বাবা মা আদর করে নাম রেখেছিলো প্রিন্স। বাবা মা’র কাছে তাদের ছেলে রাজপুত্রের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। নেত্রকোণা জেলা সদরের কাছাকাছি একটি গ্রামে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, এখন অবসরে আছেন। একটি ছেলে তাই বাবার খুব ইচ্ছে ছিলো ছেলে বড় হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হবে। কিন্তু মানুষ যা চায় তা খুব কম সময়-ই পূরণ হয়। ছোট বেলায় প্রিন্স ছাত্র হিসেবে মন্দ ছিলো না। কিন্তু যতো উঁচু শ্রেণিতে উঠতে থাকে তার রেজাল্টও ততো খারাপ হতে থাকে। তবে শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। শেষ পর্যন্ত কোনো রকমে পড়াশুনা শেষ করেতে পেরেছে প্রিন্স। নিজ জেলা সদরের সরকারি কলেজে পড়াশুনা করেছে সে। সবার মতো কয়েকবার বিসিএস পরীক্ষাও দিয়েছে কিন্তু প্রিলিমিনিয়ারিতেই উত্তীর্ণ হওয়া হয়নি তার। সরকারি বিভিন্ন পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে অনেকবার কিন্তু ফলাফল একই। এখনও আশায় আশায় নিয়মিত পরীক্ষা দেয় প্রিন্স।
পড়াশুনা শেষ করে দেড় বছর কেটে গেছে, তবু এখনও কোনো চাকরির দেখা মেলেনি। বাবা মা’র ঘাড়ে বসে বসে খেতে খুব কষ্ট হয় প্রিন্সের। বর্তমানে চাকরির যে অবস্থা, ম্যাজিস্ট্রেট তো দূরের কথা কোনো রকমে একটা চাকরি সংগ্রহ করতে পারলে সে একটু হাপছেড়ে বাঁচতে পারে। ইদানিং বাবা মার চোখের দিকে তাকাতে পারে না সে।
মা প্রতিদিনই বলে, ‘বাবা আজ চাকরির কিছু একটা হলো?’
প্রিন্স বলে, ‘না মা, চেষ্টাতো কম করছি না। আশাকরি এই মাসের মধ্যেই একটা কিছু করে ফেলবো দেখো।’
মা একটু মুচকি হেসে প্রিন্সের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, ‘বাবা আমি তোর জন্যে দোয়া করছি, সন্তানের জন্য মার দোয়া কখনও বিফলে যায় না।’
তাই মা! তাহলে কেন মানুষ ব্যর্থ হয়? কোন মা কি তার সন্তানের জন্য দোয়া করা বন্ধ রাখে? তার মানে সব দোয়া সবসময় সফল হয় না, কিছু কিছু দোয়া সফল হয়। আর তার ইচ্ছা উপরওয়ালার হাতেই থাকে।
মা চুপ করে থাকে। কোন উত্তর দেয় না। শুধু একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
রাতে এখন সে বাবার সাথে ভাত খেতে চায় না। যদি কোন কিছু বলে সেই ভয়ে সে নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে রাখে। তবু দু-এক দিনতো সাথে খেতেই হয়। এমন একদিন বাবা বললেন, ‘কিরে, কী করলি চাকরির? আর কতো দিন এভাবে বসে থাকবি? এতো মানুষের চাকরি হচ্ছে আর তোর কেন হয় না? এইতো সেদিন শুনলাম আমার বন্ধু রাজ্জাকের ছেলে রিফাতের চাকরি হলো উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসে। তোর চেয়ে কতো খারাপ ছাত্র ছিলো সে। ক্লাসে রোজ দাঁড়িয়ে থাকতো। তোর চেয়ে কতো নিচে পড়ে থাকতো তার রোল।
