাল থকেই শোরগোল। শোরগোলটা শুরু হয় সেই সকালবেলা থেকে চলে রাত অব্দি। কারা যাচ্ছে ও পাশের দেশে, কারা যাচ্ছেনা। পঞ্চাষোর্ধ্ব বছর বয়সী নিরঞ্জন বলে উঠলেন-
– যাইয়া লাভ কী? জন্মেছি ওখানে মরবনি ওখানে। খাল পার হলিই ভারত। গিয়ে লাভ কী!
এই কথার উল্টো জবাব দেয় সুনীল। যে কিনা ভারত যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। প্রত্তুত্তরে বলে উঠলো-
– বাপদাদাতো পড়ে আছে ঐ দ্যাশে, মরার সময় যাবিনা দ্যাকতে?
নিরঞ্জন বাঁশের ঝাকাটা হাতে নিয়ে অগ্রসর হয় খালপারের দিকে। আর নির্লিপ্তভাবে বলে-
– মরার সমুয় মুখাগ্নি দেবার লুকের অভাবে হবিনি সুনীল। যাইসনে।
খালে আজ মাছ ধরা পড়ছে অনেক। খালপাড়ের ও পাড়ার ছেলেছোকরাগুলো কখনো খালমূখী হয়না। সারাদিন চোরাচালানী পাচার তাদের নেশা। নিরঞ্জন এই কথাগুলো কেন ভাবছে জানা নেই। নিশ্চয় ভাবনার পেছনে কারণ আছে। ভারত থেকে একটা মোটর সাইকেল কিংবা গরু এই খাল পার করতে পারলেই একমাস ঘুমিয়ে খেতে পারে। করবেই বা কেন কাঁচা টাকা পেলে ছোকরার দল মাঠে নামবে কেন?
(সাত)
জুন মাসের বিকেল। কড়া রোদ পড়ায় গাছপালা ঝিমুচ্ছে। সনজুদের গ্রামের তালিকা তৈরি হয়ে গেছে। একশো তিরিশ পরিবার ভারতে চলে যাবে। তালিকা চূড়ান্ত। সেই তালিকায় দেবযানীদের নামও আছে। সনজু খবরটা শুনেছে বাজারে এসে। দেবযানির বাবা আজ তাদের হাসমুরগী বেচে গেছে পানির দামে। চায়ের দোকানী তহিদুল ব্যাপারটা খোলাস করলো। খবরটা শুনে একটু বিমর্ষ হয়ে পড়ে সনজু। দেবযানীরা চলে যাবে কেন? তারা কী না খেয়ে আছে? তারা কী আমাদের চেয়ে বেশি কষ্টে আছে? হাজারো প্রশ্ন উঁকি দেয় সনজুর মনে। একবার তাদের বাড়ি ঢুঁ মারা দরকার। এই পরিবারের সাথে সনজুদের যোগাযোগ চারযুগেরও বেশি সময় ধরে।
মানুষ চলে যায় কেন? মানুষ কী পারে চিরচেনা বাসভূমি ছেড়ে চলে যেতে? সনজুর মাথাটা ভো ভো করে। বাজার পেরিয়ে বাড়িফেরার সেই সাঁকোটায় একটু বসে। এখানেতো কত স্মৃতি লেগে আছে দেবযানীর। এই মেটোপথ, কলাবাগানের সারি। ডোবা পেরিয়ে বালুর ডিবি। শৈশবের গাছগুলো এখন আকাশ ছুঁয়েছে। সনজুতো তার স্বপ্ন ছুতে পারেনি- এমনকি তার দেবযানীর হাতটাও। ভালোবাসা এতো গোপনীয় হয় কেন? এতোটা অপ্রকাশ্য হয় কেন? সনজু মেলাতে পারেনা সে হিসাব। এ পাশ – ওপাশ যে দিকেই থাকায় সনজু একটা আর্তনাদের ভাষা শুনতে পায়। এই আর্তনাদের ভাষা একেবারেই নিজস্ব- এতোটাই নির্মম- এতোটাই অব্যক্ত। এর কোন অনুবাদ হয়না।
