আব্বার পায়ের দিকটাতে লাগানো নয়নতারা গাছটাতে পানি দিচ্ছে মেহেদী উল্লাহ্। চৈত্রের দুপুরে গাছে পানি দিলে গাছ মরে যায় এটা সে জানে। তবুও, নয়নতারা গাছটার দিকে তাকিয়ে তার মায়া লাগে। মনেপড়ে, প্রথম যখন গাছটা লাগায় তখন একবারে নেতিয়ে ছিলো। সে ভাবতো, কবরে পুঁতে দিলেই গাছের সাথে আব্বার যোগাযোগ তৈরি হবে। যখন গাছটাতে পানি দেয়া হবে তখন পানি গাছের মাটি চুয়ে চুয়ে ঠিক আব্বার পায়ে গিয়ে পড়বে। আব্বা যখন বেঁচে ছিলেন, সরাসরি কল চেপে কখনোই ওজু করতেন না। প্রথমে কলটাকে চাপতেন। পিতলের জগে পানি ভরাতেন। তারপর ধীরে ধীরে সময় নিয়ে ওজু করতেন। যখন তিনি দু’হাত দিয়ে কান মুছতেন, তখন চোখ বন্ধ করে রাখতেন। পায়ে পানি ঢালার সময় হাতের আঙ্গুল দিয়ে পায়ের পাতাটা ঘষে ঘষে ধুতেন। পানি ছরছর করে গড়িয়ে যেতো কলতলায়। আজ হঠাৎ করে, নয়নতারা গাছে পানি দেবার সময় আব্বার ওজু করার দৃশ্য মনে পড়তেছে মেহেদী উল্লাহ্র। রমজান মাসে মানুষটার মতিভ্রম হলো। সকালে ওজু করে জায়নামাজে বসলো। নামাজ পড়লো না। পুঁটি মাছ দিয়ে ভাত খেতে ধরে বললো, ‘বিষ দিয়া এই মাছ কেউ রান্ধছেনি হ্যাঁ!’ তারপর গজগজ করে চুপ করে থাকলো। বাড়ির কেউ ঠাওর করতে পারে নাই একটা জলজ্যান্ত মানুষ আছরের ওয়াক্তে মারা যাবে। সদর ঘরের চৌকিতে বসে মানুষটা একলা একলা বুক মালিশ করলো কতক্ষণ। তার বুকে হাত দিতে ধরতেই, চিল্লায় উঠলো, ‘কিহ্ প্রাণটারে বের করবি নাকি! জোরে ফুঁ দে, আয়াতুল কুরসি পড়, কিরে বুকে দম নাই!’ তারপর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হইলো মানুষ। প্রথমে তেলাপিয়া মাছের মতোন চোখ দু’টা ঘোলা হলো, এরপর নিথর হলো পা। তারপর হাত, মুখ, পুরা শরীর…।
আব্বা উঁচা গলায় কথা বলতে পারে বাড়ি বা মহল্লার কেউ কোনোদিন জানতো না। মরার আগেআগে মেজাজ চড়া হইছিলো লোকটার। এমন নরম মানুষ হুট করে চড়া হয়ে গেলো অথচ আমরা টেরও পাইলাম না মানুষটা চলে যাবে। মরণ আসলে নানান রকম মাজেজা নিয়ে আসে। এই কথা আম্মা বলছিলো, আব্বা চলে যাবার পরে। দাদী যেবার মরলো সেও অদ্ভুত আচরণ করছিলো। আম্মা নতুন বৌ, ঘর বাড়ি ঠিক মতোন সামলাইতে শেখে নাই তখনি চলে যান ভদ্রমহিলা। পানি খাইতে ধরেও গলায় আটকাইতো তার। বলতো, দুনিয়ার পানিতে স্বাদ নাই। জান্নাতি পানির স্বাদের কাছে দুনিয়ার পানি হইলো ডাইল ভাত। শেষ দমটা যখন ছাড়ে সে তখন সারা কপাল ঘামে জবজব করছিলো। বড় বড় করে শ্বাস নিতেছিলো। কেবলমাত্র মরণ কাছে আসলেই বোঝা যায় দমটা কত দরকারি। মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে একটু যে বসে থাকবো সে ফুসরৎটাও মিললো না।