প্রিন্স কোনো কথা বলে না। শুধু মুখ গুঁজে ভাত খায়। আর মনে মনে মাকে গালি দেয়, ‘মা কেন যে এতো বেশি ভাত দেয়, খাওয়া তাড়াতাড়ি শেষ-ই হতে চাচ্ছে না।’ খাওয়া শেষ হলেই সে টেবিল ছেড়ে উঠে যেতে পারে।
অবশেষে প্রিন্সের মায়ের দোয়াই সত্যি হলো। চাকরি হলো প্রিন্সের। যদিও নাম না জানা নতুন ঔষধ কোম্পানি, তবুওতো একটা চাকরি হয়েছে। কেউতো আর বলতে পারবে না যে, সে বাপের হোটেলে বসে বসে খাচ্ছে।
বাবা মাকে ছেড়ে ঢাকা যায় প্রিন্স। যাওয়ার সময় মা কাঁদতে থাকে যেন এমন ঘটনা ঘটা ঠিক হয়নি কোনভাবেই। মায়েরা এমনই। মিরপুর-১ এ একটি মেসে কম ভাড়ায় ওঠে সে। অফিসটা একটু দূরে, তাতে কী? অফিসের কাছের এলাকায় বাসা ভাড়া বা মেস খরচ তার পক্ষে চালানো সম্ভব নয়, তাই কষ্ট হলেও দূরে থাকা।
প্রতিদিন বাসে করে অফিসে যেতে হয় তাকে। নতুন কোম্পানি তাই কাজের চাপটাও একটু বেশি। নতুন প্রোডাক্ট বাজারে পরিচিত করতে তার বাড়তি পরিশ্রম করতে হয়। তার ওপর প্রতি মাসের নির্ধারিত টার্গেট পূরণ করতে হয় তাকে। টার্গেট পূরণ হলে পরের মাসে সে টার্গেট আরও বেড়ে যায়।
গ্রামের পথে, ঘাটে, মাঠে, নদীতে ঘুরে বেড়ানো প্রিন্স ধীরে ধীরে ঢাকার ব্যস্ততাপূর্ণ জীবনে অভ্যস্ত হতে থাকে। তার আর ঘুরে বেড়ানো হয় না। হয় না গাছপালা আর পাখি দেখা। খেলাধুলা সেটাতো ভুলেই গেছে প্রায়। সব সময় কাজ তাকে তাড়া করে বেড়ায়। রুমে ফিরেও তার কাজ ফুরোয় না। অর্ডার স্লিপগুলোর সামারি তৈরি করে। অফিস থেকে তাকে একটি এনড্রোয়েড মোবাইল দেওয়া হয়েছে। ফোনটা বেশ দামি। ফোনেও চলে বিভিন্ন দোকানের খোঁজ খবর নেওয়া আর অর্ডার নেওয়ার কাজ। সেই সকাল সাড়ে সাতটায় বের হয় তারপর দোকানের অর্ডার কাটা ও ডাক্তার ভিজিট করা শেষ করে রুমে ফিরতে তার রাত বারোটা বেজে যায়। অবশ্য এতে একটা জিনিস তার ভালো হয় সেটা হচ্ছে তার সময় কাটানোর বিষয়টি। এমন ব্যস্ততার মধ্যে তার সময় কাটে ভালো। কারণ রুমে ফিরে তার তো কেউ নেই, সে আর তার মোবাইল এভাবেই দিন কাটে তার। চাকুরিজীবী মেস হওয়ায় সবাই ব্যস্ত ও ক্লান্ত হয়ে রুমে ফেরে, তাই খাওয়া-দাওয়া সেরে প্রায় সবাই দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে তার থাকে আরও বেশি কাজ। ঘর ঝাড়ু, জামা-কাপড় কাচা, আয়রণ করা, টুকটাক অন্যান্য কাজ অথবা কোন চাকরির পরীক্ষা।
বাড়ি গেলে সে রাতে যায় পরের দিন সন্ধ্যায় চলে আসে। মা বলে, ‘তুই কেমন বদলে গেছিস বাবা। আগের মতো আমাদের কথা আর তোর মনে পড়ে না।’
না মা, আমি একটুও বদলায়নি। যদি বদলে থাকি তাহলে ঢাকার পরিবেশ আমাকে বদলিয়েছে। ঢাকার পরিবেশটাই এমন। গ্রামের ছেলেদের মতো সময় নষ্ট করার সময় আমাদের নেই। কেন? আমি এমন হই সেটাতো তোমরাই চেয়েছিলে, তাই না?
জানি না বাবা। আমার তোকে ছাড়া কিছুই ভালো লাগে না। বড্ড একা একা লাগে রে।
একটু তো কষ্ট করে থাকতেই হবে মা, কিছুই করার নেই। চাকরি করলে তো বাহিরে থাকতেই হবে। বাড়িতে থেকে চাকরি করার ভাগ্য আর ক’জনের হয়, বলো? এমন চাকরি-ই বা কয়টা আছে?