দেবযানীরা চলে যাবে ভারতে। চূড়ান্ত প্রস্ততি চলছে। সে প্রস্তুতির সাথে যোগ হয়েছে বুকফাঁটা কান্না। সে কান্না মাটির কান্না নয়- সে কান্না স্বজনহারা কষ্টের।
আজ একুশে জুলাই। দু হাজার পনেরা সাল। সীমান্তের কাঁটাতারের ওপারে বিশাল আয়োজন। দুদেশের পতাকা পতপত করে উড়ছে। দেবযানীর হাতটা ধরে আছে তার মা। পাশে সনজু তার পরিবারের সবাই। এক ফোঁটা উত্তপ্ত চোখের পানি গড়িয়ে পড়লে সনজুর হাতটায়।
(আট)
ছ’মাস হয়ে গেল। দেবযানীর খবর জানেনা সনজু। যেমনটা জানতা না দেবযানীর বাবা, যখন দেবযানীর দাদা এ দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কতকাল চলে গেছে চিঠি নেই- টেলিগ্রাম নেই- খবর নেই। দেবযানীর সাথে কী আর কখনো দেখা হবে না?
কাঁটাতারের ওপারে দেবযানীর হাতটা নাড়ছে। এটা সেই হাত- যে হাতটা এখানো ছোঁয়া হয়নি। এই দৃশ্যটা সনজুকে পাগল করে দেয়। এক ফোঁটা উত্তপ্ত চোখের পানির ছোঁয়া দিয়েই কী মানুষের ভালোবাসার সলিল সমাধি হয়, নাকি ভালোবাসা বেঁচে থাকে চিরকাল! নাকি ভালোবাসা একটি ভয়াবহ অভ্যাস। মনে করলেই মনে পড়ে – শুধু মনের পর মন পড়ে থাকে!
(নয়)
এই এক বছরে এই গ্রাম সবুজে ছেয়ে গেছে – বদলে গেছে অনেক। রাস্তা হয়েছে, স্কুল হয়েছে, ক্লিনিক হয়েছে, বিদ্যুতের খুঁটি গেড়েছে সরকারি লোক। বাজার জমে উঠেছে বেশ – শয়ে শয়ে দোকান।
অরুণ সু পলিশ
কোহিনূর পত্রিকা স্টল
মনসুরের চায়ের দোকান
জনতা সাইকেল স্টোর
ছুলেমার পানঘর
রাবেয়া টাইম জোন
জনসেবা ফার্মেসী
লিটনের মুদী দোকান
নিউ জুয়েল লন্ড্রি
নিউ গণেশ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার
দিলীপ হেয়ারকাট সেলুন
রিদয় ফ্লেক্সি ঘর
(দশ)
বাংলাদেশের একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে আজ একটা ফিচার ছেপেছে। কাগজের উপর দিকে বাম পাশে। শিরোনামে লেখা -‘ছিটমহলের গল্প – শেষ হলো একটি অমিমাংসিত অধ্যায়’। ‘The story of enclaves – ended an unresolved chapter’.
তহিদুলের চায়ের দোকানে বসে কাগজটা দেখে সনজু। সত্যি সত্যি দেবযানীর ছবি। ওরা সবাই মিলে বর্ডার ক্রস করছে। মায়ের হাতে ব্যাগ। দেবযাীনর হাতে একটা ভেজা রুমাল। সেই বিদায়বেলার ছবি দিয়ে ফিচারটা লেখা। কাগজটা হাতে নিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠে সনজু। এ কান্না দেবযানীর মতো বোবাকান্না নয়। দেবযানী যদি কোনদিন ফিরে আসে তবে কী চিনবে তার শৈশবের গ্রাম কিংবা সনজুকে।