মসজিদে গিয়ে জানাতে হলো আব্বার চলে যাবার কথা। আত্মীয়দের জানাতে হলো। খালু এসে বললো, ‘‘বড় ভালো দিনে তোমার আব্বা চলে গেলো। রমজানের প্রথম দিন আজ। রমজানে কেউ মরে গেলে বিনা হিসাবে জান্নাত। মানুষটাও ভালো আছিলো, কারো ক্ষতি করে নাই। শুনলাম, সে নাকি আইজ পুঁটিমাছ দিয়ে ভাত খাইছে! আজকের রোজাটা যদি রাখতে পারতো আরো ভালো হইতো। শেষ রিজিকটা তাইলে পুঁটিমাছ আছিলো, তাইনা বাজান! রিজিকের মালিক আল্লাহ্।’’
পানি পাবার সাথেসাথে নয়নতারা গাছটা আরো ঝিমায়া গেলো যেন। বাইরের তাপমাত্রার সাথে নিজের তাপমাত্রারে খাপ খাওয়াইতে পারতেছে না গাছটা। হাসি পাচ্ছে মেহেদী উল্লাহ্র। তার অবশ্য আব্বার কথা ভেবেই হাসি পাচ্ছে। মানুষটা একদম চমক নিতে পারে না। ঈদে জামা কাপড় কিনে দিলে বলতো, ‘আমার তো মেলা জামা কাপড়। এসব লাগবো না আমার। তোর মায়েরে দে, খুশি হবে।’ আজ এই ভরা চৈত্র মাসে, হঠাৎ করে পায়ে পানি পেয়ে কি ভাবতেছে সে! মনে হয় রাগ করতেছে। ভাবতেছে, কাম কাজ ফেলে কবরস্থানে বইসা খুব তো জগত উদ্ধার করতেছ বাপধন।
কবরের দিকে প্রাণ ভরে তাকিয়ে থাকতে ধরে মনে হলো, বেঁচে থাকতে মানুষটারে এভাবে দেখা হয় নাই। কোকড়ানো বাবড়ি চুলের লম্বা একটা মানুষ। মরে যাবার পর পর তার শরীর আরো সটান, আরো লম্বা হইছিলো। চারজন মানুশ মিলে কাঁধে উঠানোর পরেও হিমসিম খাইছিলাম আমরা। বেঁচে থাকতে মানুষটারে নজর দিয়ে দেখা হয় নাই, কবরটাকেও বেশিদিন দেখতে পারবো না। তিন বছরের জন্য নেয়া হইছে কবর।
আমি হাঁটতে শিখছিলাম দুই বছর বয়সে। বাড়ির সবাই কইতো, নবাব হয়ে জন্মাইছে। আব্বা জবাব দিতো এত আগাম হাঁটতে হইবো ক্যান! শোন বাপ, তুই বুকে শুয়ে থাক। মাটিকে দুক্কু দিতে হবে না তোর। আমার এসব স্মৃতি মনে নাই। মনে আছে নয় বছর বয়সের কথা। অনেক জ্বর হলো সেবার । সারা গায়ে গুটি গুটি করে চিকেনপক্স উঠলো। আম্মা তখন পোয়াতি। কাজ কর্ম ফেলে একটা সপ্তাহ আব্বা আমার ঘরে থাকলো। বালতিতে পানি নিয়ে শরীর মুছে দিলো বারেবারে। বুকের মধ্যে মাথাটা টেনে ধরে বলতো, ‘আব্বারে তোর জ্বালা তো কমাইতে পারতেছি না, আমি এখন কি করতাম মানিক!’