হ্যাঁ বাবা, সে কথাই ভাবছি। ছেলেকে পড়াশুনা না শেখালে মানুষ বলবে মূর্খ-অশিক্ষিত, আর পড়াশুনা শেখালে শেষ জীবনে বাবা-মাকে এভাবে শূন্য নীড়ে থাকতে হয়। মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে।
যথারীতি একদিন সকালে প্রিন্স বাসে করে অফিস যাচ্ছে। বাসের সামনে সিটে দু’জন মধ্যবয়স্ক যাত্রি উচ্চস্বরে কথা বলছিলো। এক পর্যায়ে তারা বলছে, ‘এখনকার ছেলে মেয়েরা কেমন যেন অন্য রকম হয়ে গেছে। কেমন রোবটিক। সবকিছু তাদেরকে যেন তাড়া করে নিয়ে বেড়ায়। তারাও সবকিছুকে তাড়া করতে চায়। ইচ্ছে করলেও তারা অবসর কাটাতে পারে না। অবসর পেলেও ঘুরে ফিরে যে কোনভাবে যে কোন কাজে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাথারতো একটু বিশ্রামও প্রয়োজন। এই যান্ত্রিক শহরের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে তারাও যন্ত্রে পরিণত হয়ে গেছে। আমাদের সময় আমরা কিন্তু এ রকম ছিলাম না। আমরা কাজের সময় কাজ করেছি আবার পূর্ণ বিশ্রামের মধ্যে দিয়ে অবসর সময় কাটিয়েছি। খেলাধুলা, গান-বাজনা, গল্পগুজব বিনোদনও ছিলো যথেষ্ট।’ ইত্যাদি। ইত্যাদি।
প্রিন্স শুনে হাসে আর মনে মনে বলে, ‘যতো সব বুদ্ধিজীবী গাড়িতে এসে জুটে। অবসর পেলে বিশ্রাম নেয় না এমন কোন মানুষ আছে নাকি? বিশ্রামের সময় ইচ্ছে করে কে ব্যস্ত থাকতে চায়? যতো সব আজগুবি কথাবার্তা।’
অফিস থেকে ফিরে রাতের খাবার শেষে প্রিন্স শুয়ে শুয়ে মোবাইল চালাচ্ছিলো। রাত তখন সাড়ে বারো। তবুও তার ঘুমানোর কোনো তাড়া নেই। এমনিতেই সে একটু রাত করে ঘুমায়, তার উপর পরদিন শুক্রবার তাই আজ যেন সে ঘড়ির দিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করছে না।
এনড্রোয়েড ফোনে হঠাৎ টাচ্ লেগে প্লে-স্টোর ওপেন হয়ে যায়। ওপেন হতেই তার চোখে পড়ে একটি আকর্ষণীয় গেম। মনে করে গেমতো খেলাই হয় না, তার পরেও দেখিতো গেমটা কেমন। এই বলে সে গেমটি ডাউনলোড করে ইনস্টল করে নেয়। ক্লান্ত শরীর তাই চোখে তার রাজ্যের ঘুম এসে জমা হয়। ফলে সেই মুহূর্তে গেমটি না খেলে মোবাইলটি রেখে ঘুমিয়ে পড়ে সে।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে একটু দেরীতে। উঠেই হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা সেরে নেয়। তারপর হঠাৎ তার গেমের কথা মনে পড়ে। বিছানায় শুয়ে গেমটি ওপেন করে একবার খেলে দেখতে চায়, গেমটি কেমন।
-‘বাহ্! এতো খুব-ই চমৎকার গেম। এতোদিন কোথায় ছিলো এটি। পুরোটাই এডভেঞ্চার। আর আমি এডভেঞ্চার খুব ভালোবাসি।’ মনে মনে বলে প্রিন্স।
কিন্তু গেমটির কিছুদূর যেতেই আর যেতে পারছিলো না। সে বার বার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু কোনভাবেই সে বেশি দূরে এগোতে পারে না। এক সময় তার জেদ চেপে যায়। ভাবে আজ আমি যেভাবেই হোক লেভেলগুলো পর হয়েই ছাড়বো।