এই শহরে সবচেয়ে সবচেয়ে দামি জায়গা হইলো কবরস্থান। যদি দক্ষিণের কোনো জায়গাতে পঁচিশ বছরের জন্য কবর সংরক্ষণ করতে চাই তাহলে আমার হাতে বিশ লাখ টাকা থাকতে হবে। উত্তরের দিকে খরচ একটু কম। পনেরো লাখ টাকা। জুরাইন, আজিমপুর বা খিলগাঁও কবরস্থানে দশ লাখের মতো তো লাগেই। যদি আমি আট বছরের জন্য কবর সংরক্ষণ করতে চাই তাহলে দাম একটু কমে আসবে। আমি আব্বাকে কবর দিয়েছিলাম মুগদাতে। খরচ হয়েছিলো দশ হাজার টাকা। বন্ধু স্থানীয় এক ভদ্রলোককে ফোন করে বলেছিলাম, শাহজাহানপুরে একটা কবরের ব্যবস্থা যেন করে দেয়। সে জানালো, শাহজাহানপুরে আর নতুন করে কবর নেয়া হচ্ছে না। আমি চাইলে, মুগদাতে একটা ব্যবস্থা করতে পারে। কমিশনার তার পরিচিত।
ফ্রিজিং গাড়িতে করে আব্বাকে শেষবারের মতো মুগদা নিয়ে গেলাম। মোতয়াল্লির সাথে আলাপ করে দশ হাজার টাকায় ঠিক করলাম ওনার থাকার জায়গা। একদিকে তার থাকার জায়গা পরিপাটি করা হচ্ছিল, আরেকদিকে চলতেছিলো গোসলের আয়োজন। গোসলের জন্য টাকাটা ফিক্সড, তিন হাজার টাকা। বাঁশ, চাটাই, কাফনের কাপড়, কর্পুর, গোলাপজল, আগরবাতির পেছনে সাত হাজার টাকা খরচ হলো। এখানে এসে বুঝলাম, কবরস্থানের ব্যবসাটা সাংঘাতিক। এক পাশে অনেকগুলান বাঁশ ফেলে রাখা হইছে। দরদাম করে বাঁশ কিনতে হইতেছে, চাটারি কিনতে হইতেছে। জন্মের সময় হাসপাতাল গুলান ব্যবসা করতেছে শিশুদের নিয়া, আর মরণের পর ব্যবসা হইতেছে কবরস্থানে। তাহলে কি জন্ম মৃত্যু পুরাটাই ব্যবসা! বাস্তুসংস্থান বড়ই অদ্ভুত।
জামা কাপড় কেনার সময় যেমন সুতোর কারুকাজ দেখতে হয় তেমনি কাফনের কাপড় কেনার সময়ও সবচেয়ে বেশি নজর রাখতে হয়। ইহরামের কাপড় দিয়ে যদি মুর্দাকে মুড়াতে চাই তাহলে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা খরচ পড়ে যাবে। বেছে বেছে আমি ইহরামের কাপড়টাই নিলাম আব্বার জন্য। গোলাপজলের ঘ্রাণ উনার পছন্দ ছিলো। কাশানের গোলাপজল খুঁজছিলাম। এটা অনেক এলিট জাতের। কাশানের গোলাপজল দিয়ে কাবা শরিফের দেয়াল ধোয়া হয়। পুরা মুগদা তন্ন তন্ন করেও পেলাম না গোলাপজল, পরে দেশীটাই কিনলাম। ‘বিসমিল্লাহি ওয়া আলা মিল্লাতি রাসুলিল্লাহ’ বলে আব্বাকে কবরে রাখলাম অবশেষে। তার গায়ে মুঠো ভরা মাটি দিলাম। ছোট বেলার কথা মনে পড়লো খুব। আমাদের শৈশব গ্রামে কেটেছে। জমিতে রোয়া লাগানোর সময় কি যে আনন্দ হতো। আব্বার গায়ে কাদা ছিটিয়ে দিলে একটুও রাগ করতো না। হাসতো খুব। আজ আব্বার শরীরে মাটিয়ে দেবার সময় কবরটাকে ধানি জমি মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আব্বা হলো ধান। আব্বারে আলতো করে মাটিতে রোপণ করছি শেষ বারের মতো।
আব্বার শরীর ছুঁয়ে বেড়ে ওঠা নয়নতারা গাছটায় ফুল এসেছে। গাছের গোড়ায় মাটি দিতে দিতে মেহেদী উল্লাহ্ ভাবে আব্বা নিশ্চয়ই গাছটাতে ফুল হয়ে ফুটে আছে। আব্বা ভালো আছে।
নাদিয়া জান্নাত-জন্ম ১৫ জুলাই, উত্তর জনপদ, কুড়িগ্রাম।
গল্পটাতে ছোট ছোট ব্যাপারগুলো এতো চমৎকারভাবে লিখেছেন, যেন মেহেদি উল্লাহর চিন্তাভাবনাগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। ঘটনা ছাড়াও গল্প হয়, খুব সাধারণ জীবনের গল্প – এটা সেই। এক কথায় – উপভোগ্য।
তবে শেষটা কেমন যেন আচমকা লাগলো। নামটা খুব সাধারণভাবে দেখলে এরকমই হওয়ার কথা কিন্তু গল্পের গাঁথুনি বিবেচনায় নিলে আরেকটু ব্যতিক্রমী করা যেত কি? হয়তো। বেশ কিছু স্বাভাবিক বানান ভুল চোখে পড়লো। কথকের বক্তব্যে প্রমিত এবং আঞ্চলিক ভাষা মিশে গিয়েছে।