ইতোমধ্যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। তার ঘরে মেসমেটরা অনেকে এসে দু-একটি কথা বলে তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়ে চলে যায়। সে এক মনে খেলতে থাকে। কোন দিকে যেন ভ্রুক্ষেপ নেই। বিকেলের দিকে কাজের বুয়ার চাপে একবার উঠে সে শুধু অবেলায় দুপুরের খাবার খায়। তারপর আবার খেলতে শুরু করে। আজ যে করেই হোক তাকে খেলায় জিততেই হবে। প্রিন্স সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। এমন জেদ তার ছোটবেলা থেকেই।
এক সময় বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামে। সে তখনও সব লেভেল পার হতে পারেনি। বিধায় খেলা চলতেই থাকে। বিছানার উপর, কখনও শুয়ে কখনও বসে। ঘর অন্ধকার দেখে পাশের ঘর থেকে একজন এসে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। আর সাধারণভাবে যেগুলো কথা বলে তার কোনটির উত্তর দেয় কোনটির উত্তর দেয় না। খেলায় সে এতোটাই ব্যস্ত। এবার তার ফোনে ব্যাটারি লো সিগনাল দেয়। প্রিন্স ভাবে এইতো আমি শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। আর মাত্র একটি ধাপ পেরোলেই আমি উইন। আর উইন হয়েই ফোনটা চার্জে দিবো। বেশি সময় লাগবে না।
হঠাৎ তার ফোনের পর্দা অন্ধকার হয়ে যায়। প্রিন্স বলে ওঠে, ‘ইশ্! আর একটুর জন্যে খেলাটা শেষ করতে পারলাম না। ফোনটা অফ হবার আর সময় পেলো না। আর দু’মিনিট খেলতে পারলেই আমি জিতে যেতাম। এখন আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। ভাবতেই খারাপ লাগছে। এখন আমার এতো রাগ হচ্ছে যেন ফোনটা আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলি।’
ফোনটা বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে প্রিন্স জানালা দিয়ে তাকায়। দেখে বাহিরে অন্ধকার, রাস্তায় রোড লাইট জ্বলছে। তারপর সে ঘরের দেয়াল ঘড়িটির দিকে তাকায়। দেখে তখন ঘড়িতে বাজে ৮:৩৬। ‘একি! এতো রাত হয়ে গেছে অথচ আমি বুঝতেই পারিনি? আজকের জন্য কতো কাজ রেখেছিলাম আমি। জামা-কাপড়গুলো কাচতে হবে, আয়রণ করার জন্য লন্ড্রিতে দিতে হবে, কাল সকালে অফিস। সপ্তাহ অন্তর একবারি ঝাড়ু দেওয়া হয় তাই ঘরটাও অপরিষ্কার হয়ে আছে। ঝাড়ু দিয়ে ঘরটি গোছাতে হবে। বিকালে একটু নিউমার্কেট যেতে চেয়েছিলাম। সামনে শীত আসছে তাই মা ডাবল লেয়ারের নতুন কম্বলের দাম শুনতে বলেছিলো। স্কুল লাইফের এক ফ্রেন্ড সেও ঢাকায় থাকে। ঢাকা আসার পর থেকে এক বারও দেখা করা হয়নি। সে মাঝে মাঝেই ফোন দিয়ে খুব অনুরোধ করে কোন এক শুক্রবারে দেখা করার জন্য। তার কথা রাখতে সেখানেও একবার যাবার কথা ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু কিছুই হলো না। ছি! ছুটির দিনটা এভাবে নষ্ট করলাম? সামান্য একটা গেমের পেছনে তাড়া করে এক সপ্তাহের কাঙ্ক্ষিত ছুটির দিনটি পার করে ফেললাম?’
বিছানায় বসে হাঁটুর উপর কুনুই ভর করে মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে থাকে, আর আফসোস করতে থাকে বারবার। হঠাৎ তার মনে জেগে ওঠে বাসের সেই মধ্যবয়স্ক যাত্রী দু’জনের কথা। যাদের কথা সে আজগুবি বলে উড়িয়ে দিয়েছিলো। তাদেরকে বুদ্ধিজীবী বলে কটাক্ষ করেছিলো। অথচ তাদের কথাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো!